সেদিনও ছিলে তুমি পর্ব-০২

0
3516

#সেদিনও_ছিলে_তুমি❤
#লেখনীতে-ইশরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-২

৩.
রাতেরবেলা ঘুমের মধ্যে টের পেলাম কে যেন আমার গাল ছুঁয়ে দিচ্ছে, আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি ভয়ে সিঁটিয়ে রইলাম। চোখটা খোলার সাহসটাও হলো না। গভীর ঘুমে একসময় তলিয়ে গেলাম।

পরদিন খুব ভোরে মোবাইল ফোনের বিরক্তিকর শব্দে আমার ঘুম ভাঙলো। ঘুমঘুম চোখে হাতের কাছে থাকা ফোনটা রিসিভ করে কানে লাগাতেই ওপাশ থেকে একটা ছেলের গলা শুনতে পেলাম। ছেলেটার গলার স্বর খুব পরিষ্কার। আমাকেত উদ্দেশ্য করে বলছে, ‘তুমি ঘুমিয়ে থাকলে এতো মায়াবী লাগে কেন? আর বেশিক্ষণ ঘুমিও না, নইলে হার্টের পেশেন্ট হয়ে বিয়ের আগেই মরে যাবো!’

এটুকু বলেই খট করে ফোনটা কেটে দিলো। ততক্ষণে আমি বিছানায় ওঠে বসেছি। আমি কিছু বলার সুযোগটাই পেলাম না অজানা ব্যক্তিটাকে। কাল রাতের ঘটনাটা মনে পড়তেই আমার সন্দেহ হলো, তাহলে কি কাল রাতে সত্যিই কেউ আমার কাছে এসেছিলো বা ফোনের লোকটা কি রাতের লোকটাই? হোস্টেলে আমি আর শেফা থাকি একটা রুমে, কিন্তু শেফা তো ওর বাসায় গিয়েছে। আর আমি কাল দরজা-জানালা বন্ধ করে একা ঘরেই ঘুমিয়েছি, তাহলে? রাতেরবেলা কে আসবে এখানে? শেফার কোনো প্রেমিক? হয়তো, আমাকে শেফা মনে করে এসব করছে! ভাবতেই বারান্দার দিকে চোখ পড়লো, বারান্দার দরজাটা খোলা। সেখান দিয়ে খুব বেশি কঠিন নয় কোনো ছেলের পক্ষে আসা-যাওয়া করাটা। দোতলা টপকিয়ে আসাটা খুবই সহজ! তাহলে কি বারান্দা দিয়েই রাতে কেউ এসেছিলো?

৪.
বাসের জানালা দিয়ে মৃদুমন্দ বাতাস বইছে। বাইরের কোলাহল সবকিছু কেমন অদ্ভুত দপদপানিতে পরিণত হচ্ছে, খারাপ লাগছেনা শব্দটা। নেশা নেশা ভাব। ভার্সিটিতে যাচ্ছি আমি, শেফার বাসা থেকে ঘুরে এসেছি। ওকে জিজ্ঞেস করতে গিয়েছিলাম ওর এমন কোনো ছেলেবন্ধু আছে কিনা যে এমন করতে পারে, কিন্তু না। আমাকে পরিষ্কার জানালো ওর কোনোকালেই কোনো ছেলেবন্ধু ছিলো না, আর না কোনো গোপন প্রেমিক! আর এসব শুনে বেচারি ভয়েই আধমরা।

তবে কি আমারই কোনো প্রেমিক? কিন্তু কিভাবে? আমাকে কোনো ছেলে কখনো এমন প্রপোজাল বা ইঙ্গিত দেয়নি যে আমাকে ভালোবাসে। আর ভার্সিটিতে কালকে যেটা হয়েছিলো সেটা নিশ্চয়ই ওই গুন্ডাটাইপ ছেলেটা এমনিই করেছিলো, সিরিয়াস নয়। ইশ, আমার টেনশনে মাথা ফেটে যাচ্ছে। ছোটবেলা থেকেই প্রত্যেক মানুষের কিছু আশা থাকে, চাওয়া-পাওয়া থাকে। এই চাওয়া থেকে আমাদের মনে প্রবল ইচ্ছে জাগে। সময়ের সাথে নিজের ভবিষ্যতের কথা ভেবে কিছু আশা, চাওয়াকে জলাঞ্জলি দিয়ে কেউ টাকার জন্য, কেউ উচ্চশিক্ষার জন্য ইচ্ছেটাকে মেরে ফেলে। এগুতে হয় ভবিষ্যৎ সুন্দর করার জন্য। সেজন্য প্রেমটেমের বিষয়ে আমি সর্বদাই উদাসীন, এসব ভাবার সময় আমার নেই। তবে আমার সাথে যেসব অদ্ভুত কান্ড ঘটলো তার রহস্যটা তো আমাকে জানতেই হবে!

৫.
ভার্সিটি ঢুকতেই দেখলাম সবাই-ই আমার দিকে তাকিয়ে আছে। কালকের ভাইরাল ভিডিওর জন্য নিশ্চয়ই। কিন্তু এভাবে অট্টহাসি হাসতে হাসতে লুটোপুটি খাচ্ছে কেন? আমি করিডোর ধরে ক্লাসের দিকে যেতে লাগলাম। সামনে পড়লো কালকের সেই ছেলেমেয়েদের ক্রাশ আইকন আদ্র। আমাকে পা থেকে মাথা পর্যন্ত একবার দেখে ওনিও হাসতে লাগলেন। আমার পিত্তি জ্বলে যাচ্ছে। ওনি হাসতে হাসতে সাথে থাকা সেকেন্ড ইয়ারের একটা ছেলেকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আজকাল কি ভার্সিটিটা জোকারে ভরে গিয়েছে নাকি নাঈম? দেখ তো, আমাদের সামনে কোনো মেয়ে জোকার দাঁড়িয়ে আছে নাকি?’

ওনার এ কথাটা আমার সহ্যের সীমা অতিক্রম করলো। সাথে সাথে আমি ঠাস করে ওনাকে একটা চড় মেরে বসলাম। এমনিতেই আছি এক ঝামেলায়, তার ওপর সবাই আমাকে দেখে হাসছে আর ওনি সরাসরি আমাকে জোকার বলে অপমান করলেন। আমি রেগে বললাম, ‘আপনারা বড়লোকেরা শুধু মানুষদের অপমানই করতে জানেন, তবে আমাকে এতো অবলা ভাববেন না। থাপ্পড়ের কথাটা মাথায় রাখবেন। যখন থেকে আপনার সাথে দেখা, তখন থেকেই আমার সাথে সব খারাপ ঘটনা ঘটছে। আপনি আর আমার সামনে আসবেন না।’

ওনি অবাক হয়ে রক্তচক্ষু নিয়ে আমার দিকে তাকালেন। চড় খেয়ে ওনার গাল লাল হয়ে গিয়েছে। হয়তো ওনি ভাবতে পারছে না কাল স্যার বলে ডাকা মেয়েটা আজ সরাসরি ওনাকে থাপ্পড় মেরে বসলো। আশেপাশে কেউ না থাকায় এ ঘটনা কারো দৃষ্টিগোচর হলো না। ওনাকে একপ্রকার এভয়েড করে আমি সামনে পা বাড়ালাম, ক্লাসে ঢুকতেই আরও একবার সবার হাসিরপাত্রী হলাম। একটা মেয়ে এসে আমাকে বললো, ‘তুমি দুই পায়ে দুই জুতো পড়ে এসেছো কেন? আবার জামার রং লাল, পাজামা কালো, ওড়না নীল কেন?’

আমি নিজের দিকে তাকিয়ে দেখি আসলেই তাই। এবার আমার নিজেকে দেখে নিজেরই রাগ হচ্ছে, সত্যিই নিজেকে জোকার মনে হচ্ছে। নিজে জোকার সেজে এসেছি তো সবাই জোকার বলবেই! তো ওই আদ্রে’র চড়টা কি আমি এমনি এমনিই দিলাম? ইশ, কাজটা ঠিক হয়নি। ভার্সিটির একমাত্র বড় ভাই, তাও সাবেক ভিসির পুত্র সে কিনা আমার মতো নগন্য একটা মেয়ের হাতে থাপ্পড় খেলো! এটা আমি হলে কখনোই মেনে নিতাম না, তাহলে এই ছেলেও নিশ্চয়ই মানবে না। রেগে গিয়ে না আবার আমাকে না আবার এখান থেকে বের করে দেয়।

তার চেয়ে হোস্টেলে ফিরে যাওয়াটাই ভালো এখন। সবার হাসির পাত্রী হয়ে থাকতে পারবোনা। আবার লোকটার সামনে পড়ে গেলে লোকটা না জানি কি করে বসে। এসব সাত-পাঁচ ভেবে শেষমেশ ঠিক করলাম আমি হোস্টেলেই চলে যাই।

সিঁড়ি বেয়ে নামছি, আশেপাশে কেউ নেই। চারতলা থেকে দোতলায় নামতেই কে যেন পেছন থেকে আমাকে জোর করে ধরে দু’চোখ বেঁধে আমাকে একটা ফাঁকা ক্লাসে নিয়ে গেলো।

আমিতো ভয়ে শেষ। আমাকে কি কেউ কিডন্যাপ করবে নাকি? ভাবতেই দরজা বন্ধ করার শব্দ পেলাম। তারপরে বিকট একটা শব্দ পেলাম, কেউ হয়তো লাথি দিয়ে কিছু একটা ভেঙে ফেলেছে। আমার আত্মা উড়ে গেলো। হাত আর চোখ বাঁধা থাকায় সামনের ব্যক্তিটাকে দেখতে পাচ্ছিনা।

আমি ভয়ে ভয়ে বললাম, ‘কে কে আপনি? আমার চোখ বেঁধে রেখেছেন কেন ন ন?’

কেউ এসে আমার চোখের বাঁধন খুলে দিলো। অনেকক্ষণ পরে চোখ খোলা পেয়ে মিটিমিটি করে তাকিয়ে আলোটা চোখে সয়ে নিয়ে সামনে তাকিয়ে দেখলাম আদ্র!

ওনি হুংকার ছেড়ে বলে উঠলো, ‘আমার গায়ে হাত দেয়ার মতো ভুল করেছো তুমি! এবার তুমি দেখবে আমি কে এবং কি কি করতে পারি। জাস্ট ওয়েট এন্ড ওয়াচ।’

আমি নরম গলায় বললাম, ‘আ আমি ক্ক কি করেছি স্যার?’

ওনি তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললো, ‘স্যার? বাহ! কালকে তোমাকে ওয়ার্ন করার পরেও তুমি আজ আমার সাথে রুড বিহেভ করেছো। এখন আবার স্যার বলছো! থাপ্পড় মারার সময় মনে ছিলোনা?’

—“আমি খুব দুঃখিত স্যার!”

—“তোমার দুঃখ তোমার কাছেই রাখো!”

—“আমাকে ছেড়ে দিন ভাই, প্লিজ!”

ওনি আবারও আমার দিকে রেগে তাকালেন। বললেন, ‘শুনো আমাকে ভাই বলবে না। আমি তোমার সিনিয়র বলে কি আমাকে তোমার ভাই বানিয়ে ফেলতে হবে ড্যাম ইট!’

—“ভাই বললে কি সমস্যা? স্যার তো আপনি নন, তাহলে স্যার বলবো কেন?”

আমার একথা যেন আগুনে ঘি ঢালার মতো হলো। ওনি রেগে সামনের বেঞ্চটাতে লাথি মেরে আমার গাল চেপে ধরলেন। আমাকে দেয়ালের সাথে চেপে ধরে বললেন, ‘আর একবার ভাই বললে ডিরেক্ট খুন করে ফেলবো!’

আমি এবার জোরে কেঁদে উঠলাম। প্রচুর ভয় পেলাম। মনে মনে ভাবছি ভার্সিটির ভিসির পুত্র বলে সাধারণ স্টুডেন্টদের সাথে ওনি এমন করবেন? ভার্সিটিটা কি ওনার বাপের নিজস্ব সম্পত্তি? আর আমাকে যেভাবে তুলে এনেছে তাতে বোঝা যাচ্ছে আমি সরকারি সম্পত্তি, আমাকে আটকে রাখা যায়, খুন করার হুমকি দেওয়া যায়। সব করা যায়।

ওনি আমাকে জোরে ধমকে উঠে বললেন, ‘কানে কথা গেলো মিস আরশি? নাকি অন্যকিছু করবো কানে এবং মনে কথা ঢোকানোর জন্য?’

আমি কাঁদতে কাঁদতেই হতভম্ব হয়ে বললাম, ‘অ অ অন্যকিছু ক ক্ক করবেন মা মানে?’

—“এই, একদম ন্যকা কান্না কেঁদে চোখের পানি নষ্ট করবেনা। চোখের পানি বাঁচিয়ে রাখো, কারণ এরপর থেকে আমি তোমার সাথে যা যা করবো তা খুব ভয়ানক হবে, তখন তোমার এই সুন্দর চোখের পানিগুলো কাজে লাগবে মিস আরশি!”

👉”আল্লাহ তা’আলা বলেন–
মুমিন তো সে, যে অহেতুক বিষয় থেকে বিরত থাকে!”

~ সূরা মুমিনূন (২৩) : ৩

চলবে…ইনশাআল্লাহ!

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে