সুখের খোঁজে পর্ব-১১

0
615

#সুখের খোঁজে….(পর্ব -১১)
#মৌমিতা হোসেন

নিতুর এমন আচরণে তৌসিফ প্রচন্ড বিরক্ত হয়।ভাবে সব সময় এমন করার মানে কি?আজ নিতু কে একটা শিক্ষা দেবেই।এর মধ্যেই নিতু বের হলে গিয়ে ওর সামনে পথ আটকে দাঁড়ায়। নিতু দুর্বল চোখে তাকায় তৌসিফ এর দিকে। তখনি ওর কাঁধে শক্ত করে ধরে ঝাঁকিয়ে বলে,”সমস্যা কি তোমার? এভাবে চলে যাওয়ার মানে কি?”

নিতু নিস্তেজ কন্ঠে বলে,”আমার ভালো লাগছিলো না।বমি পাচ্ছিলো।তাই…”

নিতু কে আর বলতে দেয়না তৌসিফ। রেগে চিৎকার করে বলে,”মানে কি?যখনি তোর কাছে আসি তখনই বলিস তোর ভালো লাগছে না। তোর তরফ থেকে তেমন আগ্ৰহ আমি দেখিনা কেনো?বিয়ে করে বৌ করে নিয়ে এসেছি তোকে।যখন চাইবো তখন আসবি।অন্য পুরুষ দেখলেই তো মুখে হাসি ফোঁটে।আর আমার সাথে থাকলে তোর বমি পায়?”গাল চেপে ধরে বলতে থাকে তৌসিফ।

নিতু অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে তৌসিফ এর দিকে। কি বলছে এসব !!খুব কাদে,খুব বিরক্ত হয় আজ তৌসিফ এর কথায়।গাল থেকে হাত সরিয়ে রেগে গিয়ে নিতুও আজ বলে ফেলে,”বিয়ে করেছেন তো? তাতে কি হয়েছে? কতোটুকু চেনেন আপনি আমাকে?কি জানেন আমার সম্পর্কে?আর কয়দিন পার হলেই আমাদের বিয়ের এক মাস হবে।এর মধ্যে আমার সাথে একদিন ও দশ মিনিট বসে কথা বলেছেন? জানতে চেয়েছেন আমার কি পছন্দ,কি অপছন্দ? নাকি আপনার সম্পর্কে কিছু জানার সুযোগ দিয়েছেন? আমি এই বাড়িতে এসেছি আপনার ভরসায়। কখনো আমারও যে কিছু দরকার হতে পারে সেসব বিষয়ে জানতে চেয়েছেন?আপনি সারাদিন বাইরে ঘুরে যখন মন চায় তখন বাড়ি ফেরেন।আর এসেই শুরু করেন…… “নিতু কাঁদতে থাকে আর বলতে পারে না।

তৌসিফ নিতুর এতো রাগ দেখে ওর কথা শুনে ঝটকা খায়।চুপ করে শুনতে থাকে ওর কথা।কি উত্তর দেবে বুঝতে পারেনা।

কিছুক্ষণ চুপ থেকে নিতু আবার বলে,”যখন আপনার প্রয়োজন হয় তখন কাছে টেনে নিয়ে আবার পরক্ষনেই ছুড়ে ফেলেন। বিবাহিত জীবন বুঝি এমন হয়?এমন হলে এই জীবন আমার একটুও পছন্দ না। আমার ভালো লাগে না।মা বলেছিলো সব ঠিক হয়ে যাবে। আপনার মন মতো চললেই নাকি আপনিও আমাকে ভালোবাসবেন। কিন্তু মা ভুল বলেছিলো। আপনি তেমন মানুষ নন। খুব জঘন্য আপনি। আমাকে পছন্দ না হলে আপনি কেনো বিয়ে করতে গেলেন? শুধু….. শুধু ঐ সব কাজ করার জন্য?”

কাঁদতে কাঁদতে আবার বলে,”আর আজতো এমন নোংরা ভাষা শোনালেন …..
আপনি আসোলেই একটা খারাপ মানুষ। খুব খারাপ মানুষ।”

“আমি… আমি থাকবো না আপনার সাথে।আর থাকবো না। আমি মায়ের কাছে যাবো। আমাকে মায়ের কাছে দিয়ে আসুন। দয়া করে…… আমাকে মায়ের কাছে দিয়ে আসুন।”হেঁচকি তুলে কাঁদতে কাঁদতে নিতু ধীর পায়ে হেঁটে বাড়ান্দা পর্যন্ত যেতেই জ্ঞান হারায়।

তৌসিফ নিতুর সব কথা চুপচাপ শুনছিলো।কি বলবে বুঝতে পারছিলো না। প্রথমে একটু রাগ হলেও পরে নিতুর কান্না দেখে, কথা শুনে ওর কেনো জানি খুব কষ্ট হতে থাকে।নিতু ঠিকই তো বলেছে এতো দিনের মধ্যে নিতুর সাথে কখনো ও বসে একটু গল্প করেনি, কখনো ভালো-মন্দ জিজ্ঞেস করেনি। কখনো বেড়াতেও নিয়ে যায়নি।নিতুর কোন বিষয়েই তৌসিফ এর জানা নেই। আবার এটাও ঠিক যে নিতু কে দেখলেই ওর কেমন অস্থির লাগতে থাকে।আর যখনি ওকে কাছে টেনে নেয় তখনি আবার নিমিষেই অস্থিরতা কমে যায়।এটার ঠিক কি নাম দেয়া যায় সেটা তৌসিফ জানে না। শুধু বুঝতে পারছে এই কদিনেই এই মেয়েটার প্রতি একটা মায়া জন্মে গেছে।আগেও অনেক মেয়েদের দেখে ভালো লেগেছে, অনেকে ওর পেছনে ও ঘুরেছে কিন্তু নিতুর জন্য ওর যেমনটা লাগে অন্য কারো জন্য এমন অনুভূতি কখনো আসেনি।

এসব ভাবনার মাঝেই নিতু কে পরে যেতে দেখলে তৌসিফ দৌড়ে গিয়ে নিতু কে ধরে। ওকে কোলে করে বিছানায় এনে শুইয়ে দেয়। এতোক্ষণে তৌসিফ খেয়াল করলো জ্বরে নিতুর শরীর পুরে যাচ্ছে। তৌসিফ এর কেমন যেনো অপরাধবোধ হতে থাকে। তাড়াতাড়ি ওয়াশরুম থেকে মগে করে পানি এনে জলপট্টি দিতে নেয়। কিন্তু রুমাল কোথায় পাবে? কোথায় কি আছে তার কোন কিছুই তো তৌসিফ জানে না। অবশেষে ওর নিজের পকেট থেকে রুমাল বের করে জলপট্টি দেয়। কিন্তু জ্বর না কমায় ভয় পেয়ে ওর বাবাকে ডাকে। আকবর আলি বৌ এর প্রতি তৌসিফ এর টান দেখে বেশ খুশী হয়।ঔষধ বের করে খাইয়ে দিতে বলে। কিন্তু নিতু তো বেহুঁশ।তাই অনেক সময় ধরে মাথায় জলপট্টি দেয়। খুব পরখ করে নিতু কে দেখে। অনেকটা সময় ধরে দেখে। দেখতে দেখতে তৌসিফ নিজেও ঘুমিয়ে পরে।

খুব ভোরে নিতুর ঘুম ভাঙে। তাকিয়ে দেখে তৌসিফ বসে হেলান দিয়ে ঘুমাচ্ছে।আর ওর কোলে নিতুর মাথা। নিতু তাড়াতাড়ি উঠতে গেলে দেখে মাথাটা বার হয়ে আছে। মাথায় হাত দিয়ে উঠে বসে। নিতুর উঠে যাওয়ায় তৌসিফ এর ঘুম ভেঙ্গে যায়। বিছানা থেকে নামতে নিলে নিতুর হাত ধরে তৌসিফ জিজ্ঞেস করে,”উঠে যাচ্ছো কেনো? তোমার শরীর খারাপ। শুয়ে থাকো।এখন কেমন লাগছে? মাথা ব্যাথা কমেছে?”

নিস্তেজ চোখে তাকিয়ে হাত ছাড়িয়ে কোন উত্তর না দিয়েই নিতু ধীরপায়ে ঢুলতে ঢুলতে হেঁটে ওয়াসরুমে চলে যায়। তৌসিফ সাহায্য করতে চাইলে নিতু বাধা দেয়।তাই আর জোর করেনা। অপেক্ষা করে নিতুর।

নিতু ফ্রেশ হয়ে বের হয়ে রান্নাঘরে চলে যায়। তৌসিফ ডাকলে শুধু বলে,”নাস্তা খেতে আসুন।”

ভীতু নিতুর এমন মলিন চেহারা দেখে তৌসিফ এর বুকের ভেতর কেমন জানি চাঁপা কষ্ট অনুভূত হয়। তৌসিফ মনে মনে ভাবে নিতুর সাথে কথা বলে স্বাভাবিক হবে।এই ভেবে নাস্তার টেবিলে যায়। কিন্তু গিয়ে ওর বাবার কথা শুনে চমকে যায়।

আকবর আলি বলে,”তৌসিফ বাবা বৌমা আজ মায়ের বাড়িতে যাবে। থাকবে এক মাস।ওর শরীর ভালো না। একটু রেস্ট নিলেই ভালো লাগবে।আর এখানে থাকলে বৌমার রেস্ট হবে না।তাই আর কি। এখন বলো তুমি দিয়ে আসবে নাকি আমি ব্যবস্থা করবো পাঠানোর?”

আসোলে নিতু খাবার রেডি করে শ্বশুর কে ডাকতে যায়। তখন সুযোগ বুঝে বলে যে কিছু দিন মায়ের কাছে থাকতে চায়। মাকে খুব মিস করছে।আকবর আলি বুঝতে পারে যে হয়তো দুজনের মধ্যে কোন সমস্যা হয়েছে। তাছাড়া অনেক দিন হয়েছে নিতু মায়ের কাছে যায়না তাই আর না করেনি। শুধু বলেছে,”যেতে চেয়েছিস যখন যা মা তবে তাড়াতাড়ি চলে আসিস।এই বুড়ো বাবা কিন্তু এখন তোর উপর অনেকটাই নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে।আর জানিস তো আমার ছেলেটা একটু রাগী, সংসারেও অমনোযোগী।এতো দিনেও একদিন দোকানে বসাতে পারিনি। তবে ওর মনটা খারাপ না।কাল রাতে তোর জ্বরের সময় ওর অস্থিরতা আমি দেখেছি।এই অমনোযোগী ছেলেটাই সারারাত জেগে তোর মাথায় জলপট্টি দিয়েছে।দেখে খুব ভালো লেগেছে। আমি বুঝেছি যে আমার ছেলেকে একমাত্র তুই ঠিক রাখতে পারবি।তাই রাগ করে বেশি দিন থাকিস না।”

নিতু শুনে বেশ অবাক হয়।মন খারাপ কিছুটা কমলেও ঠিক করে মায়ের কাছে যাবে আর কিছুদিন থেকেই আসবে। নিতু শ্বশুর কে বলে,”না বাবা বেশি দিন থাকবো না। তাড়াতাড়ি চলে আসবো।”বলে দুজন নাস্তার টেবিলে আসে।আর তখনই তৌসিফ নাস্তা খেতে আসলে আকবর আলি ছেলেকে এই কথা বলে।

এতোক্ষণ যেনো তৌসিফ এক ধ্যানের মধ্যে ছিলো। এভাবে হঠাৎ করে বাবার বাড়ি যাওয়ার মানে কি? তবে যেতে যখন চাচ্ছে তখন এবার আর মানা করা যাবেনা।তাই বললো,”হ্যা বাবা আমি দিয়ে আসবো। তুমি কোন চিন্তা করোনা।”

তৌসিফ ভাবে ওর কথা শুনে নিতু খুশি হবে। কিন্তু নিতু চুপচাপ ওর কাজ করে যাচ্ছে। নাস্তা শেষ হলে সব গুছিয়ে রওনা দেবে তখন তৌসিফ বলে,”আমার এলোমেলো আচরণের জন্য দুঃখিত। বলছি কি তোমার মায়ের কাছে আজ না গেলে হয়না?”

তৌসিফ আরো কিছু বলবে তার আগেই নিতু কেঁদে দেয় আর বলে,”আমাকে যেতে দিন। আমি আপনার কাছে থাকবো না। মায়ের কাছে একটু যেতে চাই। অনেক দিন মাকে দেখিনা। আমার কিছু ভালো লাগছেনা”

তৌসিফ নিতুর কথা শুনে আর কিছু বলতে পারেনা।রেডি হয়ে নিতু কে নিয়ে রওনা দেয়। দুজন পুরোটা পথ কেউ কারো সাথে কোনো কথাই বলেনি। তৌসিফ দু একবার নিতুর দিকে তাকালেও নিতু পুরো সময় বাহিরে তাকিয়ে ছিলো।

সালেহা বেগম বসে সেলাই করছিলেন।এমন সময় কলিংবেল এর আওয়াজ শুনে এসে দরজা খুলে মেয়ে আর জামাই কে দেখে অবাক হয়। এভাবে হঠাৎ কিছু না জানিয়ে আসায় একটু খটকা লাগে।কারন কাল দুপুরেও যখন কথা হয় তখন বলছিলো বেয়াই অসুস্থ। হঠাৎ ওনাকে ফেলে চলে আসার মেয়ে নিতু না। নিতু মাকে দেখেই জড়িয়ে ধরে কেঁদে দেয়। তৌসিফ সালাম জানায়।

সালেহা বলে,”কি ব্যাপার এভাবে হঠাৎ তোমরা? মানে কোন সমস্যা হয়নি তো?”

তৌসিফ সাথে সাথে বলে,”না মা আসোলে নিতুর শরীর ,মন একটু খারাপ। অনেক দিন আপনাদের দেখে না। বাবাও বললো আর ও নিজেও আসতে চাচ্ছিলো তাই বেড়াতে নিয়ে আসলাম। কিছু দিন বেড়ালে ভালো লাগবে ওর।”

সালেহা সবটা শুনে খুশি হলো। দুজনকেই বসতে বলে তাড়াতাড়ি সরবত বানিয়ে নিয়ে আসলো। তৌসিফ কে রুমে যেয়ে ফ্রেশ হতে বললে তৌসিফ বলে,”না মা আমি এখন চলে যাবো। একটু কাজ আছে। আমি নিতু কে রেখে যেতে এসেছিলাম। নিতু তো থাকবেই কিছুদিন।এর মাঝেই আবার আসবো ইনশাআল্লাহ।”

“ওমা এটা কোন কথা হলো? এতো দিন পর এসে খালি মুখে চলে যাবে?না না বাবা বসো। অন্ততঃ এক কাপ চা হলেও খাও।”সালেহা কথাটা বলেই আবার রান্নাঘরে পা বাড়ালো।
নিতু ও মায়ের পেছনে পেছনে চলে যায়।

তৌসিফ বসে বসে সাজিদ আর সেতুর সাথে গল্প করতে থাকে।এর মধ্যেই সালেহা জামাই এর জন্য চা , নাস্তা নিয়ে আসে। তৌসিফ চা খেয়ে চলে যাওয়ার প্রস্তুতি নেয়। সবার কাছ থেকে বিদায় নেয়ার পর নিতুর কাছে আসে। কিন্তু সবার সামনে কি বলবে চিন্তায় পরে যায়। সালেহা মেয়ে জামাইয়ের জড়তা বুঝতে পেরে সাজিদ, সেতুকে নিয়ে অন্য ঘরে চলে যায়। নিতুও পেছন পেছন চলে যেতে নিলে তৌসিফ হাত ধরে দাঁড়াতে বলে। নিতু চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে।

তৌসিফ বলে,”যখন তোমার যেতে মন চাইবে তখন আমাকে ফোন দিও আমি এসে নিয়ে যাবো। তোমার মোবাইলে মিস কল দিয়েছি একটু আগে। ওটা আমার নাম্বার।সেইভ করে রেখো।আর ……আর রাতের ব্যবহার এর জন্য সরি।”

কথাগুলো বলেই হাত ছেড়ে চলে যায় তৌসিফ। নিতু খানিক অবাক হয়। এতো দিনে এই প্রথম এতো নমনীয় হয়ে কথা বললো ও।তারপর আবার ভাবে যাই বলুক না কেনো এসেছে যখন তখন কিছু দিন থেকে তারপর যাবে।রোজ রোজ ওসব কাজ নিতুর ভালো লাগে না। এবার গেলে আবার কবে আসতে পারবে তার ঠিক আছে?আর বাবাতো বললই এক মাস থাকবে তাই চিন্তা নেই।এর মাঝেই মোবাইলে রিং হলে দেখে নতুন একটা নাম্বার দিয়ে ফোন এসেছে। নিতু বুঝতে পারে এটাই হয়তো তৌসিফ এর নাম্বার।তাই ইচ্ছা করে রিসিভ না করে কল কেটে দেয়।

চলবে…..

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে