সুচরিতা পর্ব-১৪+১৫

0
509

#ধারাবাহিক গল্প
#সুচরিতা
পর্ব-চৌদ্দ
মাহবুবা বিথী

সুচরিতা ওর ননাস আর ননদের দিকে তাকিয়ে বললো,
——আপু এখানে বিছানায় বসে স্বাচ্ছন্দভাবে খেতে পারবেন না। এর থেকে টেবিলে বসে আরাম করে খান।
সুচরিতার বডি ল্যাঙ্গুয়েজে উনারা আর না করতে পারলেন না। টেবিলে এসে খেতে বসলেন।
——মা,গুড়ি কচু আর বেগুন দিয়ে ইলিশমাছটা খেতে দারুন হয়েছে।
——হুম,তোর আর জোহরা পছন্দের তরকারি। বড় বউমাকে রাঁধতে বললাম।
——মা,বড় ভাবি কোথায়?(জোহরা বললো)
——রাজনকে স্কুল থেকে আনতে গিয়েছে।
—–আপু চিংড়ি মাছ দিয়ে ঢেড়সের চচ্চড়িটাও খেয়ে দেখো, খুব মজা হয়েছে।
—–জোহরা, চ্যাপা শুঁটকির ভর্তাটা মুখে লেগে আছে। মায়ের বাড়িতে আসলে খেয়ে তৃপ্তি পাওয়া যায়।
—–তোদের এতো সময় কোথায়? বসে বসে রান্না করার। চাকরি করা, আবার রান্না করা এতো চাট্টিখানি কথা নয়। আমার জামাইদের কপাল বটে। বউ পয়সা কামাই করছে। আবার রান্না করে খাওয়াচ্ছে।
সুচরিতা কিছু হাড়িভাঙ্গা আম কেটে নিয়ে এসে টেবিলে দিলো। ওকে আজকে ক্লান্ত লাগছে।
—–তোমার ডেলিভারী ডেট কবে?(তাহেরা বললো)
——দেরী আছে আপু। ফেব্রুয়ারীতে ডেট।
—–তোমার গ্রাজুয়েশন ফাইনাল পরীক্ষা কবে?”জোহরা বললো”
—–নভেম্বরে এক তারিখে শুরু হবে।
——তোমার সাবজেক্ট যেন কি ছিলো? তুমি সব কিছু সামলে নিতে পারবে তো?
—–সোসিওলোজি।ইনশাআল্লাহ পারবো।
দুপুর খাবার খেয়ে সবাই মায়ের রুমে গল্প করতে বসলো। ওদের মায়ের খাটটা বেশ বড়। ছয় ফিট বাই সাত ফিট। হিমেলের বাবা জাম গাছ কিনে কাঠের তক্তা তৈরী করে রোদে শুকিয়েছে। তারপর ঐ তক্তা দিয়ে এই খাটটা বানিয়েছে। সবাই বেশ আয়েশ করে খাটে বসে গল্প করছে। সুচরিতার শাশুড়ীর শরীরের বাঁধন বেশ মজবুত। মাথার চুলগুলো খুব একটা পাকেনি। আল্লাহর রহমতে উনার তেমন কোনো অসুখ বিসুখ নাই। শুধু একটু জর্দা দিয়ে পান খান। উনার ছেলেমেয়েরাও উনার হাতে বানানো পান খেতে পছন্দ করে। আজও উনি খাওয়ার পর সবাইকে পান বানিয়ে দিয়েছেন। এর মাঝে সখিনা ওর ছেলেকে স্কুল থেকে নিয়ে আসছে। রাজনকে খাইয়ে দিলো। ঘরে মেহমান আসার সুযোগে টিভি ছেড়ে রাজন কার্টুন দেখতে বসে গেল। এ সময় মা বকাঝকা করতে পারবে না। ওরা তিন জা খেতে বসলো। সখিনা খাওয়া শেষ করে শাশুড়ীর রুমে চলে গেল। কারিমাও খাওয়া শেষ করে শাশুড়ীর রুমে গল্প করতে চলে গেল। সুচরিতা এঁটোবাসনগুলো ধুয়ে একটু বিশ্রামের জন্য রুমে এসে বিছানায় গা এলিয়ে দিলো। ইদানিং একটুতেই ও হাঁফিয়ে উঠে। সুচরিতাকে না দেখে মেজ ননস কারিমাকে জিজ্ঞাসা করলো ,
——সুচরিতাকে দেখছি না? ও কই?
——আপা ও আমার আর ভাবির মতো নয়। একটু একাসেরে। একা একা থাকতে পছন্দ করে। স্বার্থপরও আছে। সেদিন জেবা ওর চিরুনি দিয়ে মাথা আঁচড়িয়েছে বলে চিরুনিটা সাবান দিয়ে ধুয়ে ফেললো। জেবার মাথায় কি পায়খানা লেগেছিলো বলেন? ওর টাওয়েল কাউকে ধরতে দেয় না।
—–অবশ্য টাওয়েলটা সবার ব্যক্তিগত থাকা উচিত। একটা হাইজিনের ব্যাপার আছে।
——মা, আমরা তো সবাই ঘরের মানুষ। আর জেবাতো শিশু। ও তো বুঝে না কোনটা কার টাওয়েল। একদিন সুচরিতার টাওয়েল দিয়ে মুখ মুছে ছিলো বলে ও মেশিনে দিয়ে সাথে সাথে ধুয়ে ফেললো।
——কাল তোমার ফ্লাইট কখন?জোহরা বললো,
——রাত তিনটায়।
—–পাসপোর্ট, তোমার জবের কাগজপত্র সব ঠিকঠাকভাবে গুছিয়ে নিও। ওষুধ নিয়ে নিও।
——ওষুধ ছ,মাসের জন্য নিবো। এরপর ওখান থেকে কেউ দেশে আসলে হিমেলকে কিনে দিতে বলবো।
আসরের আযান শোনা যায়। সুচরিতা জেগেইছিলো। ওদের সব কথাই ওর কানে এসেছে। পরিস্কার পরিচ্ছন্ন থাকা কি অপরাধ? উনি এমন একজন মানুষ এটা নিয়েও উনার কূটনামী করা চাই। সুচরিতা বুঝে পায় না কারিমার সমস্যাটা কি? ওর পিছনে পরে থেকে ওর কি লাভ হয়। নামাজ পড়ে শাশুড়ীর রুমে গিয়ে বললো,
—-আপু, চা বানাবো?
—–আমরা দু,বোন আছি কিছুক্ষণ। মাগরিবের পর চা বানাও। তোমার সাথে তো কথাই হলো না। তোমার বাবা অসুস্থ শুনলাম। আমি কাল বড় আপার কাছে শুনলাম। আগে জানলে দেখতে যেতে পারতাম। খালু, নাকি এখনও সামলে উঠতে পারেন নাই।
—–ডাক্তার বলেছে একটু সময় লাগবে।
—–তোমার বাবা অসুস্থ। সুসমিতার বিয়েটা দিয়ে দাও। আমার হাতে একটা খুব ভালো ছেলে আছে। আমার এক কলিগ এর ভাইয়ের ছেলে। ডিগ্রী পাশ করে বাবার ব্যবসা দেখাশোনা করে।
—–আপু ছেলে তো বেকার। তারউপর মাত্র ডিগ্রী পাশ করেছে।
—–এ তোমার কেমন কথা। তোমার বোন আবার কোন রাজকন্যা। তোমার বাবার তো সেরকম টাকা পয়সাও নেই। কিন্তু ছেলের বাবার অনেক বড় ব্যবসা। এইজন্য ছেলের যেটুকু পড়াশোনা দরজার সেটুকু করে বাপের সাথে ব্যবসায় ঢুকেছে। এতে আমি তো খারাপ কিছু দেখছি না।
সুচরিতাও ছেড়ে দেবার পাত্রী নয়
—–আপু প্রবাদ আছে, বাপ রাজা তো আমার কি”? আর এ ছাড়াও আব্বু আম্মু মনে হয় ওর বিয়ে এখন দিবেন না।
—–তাহেরা, যেঁচে কারো উপকার করতে হয় না। ওদের মেয়ের বিয়ের ভাবনা ওদের করতে দে।
—–ভাইয়া, আমি আসলে মানুষের উপকার করতে ভালোবাসি। এছাড়া আঙ্কেল অসুস্থ মানুষ। এতবড় সংসার উনি কিভাবে চালাবেন? ছেলে দুটো নিজের পায়ে দাঁড়াতে এখন অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে। এই জন্য ভাবলাম সুসমিতার বিয়ে হলে মাথা থেকে বোঝাটা নামাতে পারতো। খালু আর খালাম্মা ও একটু শান্তিতে নিঃশ্বাস ফেলতে পারতো।

সুচরিতা মনে মনে খুব বিরক্ত হলো। প্রথমতো সুসমিতা মাথার বোঝা নয়। একটা মেয়ে হয়ে আর একটা মেয়েকে মানুষ কিভাবে বোঝা বলে মনে করে? ওর ক্ষেত্রে ওর বাবা মা যে কাজটা করেছে কিন্তু সুসমিতার ক্ষেত্রে এটা ও হতে দিবে না। আগে
লেখাপড়া পরে বিয়ে। মাগরিবের আযান শোনা যায়।
সুচরিতা উঠে গিয়ে নামাজ পড়ে নিয়ে চুলায় চায়ের পানি বসিয়ে দিলো। শাশুড়ী মা এসে চায়ের সাথে পাকোড়া বানিয়ে দিতে বললেন। সুচরিতা গাজর কুচি করে নিলো। এর সাথে বাঁধাকপি, একটু আলু কুচি,পেঁয়াজ কুচি, লঙ্কার কুচি সাথে কিছু মুরগীর মাংসের কিমা দিয়ে আদা,রসুন, ধনেপাতা একটু টালানো ঝিরে দিয়ে আগে মাখিয়ে নিলো। তারসাথে একটু ময়দা আর বেসন মিশিয়ে দিলো। সবার শেষে একটা ডিম ভেঙ্গে মাখিয়ে নিলো। চুলায় তেলের কড়াই বসিয়ে ডুবো তেলে গোল গোল করে পাকোড়ার গোলা ছেড়ে দিলো। ওর বড় জা এসে হাত লাগালো। পাকোড়াগুলো বাদামী করে ভেজে প্লেটে তুলে নিয়ে সুচরিতাকে বললো,
——কারিমাটা যখন থেকে এ বাড়িতে আসছে তখন থেকে কূটনামী ভালোই শুরু করেছে। এর কথা ওর কাছে আর ওর কথা এর কাছে লাগিয়ে কি মজা পায় জানি না ভাই। দিনশেষে ঐ তো সবার কাছে খারাপ হবে। এটা কি ও জানে না?
সুচরিতার কথার উত্তর দিতে মন চাইলো না। বড় জায়ের কথাগুলো শুধু শুনে গেল।
—–তোমার কি শরীর খারাপ লাগছে?
——না,ভাবি আমি একদম ঠিক আছি।
——কথা বলছো না যে?
——আমি আপনার কথাগুলো শুনছি।
আসলে এ বাড়িতে ও কাউকে বিশ্বাস করতে পারছে না। পাকোড়া ভাজা হয়ে গেল।
——তুমি চা বানিয়ে আনো। আমি এগুলো ঘরে দিয়ে আসি।
জেবার কান্না শোনা যাচ্ছে। মনে হয় ঘুম থেকে উঠে পড়েছে। কারিমা দৌড়ে রুমে চলে গেল। কাউকে না দেখতে পেলে ও একটানা কাঁদতেই থাকবে। সুচরিতা চা নিয়ে শাশুড়ীর রুমে চলে গেল। চায়ের পর্ব শেষ করে তাহেরা আর জোহরা বাড়ির পথে রওয়ানা দিলো।

ছ,মাস পার হয়ে গেল। সোহেল বিদেশে গিয়ে এখন পর্যন্ত একটা টাকাও পাঠাতে পারেনি। লোকমুখে শোনা সোহেল ওখানে নাকি জুয়া খেলে। আল্লাহপাক ভালো জানেন ও ওখানে কি করছে?দশ লক্ষ টাকা খরচ করে নাচতে নাচতে বিদেশে গেল।অথচ এখন পর্যন্ত কোনো টাকা পাঠাতে পারলো না। ফোন দিলেই বলে,
—–আমি তো চেষ্টা করছি। চাকরি না পেলে কি করবো। করোনার পর ওদের চাকরীর বাজারে ধ্বস নেমেছে।

সোহেল যা বলে হিমেলকে তাই বিশ্বাস করতে হয়।এছাড়া তো আর কোনো উপায়ও নেই। অথচ এদিকে হিমেলের উপরে সংসারের পুরো চাপ পড়েছে। ডলার সঙ্কটের কারণে ওর ব্যবসা চালিয়ে নিতে সমস্যা হচ্ছে। অফিসের স্টাফদের বেতন সময় মতো দিতে পারছে না। রোমেল ওর বউ বাচ্চা নিয়ে যশোরে চলে গেছে। কারিমা আর জেবার খরচ ওকেই বহন করতে হচ্ছে। বিদ্যুতের কার্ডে টাকা ভরে কুলানো যাচ্ছে না। তিনটে রুমে এসি চলে। গ্যাস বিল, পানির বিল, বাড়ির কর,সব দিয়ে হিমসিম খাচ্ছে। পাগলা ঘোড়ার মতো দ্রব্যমুল্যের দাম উর্দ্ধগতিতে ছুটছে। জেবার জন্য যে নিডো দুধ আড়াইহাজার টাকায় কিনতো ডলারের দাম বেড়ে যাওয়াতে সেটা এখন চার হাজার টাকা দিয়ে কিনতে হচ্ছে। লাগাম ধরার যেন কেউ নাই। অসাধু ব্যবসায়ীরা মুনাফা লুটছে। এক ধাক্কায় অকটেনের দাম লিটার প্রতি ৯৯ টাকা থেকে বেড়ে ১৩০ টাকা। ড্রাইভারের খরচ তেলের দাম দিয়ে সামনে মনে হয় গাড়িটা আর রাখতে পারবে না। বিক্রি করে দিতে হবে। হিমেল যেন আর পেরে উঠছে না। ঘরে বাইরে ওর পাগল হবার যোগাড়। এখন জানুয়ারী মাস। সামনের মাসে সুচরিতার ভেলিভারী হওয়ার কথা। টাকার সংকুলান করতে সুচরিতার সাথে আজকাল ভালো করে হিমেলের কথাও হয় না। অথচ এই সময়ে সুচরিতার সবচেয়ে বেশী সাপোর্টের প্রয়োজন।

চলবে

#ধারাবাহিক গল্প
#সুচরিতা
পর্ব-পনেরো
মাহবুবা বিথী

সুচরিতার চেহারা আস্তে আস্তে খুব খারাপ হয়ে যায়।শরীরে প্রচুর পানি চলে আসে। ছেলের মা বান্দরী আর মেয়ের মা সুন্দরী এই থিউরীতে শাশুড়ীমা মনে মনে আনন্দিত হোন। শেষবেলায় সুচরিতার অনেক যত্নআত্তি শুরু করে দেন। বড় মাছের মাথা নানা রকম ফলফলাদি খাওয়ানো শুরু করেন। উনি ধরেই নিয়েছেন সুচরিতার ছেলে হবে। এদিকে কারিমার ঘুম হারাম হয়ে গেছে। সত্যিই যদি সুচরিতার ছেলে হয় জেবার কপালে তো ওর দাদীর আদর আর জুটবে না। এ চিন্তায় কারিমার চোখের ঘুম হারাম হয়ে গেছে। এর মাঝে সুচরিতার অনার্স পরীক্ষা ভালোভাবেই শেষ হলো।
অবশেষে সুচরিতার ডেলিভারীর দিন এগিয়ে আসলো। সেদিন ছিলো ফাগুনের প্রথম দিন। শীতের শুস্কতা পেরিয়ে বসন্তের শীতল হাওয়ায় প্রকৃতির রুপ আস্তে আস্তে ফিরতে শুরু করেছে। হিমেল আর সুচরিতার জীবনেও আজ এক ঐতিহাসিক দিন। দুজনের জীবনটা আজ পরিপূর্ণতা পেতে যাচ্ছে। বাবা মা হওয়ার স্বপ্নে দুজনেই আজ বিভোর। কিন্তু সুচরিতার ভাগ্যটাই এমন সব কিছু সহজে আসে না। অনেক লড়াই করে অর্জন করতে হয়। তাই জীবনের এই কাঙ্খিত মুহুর্তেও যেন লড়াইটা অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠলো। ডেলিভারীর দিন হাসপাতালে যাওয়ার সময় ওর শাশুড়ী মা বলে উঠলেন,
—–হিমেল, আমি সাবেরা আর তাহেরাকে হাসপাতালে যেতে বলেছি।
—–মা,ওরা চাকরি ফেলে হাসপাতালে গিয়ে কি করবে? আর ওরা তো ডাক্তার নয়। আমার শাশুড়ী মা তো যাচ্ছেন।
——উনার মেয়ের বাচ্চা হবে উনি তো যাবেন। এটাই স্বাভাবিক। তবে সাবেরা আর তাহেরাও যাবে। ওরা আজ অফিস থেকে ছুটি নিয়েছে। আজ তো বৃহস্পতিবার। এর পর দু,দিন ছুটি। সুতরাং কোনো সমস্যা নাই। ওরাও হাসপাতালে সময় দিতে পারবে।
—–মা আমি হাসপাতালে যাচ্ছি। মজা করতে কোনো রিসোর্টে যাচ্ছি না যে দলবল নিয়ে যেতে হবে।
—-ওরা গেলে তোর সমস্যা কি?
——আমার সমস্যা না। ডাক্তাররা খুব বিরক্ত বোধ করে।
হিমেল আর কথা বাড়ালো না। এমনিতেই মনটা ভালো না। শরীরে অতিরিক্ত পানি আসাতে সুচরিতার শরীরে নানা কপ্লিকেশন দেখা দিয়েছে। বাচ্চার নড়াচড়া একদম কমে গিয়েছে। মাঝে দুবার হাসপাতালে ভর্তি হয়ে অক্সিজেন দিতে হয়েছে। যাইহোক সবকিছু গুছিয়ে বেলা বারোটার দিকে হিমেল আর সুচরিতা হাসপাতালের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলো। সাবেরা আর তাহেরাও গ্রীন লাইফ হাসপাতালে পৌঁছে গেল। সুচরিতার মা যাত্রাবাড়ি থেকে হাসপাতালের দিকে রওয়ানা দিয়েছে।আগামীকাল সুচরিতার ডেলিভারীর ডেট। কিন্তু এখনপর্যন্ত পেইন নাই। বাচ্চার নড়াচড়াও কমে গিয়েছে। সুচরিতা হাসপাতালে ভর্তি হলো। ডাক্তার এসে দেখে গেল। সুচরিতার মাও চলে এসেছে। হিমেলের দুই বোনও চলে এসেছে। এর মাঝে চব্বিশ ঘন্টা পার হয়ে গেল। গতকাল বিকেল চারটায় সুচরিতা ভর্তি হয়েছে। কিন্তু এখনও সুচরিতার পেইন উঠলো না। হিমেলের বড় বোন সাবেরা এসে ডাক্তারকে বললো,
—–ম্যাডাম পেশেন্টকে ড্রিপ দিলে হতো না? তখন হয়ত ব্যথা উঠতো। বাচ্চাটাও নরমালে হতো। আমরা চাইছি না আমাদের পেশেন্টের সিজার হোক।
——আসলে আপনাদের চাওয়া না চাওয়ায় কোনো কিছু হবে না। রোগীর যেটা ভালো হবে আমরা সেটাই করবো।
তারপরও সাবেরা আর তাহেরার জোড়াজুড়িতে ডাক্তার ড্রিপ দিলো। তাও সেভাবে পেইন উঠলো না। এদিকে বাচ্চার হার্ডবিট স্লো। জরায়ুর মুখ খুলছে না। কালো রংয়ের তরল ডিসচার্জ হতে লাগলো। এসব দেখে শুনে সুচরিতার মা গিয়ে হিমেলকে বললো,
——নরমালে আর চেষ্টা করা ঠিক হবে না। তুমি গিয়ে ডাক্তারকে সিজার করতে বলো। না হলে তোমার বউ বাচ্চার বড় কোনো ক্ষতি হয়ে যেতে পারে।
এরপর হিমেল গিয়ে ডাক্তারকে সিজার করতে বলে। এর মাঝে সুচরিতার শাশুড়ীও চলে এসেছে। অতঃপর রাত আটটায় সিজার করে সুচরিতার কন্যাসন্তান হলো। কিন্তু বাচ্চার শারীরিক কন্ডিশন অনেকটা খারাপ হয়ে গেছে। ওর নাকে মুখে ময়লা ঢুকেছে। সাকার মেশিন দিয়ে ময়লাগুলো বের করা হয়েছে। বাচ্চাটা চিৎকার করে কাঁদছে। যখনি হিমেল কোলে তুলে নিচ্ছে তখনি ওর কান্না বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। এজন্য হিমেলও বাচ্চাকে কোল থেকে নামাচ্ছে না। সুচরিতার শারীরিক কন্ডিশন ও সুবিধাজনক নয়। ওকে পোস্টঅপারেটিভ কেয়ারে রাখা হয়েছে। এরকম অবস্থায় হিমেলের মানসিক অবস্থাও ভালো নয়। এর মাঝে মেয়ে সন্তান হওয়ার কারনে সুচরিতার শাশুড়ী খুব মনঃকষ্টে আছে। এদিকে সুচরিতার মাও হাসপাতালে রাতে থাকবে। আবার হিমেলের মেজ বোন তাহেরাও আজ রাতটা হাসপাতালে থাকবে। কারণ বাচ্চাটা আজ উনাদের কাছে থাকবে। সুচরিতার এখনও জ্ঞান ফিরেনি। পোস্ট অপারেটিভ কেয়ারে রাখা আছে। হিমেলের মা নিজের মনঃকষ্ট ঢাকতে হিমেলকে বললেন,
——তুই আর হাসপাতালে থেকে কি করবি? আমার সাথে বাড়ি চল।
—–মা, তুমি এটা কিভাবে বলতে পারলে? আমার মেয়েটা অসুস্থ। আর সুচরিতার এখনও জ্ঞান ফিরেনি। আমার পক্ষে এখন যাওয়া সম্ভব নয়।
হিমেলের কথা হিমেলকে ফিরিয়ে দিয়ে ওর মা বললো,
——-তুই তো আর ডাক্তার না যে ওদের সারিয়ে তুলবি। ওদের দেখার কাড়িকাড়ি টাকা খরচ করে ডাক্তার রেখেছিস। তাই ওদের নিয়ে তোকে ভাবতে হবে না। রাত এগারোটা বাজে। আমি বাড়ি যাবো কার সাথে?
—–এই মুহুর্তে এতো কথা বলার মতো আমার শক্তি নাই। তুমি সাবেরা আপার সাথে চলে যাও। আমার গাড়ি আর ড্রাইভার আছে। ফোনে বলে দিচ্ছি।
—–ওর বাসা তো মোহাম্মদপুরে।
—–তাতে কি? তোমাকে কল্যানপুরে বাসায় নামিয়ে দিয়ে ওকে ওর বাসায় নামিয়ে দিয়ে গাড়ি হাসপাতালে চলে আসবে।
এসব কাহিনী দেখে সুচরিতার মা বলে উঠলেন,
—–বেয়াইন, আপনিতো ভালো করে এখনও নাতনীর মুখ দেখলেন না।
——ও আর নতুন করে দেখার কি আছে? ঐ তো মেয়েই হয়েছে।
——আপনার কাছে গুরুত্ব কম থাকতে পারে কিন্তু হিমেলতো প্রথম বাবা হয়েছে। আপনি হিমেলের মানসিক অবস্থাটা বুঝতে পারছেন না। বাপ হয়ে সদ্য জন্ম নেওয়া অসুস্থ মেয়েটাকে ফেলে রেখে ও কিভাবে যাবে?
—–আমিও তো ওর মা। আজ দু,দিন থেকে এই ডেলিভারী নিয়ে ওর নাওয়া খাওয়া বরবাদ হয়ে গেছে। আমার ছেলেটার কথা আমি ভাববো না তো কে ভাববে?
—–মাশাআল্লাহ আপনার ছেলেটা সোমত্ত পুরুষ মানুষ। তার জন্য আপনার মায়া হচ্ছে। আর ওর বাচ্চাটাতো সদ্য ভুমিষ্ট হওয়া। তাহলে হিমেলের মনের অবস্থাটা কেমন এখন ভেবে দেখুন। আর বাচ্চাটাও ওর কোল থেকে নামতে চাইছে না। আসলে শরীরের গন্ধে বুঝতে পারছে এটা ওর বাপ। ওর কপালটা কি খারাপ এখন পর্যন্ত মায়ের দুধ মুখে নিতে পারে নাই। মাতো অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে।
—–কলিকালে কত কি দেখতে হচ্ছে। আমাদের এতো সিজার টিজার লাগেনি। বাচ্চা হওয়ার দুঘন্টা আগেও ছেলে পুলে স্বামী সন্তানের জন্য রান্না করেছি। আর টাকাও তো খরচ হয়নি। খুশী হয়ে দাইয়ের হাতে কিছু টাকা তুলে দিয়েছি। ব্যাস, এতেই বাচ্চা হওয়ার ব্যাপার মিটে গেছে। এখনকার মতো এতো নাটক হয়নি। এখনকার মানুষ বেশী ডাক্তার ডাক্তার করে। আর ডাক্তারও সহজ জিনিসটাকে জটিল করে নিজের পকেট ভরে।
——মা তুমি এসব কি বলছো? তোমার মাথা ঠিক আছে। দেখলে না সুচরিতার তো পেইন ছিলো না। এখানে সিজার ছাড়া ডাক্তারের আর কিইবা করার ছিলো?
——কেন রে, আরো দু,দিন অপেক্ষা করলে কি হতো?
——তুমি এখন বাড়ি গিয়ে রেস্ট নাও। আমি আর এসব বিষয়ে তোমার সাথে কথা বলতে চাইছি না।
হিমেলের মেজাজ মর্জি দেখে ওর মা বড় মেয়ে সাবেরার সাথে বাড়ির পথে রওয়ানা হলো।
একটা দুঃশ্চিন্তার রাত্রী পার হলো। নতুন সুর্যের উদয় হলো। হিমেল আর সুচরিতার জীবনে নতুন এক সদস্য যোগ হলো। যদিও অনেক কষ্টের পথ পাড়ি দিতে হলো তবুও জীবনটাকে পরিপূর্ণ লাগছে। সুচরিতারও জ্ঞান ফিরেছে। বারো ঘন্টা পর সুচরিতাকে কেবিনে দেওয়া হলো। সন্তানকে বুকে নিয়ে সুচরিতা মাতৃত্বের স্বাধ নিলো। এক লহমায় জীবনের সব কষ্ট দূর হয়ে গেল। সবকিছু ঠিক হওয়াতে সুচরিতার মা বাড়ি চলে গেল। বাসায় সুচরিতার বাবা অসুস্থ। উনাকে সুচরিতার মাকেই দেখভাল করতে হয়। এদিকে সুসমিতা শোভন খোকন প্রথম মামা হওয়ার আনন্দে হাসপাতালে আসতে চাইছে। সুচরিতার মা বাড়ি গেলে ওরা ভাগ্নিকে দেখতে হাসপাতালে আসবে। হিমেলও একটু ফ্রেস হতে বাড়ি চলে গেল। ও ফিরে আসলে তাহেরা বাড়ি যাবে। আজ দু,দিন ও বাড়ি ছাড়া। ওরও একটা মেয়ে। এবার ক্লাস টুতে উঠেছে। আর ওর হাসবেন্ড ও একটা সরকারী কলেজো শিক্ষকতা করে। খুব নিরীহ টাইপের মানুষ। তাহেরার মুখের উপর কোনো কথা বলে না।
যাইহোক সবাই বাড়ি চলে যাওয়াতে এই মুহুর্তে সুচরিতা আর ওর মেজ ননস কেবিনে আছে। ডেলিভারী হওয়ার এতো কাহিনীতে সুচরিতা ওর শ্বশুরবাড়ির মানুষগুলোর উপর বিরক্ত। সব রাগ গিয়ে পড়লো ওর মেজ ননসের উপর। ও রাগ চেপে না রাখতে পেরে বলেই ফেললো,
——আমার আর আমার বাচ্চার শারীরিক অবস্থা খারাপের জন্য আপনি আর বড় আপা দায়ী।
——এটা তুমি কি বলছো? তোমার বাচ্চা হবে বলে আমি বাড়ি, সংসার ছেড়ে হাসপাতালে পড়ে আছি। আর তুমি এর প্রতিদান এভাবে দিলে।
——কেন বলবো না? মৃত্যুর দরজা থেকে আমরা মা মেয়ে ফিরে এসেছি। অতিরিক্ত প্রেসার আর ডেট ওভার হয়ে যাবার কারনে বাচ্চাটা পেটের ভিতর পায়খানা করে দিয়েছে। আল্লাহ না করুন আমার বাচ্চাটার যদি কোনো ক্ষতি হতো আপনারা কি করতেন? বা আপনাদের বাচ্চা হওয়ার সময় যদি এরকম কাহিনী ঘটতো কি করতেন আপনারা?
—–আসলে আবার ও আমার অভিজ্ঞতা হলো যেঁচে কারো উপকার করতে নেই।
——আমারও আপু এরকম উপকারের দরকার নেই। যে উপকারে জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দাঁড়াতে হয়।

চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে