সূর্যস্নান পর্ব-০৩

0
909

#সূর্যস্নান
#পর্ব_৩
#Nishat_Tasnim_Nishi

“সরি, সরি আমি ভেবেছিলাম আম্মু।” আমি কিছু বললাম না, চুপচাপ জামার উপর থেকে কাপড় টা খুলে ওড়না নিয়ে চলে আসলাম। এরপর আন্টি এসে উনাকে বললেন,,”কী হয়েছে?আমি কেনো চলে যাচ্ছি?”উনি কিছু না বলে চলে গেলেন। সেদিন ই এই অস্বাভাবিক ঘটনা ঘটেছে। কিছুক্ষন পর উনি বললেন,,”তুমি বুঝতেছো না কেনো যা বলতেছো তা সম্ভব নয়। আমরা কি কাপল নাকি যে এসব করবো। ” আমি উনার কথায় কান না দিয়ে চুপ করে রইলাম।এরপর উনি ধীরে এসে আমার মাথার কাছে বসলেন,মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে আদুরে গলায় আমাকে অনেক্ষন লেকচার দিলেন। শেষমেষ উনি বললেন,,”তুমি যদি তোমার ফ্যামিলিকে আমাদের বিয়ের জন্য রাজি করাতে পারো তাহলে, আমি নিদ্র কথা দিচ্ছি তুমি যা বলবে আমি তাই করবো।”

আমি চট করে উঠে বললাম,,”সত্যি?”
উনি আমাকে আশ্বাস দিয়ে বললেন,,”হুম..!!” অবশেষে উনাকে প্রমিস করিয়ে দম নিলাম।তারপর চুপচাপ দরজা খুলে ঘরে চলে আসলাম। বাহির হতেই দেখলাম আন্টি আর ভাবী আমাদের দিকে তাকিয়ে আছেন।আমি উনাদের পাত্তা না দিয়ে চলে আসলাম। ঘরে আসতেই মায়ের হাজার প্রশ্নের সম্মুখীন হলাম। কোনোরকম জবাব না দিয়ে রুমে চলে আসলাম,মাথায় শুধু একটা কথাই ঘুরতেছে কীভাবে রাজি করাবো। পুরো রাত টেনশনে ঘুমাতে পারলাম না।সকালে মা এসে ডাকতেই বিরক্তি নিয়ে চোখ খুললাম।

–“কী হয়েছে মা,এত সকাল সকাল কেনো বিরক্ত করতেছো?”

–“একটু ওর দুপুর হবে আর তুই বলতেছিস সকাল। তাড়াতাড়ি উঠ আয়ান এসেছে।”

আমি দ্রুত উঠে বসে বললাম,,
–“কী কিন্তু কেনো এসেছে?”

মা বিছানা ঠিক করতে করতে বললেন যে উনি নাকি আমাকে ঘুরতে নিয়ে যেতে এসেছেন।আমি জিদ দেখিয়ে বললাম যে একদিন না হগেই ঘুরতে নিয়ে যেতে এসেছো এসব কী ধরনের কথা।

–“বেশি কথা না বলে রেডী হয়ে আয়,তোর বাবা বলেছে। বুঝেছিস?”কথাটা বলেই মা রুম থেকে চলে গেলেন।আর আমি চাপা রাগে ক্ষেপে পড়লাম। মাঝে মাঝে খুব রাগ লাগে বাবার উপর,মনে হয় আমাকে ভালোইবাসেন না। বিছানায় বসে বসে অনেক্ষণ ভাবলাম যে কীভাবে নিদ্রর কথা বলবো। তখনই চট করে বুদ্ধি আসলো যে আয়ানকে দিয়েই ব্যবস্থা করবো। কীভাবে করবে সেটা ওর ব্যাপার! বাসা থেকে খুশি মনেই আয়ানের সাথে বের হয়েছি,আমাকে খুশি দেখে সবাই কিছুটা চমকে গিয়েছিলো।আমি সেদিকে পাত্তা দিলাম না।

প্রায় মিনিট বিশেক আগে বের হয়েছি ঘর থেকে।গাড়ীতে বসে আছি দুজনেই কারো মুখে কোনো কথা নেই। উনি গম্ভীর হয়ে বসে আছেন আর আমি বিরক্তি নিয়ে।কেনো যেনো উনাকে আমার পছন্দ নয়। আমি নিজেও জানি না। উনি সামনের দিকে তাকিয়ে ড্রাইভ করছেন আর আমি উনার পাশের সিটে বসে ফেসবুকিং করছি। উনি আড়চোখে একবার আমার দিকে তাকালেন,নিরবতা ভেঙ্গে উনিই বললেন,,

–“জিজ্ঞেস করবে না কোথায় যাচ্ছি!”

আমি বিরক্তি নিয়ে বললাম,,

—“প্রয়োজনবোধ করি নি।”

এরপর আবার নিরবতা,উনি কেমন রিয়েক্ট করেছে সেটা খেয়াল করি নি কারন আমার পুরো মনোযোগ ফোনের স্ক্রিনের উপর ভেসে উটা নিদ্রের মুখে। আমি নিজেও জানি না কেনো এত ভালোবাসি উনাকে। উনার সবকিছুই আমার ভালো লাগে,উনি যখন হাসেন তখন মনে হয় মুক্ত ঝরে। হঠাৎ নিদ্রের বলা কথা মনে পড়লো। আমি দ্রুত ফোন টা ব্যাগে রেখে দিলাম। উনাকে কীভাবে বলবো সেটা নিয়ে ইতস্ত করতে লাগলাম।আমাকে উশখুশ করতে দেখে উনি এক হাত দিয়ে পানির বোতল এগিয়ে দিলেন,আমি তাকাতেই বললেন,,

–“পানি টা খেয়ে একদমে বলে ফেলো যা বলতে চাও!”

আমি চমকে উঠলাম,উনি কীভাবে বুঝলেন আমি কিছু বলতে চাই!

–“আমি অনেক কিছুই বুঝি যা তুমি বুঝো না।তাই এত ফর্মালিটি না করে সোজাসুজি বলো যে কেনো আমাকে বিয়ে করতে চাও না!”

উনার এমন ঠান্ডা আর স্বাভাবিক কথাবার্তা আমার অবাকের রেশ আরেক ধাপ বেড়ে গেলো। উনি কীভাবে বুঝলেন, আমার ভাবনা-চিন্তার মাঝেই উনি আবারো বললেন,,”চিন্তা পরে করতে পারবে আগে বলো কেনো চাও না।” আমি আর কোনো কিছু না ভেবে সরাসরি বললাম যে আমি নিদ্রকে ভালোবাসি আর নিদ্রকেই বিয়ে করতে চাই।উনি সাথেসাথে গাড়ী থামিয়ে দিলেন,আমার দিকে একপলক তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন নিদ্রকে কী আমাকে ভালোবাসে? আমি বললাম জানি না তবে উনি বলেছেন আমি যদি আমার পরিবারকে রাজি করাতে পারি তাহলে উনি বিয়ে করবেন। আয়ান কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন,কেনো যেনো মনে হচ্ছিলো উনার নিঃশ্বাস আটকে আসছিলো। উনি পকেট থেকে ফোনটা বের করলেন, এরপর কাউকে ফোন করে বললেন,,”এখনই নিদ্রকে ফোন দিবি আর আমাকে কানেক্ট রাখবি, ওকে শুধু জিজ্ঞেস করবি নূপুর এর ব্যাপারে ওর ফিলিংস কেমন!” ও পাশে কী বললো কিছু শুনলাম না।তবে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই ফোনের স্পীকারে নিদ্রের আওয়াজ ভেসে উঠলো। আমি কান খাড়া করে উনাদের কথাবার্তা শুনার প্রস্তুতি নিলাম। একটুপর নিদ্রকে ওই ছেলেটি প্রশ্ন করলো,,”দোস্ত, সত্য কথা বলবি,চারতলার নূপুরেরর ব্যাপারে তোর ফিলিংস কী রে?”

নিদ্র একদম রেগে বললো,,”বুঝি না সবাই শুধু নূপুর নূপুর কেনো করছে?বাসার সবাইও নূপুর নূপুর করছে।ওদের হাজার প্রশ্নে বিরক্ত হয়ে ঘর থেকে বের হয়ে এসেছি।”

নিদ্রের কথা শুনে আমি আড়চোখে আয়ানের দিকে তাকালাম,উনার মুখের তেমন কেনো পরিবর্তন দেখলাম না। ছেলেটি আবার বললো,,

—“দোস্ত রেগে যাচ্ছিস কেনো?কী হয়েছে বল।”

নিদ্র এবার নরম গলায় বললো,,

—“এত বছর থেকে যে ফিলিংস লুকিয়ে আসছি তা সবার সামনে চলে আসছে, আমি কী করবো বল।”

ছেলেটি চুপ করে রইলো। নিদ্র আবার নিজে নিজেই বলতে লাগলো,,

—“আমার না খুব কান্না পাচ্ছে। তোরা তো সবাই জানিস নূপুরেরর প্রতি আয়নের ফিলিংস কেমন!কিন্তুু কখনও আমার ফিলিংস জেনেছিস?আমি না নূপুরকে খুব ভালোবাসি রে,কিন্তুু ওকে কখনও বলি নি। নূপুর আমাকে আরো অনেক আগে থেকেই ভালোবাসে,আমি সেটা বুঝতাম কিন্তুু কখনও প্রশ্রয় দিতাম না ওর ফিলিংসকে। কেনো করতাম জানিস? কারন আমি কোনোভাবেই নিজের বন্ধুকে ধোকা দিতে পারবো না। নূপুর যখন আমার ঘরে আসতো তখন অযথাই ওকে বিরক্ত করতাম,ওকে রাগিয়ে দিতাম এই কারনে যে ও আমার উপর অভিমান করুক।কিন্তু হতো উল্টো ও আমার প্রতি আরো বেশি ঝুঁকে পড়তো।কাল রাতে ও এসে অনেক পাগলামি করেছে,কোনো রকম ওকে সামলিয়ে বাসায় পাঠিয়েছি। আমার পুরো পরিবার আমাকে সন্দেহ করেছে,সবাই মিলে গোল মিটিং এ বসে আমাকে হাজার প্রশ্ন করেছে, আমি কোনো রকম উনাদের জবাব দিয়েছি। বাসায় পাঠানোর সময় ওকে বলেছি যে ওর ফ্যামিলি যদি রাজি থাকে তাহলে আমি ওকে বিয়ে করবো,আমি জানি ও কখন ভয়ে ওর বাবাকে বলতে পারবে না।আর ওর বাবা যদি রাজিও হয়ে যায় তাহলে আমি উনার সামনে অন্য মেয়েকে নিয়ে ঘুরাঘুরি করে উনার মনে ভুল ধারনা প্রবেশ করিয়ে দিবো।আমি চাই ও আয়ানকেই বিয়ে,, ”

পুরো কথা শেষ হওয়ার আগেই আয়ান ফোনটা কেটে দিলো। এতক্ষন একটা ঘোরের মধ্যে ছিলাম, উনার ফোন কাটার সঙ্গে সঙ্গে ঘোর ভেঙ্গে গেলো। আমি উনাকে কিছু বলতে যাবো তারে আগেই উনি ফোনটা সিটের উপর জোরে ফেলে দিয়ে আমার হাত থেকে পানির বোতল কেড়ে নিয়ে ঢকঢক করে পানি খেতে লাগলেন। এরপর নাকে,মুখে পানির ছিটে দিলেন।উনাকে অস্থির দেখপ আমি আর কিছু বললাম না। আমি দৃষ্টি সরিয়ে বাহিরের দিকে তাক করলাম। মনটা কেমন উৎফুল্ল হয়ে গেলো,নিদ্র আমাকে ভালোবাসেন। ইচ্ছে করছে এক ছুটে নিদ্রের কাছে চলে যেতে,ওকে ছুঁয়ে দিতে। আমার ভাবনা-চিন্তার মাঝেই আয়ান আমাকে কোমল কন্ঠে ডাক দিলেন, ‘নূপুর’ বলে। আমি হালকা কাত হয়ে উনার দিকে তাকালাম,উনার দৃষ্টি দেখে মনে হলো উনি আমাকে কিছু বলতে চান।উনি কিছু বলবেন তার আগেই আমি কান্নামাখা কন্ঠে বললাম,,

–“দেখেছেন নিদ্র ভাইয়া কী বলেছে?আপনি প্লিজ আমার আব্বুকে বলেন যে আপনি আমায় বিয়ে করতে চান না।প্লিজ ভাইয়া, আপনার সামনে হাত জোড় করছি প্লিজ।”

আমার আকুতি-মিনতি উনার কান পর্যন্ত পৌঁছিয়েছে কী না জানি না। তবে এটুকু জানি উনি যদি না মানেন তাহলে আমি উল্টা-পাল্টা কিছু করে ফেলবো। উনি কোনোকথা না বলে গাড়ি থেকে বের হয়ে দরজাটা ঠাস করে লাগিয়ে চলে গেলেন। উনি বের হতেই আমি কেঁদে দিলাম,কোনোরকম নিজেকে সামলিয়ে শক্ত করলাম। কিছুক্ষন পর উনি ফিরে এসে গাড়ী স্টার্ট করলেন,আমি উনার দিকে আশা ভরা দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছি জবাবের জন্য।

অনেক্ষন পর উনি সামনের দিকে তাকিয়ে আমাকে বললেন,,

–“চিন্তা করো না, তুমি যা চাইছো আমি সেটার ব্যবস্থা করে দিবো।”

উনার কথা শুনে আমি বিষ্ময়ে হা হয়ে গেলাম,উচ্ছাসিত কন্ঠে বললাম,,”সত্যি!”

উনি কেমন করে যেনো আমার দিকে তাকালেন, আমি মাথা নিচু করতেই তাচ্ছিল্যের হাসি দিলেন।আমি অপরাধীর মতো দৃষ্টি নিচের দিকে রাখলাম।উনি জোরপূর্বক হেসে আমাকে বললেন,,

–“হুম,সত্যি।তবে একটা শর্ত আছে।”

আমি সঙ্গে সঙ্গে বললাম,,

—“আমি আপনার সব শর্তে রাজি।”

উনি সিরিয়াস ভাবে বললেন,,

—“ভেবে বলছো তো?”

বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে উঠলো,আবার এক অজানা ভয় হতে লাগলো।উনি কী চাইবেন এটা ভেবেই অস্থির হয়ে উঠলাম।এরপর প্রশ্নবিদ্ধ চোখে উনার দিকে তাকালাম।

উনি এবার হেসে দিলেন,হাসিমুখেই বললেন,,

—“রিলেক্স, আমি তেমন কিছু চাইবো না।
তোমার কপালে ঘাম বেয়ে পড়ছে।এত ভয় পেয়েছো নাকি?”

আমি কপালে হাত দিয়ে দেখলাম সত্যি কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। উনি টিস্যু এগিয়ে দিয়ে বললেন,,”মুছে ফেলো।” আমি ছোঁ মেরে টিস্যু নিয়ে ঘাম মুছে ফেললাম।

.

চলবে?

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে