সন্দেহ পর্ব-২৮+২৯

0
1328

#সন্দেহ
#সৌরভে_সুবাসিনী(moon)
#পর্বঃ ২৮
.
.
অনুর ফুটফুটে ছেলে হয়েছে৷ মায়ের রঙ পেয়েছে । চোখগুলো ঠিক অনুর চোখের মতো।
.
নীল এবং বাকী সবার অস্থিরতা কমেছে। নীল,সাম্যর বাবা দুজনেই আজান দিলেন৷
সীমন্তিনী তো কোল থেকে ছাড়বেই না।
.
সাম্য অস্থির হয়েই দাঁড়িয়ে অটির সামনে।
অনু কে কি করছে? এত সময় লাগে না কি?
অপারেশন করা হয়েছে তাও তো এত সময় লাগে না।
.
সবার মধ্যে চিন্তা ধীরেধীরে বাড়তে লাগলো।
অনুর এ অবধি সাত ব্যাগ ব্লাড লেগেছে।
এতটা দূর্বল? ভয় হচ্ছে এবার। আশাকে বেরিয়ে আসতে দেখে সাম্য এগিয়ে গেলো।
.
– অনু ঠিক আছে? কথা বলছেন না কেনো? কখন বের করা হবে?
– কেবিনে দিয়ে দিচ্ছি কিন্তু….
– কিন্তু?
– মনে হচ্ছে না ভাবী নিজে বাঁচতে চায়। জানেন তো পেশেন্টের মানসিক অবস্থার উপর চিকিৎসা অনেক টা নির্ভর করে। হয়তো….
– যদি এমন টা হয় আগুন জ্বালিয়ে দিবো আপনার হাসপাতালে। মনে রাখবেন.
.
.
অনুকে কেবিনে দেওয়া হয়েছে। এক হাতে ব্লাড অন্য হাতে স্যালাইন চলছে৷ সাম্য পাশে গিয়ে বসতেই খেয়াল করলো অনু প্রচন্ডভাবে কাপছে। শান্নিক উঠলো না কি?
.
দৌড়ে গিয়ে আশা কে ডেকে আনে। আশ্চর্য এই বাজে রকমের গরমেও অনুর কাপুনি কমছে না।সাম্য চলে যেতে নিলে অনু অনু হাত উঁচু করে ওর হাত ধরলো।
স্যালাইন থাকার কারণে একটু ব্লাড এসে গেছে।সাম্য দ্রুত ওর হাত ধরে পাশে বসে অনুর মাথায় হাত রাখতেই অনুর দুচোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়ছিলো। চোখ খুলে অস্পষ্ট স্বরে কিছু বলছিলো।
.
.
.
নিলয়ের সামনে দাউদাউ করে আগুন জ্বলছে৷ হু আগুন। সে অনুর সব কিছু পুড়িয়ে ফেলেছে। এমনকি অনুর মায়ের শাড়িগুলোও।
ওরকম নষ্টার জিনিসপত্র রাখা মানে নিজের ঘর অপবিত্র করা।
.
.
নীলাভ্র মায়ের কাছে গিয়ে জানালো অনুর ছেলে হয়েছে৷ ঠিক নিলয়ের মতো। নীল ছবি পাঠিয়েছে। উনি কেঁদে উঠলেন। কেনো এই মা মরা মেয়ের সাথে এমন করছে তার ছেলেটা? অনু যে পবিত্র সে জানে কিন্তু ছেলের বিরুদ্ধে যেতে পারছে না। ফোন হাতে নিয়ে কয়েকবার চুমু দিলো । ওযু করে এসে দু রাকাত নফল নামাজ পড়ে নিলো।
.
.
অনুর কথাগুলো শুনে সাম্যর মাথায় আগুন জ্বলছে। অনুর হাত ধরে বললো
– তুই কি চাস তুই বল? তুই যদি ওর কাছে ফিরে যেতে চাস তাহলে নিলয় তোকে নিতে বাধ্য। আমি করবো ওকে বাধ্য। আর তুই যদি ফিরতে না চাস তাহলে সে ব্যবস্থা আমি করবো। তোর গায়ে ফুলের টোকা পড়বে না আজ থেকে। আমি সব ঠিক করে দিবো।
কিন্তু প্রমিস কর! মরতে চাইবি না। তোর ছেলে হয়েছে অনু। তোর আহামাদ। তোর অংশ। ওর জন্য বাঁঁচবি। তুই নিজের পরিচয়ে বাঁঁচবি। আমার হতে হবে না তোকে। আমার নাম নিস না তুই আমার কোন আফসোস নেই কিন্তু তুই হেরে যাস না। আমি বাঁচবো না তোর কিছু হলে। প্লিজ বুঝ। না হলি তুই আমার।
তুই তো সে দেবী যাকে ভালোবাসতে হলে স্পর্শ করার প্রয়োজন হয় না।
.
.
– সাম্যদা! আমার ছেলে?
.
সীমন্তিনী ছেলেকে নিয়ে এলো। সাদা তোয়ালে তে প্যাচানো পিচ্চি পুচ্চি ছেলে। ওমা! ক্ষুধা লেগেছে না কি? সাম্য এই প্রথম দেখলো এতক্ষণ তো চিন্তায় মাথায় কাজ করছিলো না। সাম্যর কোলে সীমন্তিনী আগে দিলো।
.
.
– আসসালামু আলাইকুম আহামাদ। কেমন আছো বাবুসোনা তুমি? দীর্ঘ জীবি হও। তোমার মায়ের সেই শক্ত লাঠি, সেই ভিত্তি হও যার জোড়ে সে বেঁচে থাকার সাহস পাবে।
.
.
সাম্যর কথা কি বুঝলো সে কে জানে তবে মুখ দিয়ে শব্দ করে সায় দিচ্ছে।
.
সাম্যর মায়ের দু চোখ ছলছল করে উঠলো। অনুকে এই অবস্থায় দেখতে যে ভালো লাগছে না।
.
-আচ্ছা! ভাইয়া এখন বাহিরে যা। বাবুকে শাল দুধ দেওয়া হয়নি। আর বাহিরে দেখ আয়াখালারা টাকা চাইছে৷ নীল তো নেই মেডিসিন আনতে গেছে। বাবারা নামাজে। একটু দেখ তাদের টাকা…..
.
– আমি পারলে আমার পুরো ব্যাংক ব্যালেন্স দিয়ে দিবো। আজ সব থেকে বড় পাওয়ার দিন। আল্লাহ্ দুহাত ভরে দিয়েছে আমিও যতটা পারবো দিবো।
তার আগে অনু বল কি খাবি?পেট খালি হয়েছে নিশ্চয়ই অনেক ক্ষুধা লেগেছে? যা পেট ছিলো তোর…….
.
সাম্যর মা ছেলের মাথায় হালকা চাটি মেরে বললো
– এখন না।স্যালাইন চলছে পরে রে বাবা। যখন খাবে বাসায় থেকে এনে দিবো। এখন না।
.
.
সাম্য বাহিরে চলে গেলে মামী সাহায্য করে অনুকে বাচ্চাকে ফিডিং করতে৷ এদিকটায় নীল মিষ্টি কিনে এনে পুরো হাসপাতালে দিচ্ছে।
নিলয় কে তারা কি ভুলে গেছে?

.
.
.
মাঝরাতে অনুর ঘুম ভেঙে যায়। কেউ ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে।ভালো ভাবে তাকাতেই অনু ডেকে উঠে
– আম্মো….
– আম্মো সত্যি তুমি? এই আম্মো?
– হ্যাঁ মা আমি। আমার ছোট্ট অনুমনি আজ মা হয়েছে? পুতুলের একটা পুতুল হয়েছে।
জানিস তো মা এখন তুই মা।
.এখন একটা ফুটফুটে বাচ্চার মা তুই। তোকে এখন নিজের আগে বাচ্চার কথা চিন্তা করতে হবে। সমাজ যা বলে বলুক। মা তুই জানিস তুই কতটা পবিত্র। আল্লাহ্ জানে তুই কতটা পবিত্র। কাউকে প্রমাণ করার দরকার নেই। তুই নিজেকে প্রমাণ কর মা৷ পুরুষ মানুষ ছাড়াও মেয়েরা বাঁচে।আবেগে, চিন্তায় এমন কোন সিদ্ধান্ত নিস না যাতে ফুটফুটে প্রাণ টার কোন ক্ষতি হয়৷ আহামাদের খেয়াল রাখিস।আমার সোনা মা। ভালো থাকিস মা। আল্লাহ্ হাফেজ।
.
.
অনুর ঘুম ভেঙে গেছে৷ স্বপ্ন ছিলো। মা এসেছিলো। আম্মো…. এত দিন পর৷ প্রায় চার বছর পর মা কে স্বপ্নে দেখলো। শেষ দেখেছিলো বিয়ের আগের রাতে৷ আবার আজ। আম্মোর কিসের জন্য সতর্কতা দিয়ে গেলো? অনুর কি সামনে খুব বিপদ না কি?
.
.
সকাল গড়িয়ে বিকেল৷ সবাই আসবে একটু পর৷ অফিসে ব্যস্ত। মামি ছিলো এতক্ষণ একটু আগে বেরিয়ে গেলো৷ সাম্য আসছে। অনু সবে চোখ বন্ধ করেছে৷ পাশে আহামাদ ঘুমিয়ে আছে৷
.
.
ইরা- কেমন আছো অনু?
অনু- ভাবী? এসো। হুম ভালো।
ইরা- আমি আসলে ভনিতা বাদ দিয়ে বলে ফেলি, নিলয় নিচে অপেক্ষা করছে এই যে ডিভোর্স লেটার পাঠিয়েছে তুমি সাইন করে দাও।
.
.
চলবে।

#সন্দেহ
#সৌরভে_সুবাসিনী(moon)
#পর্বঃ ২৯
.
.
.
খাবার টেবিলে বসে আছে ইমরুল। সারাদিন আজ বাহিরে ছিলো। একমাত্র বোনের জন্য কোন কষ্টই কষ্ট মনে হয় না।
.
– হ্যাঁ রে ইমু! সারাদিন কই ছিলি?
-মা রাইয়ান এর কাছে গিয়েছিলাম।
– কে তোর উকিল বন্ধু? হঠাৎ ওর কাছে?
– কাল রাতে ইরা কল দিছিলো।তাই দরকারে….
– ক্যান? ইরা ঠিক আছে তো?
– হু।নিলয় না কি ওর বউ কে তালাক দিবো তাই ডিভোর্স লেটার রেডি করতে…..
– ইয়া আল্লাহ্! কি বলিস?
– মেয়েটা ভালো না মা! পেটের বাচ্চা না কি নিলয়ের না নীলের। আগেই সন্দেহ হইছিলো কাল এখান থেকে গিয়ে হাতেনাতে ধরছে।
– না বাবা! এটা মানতে পারলাম না। মেয়েটা কত ভালো আমি জানি । ওমন মেয়ে এত খারাপ কাম করবার পারে না।
– তাহলে কি আর মা? আমার তোমার কথায় তো আর দুনিয়া চলে না।
– হ্যাঁ রে বাবা! সত্যি তালাকনামা বানাইয়া দিছস?
– হু! এত ক্ষণে হয়তো ওরা হাসপাতালে চলেও গেছে। কাল না কি বউ এর ছেলে হইছে।
– আরে কি করছিস? আমাগো জিগাবি না? স্বামী স্ত্রীর মধ্য ভুল বুঝাবুঝি হয় তাই কইয়া তালাক? না না এটা ঠিক না।
– মা! ইরা সব টা জানে। ও জেনে ভুল করবে না । আর ইরার খুশিই সব থেকে বড়।
.
হাত ধুয়ে উঠে গেলো ইমরুল। ওর মা দ্রুত ঘরে গিয়ে নীলাশা কে কল দিচ্ছে। তার ছেলে যে এত বড় কাজ করতে যাচ্ছে তারা জানে তো? এত অন্যায় ধর্মে সইবে না।
.
.
রান্নাঘর থেকে সব শুনলো ইরার ভাবী। সে সব টা জানে। এসব কাজ ইরার করা। আজ যদি কিছু না করে তবে সে নিজেই মুখ দেখাতে পারবে না। নিলয় কে বুঝানোর ক্ষমতা ওর নেই তবে নীলাভ্র ভাই সব টা বুঝবে হয়তো। দ্রুত কল দিলো সে নীলাভ্র কে৷
.
.
.
সাম্য আশা কেবিনের বাহিরে দাঁড়িয়ে।ইরার কথা স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে। ভিতরে গিয়ে দাড়াতেই ইরা উঠে দাড়ালো।
কেনো যেনো এই সাম্য লোক টাকে ইরা বড্ড ভয় পায়৷ সাম্যর হাতে রাখা ফ্ল্যাক্স, ফ্রুট আর টিফিন ক্যারিয়ার ঠিক জায়গায় রেখে ইরার সামনাসামনি হলো।
.
.
– বসুন। মিস ইরা। এবং আপনার কুলাঙ্গার দেবর কে কল দিয়ে আসতে বলুন।
– দেখুন! আমি এখানে বসতে আসিনি। আর নিলয় আসবে না। আসার হলে আগেই আসতো।
– বিয়ের সময় কি আপনি ওর হয়ে এসেছিলেন?
– মানে?
– ওকে আসতে বলুন। যা কথা সামনাসামনি হবে।
.
.
ইরা উপায় না পেয়ে নিলয় কে কল দেয়। এদিকে মোটামুটি সবাই এসেছে।
অনু চুপচাপ বসে আছে। ছেলেকে কোলে নিয়ে। এই দিন নিয়ে কত স্বপ্ন ছিলো ওদের।
.
– বাবু কে আমি আগে কোলে নিবো।
– কেনো? আমার ছেলে আমি নিবো!
– পেটে রাখছি আমি সো আমি নিবো।
-সমস্যা নেই আমি তোমাকে সহ নিবোনি।
– হুহ্।
– আচ্ছা শোন শানসাইন! বাবুকে প্রথম দেখলে না কি কিছু দিতে হয়?
– এমন কোন হাদিস নেই।
– কিন্তু আমি দিবো। আমদের বাবু হওয়ার পর আমি তোমাকে সব থেকে সেরা গিফট টা দিবো।
.
.
হ্যাঁ! নিলয় দিয়েছে সব থেকেই সেরা গিফট। ডিভোর্স লেটার।
..
.
সাম্যদা পেপার টা দাও। আমি সাইন করে দিচ্ছি।
– অনু তুই সিউর? (সীমন্তিনী)
-হ্যাঁ! আমি শিউর শিমুদি। ভাবার কিছু দেখছি না।
– এখন ভাবার অনেক কিছু আছে। তুই একা না এটা ভুলিস না। (মামি)
– আমি জানি আমি একা না। তাই এই সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য। আমি একা সব সহ্য করেছি, অপবাদ,অত্যাচার সব কিন্তু এখন আর না। আমার সন্তানের জন্ম পরিচয় নিয়ে? না আমি মানবো না।
– অনু! তুই বুঝে বলছিস তো? দেখ তুই যদি চাস নিলয় তোর পায়ে ধরে মাফ চাইতে বাধ্য এবং সে বাধ্য আমি করবো। তোকে তোর সম্মান দিয়ে ওর ঘরে রাখবে। আমি কথা দিচ্ছি কিন্তু এটাও বলবো তুই যা চাইবি আমরা তাই করবো। শুধু তোর সুখ আহামাদের কথা চিন্তা করে সিদ্ধান্ত নিস।
.
– সাম্য দা। সম্মান এমন একটা জিনিস যা কান্না কিংবা ভিক্ষা করে পাওয়া যায় না। জোড় করেও না । এটা অনুভূতির বিষয়। যা আপনাআপনি আসবে। আমি আহামাদের কথা চিন্তা করেই সিদ্ধান্ত নিয়েছি । আমি চাই না আমার সন্তান তার ছায়াও সহ্য করুক যে ওর জন্ম নিয়ে সন্দেহ করেছে।
.
.
হাসপাতালে সবাই দাঁড়িয়ে। সবার সামনেই অনু সাইন করে দিলো।
ইরা পেপার দিয়ে চলে যাচ্ছে। আজ তার খুশির দিন। মনে মনে গান বাজছে।
.

.

প্রথম ও যৌবনের কালে যেদিন তোমায় দেখেছি এ দেহো পিঞ্জিরার মাঝে আপন করে রেখেছি।
.
.
কিন্তু ইরা হয়তো চিন্তাও করেনি যে তার ভবিষ্যৎ কতটা ভয়ংকর হতে চলেছে। সে যে সর্বনাসী খেলায় মেতে উঠেছে তার সবটাও যে এই আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যাবে
.
.
এখন সবার মাঝে একটাই প্রশ্ন! কি হতে যাচ্ছে অনু আহামাদের পরের সংগ্রাম? কে নিবে ওর দায়িত্ব?
.
.
নীল সীমন্তিনী কে নিয়ে হাসপাতালের ক্যান্টিনে বসে আছে। সীমন্তিনীর দুচোখ লাল। রক্তাক্ত হচ্ছে সে ভিতরে বাহিরে। আজ এসবের জন্য সে দায়ী। সে চেয়েছিলো অনু ভালো থাকুক।তার ভালো চাওয়া এতটা খারাপ হতে পারে? জানলে সে কখনো এমন করতো। সীমন্তিনীর এক হাতের উপর হাত রাখলো।
-সীমো…. আমি একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি ।যেহেতু তুমিও এর সাথে জড়িয়ে আছো তাই তোমার সম্মতি আমার প্রয়োজন। সীমো আজ আমাদের দুজনের জন্য অনুর এই অবস্থা।মানো না মানো আমরা মেয়েটার সুখের কথা চিন্তা করে ওকে নরকে ঠেলে দিয়েছি। তাই…
– তাই!
– তাই আমি অনু ও আহামাদের দায়িত্ব নিতে চাচ্ছি।
.
.
চলবে…….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে