শেষ বিকেলের রোদ পর্ব-০২

0
1062

শেষ বিকেলের রোদ – ২য় পর্ব
©শাহরিয়ার

বই খুলতেই ছোট একটা চিরকুট বেরিয়ে আসলো তাতে লেখা,

“এখন থেকে তোর যে বই লাগবে আমাকে বলবি অন্য মানুষের বই আনতে হবে না”

— আমি মনে মনে বলি হয়েছে নিজেই বেকার তার কাছে বলবো আমার প্রয়োজনের কথা। কিন্তু আমি ভেবে পাচ্ছিলাম না সে কি করে বুঝলো বইটা আমার প্রয়োজন। সব চিন্তা মাথা থেকে সরিয়ে আমি বইটা খুলে পড়তে বসলাম। পড়তে পড়তে একটা সময় ঘুমিয়ে পড়লাম।

— সকালে মায়ের ডাকে ঘুম ভাঙতেই তাড়াতাড়ি উঠে বই গুলো গুছিয়ে রেখে দরজা খুলে দেই।

— মা আর কত ঘুমাবি? তাড়াতাড়ি উঠে রেডি হয়ে নে ভার্সিটিতে যেতে হবেতো। এতো বড় মেয়েকে এখনো ডেকে তুলতে হয় ভার্সিটিতে যাবার জন্য। আজ বাদে কাল বিয়ে দিতে হবে, সংসারের কাজতো ঠিক মত কিছুই শিখেনি তার উপর সুযোগ পেলেই শুধু ঘুম আর ঘুম, বকবক করতে করতে মা রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। আমিও সোজা ওয়াশ রুমে চলে গেলাম।

— রেডি হয়ে ডাইনিং এ এসে দেখি সোহান নাস্তার টেবিলে আসেনি, বড় চাচীকে ডাক দিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম সোহান ভাইয়া কোথায় নাস্তা খেতে আসেনি কেন?

— বড় চাচী কোথায় আর যাবে হয়তো ছাদে যেয়ে বসে আছে। আরতো কোন কাজ নেই।

— আমি হাসতে হাসতে আচ্ছা বড় চাচী তুমি বলোতো আমি যে তোমাকে কাল বললাম সোহান ভাইয়াকে বিয়ে দিয়ে দিতে, তুমি কেন তা বলে দিলে? তোমার পেটে কি কিছুই থাকে না।

— বড় চাচী কেন তোকে কি কিছু বলছে? শুধু বল কিছু বলে থাকলে ওরে বাড়ি থেকে বের করে দিবো।

— আরে না কি বলবে আমাকে? তোমার ছেলের সেই সাহস কি আছে নাকি। কথা বলতে বলতে নাস্তা শেষ করে ডাইনিং থেকে বের হয়ে সোজা ছাদে উঠে আসলাম। ছাদের শেষ কর্ণারে দাঁড়িয়ে আছে সোহান।

— কি ব্যাপার এখানে দাঁড়িয়ে আছো কেন?

— এমনি, তুই ভার্সিটিতে না যেয়ে এখানে আসলি কেন?

— তোমাকে নাস্তার টেবিলে পেলাম না তাই আসলাম। এখন বলো নাস্তা না করে কেন এখানে দাঁড়িয়ে আছো?

— মনটা ভালো নাই, আসলেই একটা জব খুব জরুরি দরকার।

— হয়েছে এসব নিয়ে মন খারাপ করে থাকতে হবে না তোমাকে। সময় হলেই হয়ে যাবে, এখন নিচে চলো নাস্তা করবে আমাকে আবার ভার্সিটিতে যেতে হবে।

— তুই যা আমি পড়ে নামছি,

— আচ্ছা ঠিক আছে আমি নেমে যাচ্ছি, আর শোন তোমাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ বই দু’টোর জন্য। আমি যেন ভার্সিটি থেকে এসে শুনি তুমি ঠিক মত খেয়ে বাসা থেকে বের হয়েছো, নাহলে…

— নাহলে কি?

— সেটা সময় হলেই বুঝবা, বলতে বলতে সেখান থেকে সোজা নেমে আসলাম। রিক্সা নিয়ে রওনা হলাম ভার্সিটিতে যাওয়ার জন্য। ভার্সিটির গেটে আসতেই তরীকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ওর দিকে এগিয়ে গেলাম।

— তরী শুনেছিস ফারজুর বিয়ে ঠিক হয়েছে,

— সত্যি কার সাথে?

— তরী কার সাথে আবার আরিফ ভাইয়ের সাথে মানে যার সাথে ওর রিলেশন ছিলো তার সাথেই। শুনলাম আরিফ ভাইয়ের নাকি খুব ভালো একটা জব হয়েছে, তারপরেই ফারজুর বাসায় উনি বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে যায়। তারপর দুই পরিবারের মতামতে বিয়ের তারিখ ও ঠিক হয়ে গিয়েছে।

— বাহ তাহলেতো দারুণ হলো, কবে বিয়ে?

— তরী আগামি শুক্রবার বিয়ে। হয়তো আজ কালকের ভিতরেই বিয়ের কার্ড পেয়ে যাবি। তারপর বল তোর কি অবস্থা

— এইতো চলছে, রাসেল ভাইয়ের কি খবর? অনেক দিন ভার্সিটিতে আসতে দেখি না, ঝগড়া করেছিস নাকি তোরা দু’জন?

— তরী না ঝগড়া হবে কেন, আমিই আসতে মানা করেছি, কে কি মনে করবে তাই বলছি আমরা ভার্সিটির বাহিরেই দেখা করবো।

— ওহ আচ্ছা ভালোই করেছিস

— তরী এখন বল তোর কি খবর, কতদিন ধরে বলতাছি একটা প্রেমটেম করে ফেল তাতো করতেছিস না।

— উফ আবার শুরু করেছিস? তাড়াতাড়ি চলতো ক্লাশ শুরু হয়ে যাবে। টুকটাক কথা বলতে বলতে দু’জন চলে আসলাম ক্লাশ রুমের ভিতর।

— বিকেলে ক্লাশ শেষ করে বাড়িতে ফেরার পথে ঝুম বৃষ্টি শুরু হলো। হঠাৎ বৃষ্টিতে রিক্সায় আসায় ভিজে একাকার হয়ে গেলাম। বাসায় এসে দ্রুত নিজের রুমে চলে আসলাম, জামা।চেঞ্জ করতে শুরু করলাম এমন সময় হুট করে সোহান ঘরে ঢুকে পড়লো।

— ইস দরজাটা বন্ধ করে নিতে পারিস না।

— কথাটা শুনে আমি পেছনে ফিরে তাকাতেই দেখতে পাই সোহান অন্য দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে আছে, লজ্জায় আমার মাথা কাটা যাবার অবস্থা। কোন কথা না বলে আমি দ্রুত ওয়াশ রুমে চলে আসলাম। এতোটাই লজ্জা আর ভয় পেয়েছি যে জামা চেঞ্জ করতেও হাত পা সব কাঁপতে শুরু হয়ে গিয়েছে আমার। মনে মনে হাজারটা বকা দিয়ে অনেক কষ্টে জামা চেঞ্জ করে বের হলাম। বের হয়েই দেখতে পাই সোহান আমার বিছানায় চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে। ইচ্ছে করছে দুমধাম করে কিল ঘুষি মেরে বুকটা ফাটিয়ে ফেলি, কিন্তু তা করা সম্ভব না কারণ সোহানের শক্তির সাথে আমার পারা সম্ভব নয়। কথা গুলো ভাবতে ভাবতে সোহান চোখ মেলে তাকালো।

— সোহান কিরে ফুলটুসি এমন মুড অফ করে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? আমি কিছু দেখিনি বিশ্বাস কর।

— তোমাকে আমি কতদিন বলেছি আমার ঘরে যখন তখন আসবে না।

— দেখ ফুলটুসি সত্যি বলছি আমি কিছুই দেখিনি।

— আমি রাগে শরীর থেকে ওড়নাটা টান দিয়ে ফেলে দিয়ে কি দেখবে দেখো।

— সোহান বিছানা থেকে লাফিয়ে উঠে থাপ্পর মারার জন্য হাত তুলেও তা নামিয়ে নিলো। কিছু বলতে চেয়েও বলতে পারলো না। মাথাটা নিচু করে রুম থেকে বেরিয়ে আসলো।

— পুরো সন্ধ্যা নিজের রুমের ভিতর বসে রইলাম, নিজেকেই নিজে বকতে শুরু করলাম। কি থেকে কি হয়ে গেলো এতোটা বাজে ব্যবহার না করলেও পারতাম সোহানের সাথে। ওতো ইচ্ছে করে আর এমনটা করেনি। ভুলতো আমারও ছিলো আমি তাড়াহুরোয় দরজাও লাগাইনি আর ওয়াশ রুমেও যাইনি। যে করেই হোক সোহানের কাছে ক্ষমা চাইতে হবে।

— রাতে খাবার টেবিলে সোহানকে পেলাম না। সবার সামনে বড় চাচীকে জিজ্ঞাসাও করতে পারলাম না। এদিকে মনটে কেমন ছটফট করছে সোহানের জন্য। বিছানার এ পাশ ও পাশ করছি কিন্তু কোন ভাবেই দু’চোখের পাতা এক করতে পারছি না। সোহানকে কয়েকবার ফোন দিয়েও সুইচ অফ পেয়েছি। এসব কথা চিন্তা করতে করতে এক সময় দু’চোখের পাতা এক হয়ে আসলো।

— সকালে ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে নাস্তার টেবিলেও সোহানকে পেলাম না। বড় চাচীকে জিজ্ঞাসা করলাম সোহান ভাইয়া কোথায়?

— বড় চাচী বলতে পারছি না, সকাল থেকে দেখা হয়নি এখনো। হয়তো ঘুমাচ্ছে নয়তো কোন এক ফাঁকে ছাদে উঠে বসে আছে।

— আর কোন কথা না বাড়িয়ে তাড়াতাড়ি নাস্তা শেষ করে দ্রুত ছাদে চলে আসলাম। না সোহান আজ ছাদে আসেনি, তবে কি নিজের রুমেই শুয়ে আছে কথা গুলো ভাবতে ভাবতে নিচে সোহানের রুমের সামনে এসে দরজায় কয়েকবার টোকা দিলাম। কিন্তু ভিতর থেকেও কোন সারা শব্দ না পেয়ে দরজা হালকা ধাক্কা দিতেই খুলে গেলো। সোহান ঘরের ভিতরেও নেই। তার মানে সোহান পুরো বাড়িতেই নেই। মনটা ভীষণ রকম খারাপ হয়ে গেলো, আমার উপর রাগ করেই এমনটা করছে সোহান সে আমি জানি বুঝি। ভাবতে ভাবতে বাড়ি থেকে বেড়িয়ে পড়লাম।

— রিক্সায় বসে পুরো রাস্তায় সোহানকে খুঁজতে খুঁজতে ভার্সিটিতে ঢুকলাম। কোথাও ওর দেখা পেলাম না। ভার্সিটি ক্লাশ কোন কিছুই ভালো লাগছে না। সব কিছুই কেমন বিরক্তি কর মনে হচ্ছে।

— তরী কিরে তোকে আজ এমন দেখাচ্ছে কেন?

— কই কেমন?

— তরী কেমন জানি উদাসী উদাসী দেখাচ্ছে।

— কি যে বলিস না, আসলে মনটা ভালো নাই।

— তরী কেন কেন কি হয়েছে? বয় ফ্রেন্ডের সাথে ঝগড়া করেছিস নাকি। বলেই হা হা করে হাসতে শুরু করলো।

— পারিস ও তুই জানিসতো আমার কোন বয়ফ্রেন্ড নাই, তবুও অযথা কেন এসব বলিস। গতকাল বিকালে একটা ঘটনা ঘটে গেছে তাই মনটা খারাপ।

— তরী কি এমন ঘটনা ঘটলো যে তোর মনটাই খারাপ হয়ে গেলো? পাত্র পক্ষ আসছিলো নাকি দেখার জন্য।

— উফ তুই ও না পারিসও, সোহান ভাইয়ার সাথে ঝগড়া হইছে একটু।

— তরী উফ সোহান ভাইয়া হিরো, দেখলেই মনে হয় ক্রাশ খেয়ে গেলাম।

— আচ্ছা তাই ঠিক আছে রাসেল ভাইয়ের সাথে দেখা হোক তাকে সব বলছি।

— তরী পাগল নাকি তুই? যাই হোক আমি সত্যিই বলছি সোহান ভাইয়ের সাথে চাইলে তুই প্রেম।করতেই পারিস। আর না হলে কোন দিন আমার ব্রেকআপ হয়ে গেলে আমি ঠিকই তাকে প্রোপোজ করে বসবো।

— কি সব বলিস না, বাদ দে আমি চলে যাচ্ছি বলে ভার্সিটি থেকে বের হবো এমন সময় ফারজু আর আরিফ ভাইয়ের সাথে। অনেক দিনপর দেখা কেমন আছিস তুই।

— ফারজু আমি ভালো তোর খবর কি?

— আমিও ভালো আছি, আরিফ ভাইয়া কেমন আছে।

— টুকটাক কথা বলতে বলতে ফারজু ব্যাগের ভিতর থেকে ইনভাইটেশন কার্ড বের করে দিয়ে বললো। তাড়াতাড়ি যেন চলে আসি। কার্ডটা হাতে নিয়ে আমি রিক্সায় উঠলাম।

— কার্ডটা খুলতেই ওদের নাম দু’টো দেখতে দেখতে হঠাৎ কল্পনার জগৎ এ হারিয়ে গেলাম। যেখানে কার্ডে আমার আর সোহান ভাইয়ার নাম লেখা। দু’জন মিলে কার্ড দিয়ে বেড়াচ্ছি বন্ধু বান্ধবি আত্মীয় স্বজনদের। আর লজ্জায় আমার মুখ লাল হয়ে রয়েছে সকলে নানান রকম কথা বলছে আমাদের নিয়ে শুনতে শুনতে কেমন জানি লজ্জা পাচ্ছিলাম।

— রিক্সাওয়ালা মামার ডাকে বাস্তবে ফিরে আসলাম। রিক্সা ভাড়া দিয়ে এক দৌড়ে বাড়ির ভিতর ঢুকতে যাবো অমনি দরজার সামনে কারো সাথে ধাক্কা খেয়ে পড়ে গেলাম।

চলবে..

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে