শুভ্র নীলের প্রেমপ্রহর ২ পর্ব-০৬

0
1121

#শুভ্র_নীলের_প্রেমপ্রহর_২
লেখক-এ রহমান
পর্ব ৬

ফ্যান চলছে শন শন শব্দে। ঘরের দরজাটা অর্ধেক খোলা। ভেতরে তেমন তীব্র আলো নেই। কোন রকমে দেখা যাচ্ছে। ঈশা ধির পায়ে দরজার কাছে এসে দাঁড়ালো। কিছুক্ষন আগে ইভানের চেহারা দেখে তার মনে ভয় তৈরি হয়েছে। এখন সামনে যেতেও বুক দুরুদুরু কাঁপছে। কখন রাগ করে বসে সেটা ঈশা আজও বুঝতে পারল না। একটা শ্বাস টেনে দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। মাথাটা বাড়িয়ে দিয়ে ভেতরে তাকাল। ইভান পকেটে হাত গুঁজে জানালার বাইরে তাকিয়ে আছে। ঈশা ভয়ে ভয়ে ভেতরে ঢুকল। এগিয়ে গিয়ে ইভানের পেছনে দাঁড়ালো। নিচের দিকে তাকিয়ে মিনমিনে কণ্ঠে বলল
–কেন ডাকলে?

ইভান ঘুরে তাকাল। শান্ত কণ্ঠে বলল
–এসব করে কি প্রমান করতে চাও?

ঈশা থমকাল। চোখ তুলে তাকাল ইভানের দিকে। বোঝার চেষ্টা করলো কি বলতে চায়। কিন্তু বুঝতে না পেরে কৌতূহলী কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো
–কিসের কথা বলছ? আমি তোমার কথা বুঝতে পারছি না।

ইভান মৃদু হাসল। বলল
–এই আফসোসটা আমার সারাজীবন থাকবে যে তুমি আমার কথা বোঝনা। যাই হোক এই যে তুমি বাড়ির বউয়ের মতো দায়িত্ব পালন করছ। নিজের মতো সবার খেয়াল রাখছ। এতে তোমার প্রতি সবার এক্সপেকটেশন বেড়ে যাচ্ছে। কয়েকদিনে এই বাড়ির সবকিছু তোমার উপরে নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। মা চাইছে তুমি এই বাড়িতেই থাকো।

ঈশা অস্থিরভাবে কয়েকবার পলক ফেললো। অসহায়ের মতো জিজ্ঞেস করলো
–মা চাইছে? আর তুমি?

ইভান হেসে ফেললো। বলল
–কি বলেছিলাম ভুলে গেছো? বলেছিলাম যেদিন তোমার মনে হবে আমার শাস্তি পাওয়া হয়ে গেছে আর এখন যা হচ্ছে পুরোটাই আমার সাথে অন্যায়। সেদিন তুমি আমার কাছে আসবে। আমি সেদিনের জন্য অপেক্ষা করবো।

ঈশা পূর্ণদৃষ্টি মেলে তাকাল। মনে পড়ে গেলো সেদিনের কথা। ঠিক এভাবেই বলেছিল ইভান। ঈশা সেদিন তার কাছে সময় চেয়েছিল। ঠিকঠাক নিজেকে গুছিয়ে নেয়া হয়ে গেলেই চলে আসবে। ইভান কে বলতে হবে না। কিন্তু আজও কেন সময় শেষ হচ্ছে না? কেন নিজেকে গুছিয়ে নিতে পারছে না সে? গুছিয়ে নেয়াটা কি তাহলে শুধুই বাহানা। আজ ঈশার মনে হচ্ছে সে সত্যিই ইভান কে অনেক কষ্ট দিয়েছে। একটু সাহস করে নিজেকে পরিস্থিতির সাথে খাপ খাইয়ে নিতে পারলেই তারা একসাথে ভালো থাকতে পারতো। কিন্তু আজ এই সম্পর্কের মাঝে অনেক দূরত্ব তৈরি হয়েছে। ইভানের ঐ গভীর দৃষ্টিতে আগে ভালবাসা চোখে পড়ত। কিন্তু এখন শুধু অভিমান। কিছুই আগের মতো নেই। সবটার জন্য ঈশা নিজে দায়ী। ইভান সম্পূর্ণ চেষ্টা করেছিল তাকে ভালো রাখার। কিন্তু সে নিজেই উপলব্ধি করতে পারেনি। ভীষণ স্বার্থপর সে। ইভানের কষ্টটা সে বুঝতে চায়নি। কথাটা ভাবতেই তার চোখ ছলছল করে উঠলো। ইভান বিষয়টা খেয়াল করলো। তার মনটা ভীষণ খারাপ হল। সে ঈশাকে কষ্ট দিতে চায়নি। মায়ের কথা রাখতেই ঈশাকে এসব কথা জানানো জরুরী ছিল। সে এখনই এই বাড়িতে আসতে না চাইলে এভাবে দায়িত্ব পালন করার কোন প্রয়োজন নেই তো। শুধু এই বাড়ির মানুষ কেন সে নিজেই তার উপরে নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে। এতো বছর দূরে থেকেও ইভানের এমন কষ্ট হয়নি। সে পরিস্থিতি মেনে নিয়েছিল। কাছে পাওয়ার আকুলতা দমিয়ে রাখতে সক্ষম হয়েছিলো। কিন্তু এখন কেন পারছে না। তার প্রতিটা মুহূর্তে মনে হচ্ছে দম বন্ধ হয়ে আসছে। ঈশাকে যত কাছ থেকে দেখছে ততই তার প্রতি দুর্বল হয়ে পড়ছে। মনে হচ্ছে ঈশাকে তার ভীষণ প্রয়োজন। নাহলে দম বন্ধ হয়ে মারা যাবে। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবগি কণ্ঠে বলল
–আমি তোমাকে কষ্ট দিতে চাইনি ঈশা। তোমাকে কষ্ট দেয়ার ক্ষমতা আমার নেই। কথাগুল বলা জরুরী ছিল। আর আমি তোমাকে জোর…।

ইভান কথা শেষ করতে পারল না। তার আগেই ঈশার চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়লো। নিজের কান্নাটা আটকে রেখে থেমে থেমে বলল
–আমি বাড়ির বউয়ের মতো দায়িত্ব পালন করছি না। বড় বউ হিসেবে সবার খেয়াল রাখা আমার দায়িত্ব। এতদিন আমি সেটা করতে পারিনি আমার ব্যর্থতা। এখন আর এমন হবে না। জোর করতে হবে না। আমি নিজেই চলে আসবো।

বলে চোখের পানি মুছে ঘুরে দাঁড়ালো। চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই ইভান গম্ভীর আওয়াজে বলল
–যদি জোর করি? সময় দিতে না চাই?

ঈশা ঘুরে তাকাল। ইভানের দৃষ্টিতে অসহায়ত্ব। ঈশার বুক চিরে বেরিয়ে এলো দীর্ঘশ্বাস। কিছু বলার আগেই তার চোখ পড়লো টেবিলে পড়ে থাকা ঔষধের স্ট্রিপ গুলর উপরে। কোন কথা না বলে এগিয়ে গেলো সেদিকে। এক এক করে সমস্ত ঔষধের স্ট্রিপ চেক করে দেখল। ঈশা ভালোভাবেই বুঝে গেলো যে ইভান সকালে ঔষধ খায়নি। ইভানের দিকে না তাকিয়েই গম্ভীর আওয়াজে বলল
–তুমি সকালে ঔষধ খাওনি কেন?

ইভান হতাশ শ্বাস ছাড়ল। অসহায় কণ্ঠে বলল
–আমার ওসবের প্রয়োজন নেই ঈশা। আমার প্রয়োজন অন্যকিছু। আমি অন্য কিছুতে আসক্ত। যেটা ছাড়া আমার বেঁচে থাকা কঠিন হয়ে পড়ছে। ভীষণ কঠিন।

বলেই থামল। ঈশা ঔষধ আর পানি নিয়ে ইভানের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। বলল
–দরকার আছে কিনা সেটা আমি বুঝে নেবো। এখন এগুলা খেয়ে নাও।

ইভান অসহায়ের মতো বলল
–ঔষধ খেলে আমার অসস্তি হয়। ঘুমের ঔষধ খেয়েও ঘুম আসেনা। মাথা যন্ত্রণা করে। কাল সারারাত ঘুমোতে পারিনি।

করুন চোখে তাকিয়ে কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে আবার বলল
–তোমার সঙ্গে কাটানো প্রতিটা মুহূর্ত আমার কাছে বড্ড প্রিয়। কিন্তু আফসোস সেই প্রিয় মুহূর্ত আমৃত্যু কাটানোর মতো দুঃসাহস আমার নেই। আমি তোমাকে জোর করতে চাইছি না। আবার না করেও থাকতে পারছি না। ভীষণ এলোমেলো আমি।

বলেই চোখ বন্ধ করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। ঈশার ভীষণ কষ্ট হল। এমন কেন মানুষটা? নিজের কষ্টের কথা কোনদিন মুখ ফুটে বলে না। ভেতরে এমন এলোমেলো বিদ্ধস্ত হয়ে পড়ে একা একা। ঈশা কাছাকাছি গিয়ে দাঁড়ালো। তাদের মাঝে কয়েক ইঞ্চি দূরত্ব মাত্র। ইভানের হাত ধরে ঔষধ গুলো হাতে দিয়ে চাপা ধমক দিয়ে বলল
–একদম অজুহাত দেখাবে না। আমার সাথে এভাবে জেদ করে কোন লাভ নেই। ঔষধ খেতেই হবে। আমার জন্য।

শেষের কথাটা শুনে ইভান আর কোন কথা বলতে পারল না। ঈশার জন্য সে সব কিছু করতে পারে। ঔষধ নিয়ে বলল
–তোমার জন্য প্রয়োজনে বিষ খেতে পারব। আর এটা তো সামান্য ঔষধ।

ঈশা তার কথা শুনে শব্দ করে হাসল। ইভান মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে আছে তার দিকে। কতদিন পর ঈশাকে এতো কাছ থেকে হাসতে দেখেছে। ঠিক সেই সময় ইফতির গলা শোনা গেলো
–ভাইয়া তোমরা বাইরে আসো। দেখো কে এসেছে।

ঈশা আর এক মুহূর্ত দাঁড়ালো না। বের হয়ে আসলো। বাইরে আসতেই কানে আসলো হাসির আওয়াজ। সোফায় চোখ পড়তেই দেখল তার কাজিন সম্প্রদায়ের সবাই কি একটা বিষয় নিয়ে হাসাহাসি করছে। ঈশা বেশ অবাক হল। সবাইকে একসাথে দেখবে সেটা সে আশাই করেনি। কিছুই না জানিয়ে হুট করেই তারা চলে এসেছে। ইভান পেছনে এসে দাঁড়ালো। বলল
–তোরা সবাই?

সবাই থেমে গেলো তার কথা শুনে। ইশান বলল
–কেন এসে ভুল করে ফেলেছি নাকি? ভুল করলে চলে যাই।

ইভান সরু চোখে তাকাল। এগিয়ে গিয়ে তার পাশে বসল। কান ধরে বলল
–তোমার পাকনামি বন্ধ করো। বেশী বুঝতে হবে না। ফাজিল ছেলে।

সায়ান বলল
–এখন কেমন আছিস তুই?

ইভান মৃদু হেসে বলল
–ভালো আছি।

সায়ান হেসে ঈশার দিকে তাকাল। বলল
–যাক তাহলে ঈশা ভালই সেবা করছে। তাই তো এতো তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে গেলি।

ইভান আড় চোখে ঈশার দিকে তাকিয়ে বলল
–একদম। রাত জেগে সেবা করে। এতো বেশী সেবা করে যে আমার নিজেরই মাঝে মাঝে অসহ্য হয়ে যাচ্ছে। আমার তো আবার এতো সেবা নেয়ার অভ্যাস নাই।

ঈশা সরু চোখে তাকাল। কথার অর্থ ঠিকঠাক ধরতে পারল। ইরিনা সন্দিহান কণ্ঠে বলল
–ভাইয়া কি ঈশার প্রশংসা করলো নাকি বদনাম। ঠিক বুঝতে পারলাম না।

ঈশা রাগী সরে বলল
–তোমরা বস আমি রান্না ঘরে যাচ্ছি।

ঈশা ইভানের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো যাওয়ার আগে। ঈশা চলে যেতেই ইভান মুচকি হাসল।

————
শরতের আকাশ ঝকঝকে। বেশ ঝলমলে রোদ। দুপুর হলেও বাতাসের কারনে রোদের তেজটা তেমন গায়ে লাগছে না। দুপুরে খাওয়া শেষ করে সবাই ইভান দের ছাদে আড্ডা দিচ্ছে গরম চায়ের সাথে। ইভান চায়ের কাপে চুমুক দিতেই ইরা এসে দাঁড়ালো। প্রশস্ত এক হাসি দিয়ে বলল
–তোমরা সবাই এখানে? আমি তোমাদের সবাইকে খুঁজে বেড়াচ্ছি।

ইলু হাত বাড়িয়ে বলল
–আরে তুই এতক্ষন কোথায় ছিলিস? আয় এদিকে।

ইরা এসে বসল ইলুর পাশে। তার পাশেই একদম অপরিচিত একটা মেয়ে দাড়িয়ে আছে। সে নিচের দিকে তাকিয়ে আছে। দৃষ্টি অস্থির ভাবে এদিক সেদিক ফেলছে। বোঝাই যাচ্ছে সবার মাঝে ভীষণ অসস্তি হচ্ছে তার। ইশান তার দিকে তাকিয়ে বলল
–কেমন আছো সিয়া?

ইভান তার পাশেই বসে ছিল। ইশানের কণ্ঠ শুনে তার দিকে তাকাল কৌতূহলী চোখে। মেয়েটাকে ইভান আজকেই প্রথম দেখছে। কিন্তু ইশানের মনে হয় পরিচিত। মেয়েটা ভীষণ অপ্রস্তুত কণ্ঠে বলল
–ভালো আছি। আপনি কেমন আছেন ভাইয়া?

ইশান হেসে বলল
–ভালো আছি। অনেকদিন পর দেখা হল তোমার সাথে।

সিয়া মৃদু হেসে বলল
–আসলে পরীক্ষা চলছিলো তো তাই একটু ব্যস্ত ছিলাম।

–ওহ! পরীক্ষা শেষ? কেমন হল?

সিয়া নিচের দিকে তাকিয়ে বলল
–মোটামুটি হয়েছে।

সিয়া কথা শেষ করতেই ইরা বলল
–আসলে ও ইভান ভাইয়াকে দেখতে এসেছিলো। ভাইয়ার কথা শুনে বলছিল আসবে বাসায়। তাই নিয়ে আসলাম।

ইভান চমৎকার হেসে বলল
–সো সুইট অফ ইউ। তুমি এসেছ আমি খুব খুশী হয়েছি।

সিয়া ভীষণ অসস্তি নিয়ে ভদ্রতার সাথে বলল
–ধন্যবাদ ভাইয়া। এখন আপনি কেমন আছেন?

ইভান একটু দুষ্টুমি করে বলল
–ভালো আছি। তোমাকে দেখে আরও ভালো হয়ে গেলাম।

সিয়া হাসল। ইরা হেসে বলল
–তোমরা গল্প করো। আমি আসছি। সিয়া বাসায় চলে যাবে তো।

ইরা আর সিয়া বাসায় যাওয়ার জন্য সিঁড়ির দিকে যেতেই ইভান গলা তুলে বলল
–এতো তাড়াতাড়ি চলে যাবে সিয়া? আর একটু থাকতে।

সিয়া ঘুরে তাকাল। মৃদু হেসে বলল
–আজ না ভাইয়া। আরেকদিন আসবো।

ইভান প্রশস্ত হেসে বলল
–অবশ্যই। মাঝে মাঝেই আসবে আমার সাথে দেখা করতে। খুব খুশী হবো।

সিয়া হেসে চলে গেলো। ওরা চলে যেতেই ইভান ঠোট কামড়ে সামনে তাকিয়ে বলল
–মেয়েটা ভীষণ কিউট।

ইশান সরু চোখে তাকাল। বলল
–তুমি বিবাহিত ভাইয়া। বিবাহিত হয়ে একটা মেয়েকে দেখে এমন কথা বলতে লজ্জা করে না।

সবার মুখে দুষ্টু হাসি। ইভান ইশানের দিকে তাকিয়ে বলল
–বিবাহিত বলে কি আমার চোখ নেই? সুন্দর কিছু দেখলেই তার প্রশংসা করতে হয়। এটাতে লজ্জা পাওয়ার কিছু নেই। তাছাড়া ভাবছি বিয়ে না করলে একটা চান্স নেয়া যেতো। মেয়েটা আমাকে দেখতে এসেছিলো শুনলি না?

ইশান সরু চোখে তাকাল। সবার মুখে দুষ্টু হাসি। ইভান ইশানের রাগের কারন বুঝতে পেরেই ঠোট চেপে হাসল। তারপর ঈশার দিকে ফিরে তাকাতেই দেখল সে তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে আছে তার দিকে।

চলবে……

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে