সুখের খোঁজে পর্ব-০৫

0
621

#সুখের খোঁজে….(পর্ব -৫)
#মৌমিতা হোসেন।

আসিফ ডাক্তার তৌসিফ এর মেয়েদের প্রতি এমন মনোভাব সম্পর্কে অবগতো ছিলেন না। তিনি আকবর আলি কে যেটুকু
দেখেছেন তাতে তার মনে হয়েছিলো পরিবারটা ভালো।পরে আকবর আলির কাছে ছেলের উচ্ছৃঙ্খল জীবন যাপন এর কথা শুনে প্রথমে আপত্তি জানায়। কিন্তু আকবর আলির অনুরোধে ভাবে যে,মা মরা ছেলে কোন ভালো সংসারি মেয়ে পেলে যদি আড্ডাবাজি ছেড়ে ভালো হয়ে যায় তাহলে ক্ষতি কি। আর নিতু পড়াশোনায় অমনোযোগী হলেও খুব সংসারি লক্ষি মেয়ে।এতে কোন সন্দেহ নেই।এসব ভেবে তিনি আকবর আলি আর তৌসিফ কে নিয়ে একদিন সন্ধ্যায় নিতু দের বাসায় আসার প্রোগ্ৰাম করে। ওদের সাথে তৌসিফ এর দুই চাচা -চাচিও আসার সিদ্ধান্ত নেয়।

ছেলের বাড়ির লোকজন আসবে তাই সকাল থেকেই সালেহা বাজার ,রান্না,ঘর গোছানো সহ সব কাজে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছে। ছেলে একটু কম পড়াশোনা জানলেও নিজেদের ফ্ল্যাট, দোকান আছে।একটাই ছেলে।কোন ঝামেলা নেই।সব মিলিয়ে সালেহার বেশ পছন্দ হয়। তবুও ভাবে যদি কথা বলে ছেলেকে ভালো না লাগে তাহলে না করে দেবে।

এদিকে নিতু পড়ালেখায় আগে অমনোযোগী হলেও বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে পড়ালেখার প্রতি আগ্ৰহ বাড়ে। নিতু মনে মনে ঠিক করে পড়ালেখা করে একটা চাকরি করবে। মায়ের পাশাপাশি সেও তার উপার্জন থেকে সংসারে খরচ করবে। সেতু আর সাজিদ কে অনেক পড়ালেখা করাবে।এতে মায়ের কষ্ট একটু হলেও তো কমাতে পারবে। কিন্তু হঠাৎ করে বিয়ের প্রস্তাব আসায় মনে হচ্ছিলো ওর স্বপ্ন হয়তো আর পুরন হবে না। নিতু সব ভাগ্যের ওপর ছেড়ে দেয়।

নিতুর মা একটা জামদানী শাড়ি বের করে নিতু কে দেয় পড়ার জন্য। নিতু প্রথমে শাড়ি পড়তে না চাইলেও মায়ের জোড়াজুড়িতে রাজি হয়। সবুজ রঙের লাল পাড়ের শাড়িটা নিতুর খুব পছন্দের। কিন্তু নিতু শাড়ি পড়তে পারেনা। সালেহা বেগম নিতু কে শাড়িটা খুব যত্ন করে পড়িয়ে দিয়ে একটু সাজতে বলে রান্নার কাজে চলে যান। নিতু মায়ের কথায় হালকা সাজে।চোখে কাজল, হালকা লিপস্টিক, হাতে কাঁচের চুড়ি,লম্বা চুল খোঁপা করে রাখা এই সাজেই নিতু কে দেখতে বেশ মিষ্টি লাগছিলো।কেউ এভাবে দেখতে আসছে ভেবে নিতুর কেমন জানি অস্বস্তি হচ্ছিলো।

এর মধ্যেই সাজিদ, সেতু দৌড়ে নিতুর রুমে এসে বলে পাত্র চলে এসেছে। সেতু বলে,’আপু ভাইয়া দেখতে বেশ সুন্দর।লম্বা,শ্যামলা একটু নায়ক নায়ক ভাব আছে। তোমার সাথে বেশ মানাবে।’

নিতু ভাই বোনের কথা শুনে একটু লজ্জা পায়। কিন্তু কিছু বলেনা।চুপ থাকে। নিতু মনে মনে দোয়া করে,যে ছেলে দেখতে যেমনি হোক না কেনো চরিত্র যেনো ভালো হয়। চরিত্র ভালো হলেই হলো।এর মাঝেই নিতুর মা আর ডাক্তার চাচার বৌ রুমে আসে নিতু কে পাত্র পক্ষের সামনে নিয়ে যাওয়ার জন্য । সালেহা রুমে এসে মেয়েকে দেখে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে।বলে,’মাশায়াল্লাহ আমার মেয়েটাকে একদম পরীর মতো লাগছে।’

সালেহার নিতুর বাবার কথা খুব করে মনে পড়তে থাকে।কান্না চেপে রেখে নিতু কে নিয়ে ড্রয়িং রুমে আসে। নিতু মাথা নিচু করেই সবাইকে উদ্দেশ্য করে আস্তে সালাম জানায়। তৌসিফ এর চাচিরা নিতুর হাত ধরে তাদের পাশে বসিয়ে বলে,’মাশাআল্লাহ মেয়েতো দেখতে ভারী মিষ্টি।কেমন আছো মা?’

‘জ্বী ভালো আছি।’

চাচির কথায় তৌসিফ চোখ তুলে নিতুর দিকে প্রথমবারের মতো তাকায়। সাধারণ সাজে নিতু কে তৌসিফ এর ভালোই লাগে। তবে আহামরি কিছু না। মোটামুটি আর কি।

আকবর আলির নিতু কে খুব পছন্দ হয়। টুকটাক কথা জিজ্ঞেস করে।এরই মাঝে সালেহা নাস্তা নিয়ে আসে।বাবা না থাকা সত্ত্বেও মেয়ের বাড়ির আয়োজন দেখে তৌসিফ এর বাবা চাচারা বেশ খুশি হয়। তৌসিফ একটু এলোমেলো জীবন-যাপন করলেও বাবাকে সে প্রচন্ড ভালোবাসে।তাই বাবার যেখানে মেয়ে পছন্দ হয়েছে সেখানে তৌসিফ আর না করলো না।

ডাক্তার চাচা আর তৌসিফ এর ছোট চাচা বড়দের অনুমতি নিয়ে তৌসিফ কে নিতুর সাথে আলাদা করে কথা বলতে বলে। কিন্তু যেহেতু তৌসিফ এর বাবার নিতু কে পছন্দ হয়েছে তাই তৌসিফ আর নিতুর সাথে কথা বলার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলো না।আর তাই আলাদা কথা বলার ব্যাপারে অনাগ্রহ প্রকাশ করলো।

এদিকে নিতু প্রথমে এক পলক তৌসিফ কে দেখার পর আর চোখ তুলে তাকায়নি। তবে মনে মনে চাচ্ছিলো যেনো বিয়ের আগে একবার কথা বলার সুযোগ পায়। কিন্তু তৌসিফ যখন এই ব্যাপারে না করে দেয় তখন বেশ অবাক হয়। ভাবে সব ছেলে হয়তো এক নয়।এই ছেলে যেহেতু বাবাকে এতো মান্য করে সেক্ষেত্রে পড়ালেখা কম করলেও ছেলে নিশ্চই ভালো চরিত্রের হবে।

ছেলের বাবা,চাচাদের অমায়িক ব্যবহারে মুগ্ধ হয়ে ঐ রাতেই সালেহা বেগম বিয়ের দিন তারিখ সব ঠিক করে ফেলে। লেনদেন এর প্রসঙ্গ আসলে আকবর আলি এক কথায় না করে দেন।তার একটাই চাওয়া আর সেটা হলো ছেলের জন্য একটা লক্ষি বৌ।যে তার ছেলেকে বাহিরের আড্ডাবাজি আর উচ্ছৃঙ্খল জীবন থেকে ফিরিয়ে এনে সংসারি করতে পারবে। ছেলের বৌ এর কাছে থেকে এটুকুই তার চাওয়া। আকবর আলির কথা শুনে সালেহা আরো বেশি খুশি হয়।কারন এই যুগে এমন শ্বশুর পাওয়াও ভাগ্যের ব্যাপার।নিতুর মা ভাবে ছেলেরা বিয়ের আগে তো একটু এমনি হয়।এটা কোন চিন্তার বিষয় না। বিয়ে হলেই দেখা যাবে সব ঠিক হয়ে গেছে।

তৌসিফ এর বাবার কথা শুনে নিতুও মনে মনে খুশি হয়। বাবাকে খুব মনে পড়ে নিতুর।।আকবর আলি নিতুর মাথায় হাত দিয়ে বলে,’আজ থেকে আমি তোর বাবা।তাই বেয়াই এর কথা মনে করে আর কাঁদবিনা মা। আমার সংসার এর দায়িত্ব নিতে প্রস্তুতি নিতে শুরু কর।’

আকবর আলি তৌসিফ কে ডেকে ছোট একটা বক্স দেয় আর বলে,’বৌ মাকে পড়িয়ে দে।’

তৌসিফ তেমন কিছু না বলে বাবার কথা মতো নিতু কে আংটি পড়িয়ে দিলো। নিতু একটু কেঁপে ওঠে তৌসিফ এর স্পর্শে। পরানোর সাথে সাথেই হাত ছেড়ে উঠে দাড়ায় চলে যাওয়ার জন্য।আসোলে এই সম্পর্কের বাঁধনে তৌসিফ জড়াতেই চাচ্ছেনা। বাইরের জগৎটাই ওর বেশ ভালো লাগে।তাই নিতু কে দেখে একটু ভালো লাগলেও ওর প্রতি তেমন কোন অনুভূতি ওর মনে আসেনি।

তৌসিফ এর হঠাৎ যাওয়ার জন্য তাড়াহুড়ো দেখে নিতু একটু অবাক হলেও বাবার কথা শুনে নিতু আবেগি হয়ে কেঁদে দেয়। সবাইকে সালাম জানায়। অনেক রাতে সবাই খাওয়া দাওয়া শেষ করে বিদায় নেয়।আর পনেরো দিন পরেই বিয়ের তারিখ ঠিক করা হয়।

পরদিন থেকে সালেহার বাসায় কেনাকাটার তোরজোর শুরু হয়। বেশি কিছু না পারলেও যতোটুকু সামর্থ্য আছে সেই অনুযায়ী কি কি দেবে তার লিস্ট করলো। একটা খাট আর আলমারি কিনে পাঠিয়ে দেয়। ছেলের জন্য পোশাক কিনে আর নিতুকে নিজের সোনার চুড়ি দুটো পড়িয়ে দেয়।

এই পনেরো দিনে তৌসিফ একবার এর জন্য নিতু কে ফোন দেয়নি বা দেখা করতে চায়নি।নিতু ভেবেছিলো তৌসিফ হয়তো ওকে ফোন দেবে, কথা বলবে। একটু কথা বললে অনেক কিছুই জানতে পারবে একে অপরের সম্পর্কে। তাহলে নিতু সহজেই ঐ বাড়িতে গিয়ে সবার সাথে মিশতে পারবে। কিন্তু তৌসিফ এর এমন অনাগ্ৰহ দেখে ও কিছুটা চিন্তায় পরে যায়। মনে মনে অবশ্য নিতুর তৌসিফ কে ভালো লাগে। জীবনে প্রথম কোনো ছেলের প্রতি এমন অনুভূতি আসে নিতুর মনে। তবে এই অনুভূতির নামটা ওর ঠিক জানা নেই।

অন্যদিকে তৌসিফ এর বন্ধুরা সবাই বন্ধুর বিয়ে খাবে তাই খুব হৈ হুল্লোড়ে মেতে থাকে। যদিও তৌসিফ খুব একটা খুশি ছিলো না।পরাধীন হতে হবে এই ভেবে বিরক্ত হচ্ছিলো।আর তাই কথা বলারও কোনো আগ্ৰহ ছিলো না। বন্ধুদের বলে,’বিয়ে মানে কি শারীরিক চাহিদা মিটবে,বাচ্চা হবে,বৌ সব সামলাবে।এইতো।এর বাইরে আর কি?’

বন্ধুরা অনেক আজেবাজে গল্প করতে থাকে। সবাই এসব শুনে একসাথে মজা নেয়।এক বন্ধু এর মাঝে বলে,’আমাদের সাথে ভাবির পরিচয় করিয়ে দিবি না?একটু দেখি আমাদের ভাবি দেখতে কেমন।’

তৌসিফ বলে,’দেখার কি আছে?কোন রাজকন্যা নয়।চলে মোটামুটি। বাবার পছন্দ। ঘরে একটা মেয়ে মানুষ লাগবে ঘর সামলাতে।এই মেয়ে এসে ঘর সামলাবে আর প্রয়োজনে প্রয়োজন মেটাবে এর বেশি আর কোন চাহিদা নেই আমার।’

বন্ধুদের দিকে তাকিয়ে চোখ টিপ দিয়ে হাসতে থাকে তৌসিফ। বন্ধুরাও সব হো হো করে হেসে দেয়।এভাবেই পনেরো দিন পার করে তৌসিফ। নিতুর জন্য কোন কিছু কিনতেই বাবার সাথে মার্কেটেও যায়নি ও।সব কিছু ওর বাবাই পছন্দ করে কেনে।

অবশেষে বিয়ের দিন চলে আসে। যেহেতু নিতুদের অবস্থা বেশি ভালো না তাই ঘরোয়া ভাবেই বিয়ের আয়োজন করা হয়।নিতু দের পক্ষ থেকে নিকট কয়েকজন আত্মীয় আর নিতুর কয়েকজন বান্ধবী কে বলা হয়।যদিও নিতুর খালামনি ছাড়া অন্য কেউ আসে না বিয়েতে।ফুপু,চাচা সবাই উল্টো রাগ দেখিয়ে বলে যে আসবে না।তাই সালেহাও আর জোর করে না।

আর তৌসিফ পক্ষ থেকে ওর চাচারা, এলাকার কয়েকজন মুরুব্বি আর ওর বন্ধুদের বলা হয়।

বিয়ের দিন সকাল থেকেই ব্যস্ততা শুরু হয় সালেহার।বাড়িতেই বিয়ের আয়োজন করা হয়।রান্নার জন্য একজন বাবুর্চি নিয়ে আসে। নিতু কে ওর দুই বান্ধবী আর সেতু মিলে একটা পার্লারে নিয়ে যায়। নিতুর অবশ্য এতো ভারী মেকআপ কখনোই পছন্দ ছিলোনা। কিন্তু সবার জোড়াজুড়িতে রাজি হয়।পাশেই একটা পার্লার থেকে সেজে আসতে সন্ধ্যা হয়ে যায়।সালেহা মেয়েকে দেখে কেঁদে দেয়।বলে,’মাশাআল্লাহ।দেখতে দেখতে কতো বড় হয়ে গিয়েছে আমার মেয়েটা। দোয়া করি যেনো সুখে সংসার করতে পারিস।তোর শ্বশুর আর তৌসিফ এর সব কথা মেনে চলবি। মনে রাখিস মা তোর বাবা নেই। নতুন সংসার তার অপরে তৌসিফ এর মা বেঁচে নেই।তাই হয়তো সব তোর মন মতো হবে না।সব হয়তো অগোছালো পাবি।সব গুছিয়ে সুন্দর মতো সংসার করবি। আমার বিশ্বাস তুই কখনো এমন কিছু করবিনা যাতে আমি ওনাদের কাছে ছোট হই। মেয়েদের অনেক কিছু ত্যাগ করতে হয়।এটাই নিয়ম হয়ে এসেছে। আশা করি আমার কথা বুঝতে পেরেছিস।’

‘আজ তোর বাবা বেঁচে থাকলে হয়তো আমাদের জীবনটা অন্যরকম হতো। আরেকটা কথা বিয়ের পর যদি তৌসিফ চায় তাহলে পড়ালেখা চালিয়ে যাবি নাহলে সংসার ধর্ম পালন করবি। এক্ষেত্রে এখন আর আমার কিছু করার নেই রে।’

নিতু মায়ের কথায় মাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকে। বুকের ভেতর কেমন যেনো খালি খালি লাগতে থাকে। ভাবতে থাকে মেয়েদের জীবনটা সত্যি বড়ই অদ্ভুত। এতো বছরের আপন মানুষদের ছেড়ে আজ অপরিচিত একজনের সাথে তার বাড়ি চলে যেতে হবে।তাদের সবাইকে আপন করে নিতে হবে।চাইলেও আর আগের মতো মায়ের কাছে থাকতে পারবেনা। বাবার কথা খুব মনে পড়তে থাকে….

চলবে ‌……

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে