সেদিনও ছিলে তুমি পর্ব-১২

0
2299

#সেদিনও_ছিলে_তুমি❤
#লেখনীতে-ইশরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-১২

৩১.
পা’টা রেলিঙের বাইরে দিতেই আমার মনে হলো, শুধু শুধু এতবড় ঝুঁকি নিয়ে কোনো লাভ আছে? নিজের জীবনটা কি আমার এতোই সস্তা যে সুসাইডের ঝুঁকি নেবো? মরে গেলে তো আর কোনোদিনই আদ্র’কে দেখতে পাবোনা। এতো মানুষের ভালোবাসা রেখে আমি শুধু শুধু কেন মরবো?
তারপর ডিসিশন চেঞ্জ করে যে-ই না রেলিঙ থেকে নামতে যাবো অমনি আমার হাত-পা থরথর করে কাঁপতে লাগলো। নিচে তাকাতেই কলিজা পর্যন্ত কেঁপে উঠলো। ভয়ে হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসতে লাগলো, তখন মাগরিবের আযান হচ্ছে মসজিদে। একটা রডের কোণা ধরে কোনোমতে নেমে এলাম রেলিঙ থেকে। আটকে রাখা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে হাত-পা ছড়িয়ে বসে পড়লাম ছাদের ফ্লোরে। ভাবলাম, সিনেমাতে যদি এমন সিচুয়েশন ক্রিয়েট হতো তাহলে হিরো যদি সুদূর অস্ট্রেলিয়াতেও থাকতো, তাহলে সুপার পাওয়ার নিয়ে কয়েক সেকেন্ডের মাঝে এসে পড়তো। কিন্তু আফসোস, জীবন সিনেমা নয়।

কিন্তু ‘আদ্র টাকে তো একটু শিক্ষা দিতেই হবে। কি করবো? ওনিতো নিশ্চয়ই আমার হুমকি শুনে আসবেনই। যতইহোক বউ বলে কথা। আমি নিচে নেমে এলাম। তারপর মায়ের সাথে কথাবার্তা বলে ব্যাগপত্র গুছিয়ে বেরিয়ে এলাম বাসা থেকে। পেছনে রেখে এলাম আমার ছোট্ট সংসারের প্রিয় মানুষগুলোদের। চোখ দিয়ে পানি গড়াচ্ছে, খুব কষ্ট হচ্ছে।

অন্ধকার পথঘাটে নিয়ন বাতি কেমন গুমোট আলো ছড়াচ্ছিলো। আমার গন্তব্য কোথায়, জানা নেই। ফোন হাতে নিয়ে দেখি সাতটা পাঁচ। আদ্র সাহেব নিশ্চয়ই বাসায় এসে পৌঁছেছেন।আমাকে না পেয়ে ওনার রিয়েকশন ঠিক কেমন হচ্ছে তা আমার অজানা।

৩২.
হাতমুখ ধুয়ে এসে বসলাম বিছানায়। শেফা গ্লাসে করে শরবত নিয়ে এসেছে, খুব ঠান্ডা। খেলেই গলা বসে যাবে এমন একটা অবস্থা। আমি খুব ক্লান্ত, খেয়ে নিলাম। শেফা আমার পিঠে হাত রেখে চিন্তিত গলায় বললো, ‘কি হইসে তোর?’

—“কিছুনা।”

—“তাইলে ব্যাগপত্র নিয়ে আসলি যে?”

—“তোর বাসায় বেড়াবো!”

—“তো আদ্র ভাইকে নিয়া আসতি!”

—“চুপ থাক।”

—-“কেন?”

—“আমি বলছি তাই।”

—“তুই বললেই হইলো নাকি? আদ্র ভাই আমার দুলাভাই, সো আমি বলতেই পারি!”

—“তাই নাকি হারামি? ওনি তোর দুলাভাই আর আমি? আমি কি?”

—“তুই আমার বান্ধবী!”

আমি রেগে বললাম, ‘শুধু বান্ধবীই? আচ্ছা। ভালো!”

শেফা বললো, ‘রাগ করস কেন? কি হইসে বল না!”

—“জানিনা। শুধু তোর আদ্র ভাই যদি আমার খোঁজ করে তাহলে বলবি আমি এখানে নাই, ওকে?”

শেফা ভ্রু কুঁচকে বললো, ‘কেন কমু না? ঝগড়া করছোস?’

—“না।”

শেফা আর কিছু জিজ্ঞেস করলো না। আমি বললাম, ‘তোর বাসার সবাই কই?’

—“বাসায় নাই, নারায়ণগঞ্জ গিয়েছে। মামার ছেলের বিয়েতে!”

—“তুই যাস নাই কেন?”

—“বিয়েবাড়ির ঝামেলা ভাল্লাগে না!”

—“ভালো করছোস। তুই চলে গেলে এখন আমাকে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরতে হতো!”

শেফা চুপ। দুলে দুলে ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসে। পরক্ষণেই ডাইনিংয়ে রাতের খাবার রেডি করে। আমি কিছুক্ষণ টিভি দেখলাম, সিরিয়াল চলছে। যেটা আমার দু’চোখের বালি। চ্যানেল ঘুরাতে ঘুরাতে একটা রোমান্টিক গানে এসে আটকে গেলো। হাই সাউন্ডে গান বাজছে, অতি আবেগী রোমান্টিক গান। রিমোট কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে, সেখানে আটকে রইলো। আমি আর উপায় না পেয়ে এটাই শুনতে লাগলাম, যা সিন চলছে সেটা দেখার জন্য আমার চোখ প্রস্তত নয়। হঠাৎ শেফা এসে বললো, ‘ছিহ,,,আরশি তুই এসব কি অশ্লীল গান দেখছিস? বন্ধ কর।’

আমার কাছে গানটা খুব পছন্দ হচ্ছিলো, আমি ওকে ধমক দিয়ে বললাম, ‘চুপ কর। নিজে বুঝি খুব ভালো গান দেখো? এতোই যখন ছিহ ছিহ করছিস তো মোবাইলে এসব রাখিস কেন? রবীন্দ্রনাথ, নজরুলের গান রাখতে পারোস না? সারাদিন মা-মাটির গান শুনবি। তা-না, এখানে এসে নাক সিঁটকাচ্ছিস। যত্তসব!’

শেফা মুখ কালো করে দরজায় দাঁড়িয়ে রইলো। আমাকে বললো, ‘খেতে আয়!’

—“ক’টা বাজে?”

—“এগারোটা!”

—“ওহহহ, তোরা কয়টায় খাস?”

—“সাড়ে ন’টা।”

আমি গম্ভীর গলায় বললাম, ‘আমি আসাতে বোধহয় তোর প্রবলেম হচ্ছে, তাই না রে? তোর বাসার সবাই থাকলে আরও বিরক্ত হতো। ভাগ্যিস নেই!’

শেফা রেগে বললো, ‘মোটেও না। তুই যদি সবসময় আমাদের বাসায় থাকিস তাও আমার বাসার কেউ বিরক্ত হবেনা। আম্মু আব্বু তো তোকে বলছিলোই আমাদের বাসায় থাকতে, তুই-ই তো থাকোস নাই। আর আমি? তুই যদি আমাকে মেরেও ফেলিস তাহলেও আমি বিরক্ত হমু না। বিকজ,, তুই আমার জান।’

আমি হেসে বললাম, ‘হইসে থাম। ডায়লগবাজি শিখে গেছিস দেখছি!’

শেফাও হাসে। আমাকে চোখ মেরে বলে, ‘আদ্র ভাই তোর সাথে এগুলো করে না?’

আমি অবাক হয়ে বললাম, ‘এগুলো মানে?’

—“আরে টিভিতে যা দেখছিলি এতোক্ষণ!”

আমি যখন বুঝতে পারলাম শেফা কি মিন করছে তখন ওর দিকে চোখ পাকিয়ে তাকালাম। রাগী গলায় বললাম, ‘এতো পেকে গেছিস তুই? অশ্লীল মাইয়া!’

—“বল না, বল না।”

—“কি?”

—“এই যে, আদ্র ভাই তোর সাথে এসব করছে কিনা?”

—“তুই যাবি ছাগল? কিসব ভাবনা। আর আদ্র আর আমি, এসব? ছিহ।”

শেফা যেন আশাহত হলো। আমাকে বললো, ‘হইসে তুমি যে নিরামিষ আমি জানি। এখন খাইতে আসো!’

আমি ওঠে গেলাম শেফার পিছু পিছু। ডাইনিংয়ে গিয়ে দেখি শেফা ভাত, ডাল, মাংস সাজিয়ে রেখেছে। আমি আর শেফা একসাথে খেতে বসলাম, বাসায় কেউ না থাকায় আমি একটু স্বস্তি পেলাম। সবাই থাকলে না জানি কিসব ভাবতো, যদিও শেফার বাসার সবাই মোটেও এমন নয়। খুবই ভালো আর মিশুক।

৩৩.
ঘুমাতে ঘুমাতে রাত প্রায় বারোটা বেজে গেলো। সারাক্ষণই আদ্র সাহেবের কথা মনে পড়ছে! আমি কিছুক্ষণ ওনার কথা ভাবলাম। আমাকে বাসায় না পেয়ে ওনি কি করবেন? খুঁজবেন আমায়? নিশ্চয়ই খুঁজবে, খুঁজতে খুঁজতে যদি এখানে চলে আসে তাহলে? আসলে আসুক, না আসলে নাই। চারদিন পালিয়ে পালিয়ে রয়েছে, আমিও না হয় পালিয়ে থাকি ক’টা দিন।

আমি আছি শেফাদের গেস্টরুমে। শেফা ওর রুমে। দুজন আলাদা শুয়েছি। গভীর ঘুমে মগ্ন হলাম একসময়। সুখস্বপ্ন কখনোই দেখিনি৷ তবে আজ দেখলাম। মোটামুটি ভালোই! স্বপ্নের ৯৫% ভুলে ৫% শুধু মাথায় আছে, বাকিটা ব্রেন রিমুভ করে দিয়েছে। ফজরের আযানের সময় ঘুম ভাঙলো, অনেক আলসে লাগছিলো, তাও নামায পড়ে নিলাম। শেফার ঘরে উঁকি দিয়ে দেখি ও বাচ্চাদের মতো গুটিশুটি মেরে শুয়ে আছে। এতসুন্দর, সুশীলা একটা মেয়ে মাঝেমাঝে এমন সব কান্ড করে যেনো ও দুই বছরের বাচ্চা। আমি ওর চুলগুলোতে হাত বুলিয়ে দিলাম রুমে এসে আবারও শুয়ে পড়লাম। ভেতরে ভেতরে আদ্রে’র উপর রাগ হচ্ছে। ওনি কি আমাকে খুঁজতে আসেননি? আসলে এতোক্ষণে পেয়েই যেতো। ওনি কি তবে আমার সুসাইডের কথা শুনেও বাসায় আসেননি? ওনি কি তাহলে আমাকে আর পছন্দ করেন না? আমার বাসা থেকে বেরিয়ে আসাটা কি তবে বৃথা হয়ে গেলো? এগুলো ভেবে ভেবে কষ্ট পাচ্ছিলাম। বিছানায় শুয়ে কম্বল গায়ে টানতেই আমি ভয়ে এক চিৎকার দিয়ে উঠলাম। কে যেন ওপাশ থেকে কম্বল জড়িয়ে শুয়ে আছে। আরো একটা চিৎকার দিতেই কে যেন আমার মুখটা চেপে ধরলো। আমাকে টেনে কম্বলের নিচে নিয়ে গেলো, জড়িয়ে ধরে আমার ঠোঁটে ঠোঁট রাখলো!

আমি হতভম্ব, অবাক, কিংকর্তব্যবিমূঢ়! আমার অবচেতন মস্তিষ্ক তখন ভাবছে কে এটা? চোর? নাকি ভূত? আমার তখন মনে হচ্ছে প্যারানরমাল বিভিন্ন কাহিনী! কারণ এসব প্যারানরমাল ঘটনাগুলো বেশিরভাগই হয় খালি বাসায়, গেস্টরুম বা স্টোররুমে। আর শেফাদের এই গেস্টরুমটা বলতে গেলে অলওয়েজ তালাবদ্ধ থাকে, আমি কি তাহলে কোনো জ্বিনের হাতে পড়লাম? ভেবে কূল কিনারা পাচ্ছিনা। ওদিকে কম্বলের নিচে কে যেন আমার পেটের কাছ থেকে জামাটা সরিয়ে ঠান্ডা বরফ-শীতল হাত রাখলো। আমি কেঁপে উঠলাম! একবুক সাহস নিয়ে কম্বল সরিয়ে জিনিসটার দিকে তাকাতেই আমার মাথা ঘুরে গেলো। এ আমি কি দেখছি?

৩৪.
গুমোট অন্ধকারে আবছা আলোয় আমি দেখলাম রক্তবর্ণ চোখ নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে আদ্র! আমি ভয় পেয়ে গেলাম। আমি কিছু বলার আগেই ওনি আমাকে চেপে ধরে চিৎকার করে বললেন, ‘ আমাকে মেরে ফেলতে চাও? তাহলে মেরে ফেলো। আমাকে শাস্তি পেতে দেখলে খুব শান্তি হবে তুমি, তাই না?’

আমি কিছু বলতে নিলেই ওনি আমাকে চুপ করিয়ে দিলেন। বললেন, ‘একদম চুপ। একটা কথা বললে কি করবো, নিজেও জানিনা। আমাকে এভাবে ভয় না দেখালে কি পার‍তে না তুমি? আমি পাগলের মতো ছুটে এসেছি, সারা রাস্তা আমি টেনশনে মরে যাচ্ছিলাম। শুধু মনে হচ্ছিলো, এতোক্ষণে সবকিছু শেষ! আমি আমার মায়াবতীকে হারিয়ে ফেলেছি! জানো তুমি? আমার নিঃশ্বাস আটকে আসছিলো, বাসায় আসার পর দেখি তুমি নেই। পুরো বাড়ি খুঁজেও তোমাকে যখন পেলাম না তখন আমি ভেবেছি আমাকে ছেড়ে বুঝি চলে গিয়েছো! কেন এমন করলে তুমি? কেন? কেন আরশি?

ওনি আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছেন। ওনার পাঞ্জাবি ভিজে গিয়েছে ওনার চোখের পানিতে! ওনার শরীর থেকে আসছিলো সুন্দর একটা ঘ্রাণ, ফুলের সুঘ্রাণ! এটা কি আতরের সুগন্ধ? আমি ওনার পিঠে হাত রাখলাম। সত্যিই ওনি আমাকে কতটা ভালোবাসেন! এতো ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্য কি আমি? এর দাম আমি দিতে পারবো কখনো? আচ্ছা, ভালোবাসার কি দাম হয় কখনো? ভালোবাসা কি কেনা যায়?

👉”রাসুল সাঃ বলেছেন,
যে আমাকে স্বপ্ন দেখে সে প্রকৃতই দেখে। কারণ শয়তান আমার আকৃতি ধারণ করতে পারে না।”

~ সহীহ্ বোখারীঃ৬৯৯৭

চলবে….ইনশাআল্লাহ!
ত্রুটি মাফ করবেন দয়া করে!

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে