শ্বাশুড়ি পর্বঃ১২

0
1191

শ্বাশুড়ি
সৌরভে_সুবাসিনী(moon)
পর্বঃ১২
.
.
অয়ন,আমিনের মুখে বেশ চিন্তার ছাপ। দুজনেই ক্লান্ত। আলো সরে গিয়ে ওদের ভিতরে আসতে দেয়, কোন প্রশ্ন করেনা। শুধু বলে ফ্রেশ হয়ে আসতে। দেখেই বুঝা যাচ্ছে দু ভাই সারাদিন না খাওয়া।
.
ফ্রেশ হয়েই ওরা খেতে এলো। দুভাই কিছু একটা বলছে৷ আলো চুপচাপ ওদের খাবার দিচ্ছিলো। কই থেকে যেনো বাচ্চা দুটো এসেই অয়ন কে ধরলো। এখন আর বেচারার খাওয়া গেলো। একজন হলে কথা ছিলো৷ দুজন কে নিয়ে খাওয়া সম্ভব না। তাই আলোর দিকে অসহায় চোখে তাকিয়ে আছে সে।
আলো ভাত মেখে অয়নের মুখের সামনে ধরতেই খাচ্ছে আর বাচ্চাদের সামলাচ্ছে।
.
.
-বৃদ্ধাশ্রম ছাড়া আর কোন উপায় দেখছি না৷ (আমিন)
-তাহলে তাই হোক। হাসপাতালের থেকে রিলিজ দেওয়ার পর না হয়…. (অয়ন)
.
-কোথায় ছিলা? আর কি হয়েছে? কাকে বৃদ্ধাশ্রমে রাখবা?
.
অয়ন আমিন দুজনেই চুপ।
কিছুক্ষণ পর অয়ন বলা শুরু করে
-কাল রাতে আমিন কল দিয়ে দ্রুত বাড়ি যেতে বলে। এত রাতে রাস্তায় কিছুই পাবো না তাই তোমার মানা স্বত্বেও বাইক নিয়ে বেরিয়ে যাই৷ বাড়ি গিয়ে দেখি মা বিছানায় শুয়ে আছে। সন্ধ্যায় না কি কল পাড়ে পড়ে গিয়ে মাথায় আর কোমড়ে লেগেছে। বেশ ব্লাড গিয়েছে। আমিন বাসায় ছিলো না। তাঞ্জু চাইলে হাসপাতালে নিতে পারতো কিন্তু ফ্রেন্ডের বিয়েতে যাবে বলে তখন মা কে রেখে চলে যায়। রাতে আমিন ফিরে এসে মা কে দেখে ঘুমাতে কিছু না বলে চলে যায়। গভীর রাতে পানি খেতে উঠে দেখে মায়ের অবস্থা খুব খারাপ । আমাকে কল দিয়ে মা শুধু বললো
তার সময় শেষ আমি যেনো গিয়ে দেখে আসি।
.
.
আলো বাবু কে কোল থেকে নামিয়ে অয়নের পায়ের কাছে দুহাটুতে ভর দিয়ে অয়নের দুহাত ধরে বলে
.
– মা ঠিক আছে তো?
– হাসপাতালে নেওয়ার পর ডক্টর বললো ব্লাড অনেক গেছে ব্লাড দিতে আর বাম পা ভেঙে গেছে। বেড রেস্ট দিতে। দুদিনে রিলিজ দিবে।
-যাক আলহামদুলিল্লাহ্। এখন সুস্থ আছে এটাই অনেক।
.
-হুম! কিন্তু আপু সমস্যা অন্য।
-কি?
– আসলে তাঞ্জু মা কে রাখতে চাইছে না। একে তো মায়ের বয়স হয়েছে আর এমন অসুস্থ তাই এই অবস্থায় তাঞ্জু কিছুতেই মা কে রাখবে না।
.
– তো মা কে কি করবা?
-কি আর করবো? বৃদ্ধাশ্রম ছাড়া আর কোন উপায় নেই৷

.
অয়নের এই কথা শুনে আলো ওর হাত আরো জোরে চেপে ধরে।
-কি বলছো কি? মা কে বৃদ্ধাশ্রমে কেনো রাখবে?
-কোথায় থাকবে তাহলে?
-এই বাসায়। আমাদের সাথে।
-না! তা কি ভাবে? তুমি দু বাচ্চার ঝামেলা, স্কুল, সংসার এর মধ্যে?
– আমি পারবো গো।
– না! মা থাকতে পারবে ওখানে। আমরা নার্স ঠিক করে দিবো।
– আল্লাহ্ আমাদের দুজন দান করছে। আমি যদি দুজন সামলাতে পারি আরো একটা পারবো।
– কিন্তু আপু!
– তোমাদের জন্মের পর কি মা তোমাদের এতিম খানায় দিয়ে দিয়েছিলো? না তো? কষ্ট করে মানুষ করেছে না?? তো কেনো এখন তার বিপদের দিনে…
– আলো! মোনাপাখি বুঝার চেষ্টা করো।
-তুমি বুঝার চেষ্টা করো।
.
আলোর জিদের কাছে দুই ভাই হার মানলো।
.
দুইদিন পর রাহেলা বেগম কে নিয়ে অয়ন আমিন বাসায় এলো। এই দুই দিনে আলো যতটা পেরেছে গুছিয়ে নিয়েছে। যদিও নার্স রাখা আছে তবুও রাহেলা বেগমের জন্য সব কিছু আলো নিজে করেছে।
.
কলিং বেলের শব্দে আলো দৌড়ে গিয়ে দরজা খুললো। রাহেলা বেগম কে দেখেই আলো গলা জড়িয়ে ধরে বলে
– মা! আপনি আসছেন! আসুন না! এটা তো আপনার নিজের বাসাই।
.
হুইল চেয়ারে বসে রাহেলা বেগম এলো আলোর সংসারে। বার বার মনে হচ্ছে আলো তাকে অনুগ্রহ করছে। সত্যি কি তাই?
.
দিনে দুবার আলো রাহেলা বেগমের পায়ে তেল মালিশ করে দেয়। ভাঙা অংশ প্লাস্টার করা হলেও বাকী অংশে সে যথেষ্ট কেয়ারফুল ভাবে করে। গোসল, খাওয়া, নামাজ সব আলো দেখে। এদিক ওর দুই বাচ্চা,সংসার, স্কুল সব করছে নিজেই।
মাঝেমধ্যে আলো হিমশিম খেলে অয়ন তো আছেই৷
.
দেখতে দেখতে তিন মাস পার হলো রাহেলা বেগম মোটামুটি চলতে পারে। তবুও আলো সাহায্য করেই।
.
একদিন সকালে আলো রাহেলা বেগম কে ডাকতে আসে। নামাজের জন্য। স্পষ্টত দেখতে পায় আলো সবে মাত্র গোসল সেরে বেরিয়েছে। মুখে স্নিগ্ধ ভাব কিন্তু আজ রাহেলা বেগমের রাগ হয় না। মনে প্রশান্তির মতো লাগছে। আলো যেনো তার কাছে এক পূর্ণ নারী৷ তার নাতী নাতনী রা হাটতে শিখেছে, ডাকতে শিখেছে। সারা বাসা মাতিয়ে রাখে।
রাহেলা বেগম নিজেকে পরিপূর্ণ ভাবতে শুরু করেছে।
.

.
এক দিন আলোর মা -বাবা এলো। তারাও রাহেলা বেগমের সাথে যথেষ্ট অমায়িক ব্যবহার করে। অয়ন অফিস থেকে এসে ফ্রেশ হয়ে শ্বাশুড়ির পায়ের কাছে বসে পড়ে। এই নিয়ে আলোর সাথে বেজে গেলো। আলো গিয়েছে তেল গরম করতে আর এই সুযোগে অয়ন বসে পড়েছে তেল দিতে।
.
– এটা ঠিক না। আমার জায়গা তুমি উঠো…..
-উঠো মানে? আমি বসেছি তো।
-তাতে কি?
– শুনো খুব আদর খাইছো। পুরো দুই টা বছর ছাইড়া দিছি। বাবা-মা, আমিন আর আমার সেবা না হয় বাদ দিলাম। খুব পাইছো আর একটু তেই হিংসা? যাও উঠবো না।
.
আলো নাক ফুলিয়ে বাবার কাছে বসে থাকে, যখন বাবুরা অয়নের কাছে দৌড়ে আসে ধরার আগেই আলো খোপ করে ওদের নিয়ে যায়। আর বলে
-পেটে আমি ধরছি, তুমি ওদের ধরবা না।
.
.
সবাই জোরে জোরে হাসতে থাকে ওর কথা শুনে। রাহেলা বেগম হয়তো মনে মনে ভীষণ অনুতপ্ত কিন্তু তার কি এত সহজে মুক্তি আছে?
.
.
একদিন অয়ন অফিস থেকে এসে দেখে রাহেলা বেগম বাচ্চাদের খাওয়াচ্ছে আর গল্প শোনাচ্ছে। মায়ের অসুস্থ শরীরে এত ধকল আলো টা কই? অয়ন কিছুটা রেগে গেলে রাহেলা বেগম বলে
.
-চুপচাপ ফ্রেশ হয়ে আয় খেতে দিচ্ছি।
-কিন্তু তুমি কেনো আলো?
-ঘুমিয়েছে।
-এখন কোন সময়ের ঘুম আর তাছাড়া তোমার এই অবস্থায় বাচ্চাদের…..
-চুপ থাক। সারাদিন কত ধকল যায়। বাচ্চাদের সামলানো কম কথা না। তার উপর দুই বাচ্চার ধকল শরীরের উপর দিয়ে গেছে৷ আর জানিস তো বাচ্চা হলে মায়েদের ঘুম বেড়ে যায়। ওকে ডাকিস না, চল আমি খাবার দিচ্ছি।
.
.
মায়ের এমন কথা শুনে আক্কেলগুড়ুম হলো। অয়ন প্রকাশ করলো না। তবে কি মা ধীরেধীরে….
.
.
তার বেশ কয়েকদিন পর আমিন এসে হাজির। সাথে কাচা কাঠাল। আবদার হলো আলো রান্না করবে। কাঠাল দেখে আলো হাসবে না কাঁদবে বুঝে না। কারণ ও তো এসব রান্না করতে পারে না।
.
রাহেলা বেগম হঠাৎ বলে উঠে চল আলো। আমি তোকে শিখিয়ে দিচ্ছি।
আলোও মনের খুশিতে রান্না করতে ব্যস্ত৷ আমিন মনে হয় বিষম খেলো। অয়ন আমিন কে আশ্বাস দেয় এসব সত্যি৷
.
খাবার টেবিলে রাহেলা বেগম কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে। সে সব কিছুর জন্য আলোর কাছে মাফ চায়। আলো বলে সে মাফ করার কেউ না৷ মা সন্তান কে বকবেই। এসে রাহেলা বেগম কে জড়িয়ে ধরলে অয়ন আমিন ওরাও যোগ দেয়।
.
এই মেয়েকে সে বড্ড জ্বালিয়েছে কিন্তু বিপদে এই মেয়েই পাশে রইলো । তার ছেলেরাও ফেলে দিতে চেয়েছিলো কিন্তু আলোর জন্য পারেনি অপর দিকে তাঞ্জু যে তার ভাতিজি যার জন্য আলোকে সংসার ছাড়তে বাধ্য করতে চেয়েছিলো সেই তাঞ্জু তাকে ঘর ছাড়া করলো।
.
এখন আলোরা খুব খুশিতেই আছে। অয়ন আলো দুজনে মিলে পুরো সংসার বেধে রেখেছে। রাহেলা বেগম এখন আলোর শ্বাশুড়ি না মা হয়ে উঠেছে। যা প্রত্যেক মেয়েই চায়।
ভালো থাকুক না আলোরা, প্রতিটি সংসারে…….
.
.
সমাপ্ত
(কিছু কথা – আজকের বউ কাল শ্বাশুড়ি, আবার আজকের শ্বাশুড়ি কিন্তু গতকাল বউ হিসেবে থাকে। শুধু সময়ের ব্যবধান। সম্পর্ক হওয়া উচিৎ রস-মালাইয়ের মতো একে অপরের পরিপূরক। শ্বাশুড়ি মা কে মায়ের মতো ভালোবেসে দেখুন না একবার এতে হয়তো অনেক সংসারে আনন্দ ফিরেও তো আসতে পারে………..

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে