সম্পৃক্ততা পর্ব ১

0
1296

১.
– আচ্ছা ভাইয়া, মানুষের মস্তিষ্ক বিকৃত হয় তাঁর নিজের জন্য, নাকি সমাজের জন্য?

ছোট বোন হঠাৎ প্রশ্নটা করে বসল। তাহমিদ আড়চোখে একবার তাকালো ওর দিকে। প্রশ্নটা সহজ হলেও উত্তরটা সহজ হবে না বোধহয়। বিশেষ করে তাহমিদের ক্ষেত্রে! বিশেষত্ব তাঁর ক্ষেত্রে কারণ; সে মানুষটা খুব সহজ-সরল প্রকৃতির। সহজ-সরল মানুষ আবার চট করে কোনো কঠিন উত্তর দিতে পারে না৷ এটা একান্তই তাঁর মত। সে ব্যতীত, অন্য সবাই এর ভিন্নমত। কিন্তু লোকের ভিন্নমত দেখে তো আর সে নিজেকে ভিন্নভাবে ভাবতে পারে না; তাই সে সবসময় নিজের মতকে গুরুত্ব দিয়ে, নিজেকে সহজ-সরল দাবী করে।

– ভাইয়া, চুপ করে আছো কেন?

ছোট বোনের কথা শুনে তাহমিদ এবার নড়েচড়ে বসল একটু। সামনে থাকা কাঁচের গ্লাসে কিছুটা পানি আছে। গ্লাস হাতে তুলে ঢকঢক করে গিলে ফেলল সেটুকু। তাঁর অভিজ্ঞতা বলে, পানি নষ্ট করা যাবে না। এই অভিজ্ঞতা সে নিজে অর্জন করেছে; বই থেকে। কোনো এক বইয়ে পড়েছিল, ‘অপচয় করা ঠিক না’। এরপর থেকে সে অপচয় করে না। পুরোপুরি ভাবে বিসর্জন দিয়েছে অপচয়ের মতো বাজে একটা অভ্যাসকে। গ্লাসটা আবার আগের জায়গায় রেখে তাহমিদ বোনের দিকে তাকাল। ওর নাম তুলি। এটা ওর আসল নাম নয়। ওর আসল নাম তৃষ্ণা। তাহমিদের বাবা সেসময় সরকারি স্কুলের বাংলা শিক্ষক ছিলেন। ‘বাংলার মাস্টার’ নামে তাঁর বেশ খ্যাতি ছিল গ্রামে। তিনি গ্রাম থেকে ট্রান্সফার হয়ে ঢাকার একটা স্কুলে চাকরি করতেন। ঠিক সেসময় তাহমিদ এর মায়ের কোল আলো করে একটা ফুটফুটে বাচ্চার আগমন হলো। বাবা ছুটি নিয়ে গ্রামে গেলেন। মেয়েকে দেখেই ঝলমলে চোখ করে বললেন,
– আহ্! আমার সোনামণি কী সুন্দর দেখতে হয়েছে! এই ফুটফুটে মুখটা দেখলে যে কারোরই মন জুড়িয়ে যাবে। মনের সব তৃষ্ণা মিটে যাবে।

সেদিনই তাহমিদের বাবা নিজে সবাইকে আদেশ করলেন, ফুটফুটে মেয়েটাকে তৃষ্ণা বলে ডাকতে হবে। সেদিনের সেই ছোট্ট ফুটফুটে তৃষ্ণা আজ বড় হয়ে গেছে। ইন্টার পেরিয়ে অনার্স পড়ছে এখন। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে সেকেন্ড ইয়ারের ছাত্রী সে। তৃষ্ণা নামে একটু ঝামেলা আছে। এই নাম উচ্চারণ করতে তাহমিদের কেমন যেন লাগে। তাই সে বাবার অবাধ্যতা করে, ওকে তৃষ্ণা থেকে তুলি বানিয়ে দিয়েছিল। বাবা রাগ করেছিলেন। তবে কিছু বলেননি। তিনি ট্রান্সফার হয়ে গ্রাম থেকে ঢাকা যেতে পারবেন; আর মেয়ের তৃষ্ণা নামটাকে তুলি নামে ট্রান্সফার করতে পারবে না, এ হয় নাকি! তাহমিদের বাবা-মা অনেক বছর আগেই মারা গেছে। তাঁর গ্রামের বাড়ি চাঁদপুর। বাবা মারা যাওয়ার পরপরই সে শহরে এসেছে। তাঁর বড় ভাই বিয়ে করে, স্ত্রীকে নিয়ে শহরে থাকতো আগে থেকেই। সে ভাইয়ের এখানে চলে এলো। মা মারা যাওয়ার পর ছোট বোনও ঢাকায় চলে এসেছে। এখন সাভারের একটা ফ্লাটে ভাড়া থাকে। ‘মহাকাল’ পত্রিকার রিপোর্টার তাহমিদ। একজন বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারের পত্রিকায় চাকরি করাটা বাড়ি অন্য সদস্যদের কাছে বোধগম্য না হলেও সে নিজে বেশ স্বাচ্ছন্দ্যে কাজ করছে। ওখানে চাকরি করার পিছনে একটা রহস্য আছে। রহস্যটা এখন পর্যন্ত পরিবারের সব সদস্যদের কাছে গোপনীয়। বড় ভাই মাঝে মাঝে রাগারাগি করলেও সে খুব একটা পাত্তা দেয় না। মনেমনে বলে, বাবা নেই, সুযোগ পেয়ে বড় ভাই তো খিটমিট করবেই; করুক না, আমার কী!

তাহমিদ দীর্ঘক্ষণ চুপ থাকার পর সরাসরি তাকালো তুলির দিকে। তুলির চোখে বিন্দুমাত্র বিরক্তির ছাপ নেই। এই বয়সী মেয়েরা খুব কৌতূহলপ্রবন হয়। এই সহজ প্রশ্নের কঠিন উত্তর জানার জন্য ওর মনে যে কৌতূহল তৈরি হয়েছে, তা সাংঘাতিক। ইচ্ছে করেই প্রশ্নের উত্তর দিতে দেরি করছে তাহমিদ। এইরকম একটা প্রশ্নের উত্তর তাঁর জানা নেই। উল্টো পাল্টা বলে তুলিকে অন্তত দমিয়ে দেওয়া যাবে না। বাড়িতে মেধাবী লোকজন থাকলে এই এক ঝামেলা। তুলি নিশ্চয়ই ভাবছে, ভাইয়া উত্তরটা সুন্দর করে সাজিয়ে নিচ্ছে। যাতে সহজ করে ওকে বলতে পারে। সেজন্যই ও উৎসুক জতনার মতো ফ্যালফ্যাল চোখ করে তাকিয়ে আছে ভাইয়ের দিকে। কিন্তু তাহমিদ জানে, সে কেন চুপ করে আছে।
তাহমিদ অনেকক্ষণ চুপচাপ আকাশকুসুম ভাবলেও আর সাতপাঁচ না ভেবে গৌরবের গলায় বলল,
– এটা তো সহজ প্রশ্ন। প্রতিটি মানুষের মস্তিষ্ক বিকৃত হয় তাঁর নিজের জন্য। কথায় আছে না, নিজে ঠিক থাকলে দুনিয়া ঠিক।

তাহমিদের উত্তরে সন্তুষ্ট হলো না তুলি। তা ওর অসন্তুষ্ট মুখখানা দেখেই বুঝা যাচ্ছে। তাহমিদ চিন্তায় পড়ে গেল এবার। না জানি আবার কোন প্রশ্ন করে বসে!
তুলি কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থেকে আবার বলল,
– কিন্তু ভাইয়া, মানুষ তো অন্যের কারণেও খারাপ হয়ে যায়। ব্যাপারটা এইরকম যে, অনেকগুলো অসুস্থ
প্রাণীর মাঝে একটা ভালো প্রাণী এলে, তা বেশিদিন ভালো থাকে না।

– হুম, তাও ঠিক।

মুখ দিয়ে অদ্ভুত একটা শব্দ করে তাহমিদ গম্ভীর কণ্ঠে কথাটা বলল। মিনিট দুয়েক চুপ থেকে আবার বলল,
– তাহলে নিশ্চিত, একজন মানুষ খারাপ হয় সমাজের জন্য। কারণ অসুস্থ সমাজে বসবাস করে একজন সুস্থ মানুষও অসুস্থ হয়ে যায়। এর বাস্তব প্রমাণ আমাদের এলাকাতেই আছে। ওই যে ‘ছোট ভাই’ নামে পরিচিত যে ছেলেটা আছে না, ও তো আগে খুব ভালো ছিল। মেধাবী ছিল। প্রথম প্রথম আমাকে দেখলে সালাম দিয়ে কুশলাদি করতো। এরপর এলাকার বখাটে ‘বড় ভাই’ নামে পরিচিত ছেলেটা সহ ওর দলবলের সাথে মিশে, খারাপ হয়ে গেছে। এখন আমাকে দেখলে বাঁকা চোখে তাকায়। আগে নাম ছিল শিহাব। এখন ‘বড় ভাইয়ের’ ঘনিষ্ঠতা পেয়ে হয়ে গেছে ‘ছোট ভাই’।

এতেও সন্তুষ্ট হলো না তুলি। আগের মনোভাব বজায় রেখে বলল,
– কিন্তু ভাইয়া, অনেকেই আছে, যারা সুস্থ প্রাণীদের সাথে বসবাস করলেও নিজে সুস্থ হয় না, বা হতে চায় না। বরঞ্চ আশেপাশের মানুষজন, অর্থাৎ সমাজের অন্যান্য মানুষদের খারাপ পথে নিয়ে যায়। নানান ধরনের লোভ-লালসা দেখিয়ে ভালো ছেলেদের মন বিষিয়ে দেয়। ওদের মস্তিষ্ক বিকৃত করে দেয়। সুতরাং একজন মানুষের মস্তিষ্ক বিকৃত হওয়ার পিছনে শুধুমাত্র সমাজের দোষ কিংবা ব্যক্তির নিজের দোষ নেই। তৃতীয় কারোর হাত আছে।

তুলির চোখ-মুখে বিশাল চিন্তার ছাপ স্পষ্ট ফুটে উঠেছে। তাহমিদ ফট করে বলে উঠল,
– নিশ্চয়ই এইসব আল্লাহর কারসাজি। তিনি উপর থেকে এইসব করছেন।

তাহমিদের কথা শুনে রেগে গেল তুলি। কিছুটা ধমকে সুরে বলল,
– আরে ধুর! মনে করো, আল্লাহ একটা স্থানে কিছু ভুট্টা ছিটিয়ে দিলেন। ভূট্টাগুলোর মধ্যে কিছু ভালো আছে, এবং কিছু খারাপ আছে। এবার সেখানে কিছু কবুতর ছেড়ে দিলেন। এবার কোন কবুতর ভালো ভুট্টা খাবে, আর কোন কবুতর খারাপ ভুট্টা খাবে, সেটা কবুতরের ব্যপার। এরজন্য আল্লাহকে দোষারোপ করলে তো চলবে না, তাই না? আবার দেখা গেল, অনেকগুলো কবুতর যেখানে জড়ো হয়ে খাবার খাচ্ছে, একটা কবুতরও তীব্র আকাঙ্ক্ষার তাড়নায় পড়ে ওই অনেকগুলো কবুতরের সাথে যোগ দিচ্ছে৷ একটা কবুতর হলো একজন মানুষ, আর অনেকগুলো কবুতর হলো সমাজ। সুতরাং একজন মানুষের মন বিকৃত হয় আড়ালের কারোর ভুল গুটি চালার কারণে।

তাহমিদ আগেই বুঝেছিল, প্রশ্নটা সহজ হলেও উত্তরে ঝামেলা আছে। তাঁর প্রচণ্ড রাগ হলো। আজব মেয়ে! অপশন দিলো দু’টো ; অথচ বলছে আসল অপরাধী এরা না, তৃতীয় কেউ। তাহমিদ বলল,
– তৃতীয় অপশনটা বললেই হতো। আমি দু’টো অপশন পেয়েছি, তাঁর মধ্যে দু’টোরই কিছুটা প্রভাব আছে। তৃতীয় কোনো অপশন থাকলে বল।

তুলি তাড়াহুড়ো কণ্ঠে বলল,
– আপাতত আর নেই। তুমি সঠিক উত্তর দিতে পারবে কি-না বলো।

– এইরকম ঝামেলাময় উত্তর আমি দিতে পারব না এখন। কাল সকালে দিলো। এখন যা।

তুলি মুখ বাঁকা করে ভাইকে টিপ্পনী কেটে বলল,
– তুমি তো ইঞ্জিনিয়ারিং এর স্টুডেন্ট ছিলে। শুনেছি, ইঞ্জিনিয়ারদের সবরকম দক্ষতা থাকে। অথচ তুমি এই সাধারণ একটা প্রশ্নের উত্তর দিতে পারলে না। আরে বাবা, সবকিছু কী আর অপশনের উপর নির্ভর করে? ধরো আমি কোনো অপশনই দিলাম না। তাহলেও এই প্রশ্নের উত্তর তোমার জানা উচিত। কারণ তুমি একজন ইঞ্জিনিয়ার। একাধারে সবকিছু জানা বাধ্যতামূলক তোমার জন্য।

এ-কথা বলে তুলি হনহনিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। তাহমিদকে আর কিছু বলার সুযোগও দিলো না। ব্যাপারটা তাহমিদের খুব গায়ে লাগল। তুলি শুধু তাকে নয়, গোটা একটা ইঞ্জিনিয়ারিং-এর মতো ভূতের বাক্সকে অপমান করলো।

তুলি বেরিয়ে যাওয়ার পর তাহমিদ দরজাটা খপ করে আটকে দিল। জানালা আগে থেকে লাগানো ছিল। এখন বাজে রাত ৯টা। ডিনার শেষ হয়েছে আরও ঘন্টাখানিক আগে। ডিনারের পর যখন তাহমিদ ঘরে এসেছিল, তখনই তুলি হাজির হয়েছিল। এখন চলে গেছে। একটু শান্তি অনুভব করছে তাহমিদ। তাকে আবার একটা কাজ বসতে হবে। মনের কিছু খটকা দূর করতে হবে। তাছাড়াও তুলির প্রশ্নের উত্তর জানতে হবে। এরজন্য একটা নারী চাই। সব সমস্যার সমাধান পুরুষ দিতে পারে না। পুরুষদের জীবনে এমন কিছু সমস্যা থাকে, যার সমাধান নারী ছাড়া আর কেউ করতে পারবে না; পারলেও তা একজন পুরুষের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পায় না। তাহমিদের সমস্যার সমাধান করার জন্য একজন নারী আছে। গভীর রাতে সেই নারীর উপস্থিতি ঘটে। উপস্থিতি ঘটে বলতে, সরাসরি রাতবিরেত ঘরে চলে আসে না; সে তাহমিদকে ফোন দেয় তিন সংখ্যার এক অদ্ভুত নম্বর থেকে! সংখ্যাটা হলো, ‘009’। এই নম্বর থেকে শুধুমাত্র রাতেই ফোন আসে। তাও আবার বিশেষ মুহূর্তে; যখন গভীর রাতে তাহমিদ একা জেগে থাকে। সকালে আর নম্বরটা ফোনে থাকে না। প্রথমবার তাহমিদ ডালায় করে ফোন দিতে গিয়েছিল। কিন্তু রাতের সেই নারীর অসাধারণ কণ্ঠের জায়গায় একটা কর্কশ কণ্ঠের মহিলা বলে, নম্বরটা ঠিক নয়। অর্থাৎ ঝামেলা আছে। সে আবার ঝামেলা পছন্দ করে না। সেজন্য সেই একবারের পর আর কখনো এই নম্বরে ফোন দেওয়ার চেষ্টা করেনি।

২.
সূর্যের আলো চোখে পড়তেই ঘুম ভেঙে গেল তাহমিদের। সিনেমাতে দেখেছে, স্বামী ঘুম থেকে উঠছে না দেখে বউ ডাকাডাকি করছে। একটু পর চিল্লাচিল্লি। তবুও যখন স্বামীর কোনো পাত্তা পাওয়া যায় না, তখন জানালা খুলে দেয়। স্বামীর মুখে এসে পড়ে সূর্যের একফালি রোদ। ঘুমের ১৩টা বেজে যায় তাঁর। চোখ ডলতে ডলতে শোয়া থেকে ওঠে বসে। সামনে তাকিয়ে দেখে, বউ জানালার কাছে দাঁড়িয়ে তোয়ালে দিয়ে চুল মুছছে। কখনো আবার চিরুনি দিয়ে চুল আঁচড়াতে দেখে। শ্যাম্পু করা চুল থেকে অসাধারণ একটা ঘ্রাণ আসে৷ সূর্যের আলো কিছুটা বউয়ের মুখেও এসে পড়ে। তাঁর ফরসা টসটসে গাল দু’টো আলোকসজ্জিত হয়ে কেমন চকচক করতে থাকে। কী অপরূপা মায়াবী দেখায় তাকে! মুড ভালো থাকলে স্বামী বিছানা থেকে নেমে বউকে কাছে টেনে নেয়। এরপর রোমান্স করে কিছুক্ষণ। আর মুড খারাপ থাকলে হয় উল্টোটা। একরাশ বিরক্তি নিয়ে বউকে ঝাড়ি দেয়। এরপর তাঁর হাত থেকে তোয়ালেটা নিয়ে চলে যায় ওয়াশরুমে।
তাহমিদের ক্ষেত্রে অবশ্য এইরকম কিছু হওয়ার সম্ভাবনা নেই। কারণ সে এখনো পিউর সিঙ্গেল। গালফ্রেন্ড ছিল একসময়; এখন নেই। সে এখনো বিয়েসাদী করেনি। হাত দু’টো ছাড়া শরীরে অন্য সব অঙ্গ তাঁর খাটি। কয়েকবার শুধু গালফ্রেন্ড এর হাত ধরেছিল। তাঁর দুই হাত সে নিজের দুই হাতের মুঠোয় নিয়ে, মুখোমুখি দাঁড়িয়ে অনেকটা সময় মেয়েটার চোখের দিকে তাকিয়ে ছিল। এতে অবশ্য তাহমিদের চোখে কিছুটা ভেজাল ঢুকেছে। তাই চোখ দু’টোও পুরোপুরি খাটি নয়। আরও একটা ঘটনা ঘটিয়েছিল তাহমিদ। একবার সে আর তাঁর গালফ্রেন্ড, বাসের পাশাপাশি সিটে বসেছিল। তখন সন্ধ্যা। মেয়েটা অনেকটা ক্লান্ত ছিল বলে ঘুমিয়ে পড়েছিল। বাসে কিছুটা আলো থাকলেও সেভাবে কেউ তাঁদের দিকে তাকিয়ে ছিল না। প্রায় সবাই নিজেদের সিটে বসেছিল। বাসে থাকা লাল-নীল রঙের লাইটের আলোয় পাশের জনকে দেখছিল সে। নিষিদ্ধ জিনিসের প্রতি মানুষের যেমন আকর্ষণ থাকে, তেমন পাশের জনের কমলার মতো ঠোঁট দু’টোর প্রতি তাহমিদের আকর্ষণ হয়েছিল। সুযোগ বুঝে একটা চুমু দিয়ে দিয়েছিল সে। মেয়েটা সেসময় বুঝতে পারেনি। গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন ছিল বোধহয়। ওইরকম একটা জঘন্য অপরাধ তাহমিদ ইচ্ছাকৃতভাবে করেছিল। সেজন্যই পরে ভীষণ অনুশোচনা হচ্ছিল। তবুও মনকে সান্ত্বনা দিয়েছে। নিজেকে খাটি বলে দাবি করেছে। তবে নিজের মনকে এড়িয়ে যেতে পারেনি। মন মাঝে মাঝেই তাকে টিপ্পনী কেটে বলে, শালা, তোর যে শুধু হাতে বা চোখে ভেজাল আছে, তা না। তোর ঠোঁটেও ভেজাল আছে! তুই পর-নারীর ঠোঁটে চুমু দিয়েছিস। হোক সে তোর গালফ্রেন্ড। বিয়ে হওয়ার আগে তো তুই তাকে নিজের বলে দাবি করতে পারিস না।

আড়মোড়া হয়ে বিছানা থেকে নেমে গেল তাহমিদ। দেয়ালে থাকা ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল, ৭টা ১০ বাজে। হাই তুলতে তুলতে প্রথমেই এলো জানালার কাছে। জানালাটা খোলা। রাতে শুধু পর্দাটা টেনে দিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল। শীত চলে গেছে। এখন আর সকালে কুয়াশা পড়ে না। তাই খুব সকালেই সূর্য উঁকি দেয় এই ঘরের জানালা দিয়ে৷ হালকা বাতাসে পর্দাটা সরে গেছিল বিধায় সহজেই সূর্যের আলো ভিতরে প্রবেশ করেছে। তাহমিদ দাঁড়িয়ে থেকে ভোর সকালে উদয় হওয়া সূর্যের মিষ্টি তাপ অনুভব করল। ‘হা’ করে কিছু খেয়েও নিলো। কিন্তু এই খাওয়াতে পেট ভরবে না। সুতরাং তাকে পেটের ক্ষুধা মেটানোর জন্য ঘর থেকে বেরিয়ে ড্রয়িংরুমে থাকা টেবিলের ওখানে যেতে হবে। আরও একটা কারণে ওখানে যেতে হবে তাকে। তুলির করা প্রশ্নের উত্তর সে পেয়ে গেছে। খুব কঠিন একটা উত্তর এখন তাঁর আয়ত্তে। এই উত্তরে কোনো ঝামেলা নেই।

৩.
বরিশালের ছোট্ট একটা গ্রামে হাফিজ উদ্দিনের বসবাস। পেশায় তিনি একজন কৃষক। নিজের বেশ কিছু জায়গাজমি আছে। সেগুলোতেই চাষবাস করেন। দৈনন্দিন জীবিকা নির্বাহের জন্য এই কাজ করেন না; কিছু সঞ্চয়ের জন্য তিনি এ কাজ করেন। একসময় তিন মেয়ে আর স্ত্রী নিয়ে এই গ্রামে বেশ সুখে সাচ্ছন্দ্যে বাস করতেন। বড় মেয়ে বিয়ে করে এখন স্বামীর সাথে ঢাকায় থাকছে। মেঝো মেয়ে স্কুল শিক্ষিকা। সে আপাতত বিয়েটিয়ের ঝামেলায় যেতে চায় না। তবে ছোট মেয়ের বিয়ের কথাবার্তা চলছে। দু’দিন আগেই পাত্রপক্ষ দেখতে এসেছিল। মেয়েকে তাঁদের পছন্দ হয়েছে। অচিরেই বিয়ের তারিখ ঠিক হয়ে যাবে।

এখন সকাল। হাফিজ উদ্দিন পান মুখে দিয়ে মেঝো মেয়ের দিকে তাকালেন। উঠোনে একটা পাটি বিছিয়ে বসেছেন তিনি। সামনে, পান রাখা থেকে শুরু করে পান বানাতে যা যা সরঞ্জাম প্রয়োজন হয়, সে-সব আছে। তিনি আড়চোখে মেয়েকে দেখে সবকিছু আড়াল করলেন। মেঝো মেয়ের নাম আসমা। বয়স আনুমানিক ২৪ অথবা ২৬ হবে। ২৫ হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। কারণ গত পরশু তাঁর স্ত্রী বলেছিলেন, আমাদের বাড়িতে ২৫ বছরের মেয়ে নেই। থাকলে বড্ড ভালো হতো। হাফিজ উদ্দিনের বয়স হয়েছে; অন্যের বয়স তো দূরে থাক, নিজের বয়সও মনে নেই। তবে তিনি নিশ্চিত, এ বাড়িতে ২৫ বছরের কোনো মানুষ নেই। থাকলে তাঁর স্ত্রী হুমাইরা, অবশ্যই জানতো।

পান চিবিয়ে তিনি আরাম করে বসার জন্য পা দু’টো মেলে দিলেন। ভেবেছেন, মেয়ে তাকে পান চিবোতে দেখেনি। এক্ষুনি তো স্কুলে চলে যাবে; আর পিছনে ফিরে দেখবে না, বাবা কী করছে! তাই আপাতত নিশ্চিন্ত। চোখ দু’টো বন্ধ করে পিছনে থাকা তিনটে উঁচু বালিশে হেলান দিলেন। কিছুটা সময় এভাবেই রইলেন। এরপর হঠাৎ ঝুমঝুম করে কিছু আঁছড়ে পড়ার শব্দ হলো। চমকে উঠলেন তিনি। পা দু’টো গুটিয়ে চোখ মেলে তাকালেন। দেখলেন, মেয়ে সামনে দাঁড়িয়ে আছে। চোখ-মুখ দেখে মনে হচ্ছে, কেউ গরম তেলে তাকে ছেড়ে দিয়েছে। আর সে ছ্যাদ করে ফুঁসছে। কিছুক্ষণ পরেই তিনি আরও একটা জিনিস লক্ষ্য করলেন। তাঁর আড়াল করে রাখা পান খাওয়ার সরঞ্জামাদি পাশে নেই; ওগুলো আছে দুয়ারে। তিনি মনেমনে আহত হলেন। মেয়ের দিকে তাকিয়ে করুণ কণ্ঠে বললেন,
– এটার কী কোনো দরকার ছিল?

আসমা আরও রেগে গেল। হাতে থাকা পরিক্ষার খাতা আর নিজের লাল কলমটা স্ব-যত্নে পাটির উপর রাখল। বাবার পাশে বসে ধমক সুরে বলল,
– অবশ্যই দরকার ছিল। আমার আদেশ না শুনলে একশবার এটাই করব।

আসমার সব আদেশ হাফিজ উদ্দিন পালন করলেও একটামাত্র আদেশ কখনোই পালন করেন না। কয়েক বছর আগে ঠিক এভাবেই হাফিজ উদ্দিন পান চিবোচ্ছিলেন। তবে সেসময় ঘরে বিছানার উপর বসেছিলেন। হঠাৎ ঝড়েরবেগে ছুটে এলো আসমা। বাবাকে পান চিবোতে আগেও দেখেছে সে। কোনোদিন কিছু বলেনি। সেদিন কী যেন হয়েছিল তাঁর। নিজের মধ্যে প্রাপ্তবয়স্ক এক সত্তার উপস্থিতি টের পেয়েছিল। রাগে চোখ-মুখ লাল করে বাবাকে বলেছিল,
– মুখ থেকে এই বাজে জিনিসটা ফেলে দাও বাবা।

হাফিজ উদ্দিন ফেলেনি। হেসে উড়িয়ে দিয়েছিল মেয়ের কথা। এতে আসমা আরও রেগে গিয়েছিল। রাগে ফেটে পড়ে, পান খাওয়ার সরঞ্জামাদি সহ ভিতরের সবকিছুই বাইরের দিকে ছুড়ে মেরেছিল। হাফিজ উদ্দিন তো চমকে উঠেছিল মেয়ের কাণ্ড দেখে। কিন্তু কিছু বলার সাহস পায়নি। আসমা আদেশের সুরে বলেছিল, আজকের পর থেকে যেন আর পান স্পর্শ করতে না দেখি তোমায়। এই মুখের পানটাই শেষ। আর জীবনেও যদি পান হাতে নাও, বা এর ঘ্রাণও শুকো, তাহলে তোমার একদিন কী আমার একদিন!
মেয়ে হয়ে বাবাকে আদেশ করছে; ব্যাপারটা হুমাইরার কাছে ভালো না লাগলেও হাফিজ উদ্দিনের কাছে বেশ ভালো লেগেছিল। তাঁর অভিজ্ঞতা বলে, বাবা-মায়েরা বুড়ো হলে শিশু হয়ে যায়। সন্তানের, সন্তান হয়ে যায়। তখন সন্তান বড় হয়ে শিশু বাবা-মাকে আদেশ করে। ভালো ভালো উপদেশ দেয়। উপদেশ না মানলে আদেশ করে। এতে তো খারাপের কিছু নেই।

ঝনঝন শব্দ শুনে আগেই ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছিল হুমাইরা। শুরুতে কিছু বুঝতে না পেরে চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিল। এখন দু’জনের সামান্য কথোপকথন শুনে আর দুয়ারের দিকে তাকিয়ে তিনি বুঝে গেলেন, আসলে ঘটনাটা কী ঘটেছে। দরজার কাছ থেকে বেরিয়ে উঠোনে পা রাখলেন তিনি। মেয়েকে বললেন,
– এইসব কী হচ্ছে? রোজ রোজ তোর বাবা পান কিনে আনছে, আর তুই সেগুলো নষ্ট করছিস। এর দ্বারা টাকা নষ্ট হওয়া ছাড়া আর কোনো ফায়দা হচ্ছে না।

আসমা বাবার দিক থেকে চোখ সরিয়ে মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল,
– তুমি চুপ করো মা। বাবা যখন এইসব কিনে, টাকা তখনই নষ্ট হয়। এরপর যখন সেগুলো গিলে, তখন বাবার জীবন নষ্ট হয়। আমি এইসব ফেলে দিয়ে বাবার জীবন নষ্ট হওয়া রোধ করছি। এগুলো খাওয়া স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর। মেয়ে হিসেবে তো আমি একটা দায়িত্ব পালন করছিই। এবার তোমার উচিত একটা দায়িত্ব পালন করা।

হুমাইরা অবাক হয়ে বলল,
– ওমা! আমি আবার কীসের দায়িত্ব পালন করব? এমনিতেই তো কতশত দায়িত্ব আমার উপর।

আসমা আঙ্গুল তুলে মাকেও আদেশের সুরে বললেন,
– সে হোক। তোমাকে আরও একটা দায়িত্ব পালন করতে হবে।

– কী?

– এখন থেকে, বাবার হাতে একটা টাকাও দেবে না।

হুমাইরা মাথার ঘোমটাটা টেনে নিলেন কিছুটা। বললেন,
– সে খ্যাতে থেকেই সবজি বিক্রি করে। সেই টাকা থেকেই নিজের জন্য পান কিনে। টাকা আমার হাতে টাকা দেওয়া তো দূরে থাক, আমাকে দেখায় না পর্যন্ত।

– শোনো, তোমাকে একটা বুদ্ধি দেই; তুমি তো ওই দোকানদারদের চেনোই। তুমি তাঁদের বলে দিবে, এখন থেকে সবজির দাম যেন বাবার হাতে না দিয়ে তোমার হাতে দেয়। এটাও বলবে, বাবা বয়স্ক মানুষ। ভুলোমন নিয়ে চলতে গিয়ে টাকা হারিয়ে ফেলে। সে হয়তো আবার টাকা চাইবে। কিন্ত আপনারা ভুল করেও তাঁর হাতে টাকা দেবেন না; আমাকে দেবেন।

মেয়ের এইরকম কূ-বুদ্ধি শুনে হাফিজ উদ্দিন নাক ফুলিয়ে তাকালেন। মনে মনে নিজেও কিছু ফন্দি আঁটলেন।
হুমাইরা বেশ খুশিই হলো। এই কাজটা করাই যায়। তিনি মেয়েকে ‘ধন্যবাদ’ দিলেন।
আসমা বলল,
– আমি এখন যাচ্ছি মা। দু’টো টিউশনি আছে আজ। ওদের পাড়িয়ে তাঁরপর স্কুলে যেতে হবে।

হাফিজ উদ্দিন হঠাৎ সোজা হয়ে বসল। গলা খাঁকারি দিয়ে মেয়েকে জিজ্ঞেস করলেন,
– তা আজকাল ওই মাস্টারের সাথে একটু বেশিই মেলামেশা হচ্ছে শুনছি। শোনো, মাস্টারটা সুবিধাজনক না। তুমিই বলো, এই সময়ে এসে ওইরকম একটা তরতাজা যুবক শহরে বড়সড় চাকরি না করে এই গ্রামের একটা সাধারণ স্কুলে মাস্টারগিরি করছে কেন? এর পিছনে একটা কারণ আছে অবশ্যই। ব্যাটার মতলব ভালা না। ওই যুবক মাস্টার গ্রামের স্কুল পড়ুয়া মেয়েদের প্রতি দূর্বল। তাই শহরে না গিয়ে এখানে এই কম পয়সার চাকরি করছে।

আসমা থতমত খেয়ে গেল। বসা থেকে উঠে খাতা আর কলম হাতে নিয়ে হাঁটা দিলো। বাবার আজেবাজে কথা তাঁর সহ্য হচ্ছে না। অত সুন্দর একজন মানুষের মন অসুন্দর হতেই পারে না। কী ভালো করেই না বাচ্চাদের পড়ায়! আসমা সবসময় ছেলে-মেয়েদের মুখে ওই মানুষটার প্রসংশা শুনে এসেছে। মানুষ খারাপ হলে একটা ছেলে বা মেয়ে অন্তত অভিযোগ করতো। কেউ মানুষটার সম্মন্ধে খারাপ কথা বলল না, অথচ তাঁর বাবা মানুষটাকে নিয়ে কীসব বলছে! এগুলো কী সহ্য করা যায়?

আসমা বাড়ি থেকে বেশ কিছুটা দূরে চলে এসেছে। সরু পথ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে সে। কিছুদূর যাওয়ার পরই দেখল, তাঁর প্রিয় মানুষটা দাঁড়িয়ে আছে। মানুষ একেক জনের কাছে একেকরকম ভাবে পরিচিত। তাঁর বাবা মানুষটাকে যুবক মাস্টার বলে। স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে সে প্রিয় শিক্ষক হিসেবে পরিচিত। আর আসমার কাছে মানুষটা, প্রিয় মানুষ হিসেবে পরিচিত। সে মাস্টারের কাছে গেল লাজুক ভঙ্গিতে। বাকি সবার কাছে আসমা মানুষটা অত্যন্ত কঠিন হলেও, এই একটামাত্র মানুষের কাছে সে লাজুক এক নারী। মানুষটা বলে; আসমা, তোমার লাজুক মুখখানা দেখলে আমার বুকে কম্পনের সৃষ্টি হয়৷ আমি চাই, এই কম্পন যেন বারবার হয় আমার বুকে। সেদিন থেকে মানুষটার সামনে গেলে আসমা আরও লাজুক হয়ে পড়ে। ঠোঁটের কোণে সেসময় হাসির রেখা লেগেই থাকে। চোখ মেলে তাকাতে পারে না; লজ্জায়!
আসমা প্রতিদিনের মতোই মাথা নিচু করে মাস্টারের সামনে দিয়ে দাঁড়াল।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে