শেষটা সুন্দর পর্ব-০৭

0
660

#শেষটা_সুন্দর
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
৭।

ক্লাস শেষ করে নিচে নামতেই রাবীরের গাড়ি দেখে মেহুলের চোখ মুখ কুঁচকে যায়। মানে লোকটাকে যেটা না করা হবে উনি সেটা আরো বেশি করে করবেন। মেহুল সিঁড়ি বেয়ে নেমে এক কোণে দাঁড়ায়। রাবীরের সঙ্গে তার দু’জন স্যার কথা বলছেন। মেহুল এখন ভুলেও তাদের সামনে যাবে না। রিতা বলল,

‘কী হলো, চল।’

‘না, দেখছিস না স্যাররা দাঁড়িয়ে আছেন। আমি ভুলেও উনাদের সামনে যাব না।’

‘কেন যাবি না? স্যাররা তোকে আবার নতুন পরিচয়ে চিনবেন, সেটা তো ভালোই হয়। চল।’

‘আরে তুই যা তো। আমি যাব না এখন।’

রিতা মেহুলকে রেখে রাবীরদের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। সালাম দিয়ে বলে,

‘ভাইয়া, ঐ যে মেহুল।’

মেহুল রাগে গজগজ করতে থাকে। রাবীর মেহুলের দিকে চেয়ে তাকে ডাকে। মেহুলের এই মুহুর্তে ইচ্ছে করছে রিতাকে চিবিয়ে খেয়ে ফেলতে। সে চোখ মুখ খিঁচে পা বাড়িয়ে রাবীরের সামনে এসে দাঁড়ায়। স্যারদের সালাম দেয়। একজন স্যার সালামের জবাব দিয়ে বললেন,

‘মেহুল, আপনি যে রাবীর সাহেবের ওয়াইফ আমরা তো জানতামই না। এখন জেনে অবশ্য খুব ভালো লাগছে যে, আমাদের মেয়ে ভালো একজন জীবনসঙ্গী পেয়েছে।’

মেহুল না পারতে হাসে। বলে,

‘জি স্যার, দোয়া করবেন।’

স্যাররা আর কথা বাড়াল না। উনারা চলে যাওয়ার পর রাবীর বলল,

‘চলুন।’

মেহুল শক্ত গলায় বলল,

‘আপনাকে না এত ভেতরে আসতে বারণ করেছি। কেন এসেছেন?’

রাবীর তার দিকে চেয়ে বলল,

‘আমার যেটা ঠিক মনে হয়েছে সেটাই করেছি। আর ভবিষ্যতেও তাই করব। চলুন।’

মেহুল নাকের পাল্লা ফুলিয়ে নিঃশ্বাস ফেলে। এই লোকটাকে কিছু বলেও লাভ নেই। অসহ্য একটা।

মেহুল গিয়ে পেছনে বসতেই রাবীর বলল,

‘প্রথম দিন পেছনে বসেছিলেন বলে কিছু বলিনি। তবে একটা কথা জেনে রাখা ভালো, যখন আপনার হাজবেন্ড গাড়ি ড্রাইভ করবেন তখন আপনার উচিত তার পাশের সিটে এসে বসা। এটাও কিন্তু একটা গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা, সেটা নিশ্চয়ই আপনি জানেন?’

মেহুল দীর্ঘশ্বাস ফেলে দরজা খুলে গাড়ি থেকে বের হয়। তারপর সামনের দরজা খুলে রাবীরের পাশের সিটে গিয়ে বসে। রাবীর খানিক চুপ থেকে বলে,

‘ধন্যবাদ।’

_____

‘কী খাবেন?’

‘কফি।’

‘এই ভরদুপুরে কেউ রেস্টুরেন্টে এসে কফি খায় না। খাবার অর্ডার দিন।’

মেহুল মেনু কার্ডটা রাবীরের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,

‘তাহলে আপনিই অর্ডার করুন।’

রাবীর মেনু কার্ডটা নিয়ে ওয়েটারকে দেখে খাবারের অর্ডার দেয়।

তারপর সে চেয়ারে হেলান বসে। মেহুলের দিকে চেয়ে বলে,

‘এবার বলুন কী বলবেন।’

মেহুল রাবীরের দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে বলল,

‘আচ্ছা, আমাকে একটা কথা বলুনতো…’

‘হু…’

‘আপনি কি একটু নরমাল ড্রেস আপে আসতে পারেন না?’

রাবীর ভ্রু কুঁচকে তাকায়। বলে,

‘কেন? আমার এই ড্রেস আপে কী সমস্যা?’

‘এই যে সারাক্ষণ এমন একটা সাদা পাঞ্জাবী গায়ে দিয়ে নেতা সেজে সেজে ঘুরেন, আপনার বিরক্ত লাগে না? একটু তো ক্যাজুয়াল ভাবেও আসতে পারেন। সবসময় এমন নেতা সেজে ঘুরলে ভালো লাগে?’

রাবীর স্মিত হাসে। বলে,

‘আমাকে আপনার ক্যাজুয়াল লুকে দেখার ইচ্ছে সেটা আগে বললেই পারতেন।’

‘মোটেও তা না। আপনাকে আমি কোনো লুকেই দেখতে চাই না। ইনফেক্ট, আমি আপনাকে দেখতেই চাই না। নেহাতই এখন আমাকে ঐ কথাগুলো বলতে হবে, তাই এসেছি। না হলে জীবনেও আসতাম না।’

‘জি বুঝেছি। এবার তাহলে ঐ কথাগুলো বলে ফেলুন।’

মেহুল গভীর নিঃশ্বাস নেয়। নিজেকে ধাতস্ত করে। জিভ দিয়ে শুকনো ঠোঁট ভিজিয়ে বলে,

‘আপনি জানেন, এই বিয়েতে আমার মত ছিল না। তাও আমি মা বাবার কথা ভেবে বিয়ে করেছি। ঠিক আছে, বিয়ে যখন হয়েছে সেটা আমাকে মেনেও নিতে হবে, আমি জানি। কিন্তু, আমার তো খারাপ লাগছে অন্য জায়গায়। আপনার মা আমাকে যেসব শর্ত দিয়েছেন ঐসব শর্ত মানা আমার পক্ষে সম্ভব না। আপনি তো ভালো মানুষ, সবাই বলে। তাই আপনাকে বলছি, আপনি নিশ্চয়ই আমাকে বুঝবেন। তাই প্লিজ, আপনি আমায় সাহায্য করুন।’

‘আপনার সমস্যার কথা আপনি খুলে বলুন। এভাবে ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে বললে বুঝব কী করে?’

‘বলছি। আসলে, আমি গানটাকে খুব ভালোবাসি। ছোট বেলা থেকেই গান গাই। স্কুল, কলেজ, ভার্সিটি সব জায়াগাতেই সবাই আমাকে এই গানের মাধ্যমেই চিনত এবং এখনো চিনে। আমি এই গানটাকে কোনোমতেই ছাড়তে পারব না। কিন্তু, আপনার মা বলেছেন আমি যেন আর গান না করি। যেটাকে আমি ক্যারিয়ার হিসেবে নিতে চেয়েছি, আমার স্বপ্ন বানিয়েছি, উনি সেই জিনিসটাকেই আমার কাছ থেকে কেড়ে নিতে চাইছেন। এখন আপনিই বলুন আমি কী করব?’

রাবীর জবাব দেওয়ার আগেই সেখানে ওয়েটার খাবার নিয়ে চলে আসেন। তাই সে থেমে যায়। খাবার রেখে ওয়েটার আবার চলে যায়। রাবীর বলে,

‘নিন, শুরু করুন।’

‘হ্যাঁ, কিন্তু আপনি আগে কিছু বলুন।’

রাবীর এক চামচ ফ্রাইড রাইস মুখে পুরে বলল,

‘খাবারটা ভালো, খেয়ে দেখুন।’

মেহুল বিরক্ত হলো। বলল,

‘খাবো তো। আগে আপনি আমার কথার জবাব দিন।’

রাবীর আরো দু চামচ খেল। মেহুল বিরক্ত হয়ে বসে রইল তার জবাবের আশায়। রাবীর এক ঢোক পানি খেল। অতঃপর সে মেহুলের দিকে চেয়ে স্বাভাবিক গলায় বলল,

‘আপনি না বললেন, আমার মা আপনাকে আগেই বলে দিয়েছেন। সেখানে আর আমি কী বলব?’

মেহুলের বুকের ভেতরে তখন ধক করে উঠল। সে টেবিলের উপর দু’হাত রেখে এগিয়ে এসে বলল,

‘আপনার মা তো নিষেধ করেছেন। আপনিও কি তবে আপনার মায়ের সাথে একমত?’

রাবীর ঠোঁট গুঁজ করে কিছুক্ষণ মেহুলের দিকে চেয়ে রইল। মেহুলের চোখে মুখে প্রচন্ড অস্থিরতা ছেয়ে পড়ছে। ক্রমে ক্রমে বিরক্তির মাত্রাও বাড়ছে তার। লোকটা একটা কথা বলতে এত সময় কেন নিচ্ছেন?

রাবীর ভেবে বলল,

‘আপনি কী চান?’

‘আমি গান গাইতে চাই। বড়ো গায়িকা হতে চাই।’

‘কিসের জন্য?’

মেহুল কপাল কুঁচকে বলে,

‘কিসের জন্য মানে?’

‘দেখুন, সবকিছুরই তো একটা উদ্দেশ্য থাকে। আপনার গায়িকা হওয়ার পেছনেও নিশ্চয়ই একটা উদ্দেশ্য আছে; আমি সেই উদ্দেশ্যটাই জানতে চাইছি।’

‘স্বাভাবিক ব্যাপার, আমি গান ভালোবাসি; তাই গায়িকা হতে চাই।’

‘শুধুমাত্র গান ভালোবাসেন বলেই গায়িকা হতে চান? নাকি গায়িকা হলে, আপনি নাম, যশ, খ্যাতি পাবেন বলে গায়িকা হতে চান?’

‘ভালো গান গাইতে পারলে এগুলো তো এমনিতেই পাব।’

‘হ্যাঁ, সেটাই। তেমনি আপনি আমার ওয়াইফ বলেও এই জিনিসগুলো এমনিতেই পাবেন। আপনাকে তার জন্য আলাদা করে আর কষ্ট করতে হবে না।’

মেহুল চোখ মুখ কুঁচকে বলে,

‘আপনি কি বলতে চাইছেন, আমি কেবল নাম, যশ আর খ্যাতির জন্য গায়িকা হতে চাই? গায়িকা হওয়া আমার স্বপ্ন। আমি কেবল নিজের স্বপ্ন পূরণ করতে চাই, ভালো গায়িকা হতে চাই। তারপর যদি এই জিনিসগুলো আমি নাও পাই তাতেও আমার কিছু যায় আসে না। আপনি ভুল ভাবছেন।’

‘ঠিক আছে, বুঝলাম। এখন খেয়ে নিন, খাবার ঠান্ডা হচ্ছে।’

রাবীরের আচরণে মেহুলের মাথা গরম হলেও নিজেকে সে যথেষ্ট শান্ত রাখার চেষ্টা করছে। সে তাই ঘন ঘন নিঃশ্বাস ফেলে নিজেকে শান্ত করে। রাবীরের দিকে চেয়ে নরম গলায় বলে,

‘আমি এখানে আপনার সাথে খেতে আসিনি। আমার স্বপ্নের কথা বলতে এসেছি। আপনি কেন আমার কথায় গুরুত্ব দিচ্ছেন না?’

রাবীর পাঞ্জাবী প্রথম বোতামটা খুলে পেছনের দিকে ঠেলে দেয়। রেস্টুরেন্টে এসি চললেও তার যে বেশ গরম লাগছে সেটা তাকে দেখেই বুঝা যাচ্ছে।

অতঃপর সে মেহুলের দিকে চাইল। কোমল স্বরে বলল,

‘আমার মা যা অপছন্দ করেন না, আজ পর্যন্ত তা কোনোকিছুই আমি করিনি। মা’কে আমি প্রচন্ড সম্মান করি। আর তারপর সেই সম্মানিত স্থানে আমি আপনাকে বসিয়েছি। তাই আপনাকেও আমি কষ্ট দিতে পারব না। আমি মায়ের সাথে কথা বলব। আমি নিশ্চিন্তে থাকুন।’

মেহুলের মন নিমিষেই খুশিতে ঝলমলিয়ে উঠে। সে আনন্দে আত্মহারা হয়ে বলে,

‘সত্যি?’

‘হু, সত্যি।’

‘অনেক অনেক ধন্যবাদ আপনাকে। আর সরিও, আগের খারাপ ব্যাবহারগুলোর জন্য। শুনুন, শুধু কথা না, মা’কে একদম রাজি করাবেন। আমি জানি মা আপনার কথা জীবনেও ফেলতে পারবেন না।’

‘হু, আই হোপ সো।’

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে