শরতের শুভ্র মেঘের ভেলায় পর্ব-১৮

0
848

#শরতের_শুভ্র_মেঘের_ভেলায়(১৮)
Sadia afrin nishi ____________________________

বাড়ির বড় লোহার গেটটির সামনে দাড়িয়ে আছি।এই বাড়িতে পা রাখতে আমার এখন আর মন চায় না। সাক্ষর ছাড়া সবকিছু কেমন অগোছালো, নিষ্প্রাণ মনে হয়। একা একা এই ভুতুড়ে বাড়িতে নিজেকে কেমন জানি মনে হয় ভুতের সর্দারনী। অনিচ্ছা সত্ত্বেও গেটের তালা খুলে বাড়ির মধ্যে প্রবেশ করলাম। ধীর পায়ে সিড়ি বেয়ে উঠে নিজের রুমে চলে এলাম। তারপর ফ্রেশ হয়ে বিছানায় গাঁ এলিয়ে দিয়ে শুয়ে পরলাম। বেশি সময় শুয়ে থাকা সম্ভব হল না। ক্ষুধার আভাস পেতেই শোয়া থেকে উঠে অগ্রসর হলাম কিচেনের দিকে। সারাদিন কাজের চাপে খাওয়া দাওয়া করা হয়নি।এখন কিছু না খেলে একদমই চলবে না। ভাত আর আলু সেদ্ধ চাপিয়ে দিলাম চুলায়।সাক্ষরের জন্য খারাপ লাগছে ওই জেল খানার খাবার খেতে হয়তো খুব কষ্ট হচ্ছে। আমি কালই কিছু ভালমন্দ রান্না করে দিয়ে আসবো।

ভাতের সঙ্গে আলু ভর্তা মিলিয়ে খেয়ে নিলাম। তারপর বিছানায় শুয়ে এপিঠ-ওপিঠ করতে করতে ঘুমিয়ে গেলাম।

———————-

ভোরের আলো ফুটতেই উঠে পরলাম। নামাজ পড়ে, কোরআন তেলওয়াত শেষ করে কিছু হালকা নাস্তা করে নিলাম। তারপর সাক্ষরের পছন্দ মতো কিছু খাবার আইটেম তৈরি করে নিলাম। এগারো নাগাদ বাড়ি থেকে বেড়িয়ে পরলাম খাবারগুলো নিয়ে।আগে খাবারগুলো সাক্ষরকে পৌঁছে দিয়ে তারপর ইনভেস্টিগেশনে যাব। সাক্ষর যে নির্দোষ তা সবাই জানে। এজন্য ওর কেসটা এখানো কোর্টে চালান দেওয়া হয়নি।এটা অবশ্য অফিসার মাইনুল হাসান স্যারের জন্যই সম্ভব হয়েছে। তিনি সাক্ষরের ফিউচারের কথা চিন্তা করে সুযোগ দিয়েছেন। সাক্ষরকে এখন কোর্টে চালান করলে কোনো দোষ না থাকা সত্বেও তার রেপুটেশনে দাগ লাগবে এজন্যই তার এই সিদ্ধান্ত।

সাক্ষরকে খাবারগুলো পৌঁছে দিয়ে এক মুহুর্ত সময় নষ্ট করলাম না তাড়াতাড়ি করে চলে এলাম ব্যারিস্টারের কাছে। ব্যারিস্টারকে বললাম আমার নেক্সট প্ল্যান সম্পর্কে,,

_”আমার কাছে একটা প্ল্যান আছে।আমাদের আরও একবার এমপির সঙ্গে কথা বলতে হবে। এমপিকে বোঝাতে হবে আমরা তাকে সাহায্য করতে এসেছি।এমপিকে রাজি করিয়ে তার শরীরে সিসি ক্যামেরা বসাতে হবে।তাহলে ক্রিমিনালের নাগাল খুব সহজেই পাওয়া সম্ভব। যেহেতু ক্রিমিনালের নেক্সট টার্গেট এমপি হতে পারে সেহেতু এই প্ল্যানটা যথাযথ হবে বলে মনে করছি।”

আমার কথা শুনে ব্যারিস্টার সাহেবও রাজি হয়ে গেলেন। কিন্তু প্রবলেম তো একটাই আর তা হলো এমপি। তিনি কী রাজি হবেন এমনটা করতে? যে করেই হোক তাকে রাজি করাতেই হবে নয়তো সবার জন্য বিপদ।

———————

অনেক বোঝানোর পর এমপিকে বোঝাতে সক্ষম হলাম আমরা। এমপির মত পাওয়া মাত্র আর এক সেকেন্ডও সময় নষ্ট না করে এমপিকে নিয়ে হাসপাতালে চলে গেলাম। সেখানে গিয়ে এমপির শরীরের সঙ্গে সিসি ক্যামেরা ফিট করে দেওয়া হলো এবং সেটার কানেকশন ল্যাপটপের সঙ্গে নিযুক্ত করা হলো। এমপি আমাদের কাজে বিরক্ত হলেও তেমন কিছু বলছেন না কারণ জানের মায়া সবারই আছে।

আজকে দিনের মতো যে যার বাড়ি চলে গেলাম। এভাবেই দিন চলতে লাগল।ক্যালেন্ডারের পাতায় যোগ হলো আরও তিনদিন। এখন পর্যন্ত আমরা খুনিকে ধরার কোনো ক্লু ই খুঁজে বের করতে পারিনি। বেলকনিতে দাঁড়িয়ে আকাশপানে মুখ করে ভাবছিলাম কিছু পুরোনো স্মৃতি ঠিক তখনই ফোনের রিংটোন টা বেজে উঠল। ফোনের স্কিনে ব্যারিস্টার বাবু নামটা দেখে তাড়াতাড়ি রিসিভ করে নিলাম। এত সকালে ওনার ফোন করার হেতুটা ঠিক আমার বোধগম্য নহে।ফোন রিসিভ করতেই ব্যারিস্টার বাবু বললেন এমপি সাহেব মিসিং। ব্যারিস্টার বাবুর কথা শুনে আমি একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেললাম।কারণ আমাদের প্ল্যান হয়তো এবার সাকসেসফুল হতে চলেছে।সময় নষ্ট না করে তাড়াতাড়ি চলে গেলাম ব্যারিস্টার সাহেবের অফিসে।সেখানে অভিসার মাইনুল হাসান স্যারকেও ডেকে নিলাম।

তিনজন গভীর মনোযোগ নিয়ে ল্যাপটপের সামনে বসে আছি। এই জায়গাটা ঠিক কোথায় বুঝতে পারছি না। তার কারণ হলো ল্যাপটপে সবটাই অন্ধকার আসছে। হয়তো এমপি সাহেব যেখানে আছেন সেখানে কোনো পর্যাপ্ত আলোর ব্যবস্থা করা হয়নি।এখন আমরা অপেক্ষা করছি কখন আলো আসবে আর আমাদের সামনে সবকিছু কখন পরিষ্কার হবে তারজন্য।

কিছুক্ষণ পরেই চারপাশ আলোকিত হয়ে উঠল।এমপি সাহেবকে এবার আমরা স্পষ্ট দেখতে পারছি। এমপি সাহেব হাত,মুখ বাঁধা অবস্থায় নিচে পড়ে আছে। তার কিছুক্ষণ পরেই এমপির সামনে একজন হুডি পরিহিত লোক এসে বসে পরল। উল্টোদিকে হওয়ায় তার মুখ এখনো আমরা দেখতে পারিনি। লোকটা সামনে যেতেই এমপি সাহেব কেমন ছটফট করতে লাগলেন।এমপি সাহেবের এমন ছটফটানি দেখে সামনের লোকটি উচ্চস্বরে হেসে উঠল তারপর এমপি সাহেবের মুখের বাঁধন খুলে দিল। মুখ খোলা পেয়ে এমপি সাহেব ভয়ার্ত দৃষ্টি নিয়ে সামনে থাকা লোকটির উদ্দেশ্যে বললেন,,

_তুতততই বেঁচে আছিস। কিন্তু কীভাবে সম্ভব। নুহাশ তো বলেছিল তোকে খতম করে দিয়েছে তাহলে তুই এখানে কীভাবে ? আমার দলের সবাইকে তাহলে তুইই মেরেছিল?

লোকটা হয়তো এমপির কথা শুনে খুব মজা পেল।সে ক্রমান্বয়ে হেসে হেসে বলতে লাগল,,

_বিশ্বাস হচ্ছে না বুঝি। আমার তৈরিকৃত ঔষধের অপব্যবহার করে টাকা কামানো অতটা সহজ নয়। তুই যে দয়ালু এমপি রুপী কতোবড় একজন মুখোশধারী শয়তান তা আমার চেয়ে ভালো আর কেউ জানে না। তুই আমার সবকিছু শেষ করে দিয়েছিস। আমার লাইফ, আমার ক্যারিয়ার,আমার লক্ষ্য, আমার আবিষ্কার এমনকি আমার কাছ থেকে আমার একমাত্র ভাইকেও আলাদা করেছিস।তোকে আমি বাঁচতে দেব না। তোর মরণ আমার হাতেই অনিবার্য। একে একে তোর সব সেনাসৈন্যদের আমি শেষ করে দিয়েছি। এবার তোর পালা। তোকে নিজের হাতে শেষ করে আমি আমার প্রতিশোধ সমাপ্ত করবো। তোর মৃত্যু হবে সবার থেকে ভয়ংকরভাবে। তোকে মেরে আমি নিজেই পুলিশের কাছে স্যালেন্ডার করব।তোর জন্য অনেকগুলো সম্পর্কের ছেদ হয়েছে, অনেকে বিনা কারণে কষ্ট পাচ্ছে।আমার জীবন তো শেষ হয়েই গেছে তা নিয়ে আমি আর ভাবি না কিন্তু যারা নিষ্পাপ তাদেরকে আমি কিছুতেই আমার মতো পরিস্থিতিতে পরে খারাপ হতে দিব না। সো এবার তৈরি হয়ে নে।তোর মতো জানোয়ারের মৃত্যু এবার আগত। এই দুনিয়া থেকে পাপ মোচনের সময় এবার চলে এসেছে।

এতটুকু বলে লোকটা ঘুরে তাকাল। উপস্থিত লোকটির মুখ দেখে আমরা সকলেই চরম আশ্চর্য। এটা তো সাক্ষরের ভাই সার্থক। যাকে সাক্ষর নিখোঁজ বলে দাবি করে। তারমানে সার্থক এই খুনগুলো করছে।কিন্তু কেন? কীসের এতো রাগ সার্থকের এমপির ওপর।এমপি কী এমন ক্ষতি করেছে সার্থকের।

গুলির শব্দ কানে বাজতেই ভাবনা থেকে বেড়িয়ে ল্যাপটপে দৃষ্টি দিলাম। আমাদের চোখের সামনেই সার্থক এমপিকে ভয়াবহ মৃত্যু উপহার দিল কিন্তু আমরা কিছুই করতে পারলাম না। শুধু মুখ বুজে চাপা আর্তনাদ করলাম। খুন করা শেষ হলে সার্থক এমপির লাশটা গাড়িতে তুলে নিল।তারপর গাড়ি চালাতে শুরু করল।

ল্যাপটপ বন্ধ করে আমরা সকলে একটা দীর্ঘ-শ্বাস টানলাম। এখন কী হবে তা আমাদের জানা। সার্থক এখন লাশটা নিয়ে সোজা খানায় যাবে তা সে একটু আগেই বলেছে।এজন্য আমরাও এখন থানার উদ্দেশ্যে বেড়নো জরুরি মনে করছি। তিনজন রওনা দিয়ে দিলাম গন্তব্য থানায়।

থানায় পৌঁছে দেখলাম সার্থক পুলিশের সামনে আগে থেকেই স্যালেন্ডার করে বসে আছে। আমরা ঢুকতেই কনস্টেবল এনায়েত এসে অফিসার মাইনুল হাসানকে বলল,,

_স্যার এই লোকটা নাকি খুনি। উনি নিজে থেকে সবটা স্বীকার করছেন। ওনাকে কী এ্যারেস্ট করব স্যার?

অফিসার কিছুক্ষণ মৌনতা পালন করে বললেন,,

_আমি দেখছি তোমরা তোমাদের কাজ করো।

এখন আমাদের সামনে ক্লিয়ার সার্থকই খুনগুলো করেছে। আসল অপরাধী কে তা তো জানা গেল কিন্তু একটা ব্রিলিয়ান্ট গ্রেটফুল ছেলে কেন এমন বিপথে অগ্রসর হলো তা তো এখনো জানার বাকি আছে। সাক্ষর নিজের ভাইয়ের এমন অবনতি দেখে কেমন রিয়েক্ট করবে সেটাও তো ভাবনার বিষয়। সবকিছু সমাধান হয়েও অনেক কিছু এখানো অন্ধকারে রয়ে গেছে।

চলবে,

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে