সে পর্ব-১১

0
1336

#সে
#পর্ব_১১
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
____________________
শীতের প্রায় শেষ সময়। গাছের পাতার মতো আমার মনে থাকা সকল সুখগুলোও ঝড়ে পড়েছে। সোনালী রোদের পিচঢালা পথ চিকচিক করছে। পরীক্ষা শেষ হয়েছে আজ দু’দিন হবে। রুদ্রকে ব্লক করার পর আর কথা হয়নি। এমন না যে, আমি কথা বলার অপশন রাখিনি। রেখেছি। হোয়াটসঅ্যাপে ব্লক করিনি। নাম্বারও ব্লক করিনি। সে চাইলেই পারতো যোগাযোগ করতে। কিন্তু না। সে করেনি। করিনি আমি নিজেও। মন অনেকবার করে বলেছিল একটা ফোন কিংবা ম্যাসেজ করার জন্য। আমার মতে, পৃথিবীর সবচেয়ে বেহায়া জিনিসটি হচ্ছে মন। শুধু মন নয়। মেয়ে মানুষের মন। এদিক থেকে ছেলেদের তুলনায় মেয়েদের মন-ই সর্বাত্মক বেহায়া হয়।

কেন বলছি এ কথা? বলছি তার কারণ আছে। আমি কিন্তু রুদ্রর সব খবরই রাখি। সে দিব্যি আছে। আগে যেমন ছিল তেমনই। কোনো চেঞ্জ নেই। আমি এভাবে চলে আসায় তার জীবনে বিন্দুমাত্র কোনোরকম প্রভাব ফেলেনি। এর মানে কী দাঁড়ায়? তার জীবনে আমি আদৌ কিছু ছিলাম-ই না। যার জীবনে আমার কোনো প্রায়োরিটিই নেই, তার জন্য উতলা হওয়ার মাধ্যমকে বেহায়া বলব না?

এদিকে ঢাকায় যাওয়ার কার্যক্রম সম্পন্ন করে ফেলেছে বাবা। যতই ঢাকায় যাওয়ার দিন ঘনিয়ে আসছে ততই রুদ্রর সাথে কথা বলার জন্য মন ছটফট করছে। এতকিছুর পরও মনে হচ্ছে একটু কথা বলি। আমার মনের এই একটু চাওয়াকেও এখন আমি প্রাধান্য দিচ্ছি না। আসলে অপর মানুষটির অবহেলা সহ্য করতে করতে এমন একটা পর্যায়ে চলে এসেছি যে, এখন ভালোবাসার আগে ইগো নামের একটা শব্দ ঢাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমি চাইলেও পারছি না ইগোকে উপেক্ষা করে রুদ্রর কাছে যেতে। ইগোটা কি আসা প্রয়োজন ছিল না?

এরপর রুদ্রর সাথে আমার দেখা হয় রোজের জন্মদিনে। আমি জানতাম না সেখানে রুদ্রও উপস্থিত থাকবে। কারণ এতদিনে আপনারাও আমার সাথে এটা তো এটলিস্ট বুঝে গেছেন যে, সে ঠিক কতটা ব্যস্ত মানুষ! তাই এমন ছোটোখাটো জন্মদিনের অনুষ্ঠানে সে আসবে এটা আমার ভাবনারও বাহিরে ছিল। আবার এমনও হতে পারে, আমি বাদে বাকি সবারই প্রায়োরিটি তার কাছে অল্প হলেও আছে। থাকতেই পারে। অস্বাভাবিক কিছু না। যতটা উৎফুল্লতা নিয়ে অনুষ্ঠানে জয়েন করেছিলাম ততটাই মিইয়ে গিয়েছিলাম রুদ্রকে দেখে। রুদ্রর সেই হাসি দেখে। আমার ধারণা ছিল, আমায় দেখার পর হয়তো সে মুখ ঘুরিয়ে নেবে। কিন্তু সে এমনটা করেনি। বরং আমায় দেখে হাসি হাসি মুখটা আরও হাস্যজ্জ্বল হয়ে উঠল। অন্য কোনো সময় হলে আমি চলে আসতাম। কিন্তু আজ উপায় নেই। এর কারণ প্রধানত দুটো। এক. এটাই হয়তো রোজের জন্মদিনে আমার শেষ আসা। এবং দুই. রুদ্রকে দেখার লোভ।
সে আমার দিকে এগিয়ে এসে প্রথম যেই প্রশ্নটা করল,’তুমি কি আমায় ফেসবুকে ব্লক করেছ?’

আমার বুকচিরে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। এরকম নাটক কেউ করে? এতদিন হয়ে গেছে আর সে আজ আমায় জিজ্ঞেস করছে আমি ব্লক করেছি কী-না। রাগকে কোনো রকম কন্ট্রোল করে বললাম,’দয়া করে এখানে আর কোনো নাটক করিয়েন না।’
‘আমি যা করি সব-ই নাটক হয়ে যায়? ব্লক কেন দিছ?’
‘ফেসবুকে গিয়ে লাস্ট ম্যাসেজগুলো পড়েন। তাহলেই বুঝবেন।’
‘তুমি মনে করাও।’
‘আমি পারব না।’
‘লিস্ট থেকে বের করার মতো তো কিছু হয়নি নবনী।’

আমি তার সাথে এখানে কোনো সিনক্রিয়েট করতে চাচ্ছিলাম না বিধায় সেখান থেকে সরে যাই। রুদ্রও কিছু বলল না। কিন্তু পুরো অনুষ্ঠানে সে আমার দিকে তাকিয়েই রইল। সঙ্গে মুচকি মুচকি হাসি তো আছেই। এদিকে বারবার আমায় অস্বস্তিতে পড়তে হচ্ছে। এই মানুষটাকে আমি এখনও বুঝতে পারি না। এতটা রহস্য তার মাঝে। সে আসলে চায় কী? ছাড়তেও চায় না আবার শক্ত করে ধরেও না। ঝুলিয়ে রাখার মন-মানসিকতা কতটুকু যুক্তিসংগত? অনেকটা সময় তাকে চোখের সামনে দেখে আমি নিজেও গলে যাচ্ছিলাম। নিজেকে নিজের মাঝে আটকে রাখা দায় হয়ে পড়ছিল আমার জন্য।

অনুষ্ঠান শেষেরদিকে নিজের ফ্ল্যাটে আসার সময় রুদ্র পিছু ডাকে। জিজ্ঞেস করে,’একটু কথা বলা যাবে?’

আমি না করতে পারিনি। গাম্ভীর্য বজায় রেখে বললাম,’হুম। বলেন।’
‘এখানে না। নিচে।’
‘আচ্ছা।’

নিচে গিয়ে হাঁটতে হাঁটতে রুদ্র বলল,’নবনী তুমি রাগ আর জেদ একটু কমাও বুঝছো। বয়সের তুলনায় তোমার রাগ কিন্তু অনেক বেশি।’

‘তাই? আপনি শুধু রাগটাই দেখলেন। রাগের পেছনের কারণগুলা দেখেন না?’

‘কী কারণ?’
‘ওহ! আপনি জানেনই না?’
‘না। জানাও।’
‘প্রয়োজনই মনে করছি না। আমি আসলে আপনাকে সহ্যই করতে পারছি না। এত নাটক আপনি কীভাবে করেন?’
‘সবসময় শুধু ভুল বোঝো। আমি কী করেছি বলো?’
‘কিছু করেননি। যা করার আমি করেছি। ভুল করেছি।’
‘আচ্ছা বাদ দাও এসব। আমরা ভালো করে কথা বলি?’
‘আপনার কী বলার আছে আপনি বলেন।’
‘তোমার কিছু বলার নেই?’
‘কী বলার থাকবে?’
‘এই পিচ্চি এত রাগ করো কেন সবসময়? একটু হেসে কথা বলতে পারো না? হেসে কথা বলবা। হাসলে তো তোমায় অনেক সুন্দর লাগে।’

এত কিছুর পরও সে এত স্বাভাবিকভাবে কথা বলে যে, আমি কনফিউশনে পড়ে যাই। তাকে কী বলা যায়? সে কি মনে মনে ভালোবাসে আমায়? কোনো কারণে বলতে চাচ্ছে না?

‘চুপ করে আছো কেন?’ জিজ্ঞেস করল সে।
তার প্রশ্নে সচকিত হয়ে তাকিয়ে বললাম,’কিছু না। খুব তাড়াতাড়ি-ই আমরা ঢাকায় চলে যাচ্ছি। যাওয়ার আগে একটা সত্যি কথা জানতে চাই। আপনি কি সত্যিই আমায় ভালোবাসেন না?’
রুদ্র বেশ শান্তস্বরে বলল,’না, নবনী। এর আগেও তো আমি তোমায় সবটা বুঝিয়েছি। আপাতত আমি ক্যারিয়ার ছাড়া অন্য কোনো কিছু নিয়ে ভাবছি না।’

‘আপনি আমার থেকে অনেক কিছু লুকান। অপ্রয়োজনীয় মিথ্যা কথাও বলেন। কেন করেন এমন?’
‘আবার ভুল বুঝতেছ।’
‘আপনি নিজেও খুব ভালো করে জানেন আমি কোনো মিথ্যা বা ভুল বলছি না।’

রুদ্র নিশ্চুপ। ওর নিরবতায় আমার কান্না এসে পড়ছে। কেন জানি হঠাৎ করেই ভীষণ ইমোশোনাল হয়ে পড়ছি আমি। কোনোভাবেই কান্না আটকিয়ে রাখতে পারছি না। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে বললাম,’কাল-ই আমরা ঢাকায় চলে যাচ্ছি জানেন?’
রুদ্র ডান হাতের আঙুলী দ্বারা দু’ভ্রুর মাঝখানে চুলকে বলল,’না, জানতাম না। তুমি তো বলোনি। আচ্ছা সাবধানে যেও। ভালো থেকো।’

আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম কিছুক্ষণ। কথা বলার ভাষাও লোভ পেয়েছে। কত সহজে কথাগুলো বলে ফেলল! তার মানে তো এটাই সে সত্যিই আমায় ভালোবাসে না!

আমি বিস্ময় নিয়েই জিজ্ঞেস করলাম,
‘এত সহজে কথাগুলো বলে দিলেন?’
‘একটা সহজ কথা সহজভাবে না বলে কি কঠিনভাবে বলা উচিত ছিল নবনী?’
‘আপনি কি আমায় সত্যিই ভালোবাসেন না?’
‘না। সেটা তো আমি আগেই বলেছি। একদম শুরুর দিক থেকেই। কোনো রকম সম্পর্কে জড়ানো আমার পক্ষে সম্ভব নয়।’
‘অথচ আপনি আমার সাথে এমনভাবে মিশতেন যে মনে হবে আপনি আমায় ভালোবাসেন।’
‘একটা মিথ্যে মনগড়া ধারণাকে মনে পুষে বড়ো করলে সেটা তোমার ব্যর্থতা। আমার তো নয়।’
পেছনের সব রাগ, জেদ ভুলে গিয়ে আমি ওর হাত ধরে কেঁদে কেঁদে বললাম,’দেখেন আমি কিন্তু মজা করছি না। সত্যিই কাল আমরা ঢাকায় চলে যাচ্ছি। কিন্তু আমি আপনাকে ছাড়া কীভাবে থাকব?’
‘আমার সাথে দেখা হওয়ার আগে যেভাবে ছিলে সেভাবেই। দেখো নবনী, তুমি আমায় ভুল বুঝো না। তোমার বয়স কম। আবেগ বেশি। তাই এখন এসব ভেবে কান্নাকাটি করছ। আরও বড়ো হও। তখন এই আবেগটা আর থাকবে না। একটা সময়ে তোমার আজকের কথা মনে পড়লে হাসি পাবে।’

শেষ মুহুর্তে এসে তার এই কঠিন কঠিন কথাগুলোই আমায় বদলে দিতে যথেষ্ট ছিল। তার হাত ছেড়ে দিয়ে কিছু্ক্ষণ নিরব হয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ওর মুখটা দেখছিলাম। হাতের উল্টোপিঠে চোখের পানি মুছে বললাম,
‘আজ বুঝতে পারছেন না। এখন বুঝবেন না। আজ থেকে কয়েক বছর পর যখন অন্য কারো সাথে আমায় সুখে থাকতে দেখবেন, তখন বুঝবেন কষ্ট কাকে বলে।’

দু’হাতে চোখের পানি মুছেই আমি বাড়ির ভেতর চলে আসি। এইযে আমি ফিরে যাচ্ছি,আর পিছু ফিরে তাকাবো না আমি। আর ফিরে আসব না আমি। কখনো না। কখনো না।

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে