শেষ বিকেলের আলো পর্ব-০১

0
821

#শেষ বিকেলের আলো
#সূচনা পর্ব
#নিশাত_আনজুম

সেতুর হাসবেন্ড হামিদের সাথে একটা মেয়ের কাছাকাছি বসে হাত ধরা অবস্থায় ছবিটা দেখে থমকে গেল সেতু। মেয়েটার মুখ স্পষ্ট হতেই বুক কেঁপে উঠলো তার। এতোদিনের সন্দেহ তবে সত্যি হলো! মোবাইল রিং হতেই চমকে উঠলো। সেতুর বোন রিতু ফোন করেছে।

রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে রিতু উঁচু স্বরে বললো, ” দেখেছিস এবার তোর জামাই অন্য মেয়ের সাথে হাত ধরাধরি করে কী করছে! খুব তো বিশ্বাস করিস জামাইকে, দেখ এবার। ঘরে বউ বাচ্চা রেখে অন্য মেয়ের সাথে রংলীলা শুরু করেছে। দুই ঘন্টার বেশি হচ্ছে রেস্টুরেন্টে এসে বসেছে।”

অথচ আধ ঘন্টা আগে সেতু ফোন করলে তাকে বলেছে সে অফিসে ব্যস্ত। ফোন দিয়ে বিরক্ত না করতে। এভাবেই দিনের পর দিন তাকে মিথ্যা বলে যাচ্ছে হামিদ! সেতুর গলা কাঁপছে যেন। কথা বের হচ্ছে না মুখ দিয়ে। কোনোমতে রিতুকে বললো, ” মেয়েটা ওর কলিগ। তুমি অযথাই ভুল ভাবছো। মেয়েটাকে আমি চিনি। অনেকদিন ধরে মেয়েটা ঝামেলার মধ্যে যাচ্ছে তাই হামিদের হেল্প চেয়েছে। ওরা যে রেস্টুরেন্টে গেছে সেটা ফোনে বলেছে আমাকে। তুমি দয়া করে এসব ভুলভাল ভাবা বন্ধ কর।”

” আমার চোখের দেখা ভুল তাহলে! খুব সাধু না তোর জামাই! ও সহ ওর পুরো পরিবার ঠকবাজ। বারবার বলছি সেতু সময় থাকতে ব্যবস্থা নে নয়তো কপাল পুড়বে।”

সেতু এবার রেগে গেল। বললো, ” কপাল পুড়লে আমার পুড়বে। তোমাদের ভাবতে হবে না। ”

বলেই রিতুকে কিছু বলতে না দিয়ে কল কেটে দিলো। রিতুকে সে মিথ্যা বলেছে। শুধু মেয়েটা যে হামিদের কলিগ সেটাই সত্যি। হঠাৎ রায়ান শব্দ করে কেঁদে উঠলো। ফোন রেখে দৌড়ে গিয়ে দেখলো ছোট টুল উল্টে পড়ে গেছে। তাড়াতাড়ি কোলে নিয়ে কান্না থামাতে থামাতে শাশুড়ির চেঁচামেচি শুরু হলো। সে নাকি বাচ্চা দেখে রাখে না, সারাদিন ফোন নিয়ে বসে থাকে, কাজ করে না আরো নানা কথা। সেতু এবার কেঁদেই ফেললো। এই সংসার জীবন তার ভালো লাগছে না। সব ছেড়ে দূরে কোথাও চলে যেতে ইচ্ছে করছে।

হামিদ ফিরেছে সন্ধ্যা সাতটার দিকে। তার অফিস শেষ হয় বিকালে। এতদিনও সন্ধ্যায় ফিরতো। জিজ্ঞেস করলে বলতো বন্ধুদের সাথে সময় কাটায়। সেতু আজ বুঝতে পারলো কার সাথে সময় কাটায়। অফিস থেকে ফিরলে সেতু রোজকারের মতো চুপচাপ হামিদের জামা কাপড় বের করে দিলো। হামিদ নিজ থেকে কোনো কথাই বলেনি। যেন সেতু কাজের মেয়ে। তার সম্পর্কে মাথা ঘামানোর কোনো দরকার নেই হামিদের।

রাতে খেতে বসেছে সবাই। সেতু খাবার বেড়ে দিচ্ছে। হাবিব বসে সেতুকে বললো, ” তুমি বসছো না কেন ভাবী?”

সেতু বললো, ” আমি পরে বসবো। রায়ানকে খাওয়াতে হবে আগে। ”

” একা খাওয়া যায় নাকি! মেজো ভাবীও বসে গেছে। তুমি খেয়ে রায়ানকে খাওয়াতে পারবে। বসে যাও।”

রুবিনা খেতে খেতে ছোট ছেলে হাবিবকে জিজ্ঞেস করলো, ” রফিকদের বাড়িতে কেন গিয়েছিলি আজ?”

” নোভাকে কলেজে নিয়ে গিয়েছি। ওর ভর্তির লাস্ট ডেইট ছিলো আজ। ”

” ওরে ভর্তি করাতে তোর কেন যেতে হবে? ওদের ঘরে কিছু হলেই হালিমা সবকিছুতে তোরে ডাকে কেন? তুই ওদের ঘরের চাকর?”

” চাকর হতে যাবো কেন মা? চাচী আর নোভা একা। আর চাচী সবসময় অসুস্থ থাকে। ওদের ঘরে কোনো পুরুষ মানুষ নেই। তাই তাদের পাশে থাকা আমার কর্তব্য। ”

” তোর মাথা খেয়ে নিছে হালিমা। বহুত সেয়ানা মহিলা। আর যাবি না ঐখানে। তোর বাপের লগে কথা বলে আদিবার মামাতো বইন সাদিয়ারে দেখতে যাবো। এইবার বিয়ে করতে অইবো।”

” তোমাকে আগেই বলছি মা এই ভাবনাটা তুমি বন্ধ করে দাও। সাদিয়াকে আমি বিয়ে করবো না,” হাবিব রেগে বললো।

পাশ থেকে আদিবা বলে উঠলো, ” কেন? আমার বোন খারাপ কোনদিকে। ওকে বিয়ে করতে আপত্তি কেন তোমার? ”

” তোমার বোনের চালচলন আমার একদমই পছন্দ না ভাবী। আমার বিয়েতে অবশ্যই আমার পছন্দ অপছন্দের বিষয়টা গুরুত্ব দেওয়া উচিত তোমাদের। ”

” ওরেই পছন্দ আমার। ওরেই আমার ঘরের বউ করে আনবো।”

হামিদ বললো, ” মা ও মাত্র চাকরিটা পেয়েছে। ওকে একটু সময় দাও। এখনই বিয়ে করতে হবে কেন? এমন তো না যে তোমাদের দেখাশোনার জন্য বউ লাগবে। সেতু, আদিবা তো আছেই। হাবিব যখন এখন বিয়ে করতে চাচ্ছে না তখন জোর করো না ওকে।”

হাবিবের খাওয়া শেষ ততক্ষণে। সে কিছু না বলে উঠে গেল। আদিবা তার বোন সাদিয়ার গুণগান করছে। সেতুও সরে গেল সেখান থেকে।

হাবিব রুমে এসে দেখলো তার ফোন বাজছে। পরনের শার্ট খুলে ফ্যান ছেড়ে বিছানায় বসতেই রিং বন্ধ হয়ে গেল। হাবিব ফোন হাতে নিয়ে দেখলো নোভার তিনটা কল। এদিক থেকে সে কল দিতেই রিসিভ হলো।

” তুমি আমাকে মিথ্যে বলেছো কেন? আবেদন করার সময় তুমি মহসিন কলেজ সিলেক্ট-ই করোনি। করলে আমার নাম লিস্টে অবশ্যই আসতো যেখানে আমার চাইতে কম জি.পি.এ তে আমার বান্ধবীদের এসেছে।”

” চাচী নিষেধ করেছিল তাই। অতদূর গিয়ে লেখাপড়া করা তোর সম্ভব না। এখানের কলেজটা ভালো। এই কলেজে ভালো করে পড়াশোনা কর। তোর ভালো হবে।”

” ভালোর গুষ্টি কিলাই। মা বলেনি, তুমি মাকে উলটাপালটা বুঝিয়েছো। জোর করে তো তোমরা এই কলেজে ভর্তি করিয়েছো, আমি জীবনেও যাবো না কলেজে।” রেগেমেগে বললো নোভা।

” আচ্ছা যেতে হবে না। বই কিনে ঘরে পড়া শুরু করে দে। পরীক্ষার সময় গিয়ে পরীক্ষাগুলো দিলে হবে।”

” তুমি আর মা পড়ো বই কিনে। আমি আর লেখাপড়াই করবো না।”

” তাহলে তো আরও ভালো। চাচীকে বলবো ভালো দেখে বিয়ে দিয়ে দিতে তোকে।”

কথাটা শোনার সাথে সাথেই নোভা রেগে কল কেটে দিলো। হাবিব ফোন রেখে হেসে উঠলো।

খাওয়া শেষে হামিদ বিছানায় শুয়ে মোবাইল টিপছে। সেতু খেয়ে সব গুছিয়ে রুমে গেল আরও পরে। গিয়ে সেতু স্বাভাবিকভাবেই কথা বলতে চেষ্টা করলো। কিন্তু হামিদের সেদিকে মন নেই। সে হু হা করছে।চোখ আর মন তার মোবাইলের দিকে।

” দুপুরে আপনি কোথায় ছিলেন?” এবার জোরেই জিজ্ঞেস করলো সেতু।

” কোথায় ছিলাম মানে? মূর্খের মতো প্রশ্ন করো কেন? চাকরি করি আমি। অফিস করলেই সেলারি পাই। তোমার মতো আজাইরা বসে থাকলে হাতে টাকা আসে না আমার। অযথা বকবক না করে যাও এখান থেকে। ”

ঝাঁঝালো কণ্ঠে কথাগুলো বলে সে নিজেই হাতে মোবাইল নিয়ে বারান্দায় চলে গেল। ঘরে আসলেই সেতুর কথা শুরু হয়। এটা ওটা বলতে থাকে। বিরক্ত লাগে হামিদের। ইদানিং তো ওকে জেরা করতে শুরু করেছে। হামিদের মোটেও ভালো লাগে না এসবের উত্তর দিতে, বিরক্ত লাগে। আসলে ওর সেতুকেই বিরক্ত লাগে। কেন যে মাত্র তিন মাসের পরিচয়ে বিয়ে নামক এতবড় সিদ্ধান্তটা নিয়ে নিলো! সে মোবাইলের কল লিস্টে যেতেই সায়মার নাম্বারটা শো করলো। কিছু না ভেবেই কল দিলো আর সাথে সাথেই রিসিভ হলো হামিদ মুচকি হাসলো। সায়মা তার কলের অপেক্ষায় ছিলো। প্রায় দেড় ঘন্টার উপরে কথা বলেছে দুজনে। সায়মার সাথে কথা শুরু হলে শেষই হয় না। মনে হয় যুগ যুগ ধরে বিরতিহীন কথা বললেও ফুরাবে না। রুমে এসে দেখলো সেতু রায়ানকে ঘুম পাড়িয়ে বিছানায় শুইয়ে দিচ্ছে। হামিদ ফোন রেখে বিছানায় শুয়ে পড়লো জলদি। নয়তো সেতুর বকবকানি আবার শুরু হবে।

চলবে,,

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে