সুখের খোঁজে পর্ব-০৯

0
636

#সুখের খোঁজে….(পর্ব -৯)
#মৌমিতা হোসেন

বিথি বলে,”অবশ্যই ভাবী।চলো তোমাকে বাসাটা দেখাই।”

নিতু শাড়ির আঁচল মাথায় তুলে দেয়।এরপর বিথির সাথে বের হয়।এই তিনদিন নিতু খাওয়ার ঘর আর ওর নিজের ঘর ছাড়া অন্য কোথাও যায়নি।পুরো বাসা ঘুরে দেখলো। বাসাটা মাঝখানে পার্টিশন দিয়ে আলাদা করা।একপাশে তিনটি রুম,কিচেন, দুটি ওয়াশরুম। তিনটি রুম ভাড়া দেয়া।আর যেই পাশে তৌসিফ থাকে সেই পাশে দুটো বেডরুম,ড্রইংরুম,ছোট ডাইনিং স্পেস,দুটো বাথরুম, একটা বাড়ান্দা আর কিচেন।রুম গুলো বেশ বড় বড় তবে অনেক পুরোনো বিল্ডিং।ফ্লোর পাকা করা।ওয়ালে অনেক জায়গায় শেওলা পড়েছে।সব ঘরই এলোমেলো।সব রুমে পুরোনো ফার্নিচার এ ভরা আর খুব অগোছালো।এর মাঝেই শ্বশুড় বাইরে থেকে এসে নিতু কে দেখে খুশি হয়।ডেকে পাশে বসায়।বলে,”তৌসিফ কোথায়?”

নিতু মাথা নিচু করে বলে,”বাইরে গিয়েছে। কোথায় সেটা জানিনা বাবা ।বলে যায়নি আমাকে।”

“তুমি জিজ্ঞেস করেছো?শোনো বৌমা আজ তোমায় কিছু কথা বলি।মন দিয়ে শুনবে। তোমার শ্বাশুড়ি বেঁচে থাকলে হয়তো তিনি বলতেন। অবশ্য বেঁচে থাকলে হয়তো আজ আমার ছেলেটা এমন হতোইনা।যাই হোক তৌসিফের বয়স যখন দশ বছর তখন ওর মা মারা যায়। মাকে খুব ভালোবাসতো ছেলেটা।ওর মা মারা যাওয়ার পর আমি একা ছেলেকে সামলাতে ব্যর্থ হই।ওর চাচা-চাচি চেষ্টা করেছিলো তবে ওদেরও সংসার আছে।নিজ সংসার ফেলে আমার ছেলের পেছনে পরে থাকার সময় কোথায়।তাই আমি ওদেরকেও দোষ দিতে পারিনা।সবাই বলেছিলো আমাকে বিয়ে করতে কিন্তু সেসব আর আমাকে দিয়ে হয়নি। তোমার শ্বাশুড়ি মা এর জায়গা আমি অন্য কাউকে দিতে পারিনি।আর তৌসিফ মা কে হারিয়ে পড়াশোনায় অমনোযোগী হয়ে যায়।কোনরকম এইচএসসি দেয়ার পর আর আমি আটকে রাখতে পারিনি। বন্ধুদের পাল্লায় পরে ছেলেটা আমার বেপরোয়া হয়ে গেছে। আমার ছেলের মনটা ভালো।ওর একটু যত্নের প্রয়োজন,ভালোবাসার প্রয়োজন। আমার বিশ্বাস তুমি ওকে ঘরমুখো করতে পারবে।দোকানটা যদি অন্তত ঠিকমতো চালায় তাহলেও তোমরা ভালোভাবে চলতে পারবে। নাহলে সমস্যায় পড়বে। আমার সম্বল এটুকুই।”

একটু থেমে আবার বলে,”এটা এখন তোমার সংসার। নিজের মতো করে সব গুছিয়ে নাও। তৌসিফ কে আস্তে আস্তে বুঝিয়ে দোকানে পাঠাও। দায়িত্ব নিতে বলো। আমার কিছু হলে ছেলেটা বিপদে পড়বে। জানিনা তোমাকে কতোটা বোঝাতে পেরেছি। এখন থেকে তৌসিফ এর বাইরে কখন,কোথায় যায় সেসবের হিসেব নেবে। নিজের অধিকার আদায় করে নিতে হয়। এটা মনে রেখো। অনেক কিছু বললাম মা। এবার যাও ফোন করে দেখো ও কোথায় আছে।আর অনেক বেলা হয়েছে খেয়ে নাও তুমি।”

নিতু বলে,”ঠিক আছে বাবা। আমি চেষ্টা করবো আপনার কথা মতো চলার।”

আকবর আলি নিতুর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে চলে যায় ঘরে।তখনি বিথি হাসি দিয়ে বলে,”ভাবি এতো দায়িত্ব তুমি নিতে পারবে তো?যাক এখন ভাইয়াকে ফোন দাও।বলো তাড়াতাড়ি চলে আসতে।”

নিতুর খেয়াল হলো ওর কাছে তো তৌসিফ এর মোবাইল নম্বর নেই।আসলে ওর সাথে তেমন কোন কথাই তো হয়নি।ফোন নম্বর কীভাবে নেবে।তাই বিথিকে বলে,”আমি রুমে গিয়ে ফোন দেবো।এখন বাদ দাও বিথি।”

বিথি বলে,”ঠিক আছে ভাবী।আমি তাহলে এখন যাই। আমার টিচার আসবে।”

বিথি যেতেই নিতু ভাবে তৌসিফ কে ওর কাজের জন্য পছন্দ না হলেও মা আর শ্বশুর আব্বার কথা শুনতে হবে। মেনে নিতেই হবে।তাই চেষ্টা করতে সমস্যা কি। খুব ক্ষুধা পেয়েছে নিতুর। রান্না ঘরে দেখলো রান্না করা আছে।এক বুয়াকে দেখেছিলো রান্না করতে। তিনি হয়তো এই কাজটা সামলান। খেতে নিয়ে এমন রান্না খেতে পারলো না নিতু। বাসায় ওর মা যাই রাধতো খুব ভালো লাগতো।নিতু ও শিখেছে মায়ের কাছ থেকে রান্না। তাই মনে মনে ভাবে কাল থেকে ও নিজেই রান্না করবে।

খেয়ে উঠে ঘরে একবার চোখ বোলালো।শরীর খারাপ লাগলেও ভাবলো ঘরটাকে একটু মানুষের বসবাসযোগ্য করতে হবে।তাই ঘর গোছানো শুরু করে।ঘর গোছাতে গোছাতে সন্ধ্যা পার হয়।তখনো তৌসিফ আসেনা। নিতু ফ্রেশ হয়ে আজ নিজেই রান্না ঘরে গিয়ে চা বানায়।

আকবর আলি নিতুর হাতে চা দেখে বেশ খুশী হয়।দুজন মিলে চা খায়।আকবর আলি ওনার কাজে চলে যায়। নিতু ঘরে এসে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পরে।রাত এগারোটায় ঘুম ভাঙ্গে।তখনো তৌসিফ বাসায় আসেনি। অপেক্ষা করতে করতে বেশ রাত করেই তৌসিফ ঘরে ফেরে। ঘড়িতে তখন বারোটা পার হয়েছে। ঘরে ঢুকে তৌসিফ একটু অবাক হয়।সব গোছানো,টিপটপ। নিতু তৌসিফকে দেখে ওর খাবার গরম করে টেবিলে দিয়ে ডাকতে এলো।এর মধ্যে তৌসিফ ফ্রেশ হয়ে শুয়ে মোবাইল দেখছিলো। নিতু গিয়ে বলে,”খাবার দিয়েছি। খেতে আসুন।”

তৌসিফ মোবাইলের তাকিয়েই উত্তর দেয়,”আমি খেয়ে এসেছি। এখন আর খাবো না। তুমি খাবার ঢেকে রেখে ঘরে আসো। তাড়াতাড়ি আসবে।”

নিতু প্রচন্ড বিরক্ত হয় ওর কথা শুনে। মনে মনে ভাবে ,”লোকটা এমন কেনো?গম্ভির,শক্ত মনের। সুন্দর করে যেনো কোন কথাই বলতে পারেনা।কি করে থাকবো আজীবন এই লোকের সাথে?”

খাবার ঢেকে নিতু ইচ্ছে করেই দেরি করে রুমে এসে দেখে তৌসিফ ঘুমিয়ে পড়েছে। নিতু যেনো প্রান ফিরে পায়।ও কোনভাবেই আজ আর ওসব চাচ্ছিলোনা। জেগে থাকলে বাধাও দিতে পারতো না।তাই মনে মনে বেশ খুশি হয়। চুপচাপ তৌসিফ এর পাশে শুয়ে ঘুমিয়ে পরে। ভোরে তৌসিফ এর গভীর স্পর্শে নিতুর ঘুম ভাঙে। কিন্তু কিছু করার থাকে না।তাই নিতু ও সায় দেয়। তবে মনের দুরত্ব যে একশত ভাগই রয়ে যায়। তৌসিফ আজকেও তার কাজ শেষ করে ঘুমিয়ে পড়ে।

নিতুর অস্বস্তি হয়।ও তৌসিফ কে আগে ভালোভাবে জানতে চায়,চিনতে চায়। তৌসিফ এর পছন্দ,অপছন্দ সব জানতে চায়।মন থেকে ভালোবাসতে চায়। এই ছোট্ট জীবনে যতোটুকু নিতু বুঝেছে তাতে বিয়ে মানে প্রথমে দুটি হৃদয়ের বন্ধন তারপর শরীরের।আর তাই এই চারদিন ধরে তৌসিফ এর ব্যবহারে নিতু বেশ বিরক্ত হচ্ছে।ও খেয়াল করেছে তৌসিফ এর ওর সাথে কথা বলার বা ওকে জানার কোনো আগ্ৰহ নেই। তৌসিফ শুধু সময়মতো এসে তার নিজের প্রয়োজনে নিতু কে কাছে টেনে নিচ্ছে। খারাপ ভাবে বললে ওকে ভোগ করে আবার ছেড়ে দিচ্ছে। এখানে ও কোন ভালোবাসা খুঁজে পাচ্ছেনা।আর তাই নিতুর সব কিছু বিষাক্ত লাগছে বিয়ের পর থেকে।

নিতু সিদ্ধান্ত নেয় ও নিজেই আগ বাড়িয়ে কথা বলবে তৌসিফ এর সাথে। তৌসিফ কে জানার চেষ্টা করবে। ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পরে নিতু।বাড়ান্দায় পাখির ডাকে নিতুর ঘুম ভাঙে।উঠে ফ্রেশ হয়ে ভাবে আজ নিজ হাতে নাস্তা বানাবে।এর মধ্যেই কলিং বেল বাজলে দরজা খুলে দেখে এক মধ্যবয়সী মহিলা।পান খেতে খেতে ভেতরে ঢুকতে নিলে নিতু বাধা দেয়।বলে,”খালা কার কাছে এসেছেন?”

মহিলা হেসে উত্তর দেয়,”বৌমনি উইঠ্যা পড়ছেন? আমি এই বাড়ি কাম করি আট বছর ধইরা।গতো কয়দিন ঝামেলায় ছিলাম তাই আইতে পারি নাই। আরেকটা মাইয়ারে দিয়া গেছিলাম রান্না করোনের জন্য।খুব শখ ছিলো তৌসিফ বাবার বিয়ায় মজা করমু কিন্তু হইলোনা।যাই হউক ঢোকতে দেন।এই কয়দিনে তো দেহন যাইবো ম্যালা কাম জমছে।”

নিতু বুঝতে পারেনি যে এই বাড়ির রান্নার কাজ এই মহিলা করেন।তাই ঢুকতে দিতে চাচ্ছিলোনা।এর মধ্যে আকবর আলি এসে দেখে বলেন,”রাহেলা তুমি অবশেষে আসলে।এমন ঝামেলার মাঝে কি তোমার ছুটি নেয়া ঠিক হয়েছিলো?যাক ভেতরে আসো ।এই আমার বৌমা। তৌসিফ এর বৌ। তোমাকে চেনে না তাই ঢুকতে দিতে চাচ্ছিলোনা। এসে তাড়াতাড়ি নাস্তা বানাও।”

নিতু দরজা ছেড়ে দাঁড়ায়।রাহেলা ভেতরে ঢুকে ঘর গোছানো দেখে অবাক হয়।বলে,”বৌমনি দেখি আইসাই বাসার মানচিত্র পাল্টায় ফালাইছেন। মাশাআল্লাহ।এমন একজন মাইয়া মানুষের খুব দরকার ছিলো এই বাড়িতে।এখন আপনে আপনের সংসার মন মতো সাজায় নেন।”

নিতু বলে,”ঠিক আছে খালা। আমি আপনাকে খালা বলেই ডাকবো।এখন আগে রান্না ঘরে চলেন দু’জন মিলে নাস্তা বানাই।”

রাহেলা খুব খুশি হয়। সবাই তাকে বুয়া বলেই ডাকে।এই প্রথম কেউ খালা বলে এতো সম্মান দিয়ে ডাকছে।তাই নিতু কে অল্প দেখাতেই রাহেলার বেশ পছন্দ হয়।রান্না ঘরে গিয়ে দুজন মিলে মজার নাস্তা বানায়।আজ নিতু ঠিক করে সবাই একসাথে খাবে।তাই তৌসিফ কে ডাকতে যায়। কিন্তু তৌসিফ তখনো গভীর ঘুমে নিমজ্জিত। কয়েকবার ডাকার পরেও না উঠলে যখন জোরে ধাক্কা দেয় তখন তৌসিফ বেশ রেগে যায়। নিতু রাগ দেখে ভয় পায়।সরি বলে আর না ডেকে মন খারাপ করে চলে আসে। শ্বশুর কে নিয়ে নাস্তা করে।আকবর আলি এমন পরিবেশ দেখে খুশিতে কেঁদে দেয়। নিতুর মাথায় হাত বুলিয়ে দোয়া করে দেয়।বলে,”আমার বিশ্বাস তুই পারবি আমার ছেলেটাকে সঠিক পথে আনতে। দোয়া করি মা।”

নিতু শ্বশুর এর কথায়, আদরে খুব খুশি হয়। বাবার জায়গাটা এর মধ্যেই নিতু মনের অজান্তে আকবর আলি কে দিয়ে দিয়েছে। নাস্তা পর্ব শেষ করে নিতু রাহেলা কে নিয়ে ঘর পরিষ্কার করতে নেয়।এমন সময় তৌসিফ এর ডাকে দৌড়ে রুমে যায় নিতু। আগে কখনো তেমন একটা শাড়ি পরেনি নিতু।তাই সামলাতে বেশ ঝামেলা পোহাতে হচ্ছে ওকে। এলোমেলো অবস্থায় নিতু কে দেখে তৌসিফ কিছু সময় ওর দিকে তাকিয়ে থাকে। নিতু নিজেকে সামলে বলে,”আমাকে ডেকেছেন?”

“হুম। কোথায় ছিলে? তোমার এমন অবস্থা কেনো কি করছিলে?”

“জ্বী ঘর পরিষ্কার করছিলাম। আপনাকে নাস্তা দেবো এখন?”

“একটু পরে দিও ।আগে দরজা চাপিয়ে এদিকে এসো। দরকার আছে।”

তৌসিফ নিতু কে ডাকলেই ওর অস্থিরতা বেড়ে যায়।ও ভাবতে থাকে এখন কি আবার তৌসিফ ঐ একই কাজ করবে? ভাবতে ভাবতে লজ্জা ঝেড়ে আস্তে করে বলেই ফেলে ,”এখন কি আবার আপনি ঐ একই কাজ করবেন? মানে আমি তো রান্না ঘরে কাজ করছিলাম। কিছু দরকার পড়লে খালা ডাকবে আমায়।তখন আমাকে না পেলে খারাপ ভাববে।”এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো খুব সাহস করে বলে নিতু।এরপর নিচের দিকে তাকিয়ে থাকে।

তৌসিফ নিতুর কথা শুনে জোরে হেসে দেয়।

চলবে……

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে