শেষ বিকেলের রোদ পর্ব-০৭

0
905

শেষ বিকেলের রোদ -৭ম পর্ব
©শাহরিয়ার

সবার সামনে আমাকে ফুলটুসি বইলো না প্লিজ।

— হাজার বার বলবো, যখন মন চায় তখন বলবো ফুলটুসি ফুলটুসি ফুলটুসি।

— তোমার যত বার খুশি ততবার বইলো এখন ঘুমাতে দাও। বলেই চোখ বন্ধ করে নিলাম।

— সোহান তুই এতো তাড়াতাড়ি ঘুমালে সারা রাত জ্বালাবে কে শুনি?

— মাফ করো আপাতত সারাদিন অনেক খাটুনি হয়েছে এখন ঘুম। যদি ঘুম ভেঙে যায় তখন জ্বালাবো। সোহান চুপ করে রইলো।

— রাত কয়টা বাজে জানা নেই, হঠাৎ ঘুম ভাঙতে অনুভব করি সোহান আমার চুলে বিলি কেটে দিচ্ছে। আমি জেগে গেছি তা বুঝাতে চাচ্ছি না সোহানকে, এই মুহুর্তটা নিশ্চই আমার জীবনের সেরা মুহুর্ত গুলোর একটি, আমার মাথা ওর কাঁধে আর ওর হাত আমার চুলে বিলিকেটে যাচ্ছে। আমি চুপ করে চোখ বন্ধ করে শুয়ে রইলাম। অনেকটা সময় পর হাই তুলতে তুলতে চোখ মেলে তাকালাম।

— সোহান কি ঘুম ভেঙে গেলো?

— হুম মাথার ভিতর উঁকুনের বিরবিরে ঘুমটা ভেঙে গেলো। কেমন জানি বিলি কেটে যাচ্ছিলো ওগুলো।

সোহান কি বিলিকেটে যাচ্ছিলো?

– হুম, আচ্ছা কয়টা বাজে?

সোহান ঘড়িতে তাকিয়ে দেখ।

— থাক লাগবে না। বাহিরে এখনো বৃষ্টি হচ্ছে?

— সোহান কেন ভিজবি নাকি?

— হুর তুমি সব সময় এমন করো কেন? আমার সাথে লেগেই থাকো।

— সোহান আচ্ছা চুপ কোন কথা হবে না। বৃষ্টির শব্দ শুনতে দে।

— কাঁধের উপড় মাথা রেখেই মনে মনে বলছি তুমি শোন বৃষ্টির শব্দ আমিতো টুপটাপ এই বৃষ্টির মাঝে থেকেই তোমার ভালোবাসার শব্দটা অনুভব করতে চাই। হিম শীতল বাতাসে আবারো চোখ বন্ধ হয়ে এলো।

— সোহান এই তাড়াতাড়ি উঠ নামতে হবে।

— চলে এসেছি?

— সোহান হ্যাঁ তাড়াতাড়ি নাম নাহলে ট্রেন আবার ছেড়ে দিবে।

— দু’জন তাড়াহুরো করে ট্রেন থেকে নামলাম। সারা রাত বৃষ্টি হওয়াতে বাহিরে অনেক ঠাণ্ডা, বেশ কিছুটা পথ হেঁটে বের হতে হবে স্টেশন থেকে, দু’টো ব্যাগ সোহান দু’হাতে নিয়ে আমার দিকে বড় বড় চোখ করে বলতে শুরু করলো তাড়াতাড়ি হাঁটতে পারিস না।

— পারিতো, কিন্তু যদি পরে যাই?

— সোহান অসহায়ের মত তাকিয়ে তুই আস্তে আস্তেই আয় আমি যাচ্ছি।

— একটা অটো নিয়ে রওনা হলাম ফুপুর বাড়ির উদ্দেশ্যে। বাতাসে হাত পা সব ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে।

— সোহান কিরে ফুলটুসি ঠাণ্ডা লাগে?

— হ্যাঁ, তাতো একটু লাগতেছেই।

— সোহান আমার কিন্তু বেশ ভালো লাগতাছে। কত বছর পর গ্রামে আসলাম। সকালের মিষ্টি বাতাস সত্যিই উপভোগ করার মত।

— হ্যাঁ তা ঠিক বলেছো। তবে যাই বলো না কেন আগের মত মাটির রাস্তা না থাকায় বেঁচে গিয়েছো, না হলে যে বৃষ্টি হয়েছে তাতে করে হেঁটে যেতে হতো। তখন যে তোমার কি অবস্থা হতো।

— সোহান আমার কি হতো তা ভাবতে হবে না, তুই যে কতবার কাদায় পিছিল খেয়ে পরতি, আর কোমড় ভেঙে বসে থাকতি এটা চিন্তা কর।

— ভালোই হতো তখন কোলে তুলে নিয়ে যেতে।

— সোহান আমারতো আর কাজ নেই তোকে কোলে নিয়ে হাঁটতাম।

— হয়েছে নিতেতো আর হয়নি।

— সোহান হ্যাঁ চুপ করে বসে থাক এখন।

— প্রায় ত্রিশ মিনিট পর ফুপুদের বাড়ির সামনে এসে অটো থামলো। গ্রামের বিয়ে বাড়ি বলে কথা কি সুন্দর করে সাঁজিয়েছে মনে হচ্ছে আজই বিয়ে অথচ এখনো বিয়ের সাত দিন বাকি। দোচালা টিনের বিশাল বাড়ি। চারিদিকে কত রকমের গাছগাছালি, এক নজড়ে কারো মন ভালো করে দেবার জন্য যথেষ্ট্য বাগির ভিতরে ঢুকতেই চোখ গেলো পুকুর পাড়ে। পুকুরে চারিদিকে কত সুন্দর হিজল গাছ গুলো দাঁড়িয়ে আছে। আমাদের দেখে আফরিন আপু দৌড়ে আসলো।

— আফরিন জড়িয়ে ধরে, কত দিন পর তোকে দেখলাম।

— তোমাকেও অনেক দিন পর দেখলাম, তুমিতো সুন্দরি হয়ে গেছো আপু।

— আফরিন হুর কি সব বলিস, কেমন আছো ভাইয়া তুমি?

— সোহান আমি ভালো আছি, ফুপা ফুপি কোথায়রে?

— আফরিন বাবা মা উনাদের রুমেই আছে, আসোতো আগে ভিতরে ঢুকো ফ্রেশ হও আমি বাবা মাকে ডাক দিচ্ছি। ততক্ষণে তোমরা আমার রুমে যেয়ে ফ্রেশ হয়ে নেও।

— ফ্রেশ হতেই ফুপাফুপু ঘরের ভিতর ঢুকলো। ফুপু এস জড়িয়ে ধরে দেখছো কত বড় হয়ে গেছে আমাদের মেয়েটা।

— ফুপা হ্যাঁ মেয়েদের বড় হতে কি সময় লাগে নাকি।

— ফুপু হ্যাঁ সোহানকে দেখো একদম নায়কের মত হয়েছে দেখতে।

— সোহান ফুপি সব বাদ দিয়ে আগে খেতে দাওতো কতদিন তোমার হাতের খাবার খাই না।

— তুমি আসলেই একটা খাদক।

— সোহান চোখ বড় বড় করে খবরদার তুই কিন্তু খেতে বসবি না আমার সাথে ফুপি ওরে খাবার দিবে না। সোহানের কথায় সকলে এক সাথে হেসে উঠলাম।

— ফুপা নে আয়তো তোরা দু’জনেই খাবি।

— সকলে মিলে যেয়ে ডাইনিং এ বসলাম। ফুপু আর আফরিন আপু আমাদের সকলের জন্য নাস্তা নিয়ে আসলো। নানান রকম পিঠা মুড়ি। দেখেই জিবে জল এসে যায় অবস্থা। নিজেকে সামলে চুপ করে বসে রইলাম। ফুপু নানান রকম পিঠা দিয়ে পুরো প্লেট সাজিয়ে দিলেন। সোহান মনের আনন্দে খাচ্ছে আর বলছে আহ কি যে মজা ফুপু। আমারতো মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে সারা জীবনের জন্য এখানে চলে আসি। তোমার হাতের মজার মজার সব খাবার খাওয়ার জন্য।

— ফুপু শোন পাগল ছেলে কি বলে, তোর মা আর বড় চাচী আমার চেয়ে কত ভালো রান্না করে। আমি নিজেইতো উনাদের কাছ থেকে রান্না করা শিখেছি। টুকটাক কথা বলতে বলতে নাস্তার পর্ব শেষ করে নিলাম। সোহানকে একটা ঘরে থাকতে দিলো আর আমি চলে আসলাম আফরিন আপুর সাথে তার রুমে।

— লম্বা একটা ঘুম দিয়ে দুপুরের দিকে আফরিন আপুর ডাকে জেগে উঠলাম।

— আফরিন আর কত ঘুমাবি উঠে গোসল করে নে। তারপর খাবি।

— আপু পুকুরে গোসল করা যাবে না?

— আফরিন বলে কি এতো বড় মেয়ে নাকি পুকুরে গোসল করবে। এখন কেউ আর পুকুরে গোসল করি না।

— সোহান ভাইয়া কোথায় লাঞ্চ করছে?

— আফরিন না ভাইয়াতো বাবার সাথে সেই সকালে বের হইছে বাজার করার জন্য।

— আহ্রে বেচারা এমনিতেই সারা রাত ঘুমায়নি তার উপর আবার বাজারে গেছে কি যে হবে অবস্থা কে জানে। শেষে রাস্তায় পরে না থাকলে হলো ঘুমিয়ে।

— আফরিন আরে কিছু হবে না, দেখবি অল্প সময়ের ভিতর চলে আসবে ততক্ষণে তুই ও গোসল করে রেডি হয়ে নে।

— জামা কাপড় নিয়ে ওয়াশ রুমে ঢুকতেই সোহানের কণ্ঠ শুনতে পেলাম বাহির থেকে আফরিন আপু বললো নে সোহান ভাইয়া চলে আসছে। তুই গোসল করে নে আমি ভাইয়াকে গোসল করতে বলতাছি সবাই এক সাথে লাঞ্চ করবো বলেই আফরিন রুম থেকে চলে গেলো।

— গোসল শেষ করে রেডি হয়ে ডাইনিং এ যেয়ে দেখি সকলে রেডি হয়ে বসে আছে। টেবিলে বসতেই নাকে বিরিয়ানির ঘ্রাণ আসলো। ফুপু আজ বিরিয়ানি রান্না করছো তাই না?

— ফুপু হ্যাঁ সোহানের খুব পছন্দ বিরিয়ানি তাই রান্না করেছি।

— ও সবতো উনার পছন্দেই হবে তাহলে আর কি না খেয়েই উঠে পরি।

— ফুপু থাপ্পর দিবো, এই দেখ তোর পছন্দের ইলিশ মাছের ডিম ভুনা করেছি।

— তাহলেতো আর না খেয়ে উঠছি না।

— সোহান খাবি খাবি আবার ভাব ও নিবি।

— তাতে তোমার কি।

— ফুপু ও থামতো তোরা খেয়ে নিজেদের রুমে যেয়ে রেস্ট নে।

— সকলে এক সাথে লাঞ্চ শেষ করে যার যার মত রুমে চলে আসলাম। রুমে এসে আফরিন আপুকে বললাম আমার দুলা ভাই দেখতে কেমন?

— আফরিন ভালোই বিয়ের দিন আসবে দেখিস।

— কেন আগে দেখা করা যাবে না?

— আফরিন যাবে না কেন? ফোন দিলেই চলে আসবে দেখা করতে।

— তাই নাকি? প্লীজ আপু প্লীজ ফোন দাও না। দুলাভাইকে দেখবো।

— আফরিন আচ্ছা আচ্ছা দিচ্ছি। ফোন রিসিভ করতেই সালাম দিয়ে কোথায় আছেন আপনি?

— তারপর তাকে সব খুলে বললো। এবং বললো আমি দেখতে চেয়েছি বিকেলে আসতে। কথোপকথনে বুঝতে পারলাম দুলা ভাই আসছে তার মানে আজ হবু দুলাভাইকে আজই দেখে নিচ্ছি। আফরিন আপুও তাই বললো।

— দুপুরে শুয়ে শুয়ে ফোন টিপসি, এমন সময় তরীর ফোন আসলো। ফোন রিসিভ করতেই

— তরী কেমন আছিস? কখন পৌছালি?

— ভালো আছি সকালেই এসে পৌঁছেছি, দু’জনের অনেকটা সময় কথা হলো। কথা বলে ফোন রেখে দিয়ে বিছানায় শুয়ে শুয়ে ভাবছি কি করে সোহানকে ভালোবাসি বলা যায় আর ভাবতে ভাবতে দু’চোখের পাতা আবারও এক হয়ে গেলো।

— বিকেলে চোখ মেলে তাকিয়ে বুঝতে পারলাম ঝুম বৃষ্টি হচ্ছে, আফরিন আপু আমার দিকে তাকিয়ে মন খারাপ করে, আজ মনে হয় আসবে না। কি রকম বৃষ্টি হচ্ছে।

— মন খারাপ করো না আজ আসবে না তো কি হইছে কাল আসবে।

— কথাটা বলতে বলতেই ধপাস করে বারান্দায় কারো পরে যাবার শব্দ হলো। আমরা একজন আরেক জনের মুখের দিকে তাকিয়ে বিছানা থেকে নেমে সেদিকে দৌড় শুরু করলাম।

চলবে..

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে