সে_এসেছে (পর্ব: ০2/শেষ)

0
2190

সে_এসেছে (পর্ব: ০2/শেষ)
#সুহাসিনী

সন্ধ্যায় আর কোনো ভয়ংকর ঘটনা ঘটেনি। রাতে খাওয়া দাওয়া করার পর তন্নি নিজের রুমেই ঘুমিয়ে পড়লো।রাইসা অবশ্য তন্নীর সাথেই ঘুমাতে চেয়েছিল। কিন্তু ওর প্রচন্ড মাথা যন্ত্রণা শুরু হওয়ায় একটু লেট হচ্ছে।

রাত তখন প্রায় সাড়ে বারোটা। পাশে একটা নরম শরীরের উপস্থিতি টের পেয়ে তন্নির ঘুম ভেঙে গেলো। একটা অস্পষ্ট ছায়ারূপী মেয়ে শরীর। তন্নী ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করল,
কে? কে তুমি?

-আমি? আমিও যে তোমারই মত একটা মেয়ে।

-কি চাই তোমার?

-তোমাকে। আমি যে তোমায় নিতে এসেছি।

-আমি বাবা মা কে ছেড়ে কোথাও যেতে চাইনে।আমার পিছু ছাড়ো প্লিজ।

-তন্নি, আমিও যেতে চাইনি। তারপরেও আমাকে যেতে বাধ্য করেছে। আমি একা তোমায় কিছুই ভোগ করতে দেব না। আমি কি পাপ করেছিলাম?

তন্নি মা বলে চিৎকার দিয়ে উঠলো। রাইসা তখনো নিজের ঘরেই মাথা যন্ত্রণা নিয়ে শুয়ে আছে।আর আসিফ ঘুমাচ্ছে।
মেয়ের চিৎকারে রাইসা দৌড়ে ওর রুমে গেলো। ওর পিছু পিছু আসিফও ঘুম ছেড়ে মেয়ের ঘরে ঢুকলো। সমস্ত ঘর অন্ধকার। শুধু বারান্দার দিকে আলো জ্বলজ্বল করছে। উপরের দিকে একটা রক্ত দলার মত শরীর তন্নীর শরীরটাকে আঁকড়ে ধরে আছে।

রাইসা চিৎকার দিয়ে উঠল,
-ছেড়ে দাও আমার মেয়েকে। নয়ত খুন করে ফেলবো তোমায়।

শরীরটা কিছুক্ষণ চুপ থেকে শান্ত স্বরে উত্তর দিলো,
-আমাকে আর কতবার মারবে তুমি? আমি তো গত এগারো বছর ধরেই মৃত।

রাইসা চমকে উঠলো।আসিফও যেন কিছুটা শক খেলো। রাইসার গলা শুকিয়ে যাচ্ছে। আসিফ দুইপা সামনে এগিয়ে এসে বলল,
-কে তুমি?

-আমাকে চিনতে পারছো না? আমি তিথী যে..

রাইসার চোখ দিয়ে টপটপ করে অজান্তেই পানি ঝরছে। কাঁদতে কাঁদতেই জিজ্ঞেস করল,
-কোন তিথী?

শরীরটা এবার তাচ্ছ্যিলের স্বরে হা হা করে হেসে উঠলো। তারপর বলল,
-আমাকে এত দ্রুত ভুলে গেলে মা? আমি তোমার মেয়ে তিথী। কত শখ করে আমার নাম রেখেছিলে তুমি! আমি তোমার সেই আদরের তিথী।

-মিথ্যে কথা। তিথীর কোনো অস্তিত্ব নেই।

-নেই তো।তোমরা তো তিথীর কোনো অস্তিত্বই রাখো নি। কাউকে জানতে দাও নি।আমি তো নেই আর তোমাদের মাঝে। আমাকে ছাড়া তোমরা কত সুখেই না আছো!
আসিফ মাথার চুল টেনে ধরে আছে। রাইসা শক্ত করে দরজা খামচে ধরলো। সত্যিই সে তিথীর কোনো অস্তিত্ব রাখে নি।

ভার্সিটি লাইফে বেশ ভালোই চলছিলো ওর দিনগুলো। গ্রামের সহজ সরল মেয়েটার সহজ জীবন।আসিফকে ভার্সিটির প্রোগ্রামে প্রথম দেখাতেই প্রেমে পড়ে যায়।
তারপর আস্তে আস্তে সেটা প্রেমেও রূপ নেয়। অনেক স্বপ্ন আর কল্পনা নিয়ে গড়ে উঠেছিল ভালবাসাটা। রাইসার ভীষণ ইচ্ছে ওদের বিয়ের পর প্রথম সন্তান মেয়ে হলে নাম রাখবে তিথী।

একদিন রাতে ফেরার সময় মুষলধারে বৃষ্টি নামে। রিক্সায় হুড তুলেও দুজনেই ভিজে একাকার। বৃষ্টিভেজা শাড়ি পরিহিত মেয়েটাকে দেখে নিজেকে আর আটকে রাখতে পারেনি আসিফ। রাইসার মনেও তুমুল ঝড় চলছিল। রিক্সাওয়ালার তীব্র গতির প্যাডেল যেন বাধ দিয়ে ফেলছিল। রাইসা বিরক্ত হয়ে বলে উঠেছিল ‘ মামা, রিক্সাটা একটু আস্তে চালান প্লিজ।’

সেদিন ওদের উন্মাদনাও হয়ত রিক্সাওয়ালার মনে পৈশাচিক আনন্দ দিয়েছিলো।শেষমেস একটা বাসায় ওদের রাত কাটানোর ব্যবস্থা করে দিয়ে তবেই বাসায় ফিরেছিল। বিনিময়ে পেয়েছিল নগদ ৫০০ টাকার একটা নোট।
রাইসাদের খবর নেওয়ার আর প্রয়োজন পড়েনি তার। ওরা তখন সৃষ্টির আদিম নেশায় মত্ত।এ নেশা কাটবার নয়। কাটেও নি। বহবার তার পুনরাবৃত্তি ঘটেছে।
ফলস্বরূপ মেডিকেল রিপোর্টে রাইসার গর্ভে একদিন ধরা পড়ে তিন মাসের একটা রক্তমাংসের শরীর।
ওরা তখনো ভার্সিটি স্টুডেন্ট। নিজের সন্তানকে পৃথিবীতে নিয়ে আসার সাহস ওরা পায় নি।
একদিন বিকেলবেলা শায়লা মেমোরিয়াল হাসপাতালে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে আসে তিলে তিলে গড়ে ওঠা প্রান টাকে। তবুও কমেনি ওদের মনের পূর্ণ পাপগুলো। একইভাবে চলে আসে তন্নী। ভাগ্যিস বিয়ে করে নিয়েছিল!

নিজের পাপের কথা মনে করে রাইসা কাঁদতে কাঁদতে মেঝেতে বসে পড়লো।

-তিথী, আই এম সরি মা। প্লিজ আমাকে ক্ষমা করে দে।

-ক্ষমা? কিভাবে করবো বলো তো? আমারও না ভীষণ ইচ্ছে হত পৃথিবীতে আলোর মুখ দেখবো। আর সব বাচ্চাদের মত খেলব। তোমার কোলে মাথা রেখে ঘুমাবো, তোমার হাতে খাবো। বাবার হাত ধরে বিকেলে ঘুরতে বেরোবো..
ভয় পেলে তোমাকে জড়িয়ে ধরে কোলের মধ্যে ঘুমাবো। জানো মা? ওরা আমায় ডাস্টবিনে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিল। দুটো কুকুরে আমার শরীর ছিঁড়ে খাচ্ছিল। অথচ, তখনও আমার শ্বাস চলছিল। তুমি একটুও আমার খোঁজ নাও নি।
আমি কি পাপ করেছিলাম মা? তোমাদের পাপের শাস্তি আমাকে কেন দিলে?

-তিথী, আমাকে এভাবে আর তিরষ্কার করিস না মা। ফিরে আয় আমার বুকে।ফিরে আয় তোর বোন কে সাথে নিয়ে..আমি তখন নিরুপায় ছিলাম।

-এই কথাগুলো তোমাদের নোংরা চাহিদার সময় মনে করলে আজ আমরা দুইবোনই তোমার কোলে থাকতাম। এখন আর সম্ভব না। মৃত প্রাণ কোনোদিন ফিরে আসে না। ওখানে আমার একা থাকতে ভীষণ কষ্ট হয়।তন্নীকে নিয়ে গেলাম। বাবা মা হবার অধিকার তোমাদের নেই ।আর কোনোদিন হতেও পারবে না।

মুহূর্তেই রক্তদলার শরীরটা তন্নীকে নিয়ে শূণ্যে মিলিয়ে গেলো। আসিফ স্তব্ধ হয়ে দাড়িয়ে আছে। রাইসা তখনো কান্না বিজড়িত গলায় প্রলাপ করছে..
-যাস না তিথী, যাস না। ফিরে আয় তোরা দুইবোন। ফিরে আয় আমার বুকে। তোর পাপিষ্ঠ বাবা মাকে ক্ষমা কর মা,ক্ষমা কর…

(সমাপ্ত)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে