সাঝের বাতি পর্ব-০২

0
941

#সাঝের_বাতি
#Sajid_Hasan
#পর্ব_২

ঘন শ্বাস নিচ্ছে সিয়াম ভাইয়া।তার চোখে মুখে রাগ স্পষ্ট ।চাঁদের আলোয় পুরো মুখটাই জ্বলজ্বল করছে।চেয়াল খিচে রয়েছেন উনি।কপালের রগগুলো ভেসে উঠেছে।ঠোঁটগুলো হালকা খিচে রয়েছেন।চুলগুলো এলোমেলো ভাবে ছড়িয়ে পরেছে চারিদিকে।সাদা কালারের শার্টটা ভিজে গেছে ঘামে।শার্টের সামনের দুটো বোতামই খোলা।তার চোখমুখ দেখে যে কেউ ভয় পেয়ে যাবে।অদ্ভুত লাগছে আজ।এরকম গোমরাটে রাগ তার কখনোই দেখিনি।বারবার মনে হচ্ছে,এই বুঝি কিছু বলবেন,হয়তোবা আবার অপমান করবে,নয়তো মারবেন!
.. ভাবনার বাধ ভেঙে উঠে দাড়ালেন সিয়াম ভাইয়া।কি যেনো ভেবে অবার ঝুকে পরলেন আমার দিকে।তার অচরনে রিতিমত ভয়ে সকড্ হয়ে আছি।কিছু না ভেবেই চোখমুখ বন্ধ করে নিলাম।

-ভয় পাচ্ছিস?

ভয়ার্ত দৃষ্টি নিয়ে চোখ খুললাম।কিছু বলার সাহস নেই তাই চুপ করে রইলাম।আমার কোনো উওর না পেয়ে চেঁচিয়ে বললেন উনি,

-কি রে কোনো কথা বলছিস না!ভয় পেয়েছিস খুব। তা আগে মনে ছিলো না এরকম করার আগে।প্রতিশোধ! প্রতিশোধ নিতে চেয়েছিলি না তুই।তাহলে ভয় কেনো পাচ্ছিস।

কিছুই বললাম না।কারন,আমাকে যে উনি কখনোই বোঝেনি আর আজও বুঝবেনা এটাই স্বাভাবিক।উনি মনে করছেন এগুলো আমি ইচ্ছে করে করেছি কিন্তু আমি ওই কফিটা ইচ্ছে করে ফেলিনি।
যাইহোক যেভাবেই হোক বুকে সাহস নিয়ে বলতে চাচ্ছিলাম এগুলো আমি করিনি। বলতে গিয়েও কথাগুলো বলতে পরিনি।

-তোদের মতো মিডিলক্লাস ফ্যামিলির চুপ থাকা ছারা কিছুই আশা করা যায় না।দোষ করবি, আবার চুপও থাকবি।চুপ থকে অন্য কোথাও বেচে যেতে পারিস কিন্তু এই সিয়াম এর কাছ থেকে ওত সহজে বাচাঁ যাবে না।আরে তোদের মতো মেয়েদের আমার ভালো করেই জানা আছে!আর তুই আব্বুকে আমার বিরুদ্ধে বিষিয়ে দিয়েছিস তাইনা?

-আপনি আমায় যা বলবেন বলুন কিন্তু আমার পরিবার সম্পর্কে কিছু বলতে পারেন না আপনি।দোষ তো আমি করেছি তাহলে আমার পরিবারকে কেনো টানছেন এখানে?আর মিডিলক্লাস,হ্যা আমরা মিডিলক্লাস! আমাদের আপনাদের মতো গাড়ি বাড়ি টাকা পয়সা কিছুই নেই কিন্ত আমরা আপনার মতো অমানুষ নই।আপনি একবারও বোঝার চেষ্টা করেছেন আমি ইচ্ছে করে করেছি নাকি অনিচ্ছাকৃত করেছি।একবারও বোঝার চেষ্টাটাও করেন নি আপনি।আর আমি চাচ্চুকে কিছুই বলিনি।আপনি কেনো আমায় এতো ভুল বোঝেন? ”

ব্যাস!এতটুকু কথাই তার রাগার জন্য যথেষ্ট। একহাত দিয়ে গাল দুটো টিপে ধরলেন আমার।ঠোঁটের কোনে আঘাত লাগায় ব্যাথাটা দ্বিগুন বেড়ে গেলো।তাই বাধ্যহয়ে আমতাআমতা করে বললাম,

“আহ্ লাগছে!ছাড়ুন সিয়াম ভাইয়া।”

আলতো করে হাতটা ছাড়িয়ে নিলেন উনি।কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেলেন।উঠে গিয়ে সজরে পাশে থাকা টেবিল লাত্থি দিলেন তারপর ধির পায়ে বেড়িয়ে গেলেন।আমি তো অবাক, কিছুই বললোনা।কিভাবে সম্ভব? যাই হোক!চোখে আর ঘুম এলো না। নিজেকে সমানে গালি দিয়ে যাচ্ছি,কেনো আমি একটু দেখে চললাম না।উনিতো এতটা রাগ কখনোই করেনি আমার উপর।আর আমিও তো ইচ্ছে করে করিনি।যদি ওখানে ফুলের টপটা একবার দেখতাম।তাহলে হোঁচট ও খেতে হতো না আর সিয়াম ভাইয়ার শরীরে ওই কোল্ড কফিটাও পরতো না।যদি ছোটবেলার মতো আমাদের সম্পর্কটা হয়ে যেতো….
____________________________________

আমার আর সিয়াম ভাইয়ার সম্পর্কটা মটু-পাটলুর থেকেও গভীর ছিলো।এই গভীর সম্পর্কে যে এতটা খাত ধরবে তা আমি কল্পনাতেও ভাবীনি।ছোটবেলা থেকেই যে মানুষটি সিয়া নামে পাগল ছিলো সে আজ আমায়…
.
আমার যখন নয় বছর বয়স ঠিক তখন বিদেশে পড়াশোনা করার জন্য চলে যায় সিয়াম ভাইয়া। আর তারপর আমাদের আর চাচ্চুর মাঝে সম্পর্ক বিভ্রাট।মূলত দাদুর কিছু ভুলের কারনেই এমনটা হয়েছিলো।অবশ্য এখন সবটা মিটমাট হয়ে গেছে।কিন্তু দূরত্ব বেড়ে গেছে হাজারো মাইল।আগের মতো এখন আমরা একসাথে আর থাকি না।উপরোক্ত ঘটনার পর বাবাকে কখনো দেখিনি একরাত এ বাড়িতে থাকতে। আসে,কিছুক্ষণ বসে,একটু গল্প করে তারপর চলে যায়।কখনো চাচ্চু কিংবা চাচি তাকে আটকাতে পারেনি।বিদেশে থাকা অবস্থায় সিয়াম ভাইয়াকে এসবের কিছুই জানানো হয়নি।সূদীর্ঘ বারো বছর পর যখন ফিরেছিলেন আমাদের বিচ্ছিন্নতার ঘটনা শুনে সিয়াম ভাইয়া সামান্য ভ্রু টাও কোঁচকায়নি।আধুনিকতার ছোঁয়া লেগেছিলো তার গায়ে।আমাদের সাথে ঠিকমতো কথাও বলেননি তিনি।যে সিয়ার নামকরণ পর্যন্ত করেছিলো সে মানুষটি একবাও কথা বলারও চেষ্টা করেনি তার সিয়ার সাথে।ছোটবেলায় বাবার মুখে শুনেছি,

তখন সিয়াম ভাইয়ার বয়স সারে সাত বছর।আমার জন্মের কিছুদিন পর যখন হসপিটাল থেকে বাড়ি ফিরে নিয়ে এসেছিলো আমাদের আমাকে দেখেই সিয়াম ভাইয়া কোলে তুলে নিয়েছিলো।ফটাফট দু চারটে চুমু একে দিয়েছিলো মুখ ভরে।তখন থেকেই একসাথে বড় হওয়া আমাদের।সবসময় একসাথে থাকতাম দুজনে।উনি আমার নামটা তার নামের সাথে মিলিয়ে রেখেছিলেন সিয়া!অনেক ঝামেলা করছে কিন্তু নামের একটি শব্দ ও পাল্টতে দেয়নি।আমায় নাকি চোখের আড়াল হতে দিতেন না উনি।বিদেশ যাওয়ার আগে আমার হাতে একটি সাদা ধবধবে কাচের পাথর দিয়েছিলেন সিয়াম ভাইয়া।আর কান্নাজড়িত কন্ঠে বলেছিলেন,

-এই পাথরটা তোকে এর সূন্দর্যতা দেখে দিচ্ছি না,এটা আমাদের সৃতি হিসেবে দিচ্ছি!ওখান থেকে এসে আমি এটা তোর কাছ থেকে নেবো।যত্ন করে রাখিস।আর নিজের খেয়াল রাখিস!

তার কথায় বুকটা ছিঁড়ে যাচ্ছিলো। নিজেকে যথাসম্ভব আটকাতে চেয়েও পারিনি।চিৎকার করে কেদেঁ উঠি আমি।আমাকে সামাল না দিয়েই পেছন ঘুরে অতিদ্রুত চলে যান উনি।সেদিন সারারাত কেঁদেছিলাম চাচি বাবা কেউই সামলাতে পারেনি আমায়।

পুরো বারোটা বছর নিজের কাছে আগলে রেখেছি সেই পাথরটি।এখনো আছে! তেবে দেখানোর মতো সেই সিয়াম আর সিয়াম নেই।সিয়ার নামে পাগল নন আজ তিনি।বারোটা বছরে যার জন্য অপেক্ষা করলাম সেই আমায় উপেক্ষা করলো!
একদম সুদর্ষন একটি যুবক হয়ে ফিরেছিলেন তিনি।প্রথম দেখাতেই আমার সম্পূর্ণ একটি অচেনা মানুষ মনে হয়েছিলো তাকে।একদম বিদেশি একটি ছেলে।তখনো অবাক হইনি অমি, অবাক তো হয়েছিলাম যখন তিনি আমায় না চেনার ভান করে পাশ কাটিয়ে চলে গিয়েছিলেন। আর সেদিন থেকেই আমার এই প্রচেষ্টা! তবে পরিনি!
:
:
সকালে কারো হাতের ছোঁয়ায় ঘুমটা ভেঙে গেলো।চোখ মেলে তাকাতেই মাকে দেখলাম।মিথ্যা হাসি ঝুলিয়ে রেখেছে।আমার কিছু বলার আগেই মা বললো,

-আমি সবটা শুনেছি!এ নিয়ে মন খারাপ করিস না।আর এতে তোরো তো দোষ আছে।এতো অপমান করার পরও তুই ওর পিছন ছারিস নি।

-সিয়া!

কারো ডাকার আওয়াজে দরজার দিকে তাকালাম।বিষন্ন মুখ নিয়ে তাকিয়ে আছেন চাচি।কোনো রকম রিয়েক্ট করলাম না।চাচির হাতে খাবারের প্লেট।এগিয়ে এসে বললেন,

-আমার কল্পনার ও বাইরে ছিলো যে সিয়াম এরকম করবে।ও যে….

-থাক না চাচি! এতে সিয়াম ভাইয়ার কোনো দোষ নেই। আমারই দেখে চলা উচিত ছিলো।আচ্ছা এসব বাদ দাও কখন এলে তোমরা?

চাচী উত্তর দিলো,

-ভোরে এসেছি! তুই ফ্রেশ হয়ে তারাতাড়ি খেয়ে নে।উঠতে পারবি তো?

চাচির কথায় একটু উঠার চেষ্টা করলাম।একটু পর সার্থক ও হলাম। রাতে ঔষধ খেয়ে এখন একটু বেটার ফিল করছি।ফ্রেশ হয়ে বেড়িয়ে দেখি চাচ্চুও হাজির।সবাই গল্প করছে।ধির পায়ে ওয়াশরুম থেকে বেড়িয়ে বেডে গিয়ে বসতেই চাচ্চু বললেন,

-এখন কেমন আছিস সিয়া?

-হুম…অনেকটা ভালো চাচ্চু!

-নে এবার তারাতাড়ি খাবারটা শেষ কর তারপর তোর ঔষধ আছে।

চাচি কথাটা বললেন।আমি মার দিকে করুন কন্ঠে বললাম,

-মা আমরা কখন বাড়ি যাবো?

কথাটা শুনেই চাচি ও চাচ্চু আমার দিকে তাকালো।তাদের চোখের কোনো ভাষাই আমি পড়তে পারলাম না।কোনো রিয়েক্ট ও করলেন না তারা।

-যাবো তুই একটু সুস্থ হ তারপড় না হয়…

-না মা আর নয়! তোমরা কিছু মনে করো না গো চাচ্চু।আমি এখানে থাকতে চাইছি না। কেমন দমবন্ধ লাগছে আমার।আমি বাড়ি যেতে চাই।

-হুম.যাবি তো নিষ্চয়ই যাবি।কিন্তু তোকে তো আগে সুস্থ হতে হবে।একটু সুস্থ হলেই না হয় তুই চলে যাস।
:
:
:
পরপর দুদিন অসুস্থ শরীর নিয়ে এ বাড়িতে থাকলাম।এখন অনেকটাই সুস্থ আমি।এ দুদিনে একবারও দেখা হয়নি সিয়াম ভাইয়ার সাথে।চলে যাওয়ার আগে চাচ্চু আমায় মাঝেমাঝে এখানে আসতে বলেছে।কিন্তু আমি আর কিসের জন্য আসবো?কি লক্ষ্যে আসবো?সব শেষ!যানিনা এখন আমি কি নিয়ে বাঁচবো!

#চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে