সুখের খোঁজে পর্ব-১৪+১৫

0
556

#সুখের খোঁজে….(পর্ব -১৪)
#মৌমিতা হোসেন

কথা শেষ হবার আগেই কিছু না বলে,রাগ না দেখিয়ে মোবাইল রেখে দেয়ায় নিতুর চিন্তা হয়। তৌসিফ এর নিরবতা ওকে খুব করে ভাবায়। ভালো লাগে না কিছু।বেশ কিছু সময় একা একা বসে থাকে। নিতু এতোক্ষণ বারান্দায় বসে কথা বলছিলো। ঘরে এসে দেখে সাজিদ , সেতু ঘুমিয়ে পড়েছে।একবার ভেবেছিলো তৌসিফ কে আবার ফোন দেবে পরে আবার ভাবে ফোন করে কি বলবে। ওদের মধ্যে একে অপরের সাথে বলার মতো তেমন কোন কথাই তো নেই।আছে শুধু নিরবতা।যা নিতুর কাছে অসহনীয় লাগছে।তাই নিতু মোবাইল রেখে শুয়ে পরে ।

এদিকে নিতুর কথা শুনে তৌসিফ কি বলবে ভেবে পায়না। খারাপ লাগে। নিতুর সব কথাই ঠিক। কিন্তু ওর কাছে সত্যি এসবের উত্তর নেই। খুব করে ভাবে তৌসিফ।একা একাই বিরবির করে বলে,”দোকানের দায়িত্ব,নিতুর দায়িত্ব এতো এতো দায়িত্ব আমি নিতে পারবো না। বিয়ে করেছি এইতো বেশি।এর বেশি কিছু আমাকে দিয়ে হবে না। আমার স্বাধীন জীবনে কারো হস্তক্ষেপ আমি মেনে নেবো না। কিন্তু অল্প কিছু দিন আগে আসা মেয়েটার মধ্যে কেমন যেনো এক যাদু আছে। ওকে দেখলেই ভেতরে যেই অনুভূতি হয়,ওর অনুপস্থিতি আমাকে যেমনটা কষ্ট দিচ্ছে এসবের কারন আমার জানা নেই।যাক এতো ভাবার দরকার নেই আর। আমি আমার মতোই থাকবো।ভুল কথা বলেছিলাম ,সরিও বলেছিলাম আর কি করার আছে আমার?”

তৌসিফ মোবাইল রেখে শুয়ে পরে। নিতু কে আর ফোন দেয়না।এক সপ্তাহ কেটে যায়।এই কদিনে কেউ কাউকে আর ফোন দেয়না। তৌসিফ সকাল হলেই বেরিয়ে পরতো। সারাদিন বাইরে বন্ধুদের সাথে আড্ডা,ঘুরে বেড়ানো এসবই ছিলো ওর প্রধান কাজ। ইচ্ছে করেই সারাদিন তৌসিফ ঘরে আসে না। আসলেই নিতুর কথা খুব করে মনে পড়ে।চোখ অস্থির হয়ে ওঠে ওকে দেখার জন্য।ওর কন্ঠ শোনার জন্য বন্ধুদের বিভিন্ন নাম্বার থেকে বেশ কয়েকবার ফোন দিয়েছে তৌসিফ। ওপাশ থেকে নিতুর হ্যালো,হ্যালো ডাক শুনে লাইন কেটে দেয় ও।ওর কন্ঠ শোনার জন্যই যেনো ফোনটা করা হতো। তবে যতোই সারাদিন বাইরে বন্ধুদের সাথে সময় কাটাক না কেনো রাতে বাসায় ফিরলেই আবার নিতুর কথা খুব করে মনে পড়তে থাকে তৌসিফ এর। কিছুতেই যেনো শান্তি পাচ্ছিলো না। বিষয়টা বন্ধুদের নজরেও পড়েছে।তাই ওরাও ওকে খ্যাপাতে থাকে।বৌ এর প্রেমে পাগল বলতে থাকে।সব সময় অল্পতেই রাগলেও এবার কেনো জানি বন্ধুদের এসব কথায় ও আর রাগ করেনা । মনে মনে ভাবে,”সত্যি কি নিতুর প্রেমে পরে গেলাম আমি।”

এই এক সপ্তাহে নিতু একবার ও ওকে ফোন দেয়না।তাই একটু অভিমান হয় তৌসিফ এর। রহিমার হাতের রান্নাও খেতে পারেনা বিস্বাদ লাগে।তাই এই কদিনে একটু রুগ্ন হয়ে যায়।দাড়ি বড় হয়, চুলগুলো কেমন লালচে সব মিলিয়ে চেহারা কেমন যেনো দেখা যাচ্ছে।

এদিকে নিতু তৌসিফ এর কাছে ফোন না করলেও শ্বশুর এর কাছে নিয়মিত ফোন করেছে।সময়মতো ঔষধ খেয়েছে কিনা,খেয়েছে কিনা এসব খবর নিয়েছে। রাহেলা খালাকে ফোন দিয়ে রান্না সহ সব বিষয়ে তদারকি করেছে। মাঝে মাঝে তৌসিফ এর খবর নিয়েছে। তৌসিফ এর সব খবর শুনে ওর খারাপ লাগে। কিন্তু যেহেতু ওর মনের খবর নিতুর অজানা তাই ভাবে যে হয়তো কোন সমস্যা হয়েছে বন্ধুদের সাথে তাই এমন করছে। তৌসিফ এর জন্য চিন্তা হলেও ফোন দিতে ইচ্ছে হয়না।ফোন করে খোঁজ নেয়ার মতো সম্পর্ক যে এখনো তৈরি হয়নি।তাই তো রাহেলা খালার কাছে খবর নিয়েই মনে মনে স্বস্তি পায় নিতু। নিতুর মা শ্বশুর বাড়ির সবাইকে নিয়ে মেয়ের এতো চিন্তার বিষয়টা খেয়াল করে। মেয়েকে রাতে রুমে ডাকে।নিতু খাওয়া শেষ হলে শ্বশুর এর সাথে কথা বলে মায়ের রুমে যায়।মায়ের পাশে বসে বলে,”বলো মা কেনো ডেকেছো? জরুরী কোন কিছু?কোনো সমস্যা?”

নিতুর মা বলে,”নারে কোন সমস্যা না। এমনি একটু কথা বলতাম তোর সাথে।আচ্ছা মা নিতু একটা কথা জিজ্ঞেস করি?”

নিতু বলে,”বলো মা। আমাকে কোন কথা বলতে গেলে আবার তোমার অনুমতি নিতে হবে? তুমি মা । তুমি তোমার সন্তানদের যা খুশি বলতে পারো।”

সালেহা বেগম মেয়ের দিকে তাকিয়ে হেসে বলে,”সেটা ঠিক। আমি সব বলতে পারি আমার সন্তানদের। তবে যখন ছেলে-মেয়েরা বড় হয়,তাদের বিয়ে হয় তখন অবশ্যই তাদের অনুমতি নিয়ে বলা উচিত।তখন ইচ্ছে হলেই আমরা সব বলতে পারিনা মা।”

নিতুর মাথায় এতো কিছু ঢোকেনা।তাই বলে,”মা আমি বুড়ি হয়ে গেলেও তোমার কাছে সেই ছোট নিতুই থাকবো। আমাকে কিছু বলতে হলে তোমার কখনো অনুমতি নিতে হবে না। তুমি বলো তো কি বলবে।”

সালেহা বেগম আস্তে আস্তে বলে,”ইয়ে মানে তুই বাসায় কবে যাবি?এক সপ্তাহের বেশি হয়ে গেলো এসেছিস। তৌসিফ সেই যে গেলো আর এলো না।কোন সমস্যা হয়নি তো? মায়ের মন বুঝতে পারছিস নিশ্চই।তোর বাবা থাকলে এতো চিন্তা হয়তো কখনোই হতো না।তোর ফুপিরা তো রেডি হয়ে বসে আছে কোন সমস্যা হলে কথা শোনাতে এক তিল পরিমাণ পিছ পা হবে না।তাই চিন্তা হয় তোদের নিয়ে।ভয় হয়।তোদের নিয়ে কেউ কিছু বলুক এটা আমার সহ্য হবে না।”

নিতুর প্রথমে একটু খারাপ লাগলেও ও মায়ের অস্থিরতার কারন বুঝতে পারে তাই আর মন খারাপ করে না।মায়ের কাঁধে মাথা রেখে বলে,”এইতো মা ২/১দিন পরেই যাবো বাসায়। তোমাকে ছেড়ে একা এই প্রথম এতো দিন থেকেছি। শরীর ও ভালো লাগছিলো না।তাই বাবার অনুমতি নিয়েই এসেছি। তুমি এতো চিন্তা করোনা।”

“জামাই এর সাথে কথা হয়? জামাইকে ফোন করে বল কাল আসতে।”

নিতু একটু দ্বিধা করে বলে,”ঠিক আছে মা বলবো। অনেক রাত হয়েছে এখন তুমি শুয়ে পরো। আমিও ঘুমাতে যাই।”

নিতু ওর রুমে গিয়ে ভাবতে থাকে কীভাবে তৌসিফ কে আসতে বলবে।কি মনে করবে আসতে বললে।নিজ থেকে বাসায় যাওয়ার কথা বলতে চায়না ও তৌসিফ কে। তাছাড়া শেষ দিন রেগে কতো কিছুই না বলেছে ।এখনো রেগে আছে কিনা তার কোন ঠিক আছে? আবার যদি কথা শুনিয়ে দেয়?তাই ঠিক করে ফোন দেবে না।আসতেও বলবে না। সকালে মা’কে একটা কিছু বুঝিয়ে দিলেই হবে।যখন নিজ থেকে নিতে আসবে তখন নাহয় যাবে বাসায়।

তৌসিফ সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময় বিথি, জুঁই দের সাথে দেখা হয়। সবাই ভাইয়ের চেহারার অবস্থা দেখে কপাল কুঁচকে বলে,”ভাই ভাবী মায়ের কাছে গিয়েছে মাত্র এক সপ্তাহ হয়েছে। তুমি দেখি এরই মধ্যে দেবদাস হয়ে গিয়েছো।একি অবস্থা করে রেখেছো নিজের?”

তৌসিফ একটু বিরক্ত হয়।বলে,”বেশি কথা না বলে সামনে থেকে সরে দাড়া।আর আমি ঠিক আছি ‌। কিসের দেবদাস?কার জন্য?”

জুঁই বলে,”ভাইয়া বলছিলাম যে ভাবীকে নিয়ে আসো না। অনেক দিন হয়েছে দেখিনা।কতো ভালো ভাবী। আমরা খুব মিস করছি ভাবীকে।আর তুমিও যে ভাবীর শোকে কাতর সেটা তোমাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে।”

এবার আর রাগ করেনা তৌসিফ।বলে,”দেখি কি করি।ওর বেড়ানো শেষ হোক তারপর নাহয় নিয়ে আসবো।”

ভাইয়ের এতো ঠান্ডা উত্তর ওদের ঠিক হজম হয়না।তাই মিটমিট হাসতে হাসতে ওরা বাসায় চলে যায়।

তৌসিফ বাসায় গিয়ে দেখে বাবা সোফায় বসে আছে।ও নিজের রুমের দিকে যেতে নিলে আকবর আলি ডাক দেয় ছেলেকে।বলে,”রাত এগারোটা বাজে।এতো রাত পর্যন্ত কোথায় ছিলি বাবা? তুই কি কখনোই ঠিক হবিনা? ঘরমুখো হবিনা? সংসার এর দায়িত্ব কবে থেকে নিবি তুই? আমার আর ভাবতে ভালো লাগে না। তোকে নিয়ে ভাবতে ভাবতে আমি দিশেহারা হয়ে যাচ্ছি। আমি মরে গেলে তখন দোকান সামলাতে অনেক হিমশিম খেতে হবে।তাই এখনো সময় আছে আমি বেঁচে থাকতে সব বুঝে নে। আমাকে একটু শান্তি দে।এতো সুন্দর,লক্ষি একটা মেয়েকে তোর বৌ করে এনেছি।ওর জীবনটা নষ্ট হতে দিস না। সংসারে মনোযোগ দে বাবা”

বাবার কথাগুলো তৌসিফ এর বুকে বিঁধে। আজকাল সবাই শুরু করেছে কি? সবাই সুযোগ পেলেই ওকে এতো এতো কথা শোনায়। মায়ের কথা খুব মনে পরে। নিতু কেও খুব মিস করে। ওকে দেখতে মন চায়, ছুঁয়ে দিতে মন চায় কিন্তু সেটা যে সম্ভব নয়।এই মুহূর্তে ওর নরম তুলতুলে শরীরের মাঝে ডুব দিতে খুব ইচ্ছে করছে ওর।এই কদিনে তৌসিফ একটা ব্যাপার খুব ভালো ভাবে বুঝতে পেরেছে। সেটা হলো, নিতু কে ছাড়া ওর চলবে না।জীবনে সুন্দর করে বেঁচে থাকতে হলে নিতুকে প্রয়োজন। মা মারা যাওয়ার পর থেকে নিতুর মতো অন্য কেউ এতো যত্ন করে ওকে কখনো আগলে রাখেনি।এই অল্প কদিনেই মনে হচ্ছে মেয়েটা ওর জীবনের বড় একটা অংশ দখল করে ফেলেছে।

আজ বাবাও কতো কথা বললো। সিগারেট ধরিয়ে বারান্দায় গিয়ে বসে পরে।ঘোর অন্ধকার। আকাশ মেঘে ঢাকা। মনে হচ্ছে বৃষ্টি নামবে। উদাস মনে বসে ভাবে আর সম্ভব না। কালকেই বাবাকে বলে নিতু কে নিয়ে আসবে।

আকবর আলি ছেলেকে খেতে ডাকে। তৌসিফ বলে,”খাবো না বাবা। খিদে নেই।”

আকবর আলি বুঝতে পারে ছেলের ব্যাথা। কড়া কথা ছেলেকে বলতে তার নিজের ও খুব কষ্ট হয়। কিন্তু আর কতো?এখনো দায়িত্ব না নিলে আর কবে নেবে?তাইতো বাধ্য হয়ে আজ তৌসিফ কে এতো কথা বলে।

আকবর আলি ছেলের চেহারা দেখে মনে মনে হাসে।কারন তার এই ছেলে যে বৌ এর জন্য অস্থির হয়ে যাচ্ছে।তাই নিজ থেকেই বলে,”কাল বা পড়শু সময় করে নিতু কে নিয়ে আসিস।যাওয়ার আগে ফোন করে নিস।এখনি আসতে চায় কিনা। নাকি আরো কদিন বেড়াতে চায়।

তৌসিফ কথাটা শুনেই বসা থেকে উঠে বাবার সামনে এসে দাঁড়ায়।বলে,”কাল যাবো তাহলে আনতে?”

তৌসিফ যেনো কারো বলার একটু অপেক্ষায় ছিলো। বাবার বলার সাথে সাথে তাই বেশ আনন্দ হতে লাগলো।আকবর আলি গিয়ে শুয়ে পরে। আর তৌসিফ অপেক্ষা করতে থাকে কখন ভোর হবে।সারারাত তৌসিফ এর আর ঘুম হয়না।এ কেমন যেনো এক অস্থিরতা, ভালো লাগা ।এটা এক নতুন অনুভূতি তৌসিফ এর জন্য। ভোরের দিকে একটু চোখ লেগে আসে ওর।

টিয়া পাখিটাও যেনো আকবর আলির কথা বুঝতে পারে।আর তাই ভোর হতেই নিতু নিতু বলে ডাকা শুরু করে।পাখির এই ডাকেই তৌসিফ এরও ঘুম ভাঙে। উঠে দেখে সকাল নয়টা বেজে গেছে। তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে রেডি হয়ে বের হয়ে যায়। তৌসিফ এর তাড়াহুড়ো দেখে আকবর আলি মিটমিট হাসে। তৌসিফ গাড়িতে বসে বসে ঠিক করে এবার নিতু কে বাসায় এনে ওর সাথে অনেক গল্প করবে, ওকে বেড়াতে নিয়ে যাবে, ওকে শপিং করে দেবে। তাহলে নিশ্চই আর এতো এতো অভিযোগ থাকবে না নিতুর।আজ রাস্তায় প্রচুর যানজট।রাস্তা যেনো শেষ হচ্ছেনা। নিতু কে দেখার জন্য অস্থির হয়ে যাচ্ছে তৌসিফ।এই অস্থিরতার নাম কি ভালোবাসা নাকি অন্য কিছু সেটা তৌসিফ এর জানা নেই।

চলবে…..

#সুখের খোঁজে….(পর্ব -১৫)
#মৌমিতা হোসেন

সকালে সেতু, সাজিদ স্কুলে চলে গেলে সালেহা বেগম এসে নিতু কে ঘুম থেকে ডেকে ওঠায়। ঘড়িতে তখন সকাল আটটা বাজে।এই কয়দিন সকালে উঠলেই মা জোর করে আরেকটু ঘুম পারিয়েছে। সেখানে আজ জোর করে টেনে তুলছে। রাতে দেরী করে ঘুমানোর জন্য আজ আর নিতুর ঘুম ভাঙতে চাচ্ছেনা। নিতু তাই হাই তুলতে তুলতে বলে,”মা আজ কি হয়েছে?এতো সকালে ডাকছো কেনো?আরেকটু ঘুমাই?”

“না আজ আর ঘুমাতে হবে না। বাসায় মেহমান আসবে। আমাকে আজ একটু রান্নায় সাহায্য করবি আয়। উঠে আগে ঘরটা একটু গুছিয়ে রাখ। তারপর একটু ফ্রেশ হয়ে পরিপাটি হয়ে আসবি।”সালেহা বেগম কথাগুলো বলে যেতে নিলে নিতু একটু অবাক হয়। ঘড়ির দিকে তাকায়।দেখে মাত্র আটটা বাজে।

মাকে জিজ্ঞেস করে,”হঠাৎ কে আসবে মা?রাতেও তো কিছু বললেনা।”

“সময় হলেই দেখতে পাবি।তোর জন্য সারপ্রাইজ আছে। এখন তাড়াতাড়ি আয়।”বলেই তাড়াহুড়ো করে হেঁটে রান্নাঘরে চলে যায় ।

সালেহা রাতে নিতু কে বললেও ওনার মনে হচ্ছিলো নিতু তৌসিফ কে ফোন দেবে না।তাই মেয়ের সংসার এর শান্তির জন্য রাতেই তিনি আকবর আলি কে ফোন দেন।আকবর আলিও তৌসিফ এর কথা সব খুলে বলেন। দু’জন বুঝতে পারে যে কিছু নিয়ে তৌসিফ আর নিতুর মাঝে হয়তো কোন ঝামেলা হয়েছে তাই সালেহা বেগম জামাই এবং বেয়ান দুজনকেই দাওয়াত করেন। কিন্তু দোকান খোলা।আরো কিছু সমস্যা থাকায় আকবর আলি বলেন যে তিনি যাবেন না। তৌসিফ কে পাঠিয়ে দেবেন।আর তখনই আকবর আলি গিয়ে তৌসিফ কে বলে নিতু কে নিয়ে আসার জন্য।

নিতু অবাক হয় মায়ের আচরণে।রাত পর্যন্ত কারো আসার কথা ছিলো না। হঠাৎ সকালে উঠে শোনে মেহমান আসবে।যাক মা যেহেতু বলেনি তার মানে বলবেও না।আজ ওদের সারপ্রাইজ দেবে।তাই নিতু আর জিজ্ঞেস করার প্রয়োজন অনুভব করলো না।সময় হলেই দেখতে পাবে। সাথে একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ও ফেলছে।কারন মেহমান এর চিন্তায় মা তৌসিফ এর কথা ভুলে গেছে। তৌসিফ কে ফোন করতে হবে না, আসতে বলতে হবে না তাই শান্তি লাগছে। নিতু উঠে বিছানা গুছিয়ে রান্নাঘরে যায় মাকে কাজে সাহায্য করতে। গিয়ে দেখে মা বিশাল রান্নার আয়োজন করছে। মনে হচ্ছে মেয়ে জামাই আসবে। যেহেতু মা কিছু বলবে না তাই আর জানতে চাইনি নিতু। চুপচাপ কাজ করতে থাকে। কিছুক্ষণ পরেই সালেহা জোর করে নিতু কে গোসলে পাঠায়।আর গোসল করে একটা সুন্দর শাড়ি পড়তে বলে। নিতু কিছু না বলে মায়ের কথামতো চলে যায়।

রাস্তায় যানজটে বসে নিতুর কথা ভাবছে তৌসিফ।এমন সময় দেখে ফুটপাতে ছোট একটা বাচ্চা মেয়ে গোলাপ বিক্রি করছে।দুজন অল্প বয়সী ছেলে-মেয়ে পাশ দিয়েই হেঁটে যাচ্ছিলো।দেখে বোঝা যাচ্ছে স্টুডেন্ট । ছেলেটা ছোট্ট মেয়েটার কাছ থেকে কয়েকটা গোলাপ কিনে মেয়েটাকে দেয়। মেয়েটা খুব সুন্দর একটা হাসি দিয়ে ফুলগুলো নেয়।দৃশ্যটা তৌসিফ এর খুব ভালো লাগে। মনে মনে ঠিক করে নিতুর জন্য ফুল কিনে নেবে। পরমুহূর্তেই আবার ভাবে,ফুল নিয়ে গেলে নিতু নেবে তো?এক সময় দেখে মেয়েটা বাসের ভেতর উঠে ফুল বিক্রি করছে। তৌসিফ আর না ভেবে কয়েকটা গোলাপ কিনে নেয়। গোলাপ হাতে নিজেকে দেখতে খুব অস্বস্তি হচ্ছিলো ওর।যানজট ছাড়ে তখনই মেয়েটা তাড়াহুড়ো করে নেমে যায়।বাস চলতে থাকে।প্রায় দু ঘন্টা লাগে নিতুর বাসায় যেতে।বাস থেকে নেমে বাবার কথামতো মিষ্টি, কিছু ফল এগুলো কিনে নেয়। নিতুর জন্য স্পেশাল কিছু কিনতে চায় কিন্তু ও তো নিতুর পছন্দ অপছন্দ কিছুই জানে না। তাই আর কিনতে পারেনা।

বাসার সামনে এসে কেমন জানি অস্থির লাগছে আজ।আগে কখনো এমন লাগেনি তো। নিতু কে দেখবে এক সপ্তাহ পরে তাই বেশ ভালো লাগছিলো। তৌসিফ কলিং বেল চেপে দাঁড়িয়ে থাকে।

নিতু গোসল করে গোলাপী রং এর একটা শাড়ি পরে। মাত্রই গোসল করে বের হয়ে চুল মুছতে নিয়েছে।এর মধ্যেই তৌসিফ কলিং বেল বাজালে সালেহা জোরে নিতু কে ডাকে।বলে,”নিতু কে এসেছে দেখতো মা। আমি রান্না ঘরে ব্যস্ত।”

নিতু তোয়ালে হাতেই তাড়াতাড়ি দরজা খুলতে যায় আর বলে,”হ্যা মা দেখছি আমি। অস্থির হইওনা তো।”

দরজা খুলতেই তৌসিফ কে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে হাত থেকে তোয়ালে নিচে পরে যায়। খোঁচা খোঁচা দাড়ি, উসকোখুসকো চুল, ঘামে ভেজা শার্ট সব মিলিয়ে কেমন রুগ্ন লাগছে তৌসিফ কে। দু’জন দু’জনের দিকে তাকিয়ে থাকে কিছু সময়।এরই মধ্যে নিতুর মা শাড়ির আঁচল মাথায় দিয়ে বলে,”কে এসেছেরে নিতু?”

নিতুর ধ্যান ভাঙে। তাড়াতাড়ি তোয়ালে ওঠায় নিচ থেকে। দরজা থেকে সরে দাঁড়ায়।মায়ের দিক অবাক হয়ে তাকায়। সালেহা মেয়েকে এড়িয়ে তৌসিফ এর দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে বলে,”কেমন আছো বাবা? ভেতরে আসো।”

তৌসিফ শ্বাশুড়ির দিকে তাকিয়ে সালাম দেয়।বলে,”এইতো ভালো আছি। আপনি কেমন আছেন?”

“আলহামদুলিল্লাহ ভালো।তা তোমার চেহারার এই অবস্থা কেনো? শরীর খারাপ করেছে নাকি? তাড়াতাড়ি ভেতরে এসে ফ্যানের নিচে বসো।”বলেই তাড়াতাড়ি নিতু কে বলতে যাবে এরই মধ্যে দেখে নিতু জামাই এর জন্য সরবত বানাতে গেছে। সালেহা এটা দেখে বেশ খুশী হয়।

নিতু সরবত দিলে তৌসিফ খায়।আর নিতুর দিকে তাকিয়ে দেখতেই থাকে। মনে হচ্ছে অনেক দিন পর দেখছে এই তুলতুলে নরম বৌটাকে।মাত্র গোসল করে আসা গোলাপি শাড়ি পড়া তার এই বৌকে কতোই না স্নিগ্ধ লাগছে দেখতে। শুধু দেখতেই ইচ্ছে করছে।

আর নিতু দেখছে এলোমেলো তৌসিফ কে।ও ভাবছে,”কি হয়েছে মানুষ টার?এমন অসুস্থ লাগছে কেনো দেখতে?কোই রাহেলা খালাতো একবার ও বলেনি যে তৌসিফ অসুস্থ।ওর ব্যবহার এর জন্য ওকে অপছন্দ করলেও প্রথম যেদিন দেখে সেদিন থেকেই তো নিতু তৌসিফ কে একটু একটু করে পছন্দ করেছিলো। সেই ভালোবাসা যদিও আবার হারিয়ে গিয়েছিল তবে একেবারে বিলীন তো হয়ে যায়নি।এতো দিন পর তাই এই রাগি মানুষ এর এই অবস্থা দেখে খুব খারাপ লাগছে।কেনো ওনার এই অবস্থা সেটা অবশ্য নিতুর বোধগম্য হয়না।”দু’জন দু’জনের দিকে তাকিয়ে ভাবনায় যখন ব্যস্ত সালেহা বেগম তখন ওদের দেখে মিটমিট হেসে তৌসিফ এর আনা মিষ্টি,ফল এগুলো নিয়ে রান্নাঘরে যায়।আর নিতু কে বলে,”দাঁড়িয়ে আছিস কেনো? জামাইকে নিয়ে ঘরে যা। গরমে এতোটা পথ এসে ওর নাজেহাল অবস্থা।ফ্রেশ হয়ে রেস্ট নেক।”

নিতু মায়ের কথায় মাথা নেড়ে সায় দেয়। তৌসিফ কে বলে,”রুমে আসুন।”শাড়ির আঁচল টেনে সামনে এনে ও ধীরপায়ে হেঁটে রুমে যায়। হঠাৎ এভাবে কিছু না বলে,না জানিয়ে এখানে আসার মান কি সেটা নিতু বুঝতে পারছেনা।আর মানুষ টাকে কেমন বিদ্ধস্ত লাগছে দেখেই বুকের ভেতর কেমন যেনো কষ্ট লাগছে। নিতু সোজা বারান্দায় গিয়ে তোয়ালে নেড়ে দিয়ে ঘরে ঢোকে।

তৌসিফ ওর আনা গোলাপ নিয়ে নিতুর পেছনে পেছনে হেঁটে নিতুর রুমে আসে।নিতু বারান্দা থেকে ঘরে ঢুকতেই ওর সামনে গিয়ে দাড়ায়। নিতু একটু অপ্রস্তুত হয়ে পাশে কাটিয়ে চলে যেতে নিলেই তৌসিফ ওর হাত ধরে। নিতু কে টেনে সামনে এনে দাড় করিয়ে মৃদু স্বরে বলে,”কেমন আছো?এতোদিন পরে আসলাম তবুও এড়িয়ে যাচ্ছো?”

নিতুর হাত ধরতেই ওর ভেতরে অস্থিরতা শুরু হয়ে যায়। মিনমিনে গলায় বলে,”ভালো আছি। আমি আপনার জন্য তোয়ালে বের করে আনি। মানে…তোয়ালে আনতে যাচ্ছিলাম । আপনাকে অনেক ক্লান্ত লাগছে।গোসল করে আসলে ভালো লাগবে।তাই…”

“তোমাকে কিছুক্ষণ দেখি? তোমাকে দেখলেই আমার অর্ধেক ক্লান্তি দূর হয়ে যাবে।আর এই ফুলগুলো তোমার জন্য। একটা ছোট মেয়ের কাছ থেকে কিনেছি। ইচ্ছে হলো তোমার জন্য আনতে তাই নিয়ে এলাম।”নিতুর কথা থামিয়ে দিয়ে কথাগুলো বলে তৌসিফ ওর দিকে তাকিয়ে আছে।

তৌসিফ এতো কাছে এসে কথা বলায় এমনি নিতুর ভেতরে অস্থিরতা বেড়ে যাচ্ছিলো এমন সময় আবার তৌসিফ এর অদ্ভুত কথা ,ফুল দেয়া সবই যেনো কেমন লাগছে ওর।এতো ঠান্ডা,কোমল স্বর, এতো আকুতি মেশানো আবদার কোন কিছুই ওর বোধগম্য হচ্ছিলো না। তাই ফুলগুলো হাতে নিয়ে এক ঝটকায় হাত ছাড়িয়ে নিতু দুরে সরে দাঁড়ায়। দৌড়ে আলমারি থেকে নতুন তোয়ালে বের করে দিয়ে বাইরে যাবে এমন সময় সালেহা রুমে ঢোকে। তৌসিফ এর কাছে গিয়ে বলে,”বাবা এগুলো তোমার বাবার পাঞ্জাবি -পায়জামা। তোমার হাতে কোন ব্যাগ দেখলাম না।মনে হয় তুমি কোন কাপড় আনোনি।তাই এগুলো নিয়ে এলাম।গোসল করে আপাতত নাহয় এগুলো পরো।”

সালেহা বেগম কাপড়গুলো রেখে যাওয়ার সময় নিতুও সুযোগ পেয়ে মায়ের পেছনে চলে যায়।

নিতুর দৌড়ে চলে যাওয়া, শ্বাশুড়ি মায়ের রুমে চলে আসা সব এতো দ্রুত হয় যে তৌসিফ নিতু কে আর কিছু বলার সুযোগ পায়না ।মনে মনে দীর্ঘশ্বাস ফেলে।ভাবে,”মেয়েটা কি সব সময়ই এমন ছোটাছুটি করবে?যখনই ধরতে যায় তখনই শুরু হয় ছোটাছুটি।তবুও ওকে দেখতে পেরে শান্তি লাগছে।মনে হচ্ছে মরুভূমির মাঝে যেনো এক পশলা বৃষ্টি নামলো আজ। তবে কি বন্ধুদের কথাই ঠিক?মনে সত্যিকার এর প্রেম এসেছে? শেষমেষ বিয়ের পরে বৌ এর প্রেমেই কি তাহলে পরে গেলো?প্রেম হোক আর যাই হোক নিতু কে দেখে আমি মানসিক শান্তি পাচ্ছি। অবশেষে নিতুর মাঝেই যেনো সুখ খুঁজে পাচ্ছি।”মুচকি হাসে তৌসিফ।আর তোয়ালে হাতে নিয়ে ফ্রেশ হতে চলে ওয়াশরুমে।

নিতু মায়ের সাথে রান্নাঘরে গিয়ে কাজে সাহায্য করতে নেয়। তৌসিফ এর জন্য মিষ্টি,পিঠা সহ আরো কিছু খাবার ট্রেতে সাজিয়ে দিয়ে নিতু কে নিয়ে যেতে বলে। নিতু মায়ের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে,”সত্যি করে বলোতো মা আজ কারা আসবে।কার জন্য সকাল থেকে এতো আয়োজন?”

নিতুর মা খুব স্বাভাবিক ভাবেই বলে,”কার জন্য আবার? জামাই এর জন্য।আর অন্য কে আসবে?কাল রাতেই তো তোকে বললাম তৌসিফ কে আসতে বলতে।”

নিতু থতোমতো খেয়ে বলে,”ও হ্যা মনেই তো নেই যে তুমি আসতে বলতে বলেছিলে।”

“বুঝেছি।আর মিনমিন করতে হবে না ।এখন যাতো জামাইকে নাস্তা দিয়ে আয়। দুপুরের খাবার খেতে এখনো দেরি আছে।দেখে মনে হচ্ছে না সকালে তেমন কিছু খেয়েছে।নাস্তা নিয়ে যা। আমি চা নিয়ে আসছি। সাজিদ,সেতুর ও আসার সময় হয়ে গেছে।তুই তাড়াতাড়ি যা।আর দেখ কিছু লাগবে কিনা।”

“হুম যাচ্ছি মা।”বলে শাড়ির আঁচল সামনে এনে ঠিক করে ট্রে হাতে রুমের দিকে যায়।

চলবে….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে