শ্রাবণ ঝরা মেঘ পর্ব-০৩

0
400

#শ্রাবণ_ঝরা_মেঘ [৩]
#জেরিন_আক্তার_নিপা

🌸
তাশফিন সদর দরজায় পা রাখতেই তারেক চৌধুরীর গমগমে কন্ঠ ভেসে এলো। তারেক চৌধুরী ছেলের আগে বাড়ি ফিরে ছেলের ফেরার অপেক্ষা করছিলেন। বাবার ডাক শুনেও তাশফিন থামল না। গুনগুন করতে করতে নিজের রুমের দিকে হাঁটা ধরল। তারেক চৌধুরী ছেলের এরকম বেপরোয়া আচরণ দেখে হুংকার ছাড়লেন।

-দাঁড়াও। কোথায় যাচ্ছ?”

তাশফিন যেন একটু বিরক্ত হলো। চেহারা থেকে সুখী সুখী ভাবটা কাটিয়ে সেখানে সামান্য বিরক্তি ফুটিয়ে বাবার দিকে ফিরে তাকাল।

-রুমে যাচ্ছি। আর কোথায় যাব?”

ঘন্টা খানেক আগে করে আসা কাজটা কি এই ছেলের মনে নেই? এত বড় একটা অন্যায় করেও এতটা সহজ কীভাবে থাকতে পারছে? তার থেকে বড় কথা এই কাজটা ও কেন করেছে।

-এই কাজটা তুমি কেন করলে?”

বাবা কিসের কথা বলছে সে যেন কিছুই জানে না এমন একটা ভাব নিয়ে বলল,

-কোন কাজ?”

-একটা মেয়েকে বিয়ের আসর থেকে ফেলে চলে এসেছ! কেন? মেয়েটাকে তো তুমিই পছন্দ করেছিলে। বিয়ে করবে না তাহলে এই তামাশাটা কেন করলে?”

তাশফিন ঠোঁটে মৃদু হাসি এনে তাচ্ছিল্যের চোখে বাবার দিকে তাকাল। বাবার আজ হলোটা কি? হঠাৎ ভালো মানুষ হওয়ার শখ জাগলো কেন? মিস্টার চৌধুরীকে ভালো মানুষি রুপে ঠিক মানাচ্ছে না।

-হ্যাঁ মানছি মেয়ে আমিই পছন্দ করেছিলাম। বিয়েও করতাম। কিন্তু এন্ড মোমেন্টে বিয়েটা করতে ইচ্ছে করল না।”

-বিয়ে করতে ইচ্ছে করল না! ইচ্ছে করেনি বলে একটা মেয়ের জীবন তুমি নষ্ট করলে?”

-নষ্ট করলাম কই? বিয়ে করে ছেড়ে দিলে জীবন নষ্ট হতো। এখন তো বিয়ের আগেই ছেড়ে দিয়েছি। বাবা তুমি বেশি ভাবছ। তোমার শুধু শুধু টেনশন নেওয়ার কোন মানে আছে বলো? রুমে যাও না। বড্ড টায়ার্ড লাগছে।”

তারেক চৌধুরীর ছেলের আচরণে কোনকিছু বলার ভাষা খুঁজে পেলেন না। তিনি বললেও অবশ্য ছেলের উপর তেমন কোন প্রভাব পড়বে না। তার রাগকে ভয় পাওয়া এই ছেলে অনেক আগেই ভুলে গেছে। জন্মদাতা পিতার সব কথাই এই ছেলে এখন কৌতুক হিসেবে নেয়। সেখানে তার রাগ বা শাসন করার কোন অর্থই নেই। তাশফিন ফের গুনগুন করতে করতে সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় নিজের রুমে চলে গেল। তারেক চৌধুরী কপালের দু’পাশের শিরা চেপে ধরে হতাশ হয়ে বসে পড়লেন। তার ছেলে আজ একটা মেয়ের জীবন নষ্ট করেছে। বিয়ের আসর থেকে বর চলে আসা একটা মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ের জীবনে অভিশাপ হয়ে দাঁড়াবে। সমাজের মানুষ মেয়েটাকে বাঁচতে দিবে না। কথার তীরে ঝাঁঝরা করে ফেলবে। তাশফিন রুমে এসে লাইট অন করল না। নিজের রুমে অন্ধকারে চোখ বন্ধ করেও সে চলাফেরা করতে পারবে। বেড কোথায় এটা খুঁজতে তার সমস্যা হবে না। তাশফিন অনুমানের উপর তিন পা চলে এসে দু’হাত ছড়িয়ে শরীরের ভার ছেড়ে দিল। এবং ঠিক বেডের মাঝ বরাবর পড়ল। তার অনুমান ভুল হলে বেডের কিনারা বা মেঝেতেও পড়তে পারত। কিন্তু তার অনুমান কোনদিন ভুল হয় না। এই রুমের কোথায় কী আছে সব তার নখদর্পণে। নরম বিছানায় শরীর ছুঁইয়ে তাশফিন পরম সুখে চোখ জোড়া বন্ধ করে নিল। দীর্ঘ দিন পর আজ তার চোখে ঘুমেরা ধরা দিবে।


যে ঝড় এক নিমিষে মৌরির জীবনটা তছনছ করে দিয়ে গেছে, প্রকৃতিতেও সেই ঝড় প্রলয়কাণ্ড চালাচ্ছে। বিয়ে বাড়ির রঙিন আলো এখনও জ্বলছে। কিন্তু যাকে ঘিরে এত সাজসজ্জা আলো তার জীবন থেকেই রঙ মুছে গেছে। এক ঘন্টা আগেও সবকিছু এরকমই ছিল। মেয়ের এত ভালো ভাগ্য দেখে চাচী ফুপুদের মৌরির মা’কে সান্ত্বনা দেওয়া।

-আরে পাগল কাঁদছ কেন? এটা কি তোমার চোখের পানি ফেলার দিন! তোমার মেয়েটার ভাগ্য দেখেছ? কত বড় ঘরে বিয়ে হচ্ছে। মানুষ গুলো কত ভালো। কত বড়লোক তবুও এতটুকু অহংকার নেই। জামাই মা-শা-আল্লাহ রাজপুত্রের মতো দেখতে। চোখের পানি মুছো তো।”

বান্ধবী ও চাচাতো ফুপাতো বোনেরা নানান কথা বলে মৌরিকে খেপানো।

-ভালো ছেলেদের উপর ঠা’ডা পড়া যুগে এমন দুলাভাই তুই কোত্থেকে জুটিয়েছিস মৌরি? সিক্রেটটা আমাদেরও বল। বড়লোক্স হ্যান্ডসাম ছেলের সাপ্লাই তো কবেই বন্ধ হয়ে গেছে। তুই জিতেছিস মামু। আমার যে তোর উপর কী পরিমাণ হিংসে হচ্ছে বলে বোঝাতে পারব না।”

-থাক রে, হিংসা করিস না। দুলাভাই তো আমাদের পর না। পুরোপুরি ঘারওয়ালী না হতে পরেছি তাতে কি? শালি আধি ঘারওয়ালী। সেই হিসেবে দুলাভাইয়ের উপর আমাদেরও অধিকার আছে।”

একটু আগে এধরনের আরও অনেক কথা বলে মজা করা বোনেরাও মৌরির ভাগ্যের উপর দুঃখ করছে। এমন কপাল আল্লাহ কাউকে না দিক। মামী, ফুপুরা মৌরির মা’কে সামলাতে ব্যস্ত। মেয়ের ভবিষ্যতের কথা ভেবে মা অসুস্থ হয়ে পড়েছে। মেহমানরা প্রায় সবাই চলে গেছে। যাওয়ার আগে কেউ কেউ মৌরির দিকে তাচ্ছিল্য কটুবাক্য ছুঁড়তে ভোলেননি।

-বড় ঘরে মেয়ে বিয়ে দিবে। শখের কমতি নেই। নিজের অবস্থানটাও দেখতে হবে। আমি আগেই বুঝেছিলাম গণ্ডগোল কোন একটা আছে। এখন দেখেছ তো। ছেলে বিয়ে করবে না বলে কেমন নিজের বাপের সাথেও চোপা করে চলে গেল। জোর করে বিয়ে করাচ্ছিল কোন সন্দেহ নেই। এখন কাঁদলে কী হবে? আগেই ভাবা উচিত ছিল।”

বাইরের মানুষের এসব কথা মৌরিকে কষ্ট দিচ্ছে না। যাকে সে পৃথিবীর সব থেকে বেশি আপন ভাবতে শুরু করেছিল সে-ই তো সবচেয়ে বড় আঘাতটা দিয়ে গেল। কেন করল এমন? মৌরি তো বলেনি আমাকে আপনি ভালোবাসুন। আমাকে বিয়ে, সংসারের স্বপ্ন দেখিয়ে এভাবে মাঝপথে হাত ছেড়ে দিন। মৌরির ভুল হচ্ছে। মাঝপথে না। ওদের পথ চলা তো এখনও শুরুই হয়নি। মানুষটা তার হাত ছাড়বে কি? এই হাত তো উনি কখনও ধরেনই নি।
মৌরির বাবা মাথায় হাত দিয়ে সব হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে যাওয়া মানুষের মতো একটা চেয়ারে বসে আছেন। একমাত্র মেয়েকে জীবনে কোনকিছুর অভাব হতে দেননি। ভালোবাসার কোন কমতি রাখেননি। মেয়ের সুখই উনার কাছে সবার উপরে ছিল। সেই মেয়ের জীবনই তিনি নিজের হাতে নষ্ট করে দিলেন। যাকে তিনি হীরে ভেবেছিলেন সে আসলে কয়লার টুকরোও না। মেয়েকে তিনি বিয়ের জন্য জোর করেছিলেন।
মাহিম বোনের মুখের দিকে তাকাতে পারছে না। তাশফিনের বলা কথাগুলো সে কীভাবে ভুলবে? তার জন্য তার বোনকে এত বড় শাস্তি পেতে হচ্ছে। তার বোনটার তো কোন দোষ ছিল না। প্রতিশোধ নেওয়ার হলে তাকে মেরে প্রতিশোধ পূর্ণ করত। কিন্তু তার বোনটাকে কেন বেছে নিল?

ঘনঘন বিদ্যুৎ চমকানোর সাথে সাথে একটু পরপর প্রচণ্ড শব্দে বাজ পড়ছে। বৃষ্টির বেগ বেড়েই চলছে। মৌরি এক ধ্যানে জানালার কাচের উপর পড়ে মিলিয়ে যেতে থাকা বৃষ্টির ফোঁটা গুলোকে দেখছিল। হঠাৎ সে দাঁড়িয়ে পড়লে তার কাজিন ফাইজা এসে মৌরিকে ধরতে নিল। মৌরি হাত দেখিয়ে বাধা দিয়ে বলল,

-আমি ঠিক আছি। মা কোথায় রে ফাইজা?”

-ফুপু! ফুপু, ওঘরে আছে। ডেকে দিব?”

-না। আমিই যাচ্ছি।”

-আমি তোমাকে নিয়ে যাই?”

মৌরি ফাইজার দিকে তাকিয়ে হাসল। এতে ফাইজা একটু লজ্জা পেল।

-তোরা সবাই সারাক্ষণ আমার সাথে সাথে থাকছিস কেন? আমি নিজের খেয়াল রাখতে পারব না! এতটা দূর্বল ভাবছিস আমাকে?”

ফাইজা মৌরির অনেক ছোট। নিজের কোন ভাইবোন নেই তার। মৌরিকে সে ছোট থেকে নিজের বোন ভেবে এসেছে। সব কাজিনদের মাঝে বিশেষ করে মৌরির প্রতি ফাইজার টানটা একটু বেশিই। ফাইজা প্রাণপণ চেষ্টা করেও মৌরির সামনে কান্না থামিয়ে রাখতে পারল না। অস্ফুটস্বরে কেঁদে ফেলে বলল,

-আমাকে তোমার সাথে থাকতে দাও না আপু। আমি তোমাকে বিরক্ত করব না।”


-আপনি আমার সাথে এমনটা কেন করলেন? আমি আপনার উপর কতটা রাগ করেছি জানেন? অবশ্য আপনি কীভাবে জানবেন? আপনি তো আমাকে ফেলে চলেই এসেছেন। একবারও কি পেছন ফিরে আমাকে দেখেছিলেন? দেখেননি। আপনি যে আমাকে এত কষ্ট দিয়েছেন, এখন যদি আমি এই কষ্ট সহ্য করতে না পেরে কিছু একটা করে ফেলি। তখন কি এরজন্য আপনি দায়ী থাকবেন না? হ্যাঁ, হ্যাঁ আপনিই দায়ী থাকবেন। আপনার জন্যই তো আমি জীবন…

তাশফিন লাফিয়ে ঘুম থেকে উঠে বসল। এসি চালু থাকা অবস্থায়ও সে ঘামছে। আশেপাশে তাকিয়ে হাঁপাচ্ছে। সে কি তার রুমেই আছে? হ্যাঁ। এটা তাহলে স্বপ্ন ছিল! পুরো ব্যাপারটাই স্বপ্ন ছিল বুঝতে পেরে তাশফিন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। কিন্তু কথাগুলো এখনও তার কানে বাজছে। আজকের মতো ভালো ঘুম গত এক মাসে হয়নি। ভেবেছিল আজ সারাদিন মুডটা ভালো থাকবে। কিন্তু সকাল সাতটায় এই স্বপ্নটা দেখে ফুরফুরা মেজাজের দফারফা হয়ে গেল। তাশফিন না চাইতেও মেয়েটাকে নিয়ে ভাবছে। কয়েক দিনের পরিচয়ে যতটুকু চিনেছে তাতে বুঝতে বাকি নেই এই মেয়ে মোমেরপুতুল। এই ধাক্কাট সামলিয়ে উঠতে পারলে জীবনে আর কখনও হুঁচট খাবে না। এটা একটা শিক্ষা বলা যায়।

-দূর! এই বোকা মেয়েকে নিয়ে আমি ভাবছি কেন? এর বাপ ভাইয়ের উচিত ছিল সুন্দর পৃথিবীর নিষ্ঠুর রুপটাকে চিনিয়ে রাখা। আমার কি? আমি তো বরং ফ্রীতে ওর বাপ ভাইয়ের কাজটা করে দিলাম।”

তাশফিন কম্বল টেনে নাকমুখ ঢেকে আবার শুয়ে পড়ল। তার ঘুম ভাঙল ঠিক বেলা দশটা বাজে। ফুরফুরে মেজাজে বিছানা ছেড়ে সে ডাইনিংয়ে এসে বসল। মিস্টার এন্ড মিসেস চৌধুরী আগেই বসে আছে। উনাদের উদ্দেশ্যে তাশফিন সামান্য হেসে চেয়ার টেনে বসতে বসতে বলল,

-গুড মর্নিং।”

তারেক চৌধুরী ছেলেকে সম্পূর্ণরূপে উপেক্ষা করে জুসের গ্লাস টেনে নিলেন। বাবার রাগ এখনও কমেনি? বাহ! কিন্তু লায়লা তাশফিনের দিকে তাকিয়ে গা জ্বালানো ন্যাকামি হাসি হেসে বলল,

-গুড মর্নিং ডিয়ার। আ’ম সো সো, সো সরি। লাস্ট নাইট আমি তোমার বিয়েতে যেতে পারিনি। আশা করি তুমি কিছু মনে করোনি।”

-আপনি গেলেও যে আমি বিশেষ খুশি হতাম এমনটা কিন্তু না। সো ইট’স ওকে।”

-কিন্তু, বৌমার সাথে মিট করে আমি কিন্তু ভীষণ খুশি হয়েছি।”

পাউরুটিতে বাটার লাগাতে লাগাতে তাশফিন মনে মনে হাসল। মিসেস চৌধুরীর লেবুপানি মনে হয় এখনও দেওয়া হয়নি। তাই এখনও ভুলভাল বকছে। বৌমার সাথে দেখা করেছে! স্বপ্নে নাকি নেশার ঘোরে?

-এইতো বৌমা চলে এসেছে।”

লায়লার কথা শুনে তাশফিন হেলা করে ওদিকে তাকালে নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারল না। নেশা কি মিসেস চৌধুরীর হয়েছে, নাকি তার? মুহূর্তে তার মুখ থেকে হাসি চলে গেল।

চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে