স্বপ্ন?পর্ব_৪৩/৪৪/৪৫

0
659

স্বপ্ন?পর্ব_৪৩/৪৪/৪৫
#অনামিকা_সিকদার_মুন
#পর্ব_৪৩
.
.
.
নিশির মুখটা দু’হাতে আঁজলা করে নিয়ে ডান চোখের পাতায় একটা চুমু দেয় । গাঢ় স্বরে বলে,
—“ভালোবাসি”
নিশি চোখ খুললো না । চুপ করে শুধু অনুভব করছে । নিঝুম আবার বাম চোখের পাতায় একটা চুমু দিয়ে বললো,
—” খুব বেশি ভালোবাসি ”

পরের পাতা উল্টোতেই একটা ছবি পেল বিভাবরী । ছবিটা ডায়েরীর পাতার সাথে পিন করা ।
চারপাশে মেঘের ছড়াছড়ি । একটু একটু আলো রেখা আকাশে । সূর্যটা অর্ধেক দেখা যাচ্ছে । নিঝুম নিশির মুখটা দু’হাতে ধরে রেখে ওর মুখ পানে চেয়ে আছে । আর নিশির চোখ বন্ধ । এই ছবিটাই ডায়েরীর সাথে পিন করা । কিছুক্ষণ আগেও যে বিভাবরীর মন খারাপ ছিল, সেটা আর এখন নেই । ছবিটায় হাত বুলালো বিভাবরী । ঠোঁটের কোণায় একটুকরো হাসি ফুটে উঠেছে ওর । শান্তি লাগছে খুব ।

অনুর ছবির ফ্রেমটা হাতে নিয়ে বসে আছে নিশি । দৃষ্টি ছবিটাতেই আবদ্ধ । ওর অজান্তেই টুপ করে দু’ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ল ছবিটার উপর । বার বার চোখে ভেসে উঠতে লাগল সেইদিনের কাহিনিগুলো । কাঁধে কারো ছোঁয়া পেল নিশি । কিন্তু দৃষ্টি ফিরিয়ে তাকালো না সেই দিকে । আগের মতোই বসে রইল । কাঁধে হাত রাখা মানুষটি কে সেটা অজানা না নিশির । খুব ভালো করেই এই স্পর্শর সাথে পরিচিত নিশি ।
অপর পাশের মানুষটা বসল নিশির পাশে । খুব যতনে হাত রাখল নিশির মাথায় । এতক্ষণের নীরব কান্না যেন একটা নীড় খুঁজে পেল । ফুঁপিয়ে উঠা শব্দ জানান দিল কষ্টের । নিশির মাথা টেনে বুকে চেপে ধরলো নিঝুম । আর নিশি ফুঁপিয়ে কেঁদেই চলেছে । কাঁদতে কাঁদতে বললো,
— আমার বোনটা আজ আমার সাথে নেই নিঝুম । আমাকে মায়ের মতো আগলো রাখা বোনটা আজ আমার কাছে নেই । কত্তদূরে আমার থেকে । আমি আজ চাইলেও আমার বোনটার কোলে মাথা রাখতে পারি না । গান শোনানোর জন্য আবদার করতে পারি না । খাইয়ে দেয়ার জন্য মুখ ফুলিয়ে বসে থাকতে পারি না । আমার বোনটা আমার থেকে আজ এতদূরে কেন নিঝুম??
নিশি নিজের মতো বলেই যাচ্ছে । আর কেঁদে একাকার করছে । নিঝুম চুপ করে শুধু নিশির মাথায় হাত বুলিয়ে যাচ্ছে । কিন্তু চেষ্টা করছে না নিশিকে থামানোর । কাঁদুক আজ… মাঝে মাঝে কান্নারও দরকার আছে । কান্নার সাথে সাথে মনের মধ্যে জমে থাকা কষ্ট না গেলেও কিছুটা হালকা হয় । নইলে কান্নাগুলো বুকের মাঝে পাথর হয়ে বোঝা বাড়িয়ে দেয় । সেই কষ্টের বোঝা বয়ে বেরানো যে অনেক বেশি যন্ত্রণার । সবাই যে সেই যন্ত্রণা সহ্য করতে পারে না । নিশিকে সময় দিল নিঝুম নিজেকে সামলানোর জন্য । কিন্তু নিশি থামছে না । আরো বেসামাল হয়ে পড়ছে যেন । এখন নিশিকে থামানোর একটাই উপায় আছে । “অনু…”
নিঝুম নিশির মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতেই বললো,
—অনুর সাথে দেখা করিয়ে আনবো কাল ।
নিঝুমের কথা শুনে নিশির কান্নার মাত্রা আরও বেড়ে গেল । নিঝুমের চোখ থেকেও কয়েক ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ল । কিন্তু নিঝুম সেটা চট জলদি মুছে নিল ।

রাতের খাবার টেবিলে সবার মুখই গম্ভীর । প্রতিবছরই এই দিনটায় পরিবারের সবাই একসাথে হয় । বিভাবরী বোঝে না ছোট চাচ্চু, ফুপ্পি, ফুপা সবাই একসাথে হওয়ায় কই সবাই আনন্দ করবে । তা না সবার মুখ কেমন জানি ভার করে রাখে । এই বাড়িতে বিভাবরীর ছোট চাচ্চু মাত্র এই একদিনই আসেন । একরাত থেকে পরের দিন চলে যায় । আর আসে না । জন্মের পর থেকে এমনটাই দেখে এসেছে ও । বিভাবরী অনেক চেষ্টা করেছিল এর কারণটা জানার । কিন্তু পারে নি জানতে । সবাইকে এভাবে দেখে বিভাবরীর মনও খারাপ হয়ে যায় । খাওয়া বাদ দিয়ে মাথা নিচু করে শুধু খাবার নাড়ছিল বিভাবরী ।
—বিভা…
হঠাৎ গম্ভীর কণ্ঠে কারো ডাকে মাথা তুলে তাকায় বিভাবরী । দেখে ছোট চাচ্চু ডেকে । বিভাবরী তাকাতেই তিনি বলেন,
—এখানে এসে বসো ।
পাশের চেয়ারটায় ইশারা করলেন বিভাবরীর ছোট চাচ্চু । বিভাবরী চুপচাপ উঠে ছোট চাচ্চুর পাশে গিয়ে বসে ।
—না খেয়ে শুধু খাবার নাড়ছিলে কেন?
বিভাবরীকে উদ্দেশ্য করে বললেন ওর চাচ্চু । ভাত মাখিয়ে বিভাবরীর মুখে তুলে দিতে দিতে বললেন,
—হা করো । আমি খাইয়ে দিচ্ছি ।
বিভাবরীর মুখে হাসি ফুটে উঠলো । বললো,
—আচ্ছা দাও ।
হা করলো বিভাবরী । আর ওর চাচ্চু ওকে খাইয়ে দিতে লাগল । টেবিলে বসা বাকিরা তাকিয়ে রইলো ওদের দিকে । বিভাবরীর মা নিঃশব্দে টেবিল ছেড়ে উঠে চলে গেলেন নিজের রুমে । তারপর ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলেন ।
খাওয়া দাওয়ার পর বিভাবরী ওর চাচ্চুকে খুঁজতে রুমে গিয়ে দেখে উনি নেই । রুমে না পেয়ে সোজা চলে গেল ছাদে । কারণ চাচ্চু একমাত্র রুম ছেড়ে ছাদেই যান । অন্য আর কোথাও যান না । গুটি গুটি পায়ে ছাদের দিকে এগিয়ে গেল বিভাবরী । গিয়ে দেখল সবসময়ের মতো ওর চাচ্চু ছাদের রেলিং ঘেঁসে দাড়িয়ে আকাশপানে তাকিয়ে আছে । বিভাবরী ওর চাচ্চুর কাছে এগিয়ে গেল । খুব নিচু স্বরে ডাকলো,
—চাচ্চু
বিভাবরীর দিকে না তাকিয়েই ওর চাচ্চু উত্তর দিল,
—বল মা ।
বিভাবরী কিছু একটা বলতে চাইছিল কিন্তু পারছিল না । সেটা বুঝতে পারে ওর চাচ্চু । বললো,
—বিভা মা একটা গান শোনাবি!
বিভাবরী আর কোনো কথা না বলে সোজা গান শুরু করে ।
“চাঁদের হাসি বাঁধ ভেঙেছে ….. ” রবীন্দ্রসংগীতটা গাইলো বিভাবরী । এই গানটা ওর চাচ্চুর খুব পছন্দের । পছন্দের কারণ জানতে চাইলে ওর চাচ্চু সবসময় বলত,
—“অন্য কোনো সময় বলবো ।”
সেই অন্যসময়টা আজও আসে নি । গান শেষ করে বিভাবরী বললো,
—চাচ্চু তুমি এমন কেন?
আকাশের দিক থেকে চোখ সরিয়ে বিভাবরীর দিকে তাকালো ওর চাচ্চু । কিছুক্ষণ চুপ থেকে শীতল কণ্ঠে বললো,
—কালকে তোর সব প্রশ্নের উত্তর পাবি মা ।
বিভা আর কিছু বললো না । চুপ করে তাকিয়ে রইলো চাচ্চুর দিকে । ওর চাচ্চু ওকে সবসময় তুমি করেই বলে । কিন্তু হঠাৎ হঠাৎ তুই বলে । যখন তুই করে বলে তখন কেমন জানি গম্ভীর লাগে ওর চাচ্চুকে ।
—ঘরে চলে যাও বিভা । ঘুমাও গিয়ে ।
বিভাবরী আর কথা বাড়ালো না । চুপচাপ চলে আসলো ছাদ থেকে । রুমে ঢুকে খাটের উপর বসে এক ধ্যানে কিছুক্ষণ ভাবলো এলোমেলো কিছু ভাবনা । কিন্তু যখন কিছুতেই কিছু মিলাতে পারলো না তখন একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো । হঠাৎ ওর নজরে পড়লো নীল ডায়েরীটা । ভুলেই গিয়েছিল ডায়েরীটার কথা । বিকালে ফুপ্পি, ফুপা আসায় আর ডায়েরীর কথা মনে ছিল না । এখন আবার ডায়েরীটা পড়বে বলে মনে মনে ঠিক করলো বিভাবরী । যেভাবেই হোক আজ রাতের মধ্যেই শেষ করবে ভাবলো । দেরি না করে বসে পড়লো ডায়েরীটা নিয়ে । শেষ যতটুকু পড়েছিল তার পরের পাতা বের করে পড়া শুরু করলো বিভাবরী ।
“নিশির একটা নতুন জীবনের শুরু হয়েছিল সেইদিন সকালে । ওর নতুন জীবন আর নিশি নিঝুমের ভালোবাসার স্বাক্ষী হয়েছিল সাজেক । সাথে আড়ালে ছিল নীল, অনু, আযান আর মাহি । সারাদিন সাজেকের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়িয়েছিল ওরা । রুইলুই পাড়া, মেঘপুঞ্জি, জুমঘর কটেজ, সাজেক ভ্যালি রিসোর্ট, স্টোন গার্ডেন এই জায়গাগুলোতে সেদিন ঘুরেছে ওরা । সবশেষে আবার হেলিপ্যাডে-২ এ ফিরে আসে । তারপর…
.
.
.
চলবে??
(বিঃদ্রঃ ভুলত্রুটি ক্ষমার চোখে দেখবেন । )
.

এখনই জয়েন করুন আমাদের গল্প পোকা ফেসবুক গ্রুপে।
আর নিজের লেখা গল্প- কবিতা -পোস্ট করে অথবা অন্যের লেখা পড়ে গঠনমূলক সমালোচনা করে প্রতি মাসে জিতে নিন নগদ টাকা এবং বই সামগ্রী উপহার।
শুধুমাত্র আপনার লেখা মানসম্মত গল্প/কবিতাগুলোই আমাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হবে। এবং সেই সাথে আপনাদের জন্য থাকছে আকর্ষণীয় পুরষ্কার।

গল্পপোকার এবারের আয়োজন
ধারাবাহিক গল্প প্রতিযোগিতা

◆লেখক ৬ জন পাবে ৫০০ টাকা করে মোট ৩০০০ টাকা
◆পাঠক ২ জন পাবে ৫০০ টাকা করে ১০০০ টাকা।

আমাদের গল্প পোকা ফেসবুক গ্রুপে জয়েন করার জন্য এই লিংকে ক্লিক করুন: https://www.facebook.com/groups/golpopoka/?ref=share

#স্বপ্ন?
#অনামিকা_সিকদার_মুন
#পর্ব_৪৪
.
.
.
হেলিপ্যাড-২ এর পাশে একটা দোলনা আছে । নীল অনুর হাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে সেখানে গিয়ে অনুকে দোলনায় বসালো । অনু নীলকেও ওর সাথে বসতে বলে । কিন্তু নীল পরে বসবে বলে । নীল পেছন দিকে যেয়ে অনুকে দোল দিতে থাকে । আর অনু খিলখিলিয়ে হাসতে থাকে । এক ছোট্ট কিশোরীর মতো লাগছে অনুকে । নীল মনোমুগ্ধ হয়ে দেখে সেই হাসি । অনুর জীবনে নীল আসার পর থেকে অনু আবার সেই আগের মতো হাসে । এতদিনের ছন্দ ছাড়া জীবন যেন নতুন করে আবার ছন্দ খুঁজে পেয়েছে । নীল দোলনার পিছন থেকে অনুর সামনে এসে দাড়ায় । অপেক্ষা করে দোলনা থামার । দোলনা তখনো হালকা দুলছে । নীল হুট করে গিয়ে অনু কোলে তুলে নেয় । হঠাৎ নীলের এমন কাজে অনু বেশ হকচকিয়ে যায় । বড় বড় চোখ করে তাকায় নীলের দিকে । নীলের দিকে তাকাতেই নীল চোখ টিপ দেয় । ওর ঠোঁটের কোণে দুষ্টুমি হাসি ছড়িয়ে । লজ্জা পেয়ে যায় অনু । চোখ নিচে নামিয়ে ফেলে । নীল তখন বললো,
—এই যে সুন্দরী আপনাকে না বলেছি এভাবে আমার সামনে লজ্জা পাবেন না । তখন ভুলে কোনো ভুল করে ফেললে আমাকে দোষ দিতে পারবেন না কিন্তু ।
নীলের কথায় আরো লজ্জা পেয়ে যায় অনু । আড়ষ্ট কণ্ঠে বলে,
—আমাকে নামান প্লিজ ।
নীল দুষ্টুমি স্বরে বলে,
—নামানোর জন্য তো কোলে নেই নি সুন্দরী.. ।
অনু লজ্জায় আরো নুইয়ে গেল । নীল অনুকে কোলে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে কবিতা আবৃত্তি করতে লাগলো,
— “খুব কাছে এসো না কোন দিন
যতটা কাছে এলে কাছে আসা বলে লোকে
এ চোখ থেকে ঐ চোখের কাছে থাকা
এক পা বাড়ানো থেকে অন্য পায়ের সাথে চলা
কিংবা ধরো রেল লাইনের পাশাপাশি শুয়ে
অবিরাম বয়ে চলা ।
যে কাছাকাছির মাঝে ।
বিন্দু খানেক দূরত্বও আছে
মেঘের মেয়ে অতো কাছে
এসোনা কোন দিন
দিব্যি দিলাম মেঘের
বাড়ীর, আকাশ কিংবা আলোর সারির ।

তার চেয়ে বরং দূরেই থেকো
যেমন দূরে থাকে ছোঁয়, থেকে স্পর্শ
রোদ্দুরের বুক, থেকে উত্তাপ
শীতলতা, থেকে উষ্ণতা
প্রেমের খুব গভীর ম্যাপে যেমন লুকিয়ে থাকে ভালোবাসা
তেমন দূরত্বেই থেকে যেও-
এক ইঞ্চিতেও কভু বলতে পারবে
না কেউ
কতটা কাছাকাছি
এসেছিলে বলে দূরত্বের
পরিমাপ দিতে পারেনি
পৃথিবী ।
(রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ) ”
—কাছে আমি আসি নি । আপনিই জোর করে টেনে এনেছেন আমাকে ।
অনু নীলের দিক থেকে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে বললো । নীল হেসে বললো,
—আচ্ছা তাই?
অনু ছোট্ট করে উত্তর দিল,
—হু
নীল দুষ্টুমি করে বললো,
—তাহলে দূরে সরিয়ে দেই । কি বলো?
অনু নীলের দিকে তাকিয়ে ওর গলা আরও আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে বললো,
—দিন…
নীল হেসে বললো,
—এভাবে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে রাখলে কি করে দূরে সরবো মিষ্টি ?
অনু কোনো জবাব দিল না । নিঝুম, নিশি, আযান, মাহিকে রেখে নীল অনুকে রিসোর্টে ফিরে আসে । নিঝুম, নিশি, আযান, মাহি আরও কিছুক্ষণ ঘুরাঘুরি করে তারপর ফিরবে ।
রিসোর্টে ফিরে নীল অনুকে নিয়ে রিসোর্টের বারান্দায় বসে । অনু নীলের পাশে বসে ছিল । হঠাৎ নীল অনুকে টান দিয়ে নিজের কোলে এনে বসায় । অনুকে কিছু বলারও সুযোগ দেয় না । মুখ বন্ধ করিয়ে দেয় ।
চোখ বন্ধ করে ফেলে অনু । এমন কিছু হবে ও ভাবে নি । নিজেকে ছাড়ানোর কথাটাও ওর মাথায় আসে নি । শুধু কেঁপে কেঁপে উঠছে । হৃদস্পন্দনের গতি বেড়ে গিয়েছে কয়েকগুণ । কয়েক মুহুর্ত পরে অনুভব করে ওর ঘাড়ের পেছনে চুলে কারো হাত প্রবেশ করেছে । কপালে কপাল, নাকে নাক ঠেকিয়ে রেখেছে কেউ একজন । সেই কেউ’টা হলো নীল । ওভাবেই কেটে গেল অনেকক্ষণ । নীলের নিঃশ্বাসের শব্দ অনুভব করছিল অনু । ভালোলাগার একটা অসহ্য অনুভূতি বিচরণ করছিল তখন ওর মনে ।
এদিকে নীল অনুর কপালে কপাল ঠেকিয়ে রেখে তাকিয়ে ছিল অনুর দিকে । এই মুহুর্তে অনুর চেহারাটা দেখতে কেমন লাগছে সেটা মিস করতে চাইছিল না নীল । অনুর কুচকে বন্ধ করে রাখা চোখ, ঘন ঘন শ্বাস ফেলা, অধর জোড়ার কম্পন সব এক এক করে এঁকে নিল মনের ক্যানভাসে । অনুর নাকে টুক করে চুমু দিয়ে আবার আগের মতো কপালে কপাল ঠেকালো । অনু বুঝে উঠতে পারছে না এখনো যে ঠিক কি হচ্ছে । লজ্জা লাগছে । প্রচুর লজ্জা লাগছে ওর । যদি নিশির মতো হত তাহলে হয়তো এতক্ষণে ওর মুখ লাল আভায় রাঙিয়ে যেত । অনুর নিজেকে ছাড়ানোর জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ে । নীলের থেকে নিজে সরাতে চাইলে নীল টেনে ধরে আরো শক্ত করে মিশিয়ে নেয় নিজের সাথে । অস্ফুত স্বরে বলে,
—ভুলেও আমার থেকে দূরে সরার চেষ্টা করো না । তাহলে একটু আগের যেভাবে কথা বলা বন্ধ করেছি সেটা আবার রিপিট হবে ।
শান্ত হয়ে গেল অনু । চুপচাপ মিশে রইলো নীলের সাথে । এভাবেই নিরবতায় কেটে গেল কিছুক্ষণ । নীরবতা ভেঙে নীল বলতে শুরু করে,
—একদিন রাতে হঠাৎ স্বপ্নে দেখি আমি এক্সিডেন্ট করেছি । কিন্তু আশেপাশে কেউ নেই যে আমাকে বাঁচাবে । তখনই কোত্থেকে এক মেয়ে দৌড়ে এসে আমার মাথা কোলে তুলে নেয় । তার দু’চোখ থেকে ঝরঝর করে পানি পড়ছিল । তখন সেই মেয়ে আমাকে নিয়ে হসপিটালে যায় । আমাকে বাঁচায় । কিন্তু যখন মেয়েটাকে আমি ছুঁতে যাচ্ছিলাম, আমার থেকে দূরে সরে যাচ্ছিল সে । অনেক চেষ্টা করেও তার কাছে যেতে পারছিলাম না ।
এতটুকু বলে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে নীল । সেই শ্বাস এসে পড়ে অনুর মুখে । অনু ভেতরটা এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে । খুব চেষ্টা করছে নিজেকে শান্ত রাখার । নীল আবার বলতে শুরু করে,
—তার এক সপ্তাহ পরে সত্যি একটা এক্সিডেন্ট করি আমি । কিন্তু আমার কোনো ক্ষতি হয় নি । যেই রিক্সশার সাথে এক্সিডেন্ট করি সেই রিক্সার একটা মেয়ের ক্ষতি হয় । যখন মেয়েটার মুখ দেখি তখন থমকে যায় আমার পৃথিবী । কারণ মেয়েটা অন্য কেউ না, ছিল আমার স্বপ্নে দেখা মেয়েটি । আর আমার সেই স্বপ্নের মেয়েটা হলো আমার মিষ্টি অনু ।
নীল যখন কথাগুলো বলছিল তখন নীলের প্রতিটা কথায় অনুর ভেতরে কেঁপে উঠছিল । শেষ কথা শুনে অনু চোখ মেলে তাকালো । তখনই চোখ পড়লো নীলের চোখে । চোখে চোখে ধাক্কা খেল একদফা । অনু বন্দী হয়ে গেল নীলের চোখে । এক অদ্ভুত নেশায় মাতাল হলো দু’জনেই । দু’জনের নিঃশ্বাসেই ভারী । খুব কাছে দু’জনে । সময়টা যদি এখানেই থেমে যেত । তাহলে দু’জনেই এভাবে থাকতে পারত দু’জনের খুব কাছে । কিন্তু সময় যে বহমান । থেমে থাকে না কারো জন্য । আপন গতিতে ছুটে চলে । দেখতে দেখতেই কেটে যায় সাজেক ট্যুরের পাঁচটা দিন । পাঁচদিন শেষে আসলো নিজ নীড়ে ফেরার পালা । ফিরে যাওয়ার দিন সকালে….
.
.
.
চলবে?
(বিঃদ্রঃ ভুলত্রুটি ক্ষমার চোখে দেখবেন।)
.

#স্বপ্ন?
#অনামিকা_সিকদার_মুন
#পর্ব_৪৫
.
.
.
ফিরে যাওয়ার দিন সকালে খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে নিঝুম । তারপর চটপট ফ্রেশ হয়ে নেয় । ফ্রেশ হয়ে রুম থেকে বের হয় নিশির রুমে যাওয়ার উদ্দেশ্যে । নিশির রুমের সামনে গিয়ে ভাবতে থাকে দরজায় নক করবে নাকি নিশিকে ফোন দিবে । পরে ফোন না দিয়ে দরজায় নক করে । একবার নক করার পর কোনো সারা পেল না । দ্বিতীয় বার আবার নক করলো । দ্বিতীয়বার নক করতেই দরজা খোলার আওয়াজ পাওয়া গেল । দরজার খুলতেই দেখলো নিশি না অনু দরজা খুলেছে । অনু নিঝুমকে এত সকালে দেখে একটু অবাক হয় । জিজ্ঞেস করে,
—কিছু বলবেন ভাইয়া?
নিঝুম কণ্ঠ খাদে নামিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
—নিশি কোথায়?
—আপি তো এখনো ঘুমাচ্ছে ।
নিঝুম কিছু একটা বলতে যেয়েও পারছে না । বলতে ইতস্ততবোধ করছিল । অনু বুঝতে পেরে জিজ্ঞেস করে,
—ভাইয়া কিছু বলবেন?
নিঝুম আগের মতোই ইতস্তত করে বললো,
—নিশিকে নিয়ে একটু বের হতে চেয়েছিলাম । কিছুক্ষণ পরে তো চলেই যাব । তাই আর কি..
অনু একটু হেসে বললো,
—এটা বলতে এত ইতস্ততবোধ করছিলেন আপনি! আমি ভাবলাম কি না কি । কিন্তু সমস্যা হলো আপিকে এখন শত ডেকেও ঘুম তোলা সম্ভব না ।
নিঝুম মুখটা মলিন করে ফেললো । নিঝুমমের চেহারা দেখে অনুর প্রচুর হাসি পাচ্ছিল । কিন্তু ও হাসি আটকে রাখলো । দুষ্টু হাসি হেসে বললো,
—তবে একটা উপায় আছে ।
নিঝুম অনুর কথা শুনে অনুর দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালো । অনু আগের মতোই হেসে বললো,
—আপিকে চাইলে অন্যভাবে নিয়ে যেতে পারেন ।
নিঝুমের কয়েক মিনিট লাগলো অনুর কথা বুঝতে । যখন বুঝতে বুঝতে পারলো তখন অনুর দিকে তাকিয়ে হেসে ফেললো । নিঝুমের সাথে তাল মিলিয়ে হাসলো অনুও। তারপর দরজা ছেড়ে সরে দাড়ালো । নিঝুম নিঃশব্দে রুমে প্রবেশ করে । ভোরের নতুন আলোয় দেখলো নিশির মুখটা । বাতাসে একগোছা চুল এসে মুখের উপর এলোমেলো হয়ে পড়ে আছে । নিচের ঠোঁটটা একটু দেবে আছে ভিতরে । চোখের পাতা হালকা কেঁপে কেঁপে উঠছে । নিঝুম অপলক তাকিয়ে রইলো নিশির মুখের দিকে । এক ঘোরে যেন আটকা পড়ে গেছে ও। অনু নিঝুমকে এভাবে নিশির দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে হালকা কৃত্রিম কাশি দিল । অনুর শব্দ নিঝুমের যেন খেয়াল ফিরলো । অনুর দিকে একবার তাকালো নিঝুম তারপর বিনাবাক্যে নিশিকে কোলে তুলে নিল । নিশিকে নিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য পা বাড়ায় । দরজার কাছ পর্যন্ত যেয়ে আবার পিছন ফিরে অনুর দিকে তাকায় । দেখে অনু মুচকি হেসে তাকিয়ে আছে । নিঝুম ইশারায় অনুকে ধন্যবাদ জানায় । তারপর বেরিয়ে যায় । নিঝুম নিশিকে নিয়ে বেরিয়ে যেতেই অনু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বিছানা গিয়ে বসে ।
নিঝুম নিশিকে নিয়ে রিসোর্টের পাশেই এক টিলার উপর আসে । নিশি তখনো ঘুমিয়ে লুটোপুটি । নিঝুম নিশির ঘুমন্ত মুখটার দিকে তাকিয়ে ভাবলো,
—এই মেয়েকে ঘুমের মধ্যে যদি কেউ তুলেও নিয়ে যায় তবুও টের পাবে না । পাচারও করে দিতে পারবো ।
নিশির ঘুম কীভাবে ভাঙাবে সেটাও ভাবতে লাগলো নিঝুম । হঠাৎ নিঝুমের মাথায় দুষ্ট বুদ্ধি আসে । নিঝুম আস্তে ফুঁ দিতে থাকে নিশির মুখে । মুখে ফুঁ দেয়ায় নিশির সুড়সুড়ি লাগে । তখন নিশি মুখ কুঁচকে ফেলে । নিশিকে মুখ কুঁচকাতে দেখে হেসে ফেলে নিঝুম । নিশির কপালে আলতো করে অধরজোড়া ছুঁইয়ে দিল । কপালে উষ্ণ ছোঁয়া পেয়ে পিটপিট করে চোখ খুললো । চোখের সামনে দেখতে পেল নিঝুমের হাসি হাসি মুখটা । নিশি জেগে উঠলেও তখনো ওর ঘুমের রেশ কাটেনি । নিশি ডান হাত উঠিয়ে নিঝুমের গাল স্পর্শ করলো । ও কি সত্যি দেখছে নাকি ওর ঘুমের ঘোরে স্বপ্ন মাত্র!! নিঝুমের গাল ছুঁয়ে নিশি অপলক তাকিয়ে থাকে । নিঝুম নিশির হাতেও অধর ছোঁয়ালো । তখন নিশির খেয়াল হলো নাহ এটা স্বপ্ন না । এটা সত্যি । তারপর আবার মনে হলো ও শূণ্যে ভাসছে । কিন্তু কীভাবে!! নিজের দিকে ভালো করে একবার তাকিয়ে নিঝুমের দিকে তাকালো । যখন বুঝলো ও নিঝুমের কোলে চোখ বড় বড় করে ফেললো । লজ্জায় মনে হচ্ছিল মাটির সাথে মিশে যাক । মুহুর্তেই ওর গাল গোলাপি আভা ধারণ করল । নিঝুমের দিক থেকে চোখ সরিয়ে নিল নিশি । মাথা নিচু করে ফেললো । মিনমিন করে বলল,
—নামান আমাকে…
নিঝুম নিশির লজ্জা দেখে মিটমিট করে হাসছিল । নিশিকে মিনমিন করে কথা বলতে দেখে ওকে আরো লজ্জা দেওয়ার জন্য কানের কাছে মুখ নিয়ে ওর মতোই মিনমিন করে বলে,
—উহু… নামাবো না । এভাবে নিয়েই ঘুরবো…।
অনুরোধের স্বরে নিশি আবার বলল,
—প্লিজ..
নিঝুম নিশির কথার উত্তর না দিয়ে বলে,
—স্বপ্নকন্যা সামনে তাকাও ।
নিশি বুঝে গেল নিঝুমকে এখন শত বলেও কোনো কাজ হবে না । বেশি বললে এমন কিছু করে বসবে যেটাতে ওকে আরো লজ্জায় পড়তে হবে। তার থেকে চুপ থাকাই শ্রেয় মনে হলো ওর । নিঝুমের কথা অনুসারে চুপচাপ সামনে তাকালো নিশি । সামনে তাকাতেই ওর দু’চোখে মুগ্ধতা ছেয়ে গেল । যতদূর চোখ যায় শুধু মেঘ আর মেঘ । সাদা মেঘের ছড়াছড়ি । মেঘের রাজ্যে যেন ভাসছে নিশি । খুশিতে উড়তে ইচ্ছে করছে নিশির । নিশিকে নিয়ে আরেকটু সামনে এগুলো নিঝুম । নিশি তখন হাত বাড়ালো মেঘ ছোঁয়ার আশায় । ও যে নিঝুমের কোলে সেটা বোধহয় খুশিতে একেবারে ভুলেই গেছে । নিঝুম নিশিকে হাত বাড়াতে দেখে হেসে বলল,
—মেঘ ছুঁতে চাও??
নিশি নিঝুমের কথা শুনে ওর দিকে ফিরে তাকালো । ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটিয়ে বাচ্চাদের মতো মাথা ঝাকিয়ে হ্যাঁ বলল । নিঝুম নিশির নাকে নাক ঘসে দিয়ে বলল,
—আচ্ছা ।
তারপর নিশিকে কোল থেকে নামালো । হাত ধরে এমন জায়গায় নিয়ে গেল যেখান থেকে মেঘ ছোঁয়া যায় । সাজেক হচ্ছে মেঘের রাজ্য । যেখানে সারাদিন মেঘের ছড়াছড়ি । সেখানে খুব ভোরে তো মেঘ ছোঁয়া যাবেই । নিঝুম নিশিকে দাঁড় করিয়ে ওর পেছনে গিয়ে ওর দু’কাঁধে হাত রেখে দাড়ালো । হঠাৎ মেঘ দেখে নিশির হাত তুলে উঁচু করে ধরলো । কিন্তু নিশির হাতের উষ্ণ ছোঁয়ায় মেঘ গলে পানি হয়ে গেল । সেটা দেখে নিশি মুখ লটকে ফেলে । নিঝুম হেসে নিশির গালে আলতো টোকা মেরে বলে,
—ইসস… ওভাবে মুখ লটকেছ কেন?
নিশি আগের মতো মুখ ভঙ্গিমা রেখেই বলল,
—মেঘ গলে পানি হয়ে গেল যে ।
এবার নিঝুম শব্দ করে হেসে উঠে বলল,
—উষ্ণ ছোঁয়া পেলে তো মেঘ গলে যাবেই ।
নিশি মুখ ভার করে বলল,
—কেন গলবে? আমি মেঘ ধরবো যে তাই ওরা গলবে না ।
নিঝুম নিশির কথা শুনে হাসতে লাগলো কেবল । আর নিশি ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে রইলো নিঝুমের দিকে…
.
.
.
চলবে?
(ভুলত্রুটি ক্ষমার চোখে দেখবেন ।)
.

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে