সে আমারই পর্ব-১২+১৩

0
287

#সে_আমারই
#মোহনা_মিম
#পর্বঃ১২

ক্লান্তিতে দু চোখে যখন ঘুম নেমে এসেছে, তখনই তীব্র ঝাঁকুনিতে ঘুমে ব্যাঘাত ঘটল তার। কপাল কুঁচকে বলল,

“খেতে তো দিবি না, অন্তত ঘুমাতে দে। খুব ক্লান্ত আমি।”

দৃষ্টি চাপা কন্ঠে বলে,

“আফরান ভাই! উঠুন, খাবার এনেছি আমি। খেয়ে নিন।”

আফরান চোখ মেলে উঠে বসল। পিটপিট করে তাকিয়ে বলল,

“সত্যি খাবার এনেছিস! আমি তো ভেবেছিলাম তোর বাপ সব সাবাড় করে ফেলেছে।”

“আফরান ভাই! আপনি সব সময় বাবাকে নিয়ে এমন করেন কেন?”

“তো করব না? সেদিন ভাইকে নিয়ে তোদের বাড়িতে এলাম কতদিন পর বেড়াতে। আর তোর বাপ করলটা কি? হ্যাঁ? করলটা কি? শুধু চমচম দিয়ে কাজ সেরে নিল? একটু রসমালাই আনলে কি হতো? জামাই মানুষ একটু ভালো করে আপ্যায়ন করবে না?”

অতঃপর আফসোসের কন্ঠে বলল,

“বুঝলি দৃষ? তোর কপাল খুব খারাপ। তোর জামাই তো তোকে উঠতে বসতে পে’টাবে। বিয়েতে তোর বাপ দেবে ভাঙা খাট, ভাঙা আলমারি, সস্তা জিনিসপত্র। এর জন্য তোকে শশুর বাড়িতে উঠতে বসতে কথা শোনাবে।”

দৃষ্টি চোখ গরম করে তাকায়। দাঁতে দাঁত চেপে বলে,

“ওসব নিয়ে আপনাকে এতো চিন্তা করতে হবে না। আপনার শশুর বাড়িতে তো আপনাকে দরজা থেকেই তাড়িয়ে দেবে। আর আপনি যে রসমালাই খাবেন, সেটা কি বাবা জানত? আপনি কীভাবে ডাক্তার হলেন আমি বুঝি না, একটুও তো স্বাস্থ্য সচেতন নন। আপনার থেকে তূরাগ ভাইয়া বেশ স্বাস্থ্য সচেতন।”

“হ্যাঁ! উচিত কথা বললে তো এখন খাবার খোঁটা দিবি। তোর বাপের..”

“চুপ! একদম চুপ। এক্ষুনি বিছানা থেকে নামবেন। ওয়াশ রুম থেকে ফ্রেশ হবেন। তারপর খেয়ে নেবেন এবং আমাকে উদ্ধার করবেন। যান।”

দৃষ্টির ধমকে আফরান আর কিছু বলল না। বিছানা থেকে নেমে ওয়াশ রুমে ঢুকে পড়ল। এইটুকু মেয়ে তাকে ধমক দেয়! ভাবা যায়? ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে আফরান পুনরায় বিছানায় আসন দখল করে। দৃষ্টি তাকে ইশারায় খেতে বলে। সে নিসংকোচ আবদার করে,

“খাইয়ে দিবি? হাতে খুব ব্যথা করছে।”

দৃষ্টি চোখ ছোট ছোট করে তাকায়। আফরান মুখ গোমড়া করে বলে,

“সত্যি বলছি, হাতে খুব ব্যথা। থাক, আমি নাহয় খাব না।”

দৃষ্টি হাত ধুয়ে এসে প্লেট হাতে তুলে নেয়। ভাত মাখতে মাখতে বলে,

“আপনার ডাক্তার হওয়া উচিত হয়নি। আপনার চিত্রজগতে যাওয়া উচিত ছিল। খুব সহজে চান্স পেয়ে যেতেন। ভালো অভিনয় করতে পারেন।”

আফরান তার কথা গায়ে মাখল না। হা করে পড়ে রইল। বলতে চায়ল,

“তোকে একদম বউয়ের মতো লাগছে রে। ঠিক আমার বউয়ের মতো।”

তবে কথাটা মনের মধ্যেই চেপে রাখল। যদি দৃষ্টি রাগ করে? দৃষ্টির ছোট ছোট হাত থেকে একটু একটু করে খুব তৃপ্তির সাথে খাওয়া শেষ করল। তার মুখ মুছিয়ে দিয়ে দৃষ্টি নিজে হাত ধুয়ে নিল। আফরান হামি তুলে শুয়ে পড়ল। দৃষ্টি চোখ কপালে তুলে বলল,

“একি! শুয়ে পড়ছেন কেন? বাড়িতে যান।”

“তুই তোর বাপের মতোন রুড হয়ে যাচ্ছিস রে দৃষ। এই রাত বিরেতে তো একটা গরু ছাগল কেও বাড়ি থেকে কেউ বের করে দেয় না। আর সেখানে তো আমি জলজ্যান্ত একটা মানুষ। একটু তো দয়া কর।”

“আপনি!”

“প্লিজ দৃষ! মাথাটা প্রচন্ড ধরে আছে। একটু টিপে দে তো।”

মাথা ব্যথার কথা শুনে দৃষ্টি আর কিছু বলল না। নীরবে তার মাথার কাছে বসে আলতো হাতে চুলে আঙুল চালালো। আফরান আরাম পেল খুব। দ্রুত তার চোখে ঘুম নেমে এলো। ঘুমের ঘোরে অস্পষ্ট স্বরে বলল,

“ওই মৃন্ময়ের বাচ্চার থেকে দূরে থাকবি, দৃষ। ও’র নজর ভালো লাগে না আমার। কবে যে আমি ও’র ওপেন হার্ট সার্জারি করে দেব জানি না।”

বাক্যগুলো তার শ্রবণেন্দ্রিয়ে প্রবেশ করতেই সে ঠোঁট প্রসারিত করে। চোখ থেকে চশমা খুলে পাশে রাখে। ঘুমন্ত মুখের দিকে নিষ্পলক চেয়ে ফিসফিসিয়ে বলে,

“এতো পা’গল কেন আপনি?”

আজ সকালে আর খাওয়ার সময় পেল না দৃষ্টি। বাবাদের সাথে থাকতেও পারেনি। রাতে দীর্ঘক্ষণ আফরান কে পর্যবেক্ষণ করার ফল এটা। ঘুমিয়ে পড়েছিল কখন সে জানে না। আবার ঘুম ভেঙেছেও দেরিতে। উঠে আফরানকে আশে পাশে দেখতে পায়নি। তারমানে লোকটা সকাল সকাল চলে গিয়েছে। আবার পাইপ বেয়ে নেমে গিয়েছে ভাবতেই সূক্ষ্ম শ্বাস ফেলে সে।

কলেজে দৌড়ে প্রবেশ করল দৃষ্টি। ক্লাস ইতোমধ্যে শুরু হয়ে গিয়েছে। ক্লাসের সম্মুখে দাঁড়িয়ে বুক ভরে শ্বাস নিল। অতঃপর ঢোক গিলে বলল,

“মে আই কাম ইন, স্যার?”

“ইউ আর ফাইভ মিনিটস্ লেইট, মিস দৃষ্টি।”

দৃষ্টি চোখ তুলে তাকায়। আজ যে প্রথম ক্লাসটা আফরানের সেটা তার খেয়ালে নেই। দৃষ্টি বিড়বিড় করে বলে,

“আপনার জন্যই তো আমার দেরি হলো।”

“মিস দৃষ্টি! কাম ইন।”

দৃষ্টি ভেতরে প্রবেশ করে। তবে আসন গ্রহণ করতে পারে না। আফরান জিজ্ঞেস করে,

“হোয়াই আর ইউ লেইট?”

দৃষ্টি আমতা আমতা করে বলে,

“না মানে স্যার, আজ ঘুম থেকে উঠতে একটু দেরি হয়ে গিয়েছে। তাই..”

আফরান অবাক হওয়ার ভান করে বলে,

“সেকি! আপনার কি রাতে ঘুম হয়নি? এমনটা তো নয়? যে রাতে কেউ আপনার রুমে ঢুকেছিল এবং ঘুমিয়েও পড়েছিল। আর আপনি তার দিকে তাকিয়ে থাকতে যেয়ে ঘুমানোর কথা ভুলে গিয়েছিলেন?”

ক্লাসের সবাই হা করে তাকিয়ে থাকে। দৃষ্টি দাঁতে দাঁত চাপে। ইচ্ছে করছে এই লোকের লম্বা নাকে দুটো ঘা দিতে। সে দাঁত কিড়মিড় করে বলে,

“না, স্যার। এমনিই আজ দেরি হয়েছে।”

আফরান কিঞ্চিৎ ঠোঁট বাঁকায়। বলে,

“ডোন্ট মাইন্ড মিস দৃষ্টি। আ’ম জাস্ট জোকিং। সিট ডাউন প্লিজ। অ্যান্ড এটেনশান এভরিওয়ান।”

দৃষ্টি ধপ করে বসে পড়ে। আফরান ক্লাসে মনোযোগ দেয়। প্রভাষক হিসেবে খুব ভালো পড়ায় আফরান, সকলে তার ক্লাসে উপস্থিত থাকতে পছন্দ করে।
ক্লাসের টাইম শেষে আফরান কোনো দিকে না তাকিয়েই বই নিয়ে বেরিয়ে গেল। পায়েল এসে বসল দৃষ্টির পাশে। তাকে মৃদু ধাক্কা দিয়ে বলল,

“আজ দেরি হলো কেন রে?”

দৃষ্টি রেগে গেল। চেঁচিয়ে বলল,

“বললাম তো ঘুম থেকে উঠতে দেরি হয়েছে। যখন বলছিলাম তখন তুই কোথায় ছিলি? ঘুমোচ্ছিলি?”

পায়েল মুখ কালো করে বলে,

“রাগ করছিস কেন ইয়ার? খেয়ে আসিস নি মনে হয় সকালে। আমিও খাইনি, চল ক্যানটিনে যাই।”

দৃষ্টি নিজেকে শান্ত করে। ঠান্ডা কন্ঠে বলে,

“ক্লাস শেষে যাব।”

আজ মৃন্ময় আবার দৃষ্টিকে আটকাল। তবে পার্থক্য হলো আজ সাথে পায়েল আছে, গতকাল ছিল না। তারা তাকে সালাম দিল। মৃন্ময় বলল,

“দৃষ্টি চলো লাইব্রেরীতে যাই, কিছু বাকি ছিল তো গতকালের।”

দৃষ্টির সামনে আফরানের গতকাল রাতের কর্মকাণ্ড ভাসল। আজ মৃন্ময়ের সাথে গেলে আফরান আবার আসবে একদম শিওর। সে ধীর কন্ঠে বলল,

“আসলে স্যার আজ একটু তাড়াতাড়ি বাড়িতে যেতে হবে।”

মৃন্ময় উদ্বিগ্ন কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,

“কেন? কোনো সমস্যা? শরীর ঠিক আছে?”

দৃষ্টি দাঁত চেপে মনে মনে বলে, “ভালো নেই আমার কিচ্ছু ভালো নেই। ওই লু’চু ডাক্তার আমাকে পাগল করে দেবে।” মুখে বলে,

“কোনো সমস্যা নেই, স্যার। আর আমার শরীরও ঠিক আছে। পায়েলকে মা আজ নিয়ে যেতে বলেছে, তাই।”

ডাহা মিথ্যা কথা শুনে পায়েলের চোখ কপালে উঠল।

“স্যরি স্যার। আমি নাহয় অন্য কোনো দিন ওগুলো নোট করে নেব। আপনাকে এতো কাজ ফেলে অযথা সময় নষ্ট করতে হবে না।”

“আরে না না। সময় নষ্ট কেন? স্টুডেন্ট দের সাহায্য করা তো আমার কর্তব্য। বিশেষ করে তোমার।”

শেষের কথা সে মুখে ফোটাল না। দৃষ্টি কৃতজ্ঞতার সুরে বলে,

“থ্যাঙ্ক ইউ, স্যার। আমার অনেক উপকার হলো। আসি।”

পায়েল কে টেনে হিচড়ে বেরিয়ে গেল সে। বাইরে আসতেই পায়েল এতোক্ষণ চেপে রাখা কথা বের করল,

“আন্টি যে আমাকে যেতে বলেছেন আগে বলিসনি তো? তাছাড়া সেদিনই তো ঘুরে এলাম, আজ আবার বলবে কেন?”

আফরানের অত্যাচারের ভয়ে সে যে এমনটা করতে বাধ্য হয়েছে তা সে বলতে পারবে না। কল্পনায় সে আফরানের গলা চেপে ধরল। এই লু’চু ডাক্তারের জন্য তাকে পদে পদে মিথ্যে বলতে হয়। সে হাঁটা ধরে বলল,

“ভুল করে বলে ফেলেছি স্যারের সামনে। রাতে ঘুম হয়নি মাথা ঠিক নেই। যা, বাড়িতে যা। আগামীকাল কথা হবে।”

চলবে,

#সে_আমারই
#মোহনা_মিম
#পর্বঃ১৩

পায়েলের চাচাতো ভাইয়ের কু’নজর যে বহুত আগে থেকেই তার উপর পড়েছে সেটা পায়েল জানে। এজন্য খুব সাবধানে চলাচল করে সবসময়। একটু সুযোগ পেলেই হাত ছাড়া করবে না নরপি’শাচ টা। তার গায়ে কল’ঙ্ক লেপ্টে তবেই থামবে। পায়েল সব সময় গায়ে ওড়না পেঁচিয়ে চলাফেরা করে, মাথা থেকেও নামায় না বাড়ির মধ্যে হোক বা বাইরে। বাড়ি ভর্তি লোক জনের মধ্যে হয়তো কিছু করার সুযোগ পায় না নরপি’শাচ টা। তবে আজ?
আজ পায়েলের দুই চাচা, দুই চাচি এবং তাদের ছেলে মেয়েরা মিলে বাইরে গিয়েছে কোনো আত্মীয়ের বাড়িতে বেড়াতে। তারা পায়েল কে নিজেদের পরিবারের মধ্যে গন্য করে না, তাই তাকে নিয়ে যাবার কোনো প্রশ্নই ওঠে না। পায়েল কে একা ফেলে তারা চলে গেল। তবে এই সুযোগ কীভাবে হাত ছাড়া করত চাচাতো ভাই সোহেল? সে বাহানা দিয়ে মাঝ পথ থেকেই বাড়িতে ফিরেছে। তখন থেকেই পায়েল দরজা বন্ধ করে বসে আছে। যতই ঝড় উঠুক তুফান আসুক সে দরজা খুলবে না। দরকার পড়লে না খেয়ে এর মধ্যেই ম’রবে। সে বই খুলে একটু পড়ার চেষ্টা করল। তার মধ্যেই দরজায় আঘাত হলো,

“পায়েল! কি করছিস দরজা বন্ধ করে? বাইরে আয় একটু গল্প গুজব করি। মা বাড়িতে থাকলে তো তোর সাথে একটু ভালো করে কথাও বলতে পারি না। আয়, বাইরে আয়।”

পায়েল শক্ত হয়ে বসে রইল। এমন মিষ্টি আচরণের পেছনে আছে ভয়’ঙ্কর নোংরা রূপ। সে জবাব দিল না। সোহেল আবার বলল,

“ঠিক আছে। তোকে বাইরে আসতে হবে না। আমি বরং বাইরে থেকে চা টা খেয়ে আসি।”

তার আওয়াজ আর পাওয়া গেল না। বেশ কিছুক্ষণ ধরে পাওয়া গেল না। পায়েল ভাবল সত্যিই চলে গিয়েছে কি? নাহ! তাও সে বের হবে না, এবাড়ির কাউকে সে বিশ্বাস করে না। ছোট বেলা থেকে সে চেনে এদের।
ঘড়ির কাঁটা দুপুর দুইটা ছুঁয়েছে। পেটে প্রচণ্ড ক্ষুধা অনুভব করল সে। কোনো দিন সকালেই খাওয়া হয় না তার। আজ সকালেও হয়নি, তার উপর কাল রাতে এক কথায় দু কথায় তার গায়ে হাত তুলেছিল বড় চাচী। রাতেও খেতে দেয়নি। কলেজ গেলে ক্যান্টিনে কিছু খেয়ে নেওয়া যেত, কিন্তু আজ এদের বেড়াতে যাবার জন্য যেতে পারল না।

সে-ই জানে কি কষ্ট করে এই প্রর্যন্ত এসেছে। ছোট চাচা দু এক সময় আড়ালে আবডালে তার হাতে টাকা দেয়। আবার তাকে সাহায্যও করে। তবে সম্মুখে কিছু করার সাহস তার নেই। মেডিকেলে চান্স না পেলে হয়তো তাকে কবেই কোনো বয়স্ক বড়লোক দেখে বিয়ে দিয়ে দিত। কপালের জোরে সে রক্ষা পেয়েছে এবং বাবা মায়ের স্বপ্ন পূরণ করার একটা সুযোগ পেয়েছে। সূক্ষ্ম শ্বাস ফেলল সে। এখন কিছু না খেলেই নয়, পড়াতেও মন বসবে না। ওড়নাটা ভালো করে গায়ে মাথায় পেঁচিয়ে সে রুম থেকে বের হলো। সকালের কিছু খাবার হয়তো থাকলেও থাকতে পারে। রান্না ঘরে প্রবেশ করল সেই আশায়। হঠাৎ পেছন থেকে কন্ঠস্বর এলো,

“অবশেষে বের হলি তাহলে? চল আজ আমরা খুব আড্ডা দেব।”

ভয়ে জমে গেল পায়েল। দুরু দুরু কেঁপে উঠল বুক। দৃষ্টি নিচে রেখে বলল,

“আজ অনেক পড়া আছে ভাইয়া। আমি রুমে যাই।”

সোহেল তার পথ রোধ করে। খপ করে চেপে ধরে হাত। বলে,

“চল আমার সাথে। একা একা ঘরে থাকতে কি ভালো লাগে? আমার সাথে থাকবি চল।”

পায়েল হাত মোচড়ায় অনুরোধের কন্ঠে বলে,

“আমাকে ছেড়ে দিন ভাইয়া। আমি আপনার বোন হই। আমি অন্য মেয়েদের মতো না।”

সোহেল আসল রূপে ফিরে এলো। কুটিল হেসে বলল,

“আজ সুযোগ পেয়েছি কীভাবে হাত ছাড়া করি বল? তাছাড়া সব মেয়েই আমার কাছে এক রকম। আর তুই খুব এনজয় করবি, সত্যি বলছি।”

পায়েলের গা গুলিয়ে উঠল। ঘৃণ্য দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলল,

“ছিঃ! যে নিজের বোনকে ওই নোং’রা চোখে দ্যাখে সে কোনো পুরুষের জাতের মধ্যে পড়ে না। থু!”

পায়েল থু থু ছেটায় তার মুখে। প্রচন্ড রেগে যায় সোহেল। এক হাতে মুখ মুছে দাঁতে দাঁত ঘর্ষণ করে বলে,

“আমি পুরুষ জাতের মধ্যে পড়ি কি পড়ি না আজ দ্যাখাব তোকে। তোর সব তেজ যদি ভেঙে গুঁড়িয়ে না দিয়েছি তো আমার নামও সোহেল না। এতো দিন পিছু পিছু ঘুরতাম বলে খুব দেমাগ বেড়েছে না তোর? আজ সব শেষ করব।”

তার হাত ধরে টেনে নিয়ে চলে। পায়েল চেঁচায়। হাত ছাড়িয়ে নিয়ে আপ্রাণ চেষ্টা করে। বারংবার কাতর স্বরে বলে,

“ছেড়ে দিন আমাকে। ছেড়ে দিন।”

সোহেল যেন ভয়’ঙ্কর জ’ন্তু তার কানে কিছুই যায় না। বিরক্ত করার ফলে পরপর দু ঘা বসিয়ে দেয় তার গালে। পায়েলের মাথা ঝিমঝিম করে। সে উপায়ান্তর না পেয়ে সর্বশক্তি দিয়ে কামড় বসায় তার হাতে। আর্তনাদ করে পায়েল কে ছেড়ে দেয় সোহেল। ছাড়া পেয়ে পায়েল সদর দরজার দিকে ছোটে। বাড়ির মধ্যে তাকে বাঁচানোর কেউ নেই। সোহেল ছোটে তার পেছনে। শেষ মুহূর্তে পায়েলের কাঁধের ওড়না চেপে ধরে। টান দিতেই তা হাতে চলে আসে। বাধ্য হয়ে পায়েল ওড়না ছাড়াই বের হয় পথে।

ভর দুপুরে রাস্তা ফাঁকা। দুই একটা গাড়ি চলছে মাঝে মাঝে। উদ্ভ্রান্তের মতো দৌড়ায় পায়েল। একটাই উদ্দেশ্য ইজ্জত বাঁচানো, সম্মান বাঁচানো। সে তো চায়লে ম’রতে পারত, তবে সে ম’রলে বাবা মায়ের স্বপ্ন পূরণ করবে কে? বুকটা হু হু করে ওঠে তার। বাবা মা কেন তাকে স্বার্থপরের মতো ফেলে গেল তাদের স্বপ্ন পূরণের জন্য? কেন তাদের সাথে নিয়ে গেল না? সে যে মাঝ রাস্তা দিয়ে দৌড়াচ্ছে এটা খেয়াল নেই তার। হঠাৎ হাতে টান অনুভব করে কারো বুকে আছড়ে পড়ল। মুহূর্তেই পাশ থেকে শা করে চলে গেল একটি বাস।

পায়েল শ্বাস নেয় বড় বড়। চেনে না জানে না লোকটির গায়ের সাথে মিশে দাঁড়ায়। তবে তার গায়ের গন্ধটা পরিচিত ঠেকল। চোখ বন্ধ অবস্থায় লম্বা শ্বাস নিয়ে চিনে ফেলল তাকে। দুহাত বাড়িয়ে কোমরের কাছের টিশার্ট শক্ত করে খামচে ধরল। নিজেকে যেন খুব নিরাপদ মনে হলো। তাকে সরিয়ে দিতে উদ্যত হলেই সে দুর্বল কন্ঠে বলল,

“আ আমার গায়ে ও ওড়না নেই।”

পরক্ষণেই ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। সে কান্নার কোনো শব্দ নেই। ক্ষণে ক্ষণে কেঁপে উঠছে দেহ। ভিজে যাচ্ছে লোকটির টি শার্টের বুকের অংশ। লোকটি তাকে আর সরানোর চেষ্টা করল না। না করল কোনো প্রকার শব্দ। ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইল। পায়েল কে সময় দিল শান্ত হবার। পায়েল শান্ত হলো। ফারদিন তাকে একটু সরিয়ে টিশার্টের উপরে থাকা শার্ট খুলে তার গায়ে মেলে দিল। কোনো কিছু জিজ্ঞেস না করেই বলল,

“চলো তোমাকে বাড়িতে এগিয়ে দিয়ে আসি।”

পায়েল চুপসে গেল। ভেজা কন্ঠে মিনমিন করে বলল,

“আমি, আমি যাব না।”

ফারদিন নিজের শক্ত হাতের মুঠোয় পুরে নেয় তার কোমল হাত। সব থেকে ভরসা যোগ্য বাণী ছোড়ে,

“আমি আছি তো। কিচ্ছু হবে না।”

তারা এগোয়। ফারদিন জানে না পায়েলের সাথে ঠিক কি হয়েছে? তবে এটা বুঝেছে কোনো কিছু নিয়ে ভয়ে আছে খুব। আর এলোমেলো অবস্থা দেখেই ঠাওর করতে পারছে কিছু। সে তো এদিকে এসেছিল এক বন্ধুর বাড়িতে। বন্ধুর বাড়ি থেকে বেরিয়ে টং এর দোকানে সিগারেটের সুখ টান দিচ্ছিল। তখনই দৃষ্টিতে আটকাল পায়েলের উন্মাদের ন্যায় মাঝ রাস্তা দিয়ে ছোটা। সঠিক সময়ে সে হাজির না হলে নির্ঘাত মেয়েটিকে আজ পি’ষে দিয়ে যেত।

পায়েল দের বাড়ির সামনে এসে থামল তারা। দরজাটা হাট করে খোলা যেমনটা সে রেখে গিয়েছিল। তবে কি সোহেল নেই? রাস্তার লোক জনের ভয়ে পালিয়েছে? ফারদিন তার হাত মুক্ত করে দিল। পায়েল মুখ উঁচু করে তাকাতেই গম্ভীর কণ্ঠে বলল,

“আমি তোমার কাছে কিছু জিজ্ঞেস করব না। যদি কখনও নিজ থেকে বলতে চাও তবেই শুনব। যাও, সাবধানে থেকো। গালে, ঠোঁটে মলম লাগিয়ে নিও।”

“আপনি..”

ফারদিন বুঝে ফেলল। বলল,

“না, আজ তোমাদের বাড়িতে আর যাব না। অন্য কোনো দিন আসব। হয়তো তুমি ডাকলেও আসব আর না ডাকলেও।”

সে চলে গেল। পায়েল তাকে যতক্ষণ দেখা যায় তাকিয়ে রইল। অতঃপর ধীর পা ফেলে রুমে গেল। দরজা বন্ধ করে ধপ করে বিছানায় বসে পড়ল। গায়ে জড়ানো শার্টটার দিকে চেয়ে রইল নিষ্পলক। আজ ফারদিন না থাকলে কি হতো তার?

চলবে,

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে