শেষ বিকালের আলো পর্ব-০৭

0
556

#শেষ বিকালের আলো
#পর্ব_০৭
#নিশাত_আনজুম

আজকাল সেতু বেশ ফুরফুরে মেজাজে থাকে। মনে হয় নতুন করে বাঁচতে শিখেছে। নিজেকে কীভাবে ভালো রাখতে হয় সেটা জেনে গেছে। সেতুর এই পরিবর্তনটা একদম চোখে পড়ার মতো। অবসর সময়ে সেতু নিজের মতো করে চলে। সাজগোজ করে, মুভি দেখে, গুনগুন করে গান করে, রায়ানকে নিয়ে খেলে। আগে হামিদের সঙ্গ পেতে কত কী করতো! সেতু সব কিছু এমনভাবে সামলে নিচ্ছে যে হামিদ অভিযোগ করার সুযোগটাও পাচ্ছে না। সব দায়িত্ব পালন করার পরও হামিদের মনে হচ্ছে সেতু তার কাছ থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। দায়িত্বের বাইরে সে যেন হামিদকে চেনেই না।
রাতে সেতু না ঘুমিয়ে ইউটিউবে নাটক দেখছিল। হামিদ পাশ থেকে জিজ্ঞেস করলো, ” কী দেখছো?”

সেতু শুনেও জবাব দিলো না। যেন শুনতে পায়নি এমন ভাব করলো। নাটকটা শেষের দিকে। নায়কের কান্নার সিন চলছে। নায়ক তাদের সম্পর্ক নিয়ে উদাসিন। এ নিয়ে দুজনের ঝগড়াঝাটি করে কথা বন্ধ করে দিয়েছে। এর মাঝে নায়িকার ডায়রিয়া হওয়ায় হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়েছে। নায়িকা হাসপাতালে শুনে নায়ক ভেবেছে সুইসাইড করতে চেয়েছে প্রেমিকা। তাই হাসপাতালের বেডে শুয়া প্রেমিকার পা ধরে কাঁদছে। ডায়রিয়া রোগী প্রেমিকাকে ওয়াশরুমেও যেতে দিচ্ছে না। ভাবছে ওয়াশরুমে যাওয়ার নাম করে আবার সুইসাইড করতে যাবে। এদিকে নায়িকার বেহাল অবস্থা। ফানি একটা সিন। পেট ফেটে হাসি আসছে সেতুর। তবে সে ভুলটা করলো না। হামিদ আবারও জিজ্ঞেস করলে সেতু মনে মনে কথা গুছিয়ে নিলো। তারপর মোবাইল অফ করে হামিদের দিকে তাকিয়ে উত্তর দিলো।

” খুব কষ্টের একটা নাটক। নায়ক-নায়িকার দীর্ঘদিনের সম্পর্ক। নায়িকা পাগলের মতো ভালোবাসে। কিন্তু নায়ক সম্পর্ক নিয়ে উদাসিন ছিল। নায়িকার সাথে সম্পর্কে থাকাকালীন অন্য মেয়ের সাথে সম্পর্কে জড়িয়েছে। দিনের পর দিন নায়িকাকে ধোঁকা দিয়েছে। নায়কের প্রেমে অন্ধ নায়িকা সেটা মানতে পেরে সুইসাইড করতে গেছে। এখন নায়ক কাঁদতে কাঁদতে শহীদ হয়ে যাচ্ছে ভালোবাসা হারিয়ে ফেলেছে বলে। মানে দেখেন ছেলেরা কেমন! বেশি ভালোবাসা পেলে যা হয় আর কী। ভালোবাসাকে গুরুত্বই দেয় না। বেশি ভালোবাসা পেলে তার মূল্য দিতে জানে না। মনে করে সে অবহেলা, অত্যাচার করলেও মেয়ে তাকে ছেড়ে যাবে না। ভালোবাসার মানুষটা ছাড়া ওর কোনো গতি নেই। তাই সে মেয়েকে দূর্বল ভেবে যা ইচ্ছে করে বেড়াবে। অপাত্রে ভালোবাসা দান করা সবচেয়ে বড় বোকামি। মেয়েরা সেটা বুঝতে চায় না। নিজের জীবন পর্যন্ত দিয়ে দেয়। আসলে মেয়েদেরও কী বলবো! ভালোবাসার মানুষ অবহেলা করলে, ধোকা দিলে সহ্য করতে পারে না। কোনো মেয়েই পারে না। ”

সেতু শেষের কথাটা জোর দিয়ে বললো। হামিদের বুক ঢিপঢিপ করছে। মনে হচ্ছে এসব কথা হামিদের জন্য বলা। এই প্রথম সেতুকে নিয়ে ভয় হচ্ছে তার। সায়মার কথা সেতু জানতে পারলে কী হবে সেটা নিয়ে। তখনই হামিদের ফোনটা বেজে উঠলো। ফোনটা বিছানায় থাকায় দুজনের চোখের সামনে সায়মার নাম জ্বলজ্বল করছে স্ক্রিনে। সেতু আর হামিদের চোখাচোখি হতেই হামিদের বুক কেঁপে উঠলো। সেতু চুপচাপ লাইট অফ করে শুয়ে পড়েছে। হামিদ থম মেরে বসে রইলো অনেকক্ষণ।

পরদিন অফিসে ব্রেক চলছিল। তখনই হামিদ ফোন নিয়ে দেখলো দশ মিনিট আগে সায়মা তাকে সহ অফিসের কয়েকজনকে ট্যাগ করে পাঁচটা ছবি পোস্ট করেছে। ছবিগুলো কিছুদিন আগে এক কলিগের মেয়ের বার্থডে পার্টিতে তোলা। সেখানে একটা ছবিতে হামিদ আর সেতু। ক্যাপশনে লেখা ‘আমরা’। সায়মার পরিচিতরা নিজের মতো ভেবে নিয়ে শুভ কামনা লিখে কমেন্ট বক্স ভাসিয়ে দিচ্ছে। কয়েকদিন ধরে সায়মাকে সে যথাসম্ভব এড়িয়ে চলছে। সায়মাকে বুঝিয়ে বলেছে যে তারা অনেক বড় ভুল করছে। হামিদ নিজের ভুল বুঝতে পেরেছে। তাদের সম্পর্কটা শুধু অফিসের কলিগের মতোই থাকবে। এর বাইরে আর কিছু ভাববে না। কিন্তু সায়মা নাছোড়বান্দা। সায়মার এই কাজে হামিদের মেজাজ বিগড়ে গেল। সে সায়মার সাথে সরাসরি কথা বলতে উঠলো তখনই মায়ের ফোন এলো। তিনি জানালেন সেতু রুমের দরজা খুলছে না। অনেকক্ষণ ধরে ডাকছে, ধাক্কা দিচ্ছে তাও খুলছে না। ঘরে হামিদের মা ছাড়া আর কেউ নেই। হামিদকে তাড়াতাড়ি যেতে বলেছে। মায়ের কথা শুনে হামিদের বুক কেঁপে উঠলো অজানা ভয়ে। সেতু হয়তো সায়মার পোস্ট দেখে নিয়েছে। সেতুর গতরাতের কথাগুলো মনে পড়লো। সেতু বলেছে ভালোবাসার মানুষের ধোঁকা মেয়েরা সইতে পারে না। তাহলে কি সেতু জেনে গেছে! হম্বিতম্বি করে হামিদ বেরিয়ে গেল অফিস থেকে। বাসায় গিয়ে হামিদ সেতুকে ডাকলো, দরজায় কয়েকবার ধাক্কা দেওয়ার পর দরজা খুললো। হামিদ দরজা ঠেলে ঢুকে এদিক ওদিক তাকালো। রুবিনা তেতে উঠলেন, ” কতক্ষণ ধইরা ডাকতেছি তোমারে। ডরে আমার পোলারে ডাইকা আনছি। দরজা খুলতেছো না কেন?”

সেতু অবাক হওয়ার মতো করে বললো, ” আপনাকে মা অফিস থেকে নিয়ে এসেছে? আমি আসলে ঘুমাচ্ছিলাম। আমি তো এমন মরার মতো ঘুমাই না। আজকে কী হয়েছে বুঝতে পারছি না। স্যরি মা।”

” রাহো তোমার ইনলিশ কথা। আমার জান চলে যাইতেছিল আরেকটু হইলে।” রুবিনা রাগে গজগজ করতে করতে চলে গেলেন।

” তোমার মোবাইল কই?” হামিদকে অস্থির দেখালো।

” আছে তো। বাবু কী করেছে কে জানে। চার্জ নিচ্ছে না, বন্ধ হয়ে আছে। কেন? ”

” না। অনেকবার ফোন দিয়েছি। বন্ধ পেলাম তাই।” হামিদ আসলে বোঝার চেষ্টা করছে সেতু ছবিগুলো দেখেছে কি না। সেতুর স্বাভাবিক আচরণ দেখে স্বস্তি পেল। এক্ষুনি সায়মাকে ফোন করতে হবে। সেতু বাইরে গেলে সে বারান্দায় গিয়ে ফোন করলো। সাথে সাথেই রিসিভ হলো।

“কী শুরু করেছো তুমি? ছবিটা আর কমেন্টগুলো সেতু পড়লে খুব সমস্যা হবে। বুঝছো না কেন তুমি? ”

” দেখার জন্যই তো দিয়েছি। তুমি তো বউকে বলতে পারছো না। এখন আবার পল্টি মারলে। তাহলে আমাকে ধোঁকা দিলে কেন?”

হামিদ শব্দ করে হাসলো। ” তোমাকে ধোঁকা দিয়েছি নাকি সেতুকে দিয়েছি! দেখো সায়মা, তোমার সাথে আমি কোনো কমিটমেন্ট করিনি। আমাদের সম্পর্কও বেশিদূর এগোয়নি। শুধু এখানে-ওখানে ঘুরতে গিয়েছি, খেতে গিয়েছি এসব। আর সেগুলোও করেছি তোমার ফাঁদে পড়ে। তুমি আমাকে সুযোগ দিয়েছো আমি বিবাহিত, এক বাচ্চার বাপ জেনেও।”

” এতো সাধু হলে তুমি কেন সুযোগটা গ্রহণ করেছো? আমি তো এতল সহজে ছাড়ছি না তোমাকে।”

” আমি বলছি না আমি সাধু। আমার দোষ স্বীকার করছি। তুমি আমাকে মাফ করে দাও। এখন আমি খুব ডিপ্রেশনে আছি সায়মা। আমি শান্তি পাচ্ছি না। তুমি প্লিজ কোনো ঝামেলা করো না। তোমাকে আমি আগেই বুঝিয়ে বলেছি। এখন তুমি যদি কোনো ঝামেলা করো তাহলে আমি তোমাকে, তোমার পরিবারকেও ছাড়বো না। তোমার চাকরিটা পেতে আমি সাহায্য করেছি, হারাতেও সাহায্য করবো যদি উলটাপালটা করো। মনে রেখো।”

সায়মাকে কিছু বলতে না দিয়ে কল কেটে দিল। রুমে যেতেই দেখলো সেতু ওয়াশরুম থেকে বের হচ্ছে। হামিদ এগিয়ে যেতেই মৃদু স্বরে আহ্ করে উঠলো। তাড়াহুড়ো করে গাড়িতে উঠার সময় পা কীসের সাথে লেগে কেটে গেছে। সেতু সেটা দেখে বললো,” পা থেকে তো অনেক রক্ত বের হচ্ছে। এতো কাটলো কীভাবে? ”

হামিদ বিছানায় পা তুলে দেখতে লাগলো। বললো, ” তাড়াহুড়োয় এসেছি। কোথায় লেগেছে কী জানি! এখন টের পেলাম। ”

” আমি সুইসাইড করেছি মনে করেছেন? ” জিজ্ঞেস করেই সেতু হাসলো।

‘ না’ বলতেই হামিদের গলা জড়িয়ে এলো। ঐ মুহূর্তের কথা ভেবে বুক কেঁপে উঠলো। সেতুকে ছাড়া সে নিজেকে কল্পনাও করতে পারছে না। নিজের ভুলের জন্য সারাক্ষণ অপরাধবোধে ভুগছে।

” এতো সহজে মরছি না আমি। ”

সেতু সায়মার পোস্ট দেখেছে, পোস্টের কমেন্টগুলোও পড়েছে। সে চাইলেই হামিদকে বলতে পারতো, এটা নিয়ে ঝামেলা করতে পারতো। তার মনে হলো হামিদকে বুঝানো উচিত সেতু তার জীবনে না থাকলে কেমন হবে। তাই সে ইচ্ছে করেই মোবাইল বন্ধ করে দরজা বেঁধে বসে ছিল। সে জানতো শাশুড়ী ভয় পেয়ে ছেলেকে ডাকবে। আজকে হামিদের অস্থিরতা দেখেছে সে। একটু আগে সায়মাকে বলা কথাগুলোও শুনেছে। সেতু মনে মনে বললো, ” আমি কিছুই বলবো না আপনাকে। ভুল যে করেছেন সেটা নিজের মুখেই স্বীকার করবেন। এতো সহজে ছাড়ছি না আপনাকে। ”

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে