শর্বরী পর্ব-১০

0
848

#শর্বরী
অলিন্দ্রিয়া রুহি

(১০)

নেহাল আর কুসুমকে বাসে তুলে দিতে নয়ন এসেছে সঙ্গে করে। দু’জনকে সিটে বসিয়ে দিয়ে পাশের সিটে নয়নও বসল। বাস ছাড়তে মিনিট সাতেক বাকী। নয়ন মুখ গোমড়া করে রেখেছে। আজ বৃহস্পতিবার,আগামীকাল শুক্রবার। নেহাল ইতিমধ্যে বাড়ির সবাইকে নয়নের স্নেহার কথা জানিয়ে দিয়েছে এবং নয়নের জ্ঞাতসারেই সবাই খুশি হয়েছে। হাবিব শিকদার জানিয়েছেন, শুক্রবারেই মেয়ের বাসায় যাবেন প্রস্তাব নিয়ে। কিন্তু নয়নের ভালো লাগছে না এই মুহূর্তে নেহাল আর কুসুমের চলে যাওয়াটা। তার বিয়ের কথাবার্তার সময় নেহাল থাকবে না! কেমন করে হয়! নেহাল অবশ্য বুঝিয়ে বলেছে,এখনই তো বিয়েটা হয়ে যাচ্ছে না। এখন শুধু কথাবার্তা পাকা করা হবে। সে চারদিন পরই ফিরে আসবে। তারপর ধীরেসুস্থে একটা ডেট ফালানো হবে বিয়ের এবং নয়নের বিয়ের আগাগোড়া সবটাই নেহাল নিজ হাতে সামলাবে। বাসের হেল্পার উঠে যাত্রী বাদে সকলকে নেমে যাওয়ার নির্দেশ দিলে নয়ন উঠে দাঁড়াল। স্মিতহাস্যে বলল,

“চলি।”

“সাবধানে যাস। আর মুখটা প্যাঁচার মতো বানিয়ে রাখিস না। আমরা চিরজীবনের জন্য চলে যাচ্ছি না!”

নয়ন ঠোঁট বাঁকায়। ভাবীর থেকে বিদায় নিয়ে নেমে পড়ে। দাঁড়িয়ে থাকে জানালা ঘেঁষে। দু মিনিটের মাথায় বাস চলতে শুরু করে ধীর গতিতে। হাত নাড়ায় কুসুম, নয়ন প্রত্যুত্তরে নিজের হাত নাড়িয়ে বিদায় জানালো। দেখতে দেখতে দৃষ্টিসীমার বাহিরে চলে গেল বাস। মৃদু শ্বাস ফেলে ফুটপাত ধরে হাঁটতে লাগলো নয়ন। গন্তব্য, স্নেহার কলেজ। স্নেহাকে আজ প্রথম বিয়ের কথা জানাবে সে। এরপর যা ঘটুক, দেখা যাবে! কিন্তু মিথ্যার আশ্রয়ে কোনো পবিত্র সম্পর্ক শুরু করতে মোটেও আগ্রহী নয় নয়ন।

.

.

একটা বাচ্চা তার আম্মুকে কিছু কিনে দেওয়ার আবদার করছে বারংবার। কিন্তু মায়ের সেদিকে খেয়াল নেই। সে একমনে দামাদামি করে চলেছে দোকানীর সাথে। দোকানীও বুঝেছে, শাড়িটা মহিলার খুব পছন্দ হয়েছে। তাই সেও দাম ছাড়তে চাচ্ছে না কিছুতেই। জয়নাল নিজের দোকানে বসে বসে দৃশ্যটা দেখলো। শাড়িটার কেনা দাম সাতশোর বেশি হবে না। অথচ দোকানী চাইছে সতেরোশো টাকা! জয়নাল মৃদু শ্বাস ফেলে দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে ডুবে গেল গতকাল রাতের ঘটনাটায়। সে হতভম্ব তার সাথে হওয়া সমস্যা গুলোর জন্য। সে রাতে বমি করার পর শরীরটা অনেক হালকা লাগছিল জয়নালের। সবকিছু পরিষ্কার করে,নিজে পরিষ্কার হয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দেয় খুব দ্রুতই। ঘুমও চলে আসে সঙ্গে সঙ্গে। যখন ঘুম ভেঙেছিল তখন রাত দুটোর বেশি। ছাদে কারও পায়ের চলাচল… শব্দটা ভীষণ স্পষ্ট এবং প্রখর ছিল। কাঁথার ভেতর মুখ গুঁজে চুপচাপ শুয়েছিল জয়নাল। না উঠেছে,না নড়েছে। এক অজানা ভয় তাকে গ্রাস করে নিচ্ছে ধীরে ধীরে। তার সাথে যা-ই ঘটছে,সেটা ভালো ঘটছে না কোনোভাবেই। দ্রুতই কিছু একটা করা দরকার। কিন্তু কী করবে জয়নাল! কোনো হুজুরকে বলবে তার সমস্যাটা? জয়নাল হাতঘড়ি দেখলো। সময় দুপুর তিনটা। তার মার্কেট থেকে ঘন্টা একের দূরত্বে একজন হুজুরের বসবাস,জয়নাল জ্ঞাত সেই ব্যাপারে। শোনা গেছে,ওই হুজুর খুবই ভালো চিকিৎসা দিতে জানে। তার কাছে গেলে এখনই রওনা দিতে হয়। জয়নাল ভাবলো, এখান থেকে বেরিয়ে সোজা একটা হোটেলে যাবে। কিছু খাবে,এরপর সোজা হুজুরের কাছে। দোকান বন্ধ করে অপর দোকানের কর্মীর সঙ্গে টুকটাক কিছু আলাপ করে মাথায় রোদ নিয়েই বেরিয়ে পড়ল জয়নাল। এতক্ষণ ক্ষুধা ভাব থাকলেও এখন পেটের ভেতর মোচড় দিয়ে উঠছে। হোটেলে খাওয়ার চিন্তাটা মাথা থেকে ঝেড়ে বাসে উঠে পড়ল জয়নাল। সিটে গা এলিয়ে দিতেই চোখ জোড়া মুদে গেল আপনা আপনি। বন্ধ চোখের পাতায় ভেসে উঠল গতকালকের সেই মেয়েটির অবয়ব….

.

.

কলেজ ছুটি হয়েছে। একে একে মেয়েদের ঢল বেরোচ্ছে ভবন থেকে। এটি নিশ্চয়ই গার্লস কলেজ, চিন্তা করল নয়ন। সে দাঁড়িয়ে আছে পূর্বের দিনে আসা সেই টং দোকানে। মাথা উঁচু করে অস্থির নেত্রে খুঁজছে এদিক ওদিক, কিন্তু কোথাও তার স্নেহাকে খুঁজে পেল না। সবাই চলে যাওয়ার পর দারোয়ান গেট আঁটকে দিলো। তারপরও নয়ন দাঁড়িয়ে রইলো আধঘন্টার ন্যায়। স্নেহার টিকিটাও খুঁজে পেল না শেষতক। তবে কী স্নেহা আজ কলেজেই আসেনি! নয়নের চিত্ত বেদনায় নীল। আনমনে সিগারেট ফুঁকতে ফুঁকতে ফুটপাত ধরলো আবারও। আগামীকাল সরাসরি পরিবার সমেত স্নেহার বাসায় চলে যাওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় তাহলে নেই। সেখানেই না হয় সবকিছু খুলে বলা যাবে স্নেহাকে। কিছুটা স্বস্তি মিললেও দুশ্চিন্তার অন্ত হলো না। স্নেহা যদি তাকে বিয়ে করতে রাজী না হয় শেষ পর্যন্ত! নয়নের ভাঙা মন যদি আরও একবার ভেঙে যায়! এত ব্যথা সইবে কী করে সে!

***

দুপুরের দিকে একটা হোটেলের সামনে থেমেছিল বাস। সেখান থেকেই সব যাত্রীরা খাওয়া দাওয়া এবং বিশ্রাম সেড়ে রওনা হয়েছে কক্সবাজারের পথে। কুসুম ক্লান্ত। বাসে চড়ার অভ্যেস নেই। দু’জনে সবসময় রিকশাতেই ঘোরা হয়েছে কমবেশ। এবং এই প্রথম এত দূরের যাত্রা! তার উপর গর্ভবতী। এখনই নাড়িভুঁড়ি উল্টে আসছে রাস্তার উটকো গন্ধে। কতক্ষণে যেয়ে পৌঁছোবে,কে জানে! কুসুম দুর্বল গলায় প্রশ্ন করল,

“আর কতক্ষণ লাগবে যেতে?”

সে কথার জবাব না দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন ছুঁড়লো নেহাল।

“খারাপ লাগছে তোমার?”

“একটু।”

“পানি খাবা?”

“উঁহু, পেটে মোচড় দিচ্ছে।”

“মোচড়টা কে দিচ্ছে? তোমার মতোই আরেকটি ছোট্ট কুসুম?”

কুসুমের খারাপ লাগা অনেকাংশেই লাঘব হয়ে গেল এই এক কথায়। পেটের উপর আলতো করে হাত ছুঁইয়ে দিলো। ঠোঁটের কোণায় এক চিলতে হাসি। নেহালের অধর জুড়েও হাসি। মেয়েটা অল্পতেই সুখ খুঁজে পায়। কুসুম কী যেন অনুভব করে বলল,

“উঁহু, আমার মনে হচ্ছে,তোমার মতোই আরেকটি ছোট্ট নেহাল।”

“ছেলে হবে বলছো?”

“মন বলছে।”

“কী নাম রাখবে?”

“নিনাদ।”

সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিলো কুসুম। উত্তর দিয়ে নিজেই তাজ্জব বনে গেল। উত্তরটা সে একটুও ভেবে দেয়নি। কী ভেবে হুট করে এই নামটাই মাথায় এলো! কুসুমের চমকিত মুখখানা নেহালের চোখ এড়ালো না। সে প্রশ্ন করল,

“কী ব্যাপার? কী হলো?”

“বিশ্বাস করো, আমি কিছু না ভেবেই নামটা বলেছি। তুমি যখন জিজ্ঞেস করলে ছেলে হলে কী নাম রাখবো, আমার মনে এই একটা নামই চলে এলো হুট করে। মনে হলো, এই নামটা শুধুমাত্র আমার অনাগত ছেলের জন্যেই তৈরি হয়েছে।”

“ছেলে হবে নাকি মেয়ে,তা অদৃশ্য কাঠি নাড়া মালিক ছাড়া আর কেইবা বলতে পারে! তবে যদি ছেলে হয়, তবে এই নামটাই থাকবে। নিনাদ! আমাদের ছোট্ট নিনাদ! কী? খুশি?”

উৎফুল্ল চিত্তে নেহালের এক বাহু জড়িয়ে ধরলো কুসুম। নেহালের কাঁধের উপর মাথা রেখে আদুরে গলায় বলল,

“খুব খুশি।”

.

.

আসরের আগে আগেই পৌঁছে গেল জয়নাল। হুজুর নামাযের পর বসবেন। তাই অপেক্ষা করতে হলো জয়নালকে। পেটে পাঁক দিচ্ছে বারংবার, অথচ খাওয়ার প্রতি রুচি লাগছে না। আর রুচি না লাগলে জোর করে হলেও খাওয়া যায় না কিছুই! তাই বসে রইলো জয়নাল হাফ বোতল পানি খেয়ে। আযান পড়লে সেও নামায পড়ে নিলো। তারপর সেই রুমে প্রবেশ করল যেখানে হুজুর বসেন। সবার সমস্যা শুনেন এবং সেই অনুযায়ী সমাধান করার চেষ্টা করেন। হুজুর বসে রয়েছেন। জয়নালকে ইশারায় কাছে এসে বসার আমন্ত্রণ জানালেন। জয়নাল আমন্ত্রণ গ্রহণ করল। হুজুরের মুখোমুখি বসে গত দুইদিনে ঘটা সমস্ত কথা নির্দ্বিধায় বর্ণনা করে গেল একের পর এক। হুজুর শুনলেন চুপচাপ। জয়নাল থামলো,দম নেয়। অস্পষ্ট চোখে তাকাল। তার কেন যেন খুব ভয় লাগছে। সে বারবার চাইছে,সবকিছু মনের ভুল হয় যেন। এর বেশি কিছু না। কিন্তু হুজুরের চিন্তিত চোখমুখ তার শরীরে হেলদোল শুরু করে দিলো। যখন হুজুর বললেন, “বড়ই গাছের নিচে পোঁতা হয়েছে এমন এক পুতুল, যা তোমার ন্যায়, তোমার রূপ এবং তোমারই অবয়ব”, তখন জয়নাল চমকে গেল পুরোপুরি।

(চলবে)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে