শেষ পরিণতি পর্ব-০১

0
1912

গল্পঃ #শেষ_পরিণতি
পর্ব ১
লেখিকাঃ Tuba Binte Rauf

রূপের অংহকার যে পতনের মূল তা প্রমাণ হলো আবারো।
আমার চাচতো বোন নীলিমা ছিলো অনেক সুন্দরী।
এক কথায় আমাদের এলাকার সব ছেলেদের ক্রাশ। টানা টানা চোখ, হালকা গোলাপি ঠোঁট যেন তাজা গোলাপের পাপড়ি, ফর্সা টসটসে গালে দুইটা টোল, যেন সব সৌন্দর্য দিয়ে সযত্নে তৈরি কোনো আসমানী পরী।
তার এমন সৌন্দর্য নিয়ে মুগ্ধ সবাই।নিজের ও অহংকারে পা পড়ে না মাটিতে।
নিজেকে সুসজ্জায় সজ্জিত করে যখন দম্ভের সাথে রাস্তা দিয়ে হেঁটে চলে, তখন বাচ্চা থেকে বুড়ো বয়সী সবাই তার দিকে তাকিয়ে থাকে।
এলাকার বড় ভাইরা কামুক দৃষ্টিতে তাকায় ওর দিকে, কিন্তু ব্যাপারগুলো ও বেশ উপভোগ করে।
তবে
ও যখন স্কুলে যেতো তখন হিজাব পরে সুশ্রীভাবেই যেতো।
কোনো ছেলেদের সাথে কথা বলতো না মেয়ে বান্ধবী ছাড়া, পরিবারের কড়া শাসন ছিলো।
আমাদের ক্লাসের হাতে গুনা কয়েকজন ছাড়া সবাই ক্লাস করতে যেতো শুধু নীলিমাকে দেখার জন্য।
ক্লাসের মেয়েরা তার সাথে অনেক ভাব জমাতে চায়। মেয়েরা যখন ওকে বলে, তুই আসলে অনেক সুন্দর আমরা মেয়ে হয়েও তোর অপরূপ চেহারায় মুগ্ধ। এতো সুন্দর কেন তুই!
নীলিমা তাদের বলে,
-নিজেকে আমি ফিট রেখেছি তাই এত সুন্দর। নিজেকে সুন্দর রাখতে হলে অনেক কিছু করতে হয়, যেটা সবার দ্বারা সম্ভব নয়।
উপরোক্ত কথাগুলো সবাইকে বললেও ইঙ্গিত করে মিতুর উপর। মিতু ক্লাসের সবচেয়ে ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট। স্বাস্থ্যে অনেক মোটা। শ্যাম বর্ন গায়ের রঙ। কিন্তু চেহারার মাঝে একটা মায়া আছে।
নীলিমা সবার সাথে কথা খুব কম বলে। কিন্তু যখনই বলে, নিজের প্রশংসা করে, নইলে অন্যকে ছোট করে কথা শুনায়।
বিষয়টা আমার খারাপ লাগলেও কখনও কিছু বলি না, কারণ আমি জানি ওকে এসব বলে কোনো লাভ নেই।
আমাদের স্কুলের ইংলিশ টিচার ওকে অনেক পছন্দ করতো, এমনকি নীলিমার বাসায় বিয়ের প্রস্তাব ও দেয়। ও সেটা রিজেক্ট করে দিয়েছিলো।
একদিন ক্লাস ভর্তি সবার সামনে আমাদের ম্যাথ টিচার ওকে বলে, নীলিমা তুমি এত সুন্দর প্রেম করো না কেন?
ও হাসি দিয়ে, বলে আমার মতো যোগ্য কাউকে এখনো পাইনি তাই।
নীলিমার সামনে সামনে সবাই ওর অনেক প্রশংসা করলেও আড়ালে সবাই ওকে দেমাগি বলে ডাকে, এবং নানারকম সমালোচনায় মেতে ওঠে প্রায়ই।
এরমাঝেই একদিন আমাদের এলাকার একটা নতুন ছেলে আসে। অনেক সুন্দর ও ভদ্র ছেলেটি।
তার নাম রাজন।
অন্যান্য ছেলেদের মতো রাজনও নীলিমার প্রেমে পড়ে যায়।
বেশ কয়েকদিন নীলিমার পেছন পেছন ঘোরে।
নীলিমা বিষয়টা উপভোগ করলেও সবসময় রাজনকে এড়িয়ে যায়।
রাজন প্রায়ই আমার দ্বারা নীলিমার জন্য নানারকম গিফ্ট পাঠাতো, নীলিমা সবকিছুই এক্সেপ্ট করতো কিন্তু রাজনের সাথে বলতো না, শুধু সামনাসামনি হলে একটা মুচকি হাসি দিতো।
এতেই বেজায় খুশি ছিলো রাজন।
এভাবেই চলছিলো দিন। একদিন বিকালে ক্লাস শেষে আমি আর নীলিমা বাসায় ফিরছিলাম।
ফেরার পথে একটা গলিতে ঢুকতেই,আচমকা পেছন থেকে কেউ এসে নীলিমার চোখ বেঁধে ফেলে।
আমি চিৎকার দিতে গিয়ে রাজনকে দেখে থেমে যাই।
সে আমার দিকে ইশারা করে চুপ করতে বলে।
আমি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে ওদের পেছন পেছন হাঁটতে শুরু করি। ছেলেটার চেহারার মাঝে কোনো চতুরতা নেই। ওকে দেখলেই মনে হয়, একে বিশ্বাস করা যায়। আমিও সেই বিশ্বাস রেখে এগিয়ে চলি।
নীলিমা শুরুতে চিল্লাচিল্লি করলেও রাজনের কন্ঠ শুনে থেমে যায়।
রাজন নীলিমাকে নিয়ে একটা বাসায় ঢোকে।
বাসার ভেতর ঢুকে, চারপাশে তাকিয়ে আমি অবাক হয়ে যাই। পুরো রুম লাল বেলুন ও নীলিমার ছবি দিয়ে সাজানো। সামনে একটা টি টেবিলে অনেকগুলো গোলাপফুল রাখা।
বেশ কয়েকজন ছেলেমেয়েদেরও দেখা যাচ্ছে, এদেরকে আমি মাঝে মাঝেই রাজনের সাথে দেখেছি। ওর বন্ধু বান্ধবই হবে হয়ত।
রাজন কি করতে চাচ্ছে আমি বুঝতে পেরেছি।
প্রস্তুতি কিন্তু মন্দ নয়, আমার মনে হচ্ছে এবার নীলিমা আর না করতে পারবে না।
রুমের মধ্যখানে নিয়ে নীলিমার চোখের বাঁধন খুলে দেওয়া হয়।
টেবিল থেকে সবগুলো গোলাপ নিয়ে নীলিমার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে, নীলিমাকে প্রপোজ করে রাজন। চারদিকে থেকে রাজনের বন্ধুরা ফুল ছিটাচ্ছে ওদের দু’জনের উপর।
ফুলগুলো নীলিমার দিকে ধরে বসে আছে রাজন।
নীলিমা চারদিকে চোখ বুলিয়ে একটু মুচকি হেঁসে রাজনের হাত থেকে ফুলগুলো নিলো।
হাতে নিয়ে নেড়েচেড়ে দেখে ফুলগুলো হঠাৎ ফেলে দিলো পায়ের কাছে।
আমরা সবাই থমকে গেলাম।
এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি ওদের দিকে।
নীলিমা ফুলগুলো ফেলে দিয়েই কষে থাপ্পড় দিলো রাজনের মুখে। আকস্মিক এমন ঘটনায় আমরা সবাই হতভম্ব হয়ে গেলাম।
রাজনও মুখে হাত দিয়ে অবাক চোখে তাকিয়ে আছে নীলিমার দিকে।
নীলিমা রাজনকে বলে উঠলো,
-তুই ভাবলি কি করে আমি তোর প্রস্তাবে রাজি হবো?
তোর মতো একটা খ্যাত ছেলে আমার বয়ফ্রেন্ড হওয়ার যোগ্যতা যে ১% ও রাখে না সেটা তোর বোঝা উচিৎ ছিলো। কি আছে তোর?
তুই এসেছিস আমাকে প্রপোজ করতে?
কত বড় বড় ঘরের ছেলেদের আমি রিজেক্ট করেছি,সেখানে তুই তো তাদের নখেরও যোগ্য না।
আর তোর সাহস হলো কিভাবে আমাকে টাচ করার? পরবর্তীতে যদি এমন কিছু করার বা আমার পিছে পিছ ঘোরার সাহস করেছিস তাহলে, এলাকার গুন্ডাদের ডেকে হাত পা ভাঙাতে আমার সময় লাগবে না মনে রাখিস।
কথাগুলো বলে নীলিমা আমার হাত ধরে হাঁটা শুরু করলো।
বেচারা রাজন ওভাবেই মাথা নিচু করে বসে রইলো। মনে খুব খারাপ লাগা তৈরি হয়েছে।
কেন যেন রাজনের জন্য মায়া লাগছে খুব।
আমি কিছুদুর গিয়ে নীলিমাকে থামিয়ে দিয়ে বললাম,
-কেন করলি নীলিমা এমন?
তোর ইচ্ছে না হলে তো না গেলেই পারতি প্রথমে। আবার পরে ভালোভাবেও না করতে পারতি,শুধু শুধু ছেলেটাকে এভাবে অপমান করাটা কি ঠিক হলো?
তুই তো জানিস, রাজন তোকে কতো ভালোবাসে।
– আরে বাদ দে তো তুবা। আমাকে তো কতো মানুষ ভালোবাসে, তাই বলে কি সবার ভালোবাসা গ্রহণ করতে হবে?
তাছাড়া আমি তো ভুল কিছু বলিনি। ওর জায়গা ভালোভাবে বুঝিয়ে দিয়েছি, বামন হয়ে চাঁদে হাত দিতে এসেছে, হাউ ফানি!
নীলিমার কথাগুলো আমার কাছে খুব অসহ্য লাগছিলো। আমি নীলিমাকে রেখে একা দ্রুত হাঁটতে শুরু করি।
-তুবা! তুই কেন এতো রাগ করছিস? দাঁড়া না আমাকে নিয়ে যা। কথাগুলো বলে নীলিমাও আমার পেছন পেছন হাঁটতে শুরু করে।
.
.
.
সেদিনের পর থেকে আর রাজনকে দেখা যায়নি।
অজানা কারণে রাজনকে আমার খুব মনে পড়তো। নীলিমার প্রতি রাজনের ভালোবাসা সত্যি ছিলো,কিন্তু নীলিমা সেটা বুঝলো না।
এরপর কেটে গেল কয়েকমাস।
আমরা স্কুলের গন্ডি পেরিয়ে কলেজে উঠেছি।
নীলিমা এখনো রুপে অপরূপ। বরং দিনে দিনে ওর সৌন্দর্য যেন বেড়েই চলেছে। আগের মতোই ছেলেরা এখনও নীলিমার জন্য পাগল।
নীলিমার স্বভাব বদলায়নি একটুও। সৌন্দর্যের সাথে সাথে ওর অহংকারও বেড়ে চলেছে।
কিন্তু গত কয়েকদিন ধরে ওর চলাফেরায় বেশ ভিন্নতা দেখা যাচ্ছে।
কলেজের সিনিয়র ভাইয়া ফাহিমের সাথে ওকে বেশ ঘনিষ্ঠ হতে দেখা যাচ্ছে প্রায়ই।
ক্লাসের ফাঁকে ফাঁকে ওরা দু’জন মিলে আলাদা আড্ডায় মেতে ওঠে। ক্যাম্পাসে, হোটেলে সবখানেই দু’জন একসাথে। ব্যাপারটা আসলেই সন্দেহজনক। ওদের ভেতরে কি সম্পর্ক সেটা নিয়ে আমার মাথা ব্যথা নেই, তবে নীলিমা ফাহিমের সাথে চলাফেরা নিয়ে অকারণেই আমাকে মিথ্যা বলে যেটা আমার খুব খারাপ লাগে। পুলিশ কমিশনারের একমাত্র ছেলে ফাহিম। বাবার ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে কলেজ কাঁপিয়ে বেড়ায় সবসময়। অন্যদিকে, কলেজের সবচেয়ে সুন্দরী মেয়ে, হাজারও ছেলেদের ক্রাশ নীলিমা, দু’জনের ঘনিষ্ঠতা কলেজের অনেকেরই চোখে পড়ে।
কিন্তু ফাহিমের ভয়ে কেউ কোনো কথা বলে না।

আজ সোমবার।
কলেজে শেষে আমি ও নীলিমা গেট থেকে বের হয়ে হাঁটছি।
কিছুদুর আগাতে পেছন থেকে কারও ডাক শুনে আমরা দাঁড়িয়ে পরি।
পেছনে ফিরে দেখি সানগ্লাস পরে একটা ছেলে বাইকের উপর বসে আছে।
ছেলেটার দিকে ভালোভাবে তাকিয়ে আমি হেঁসে দিয়ে বললাম,
-আরে রাজন ভাইয়া আপনি! এতোদিন পরে কোথা থেকে আসলেন?
আমার মুখে রাজনের কথা শুনে নীলিমা অবাক হয়ে গেলো।
রাজন বাইক থেকে নেমে আমাদের দিকে এগিয়ে এসে, হাই বলে হ্যান্ডসেক করার জন্য নীলিমার দিকে হাত বাড়ালো।
নীলিমা রাজনের সাথে হাত না মিলিয়েই বলতে শুরু করলো,
-বাহ! বেশ স্মার্ট হয়ে গেছো দেখছি।
দামি বাইকও কিনেছো, বেশ ভালো।
রাজন মুচকি হাসি দিয়ে বললো,
-হ্যা এখন আমার সব আছে। নিজেকে পুরো পাল্টে ফেলেছি, আর এই সব পরিবর্তন শুধু তোমার জন্য নীলিমা। এখনও কি আমাকে বিয়ে করতে তোমার আপত্তি আছে?
রাজনের কথা শেষ হতে না হতেই নীলিমা হো হো করে হেঁসে উঠলো।
আমি নীলিমার হাসির কারণটা বুঝতে না পেরে অবাক চোখে তাকিয়ে রইলাম তার দিকে।
.
.
.
(চলবে)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে