হঠাৎ দেখা

0
2011

০১. সেদিন দেখেছিলুম লাল বেনারসিতে, চোখে ছিল গাঢ় কাজল, মাথার চুলে ছিল সোনার টিকলি। বেনারসির আচঁলটা ঘোমটা দিয়ে তুলা ছিল মাথায়। বেশ মানিয়েছিলো তাকে। একবার তাকালে চোখ ফিরিয়ে নেওয়া যায় না। চোখের দিকে তাকিয়ে বুঝলুম এত আয়োজনের মধ্যেও দৃষ্টিতে তার আগুন ঝরা শূন্যতা, সেই শূন্যতায় মুরুভূমির মতো তৃষ্ণার্ত চোখ দুটো কিসের অপেক্ষায় ডেবে গিয়েছে ভেতরে, অদূরে চেয়ে আছে দিগন্তের লাল রঙের দিকে ।

সেই অঙ্কিতা, যাকে দেখেছিলুম লাল বেনারসিতে, কপালে আঁকা ছিল টিপ; মাথায় তুলা ছিলো লাল বেনারসির ঘোমটা, তাকে আজ দেখলুম বিধবার সাদা শাড়িতে ! কেমন যেন বড্ড বেমানান লাগছে চোখে। আগের থেকে শুকিয়ে গেছে অনেক, চোখের নিচে পড়েছে কালি, বয়সের ছাপ পড়েছে ভাজ পড়া চামড়ার ভেতরে । সেই চোখ, মুখ, নাক, পাতলা ঠোঁটের একপাশের কালো তিলটাও: সবকিছু আগের মতোই আছে, একটুও বদলায় নি। চুলগুলোও ঠিক আগের মতো আছে, শুধু কপালের সামনের কয়েকগাছি চুলে পাক ধরেছে। প্রথমেই তাকালুম চোখের দিকে: দৃষ্টিতে সেদিনের আগুন ঝরা শূন্যতা আর নেই। সেদিনের দৃষ্টির আড়ালের শূন্যতায় অপেক্ষা ছিলো, হয়তো অপেক্ষার আড়লে তিল তিল করে জমিয়ে রাখা আশাও ছিলো। আজ এত বছর পর সেই চোখের দিকে হঠাৎ তাকিয়ে দেখলুম- সেখানে শূন্যতা আছে ঠিকই, কিন্তু সেই শূন্যতায় আর আগুন ঝরছে না। সেই শূন্যতা কেমন যেন নিস্তব্ধ, নিঃস্পৃহ, নিরব। নেই অপেক্ষা, আশা আর হতাশাও।
আজ কত বছর পর দেখা, জানিনে। একসময় না দেখার হিসেবগুলো গুনে গুনে রাখতাম, খাতায় অংক কষার মতো। হিসেব রাখতে রাখতে কখন যে ক্লান্তি ভর করল, বিষণ্ণতা এসে অন্ধকারে ডুবিয়ে দিলো, বুঝতেই পারলুম না। সেই থেকে হিসেব রাখাটা ভুলেছি বহুবছর।

আজকের দিনটা বড় মেঘলা, সকাল থেকে ঝির ঝির করে বৃষ্টি পড়ছে ক্লান্তিহীনভাবে। অদূরে লাগানো আমার হাতের রক্তজবা গাছে ফুল ফুটেছে; বৃষ্টির ফোঁটায় কেঁপে কেঁপে ওঠছে তার পাপড়ি। সকালে স্টেশনে ট্রেন আসার কথা ছিলো, সেটা লেট করেছে। সকালের ট্রেন আসবে দুপুরে। আমার কোনো কাজ ছিলো না। বৃষ্টির বাতসের ঝাপটায় ওড়ে আসা গাছের কাঁচা পাতা ছড়িয়ে রয়েছে প্লাটফর্মের যত্রতত্র। ভাবলুম, পাতাগুলো কুড়িয়ে প্লাটফর্মটা পরিষ্কার করে দেই। পাতা কুড়িয়ে প্রায় পরিষ্কার করে ফেলেছি, অমন সময় চোখ পড়ল প্লাটফর্মের এককোণায়। দেখলুম কে যে বসে আছে সাদা আঁচলে ঘোমটা মাথায় । পাশে একটা টিনের বাক্স। শাড়ির আঁচলে মুখটা এমনভাবে ডেকে রেখেছে দেখা যাচ্চেনা। কাছে গিয়ে বললুম, -আপনি ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করছেন নাকি?

ও শাড়ির আঁচল সড়িয়ে মুখ তুলে তাকালো আমার দিকে। প্রথম দেখাতেই চিনতে পারল নাকি জানিনে। অনেক্ষণ পর ধীরে ধীরে ওঠে দাঁড়াল, মৃদুভাবে কাঁপা গলায় বললে, রুপম…!

বললুম, হ্যাঁ ।

কতক্ষণ যে বিমূঢ়ের মত দাঁড়িয়ে থাকলুম বলতে পারিনা। ও-ই আমাকে প্রশ্ন করল, বললে,- চিনতে পেরছ?

ম্লান হেসে বললুম, হ্যাঁ।

“কে?”

-অঙ্কিতা !

০২. শ্রাবণের ঘোমুট বাধা অন্ধকারে ঝড়ো বাতাসে একটুকরো ছেঁড়া চিঠির অংশ ওড়ে এসে পড়লে আমার পায়ের কাছে। তখনো কি জানতাম তার দেখা পাওয়া সম্ভব হবে? হায়, আজ কি অবেলায় তার দেখা পেলুম ! আমি জানতাম, কোনো একদিন তার দেখা পাবো; কোনো একদিন : যখন সূর্যটা অস্ত যাবে, ওপারের আকাশে অন্ধকার ঘনিয়ে আসবে, নিমজ্জিত আঁধারে নিজের প্রতিচ্ছবিও যখন দ্যাখতে পাবোনা, তখনো হয়ত তার দেখা পাবো ! আমি জানতাম তার দেখা পাবো! কিন্তু, হায়, এমনভাবে তাকে দেখতে পাবো সেটা কি কখনো কল্পনা করেছিলুম?
আমি তাকে কল্পনা করেছিলুম বাসন্তি রঙের শাড়িতে, চোখের নিচে লেপ্টে যাওয়া গাঢ় কাজলে, পাতলা ঠোঁটের কোণায় ফুটে ওঠা এক চিলতে হাসিতে ! হায় নিয়তি, আমি কি তাকে কখনো কল্পনা করেছিলুম, সাদা শাড়িতে? বেদনায় লেপ্টে যাওয়া চোখের নিচের গাঢ় কাজলের লেখাতে? শুকিয়ে যাওয়া মৃত ঠোঁটের এক চিলতে শুষ্ক হাসিতে?
কক্ষনো না। কিন্তু নিয়তি হয়ত এভাবেই আমাদের দেখা মিলিয়ে রেখেছিলো।

জিজ্ঞেস করলুম, এখানে কি করে আসলে?

স্মিতহাস্য মুখে অদূরে চেয়ে বললে, কাজের স্বার্থে কত জায়গা যেতে হয়, এখান আর সেখান বলতে কোনো কথা নেই।

“কি কাজ?”

“মেয়েদেরকে স্বাবলম্বী করে তুলার কাজ । তাদের কে নিজের পথ চিনিয়ে দেবার কাজ, নিজের আপন স্বত্বাকে ভুলে মেয়েরা নিজেকে খাঁচায় বন্দি পাখির মত করে রেখেচে , তাদের সেই আপন স্বত্বা কে জাগিয়ে তুলার কাজ।”

চুপ হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে থাকলুম অনেকক্ষণ। বুঝলুম নারী মুক্তির আন্দোলনে সে যোগ দিয়েছে। খানিক পর বললুম-“কবে থেকে এই কাজে আসলে?”

“সুজিত চলে যাবার পর।”

খানিক থেমে কিছুক্ষণ পর আপন মনেই বলতে থাকলে, সে অনেক বছর হলো। বিয়ের দুবছর পর আমি যখন পাঁচ মাসের অন্তঃস্বত্বা : রোড এক্সিডেন্টে সুজিত মারা পড়লে। শ্বশুর বাড়ির লোক ছিলো পুরোনো ধ্যান ধারণার, অপবাদ দিয়ে বল্লে, অপয়া, রাক্ষুসী। আরো কত কি উপাধি যে নামের সংঙ্গে যুক্ত করলে সেইসবের কথা এখন আর অত মনে পড়ে না। তুমি ভাবছো রাগ করে বুঝি তখন আমি চলে আসলুম। আরে না, ঠিক চলে আসলুম না, বিদেয় করে দিলো। তখন থেকে কি একটা যেনো আমার ভেতরে গজিয়ে ওঠছিলো ধীরে ধীরে, ঠিক বুঝে ওঠতে পারছিলুম না। সেই কি একটা যে আমার ভেতরের আলাদা একটা অংশ: এতদিন চাপা পড়েছিলে আবর্জনায় নিচে, এখন সুযোগ পেতেই অঙ্কুর গজানো শুরু করেছে সেটা বুঝতে আমার ঢের সময় লেগেছিলো। মেয়ে জন্ম নেওয়ার অনেক পড়ে বুঝলুম আমি আর আমি নেই। ঈশ্বর আমাকে নতুন জীবন দেখিয়ে দিলেন, আমিও সেই নতুন জীবনটাই বেচে নিলুম।

এই পর্যন্ত বলে চুপ হতে রইল। বুঝলুম, জীবন সংগ্রামে হারতে হারতে জয়ী হয়ে ওঠেছে । নিজের ভেতরে গজিয়ে ওঠা স্বত্বাটা ভেঙে ফেলেছে নিয়ম বাধা সব শেকল। ছুঁড়ে ফেলেছে মুখোশের উপরের আবরণ। শুধু নিজের ভেতরের শেকলটা ভেঙে ফেলে, আবরণটা টেনে ওঠিয়েই ক্রান্ত হয়নি। এখন ভেঙে ফেলতে চাইছে সমাজের পায়ে বাধা শেকল, মুখোশটা ছিড়ে ফেলে দেখিয়ে দিতে চাইছে আসল চেহারা।

বললুম, মেয়েও কি তোমার সাথে থাকে?

“হ্যাঁ এতদিন সাথেই ছিলো, এখন থাকে না। এলাহাবাদে ওর বিয়ে দিয়েছি বছর তিনেক আগে ।”

০৩.
আমার কথা জানতে চাইল। আমি এখানে কিভাবে স্টেশনমাস্টার হলাম? এই ভূতুড়ে জায়গায় কি করছি? এখান থেকে টার্ন্সপার হয়ে অন্যকোথাও চলে যাচ্চিনা কেন?
সংক্ষেপে সব প্রশ্নের উত্তর করলাম। কিছুক্ষণ বৃষ্টি থেমে ছিলো, এখন আবার মুষলধারায় বৃষ্টি শুরু হয়েছে। ট্রেন আসতে বেশি সময় নেই। হাতে যখন আর মিনিট দশেক সময় আছে, ওকে বসিয়ে রেখে ছুটে গেলাম বাইরে, রক্তজবা গাছটার কাছে। ফুল এসেছে অনেক, ফুলের ভারে গাছটার একটা চিকন ডাল নুয়ে পড়েছে মাটিতে। অনেকগুলো ফুল নিলাম। ভেজা শরীলে ওর হাতে যখন ফুল তুলে দিলাম ও বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে রইলে আমার দিকে। বললুম, তুমি রক্তজবা পছন্দ কর ভুলিনি। স্টেশনের ওধারটায় কয়েকটা গাছ লাগিয়ে ছিলুম অনেক আগে। প্রতি বর্ষাতে অনেক ফুল আসে, তেমনিভাবে ঝড়ে ঝড়ে পড়ে মাটিতে। কুড়িয়ে পর্যন্ত নেবার কেউ নেই। আমি মাঝে মধ্যে গিয়ে শুধু দ্যাখতুম, কখনো ঝড়ে পড়া ফুল কুড়িয়ে তুলতুম, কিন্তু ফিরে আসবার সময় ওভাবেই আবার ফেলে আসতাম । ফুলেরা হয়তো জানতো এই অসময়ে দেখা হয়ে যাবে !

ও আমার দিকে গাঢ় বিষাদভরা চোখে খানিক তাকিয়ে রইলে, ঠোঁটের কোণায় এক চিলতে শুষ্ক হাসির আভাস ফুটিয়ে তুলে বললে, রঙিন কাঁপড় ছেড়েছি সে অনেক বছর হলো; যদি নিজেকে রঙিন করার অভিলাষ মনে পুষে রাখতুম তাহলে জীবনের গাছে রক্তজবা ফুটতো তারও বহু আগে।

০৪. এই নির্জন স্টেশনে ট্রেন আসে, তবে যাত্রী হয়না সবসময়। হঠাৎ হাঠাৎ দু-একজনের দেখা পাওয়া যায়। ট্রেন থামে, ট্রেনে যাত্রী ওঠে, হুইসেল বাজিয়ে ট্রেন আবার চলে যায়। আবার কখনো যাত্রীশুন্য স্টেশনে ট্রেন আসে, পতাকা নাড়াই, কিন্তু সেদিন আর কেউ ওঠেনা, ট্রেন রীতিমতো গন্তব্যে ছুটে চলে। কিছুক্ষণের জন্য ট্রেনের হুইসেলে গমগম হয়ে ওঠে সারা স্টেশন, ট্রেন চলে গেলে আবার নির্জনতায় ডুবে যায় চারিপাশ। নিস্তব্ধ নিরবতায় খাঁ খাঁ করে দিগন্ত।

অঙ্কিতা দাঁড়িয়ে আছে প্লাটফর্মে। পরনে সাদা শাড়ি, হাতে লাল টুকটুকে রক্তজবা। দৃষ্টি দূরের মেঘলা আকাশে নিবদ্ধ। মুষুলধারায় বৃষ্টি পড়ছে, বৃষ্টির শব্দে শুনে ভাবলুম, আকাশটা ফেটে বুঝি চৌচির হয়ে গেছে। বৃষ্টির শব্দে ঢাকা পড়েছে দূরের ট্রেনের হুইসেল। বৃষ্টিতে স্নান করে ধীর শরীলে ট্রেন যখন একেবেঁকে এসে ডুকেছে পাল্টফর্মে ; ও দূরের আকাশ থেকে দৃষ্টি সরিয়ে এনে আমার দিকে ফিরে বললে, -তোমার ছেলে মেয়ের কথা জিজ্ঞেস করলুম নাতো? তোমার ছেলে মেয়ে কয়টা?

“নেই। ”

ও কেমন বিস্ময় নিয়ে চেয়ে রইলে। ট্রেনের হাতল ধরে উঠতে যাবে এমনসময় অবিশ্বাসের স্বরে ফের জিজ্ঞেস করলে, -“সত্যি কোনো ছেলে মেয়ে নেই?”

মাথা নাড়িয়ে বললুম, – না, নেই।

ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে, ও বসেছে জানলার পাশে। বাইরে থেকে তার হাতের অংশ দেখা যাচ্ছে। ট্রেনের গতি যখন বেড়ে চলেছে, ও জানলা দিয়ে মাথা বের করে তাকালো। বৃষ্টিতে ভেজে যাচ্ছে তার চুল, সেইদিকে খেয়াল নেই। ট্রেন ছুটে চলছে দ্রুত। হয়তো ওর গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে চোখের জল, বৃষ্টিতে ধুয়ে মুছে যাচ্ছে বহুদিনের জমানো ধূলোবালি। আমি তা অনুভব করলেও দ্যাখতে পাচ্ছিনা ।

কখন যে বৃষ্টি থেমে গেলো, ট্রেনের হুইসেল থেমে গিয়ে কবে যে দূরে মিলিয়ে গেলো ঠিক বুঝে ওঠতে পারলুম না। বিহ্বলতা কাটিয়ে ওঠতেই দেখি, এক অসহ্য নিরবতা, নিঃসঙ্গতা, নিস্তব্ধতা যেন দিগন্তবিস্তৃত নির্জনতা জুড়ে খাঁ খাঁ করছে। অদূরে লাগানো রক্তজবা গাছটার দিকে তাকিয়ে দেখলুম, তখনো পাপড়ি থেকে জল ছুঁইয়ে ছুঁইয়ে পড়ছে মাটিতে।

Md Abdul Aahad

১৬.০২.১৯

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে