লুৎফুন্নাহার আজমীন পর্ব-০৭

0
806

#লাভ_ফাইট
#লুৎফুন্নাহার_আজমীন
#পার্ট৭
(অনুমতি ব্যতীত কপি নিষেধ)

মাঝখানে এইচএসসি পরীক্ষা এডমিশনের চাপের ফালাকের সাথে আমার যোগাযোগ প্রায় বন্ধই ছিলো।তার মধ্যে আমি যথেষ্ট আপসেট ছিলাম মেডিকেল এডমিশন নিয়ে।যথেষ্ট পয়েন্ট থাকার পরেও মাত্র দেড় মার্কের জন্য আমি মেডিকেলে চান্স পাই না।অথচ ছোট বেলা থেকেই এই লাইনে পড়ার জন্য কতই না পরিশ্রম করেছি।তীরে এসে নৌকা ডুবার মতো।পরে ডিসিশন নেওয়া হয় প্রাইভেটে এডমিশন নেবো।ধানমন্ডির একটা প্রাইভেট মেডিকেলে আমি এডমিশন নিই।ধানমন্ডিতেই একটা দুই রুমের ফ্ল্যাট নিয়ে আমি আর ফালাক থাকতে শুরু করি।যদিও ধানমন্ডি থেকে ওর ক্যাম্পাস বেশ দূরে হয়ে যায়!তারপরও ফালাক আমার জন্য ধানমন্ডিতেই থেকে যায়। ও বাসে ঝুলে ঝুলে যাক ওর সমস্যা নেই।কিন্তু আমায় যেন দুর্ভোগ পোহাতে না হয়।তাই আমাদের ধানমন্ডিতেই থাকা।তাছাড়া ঢাকায় প্রায়ই মেয়েরা রাস্তা-ঘাটে বাসে হ্যারাসমেন্টের শিকার হয়।সময় দিতে না পারলেও দায়িত্বে তার গাফিলতি নেই।অনার্স প্রায় ওর শেষের দিকে।অনার্স শেষ করেই ছোটখাটো জব করতে চাইছে। তারপর মাস্টার্স কমপ্লিট করে একটা ভালো জবে ঢুকার ইচ্ছা তার।যেহেতু বাংলাদেশে কোনো ভালো চাকরি করতে চাইলেই কর্তৃপক্ষ অভিজ্ঞ লোক চায় তাই অভিজ্ঞতার জন্য হলেও তার ছোটখাটো চাকরি করতে হবে। প্রতিদিন ভোর সকালে বেরিয়ে যায়।আসতে আসতে রাত এগারোটা-বারোটা বেজে যায়।কখনো কখনো ক্যাম্পাসের আশে পাশেই টিউশনগুলো প্রায় সারাদিন সেখানেই থাকতে হয় ওর।রাতে আমি তার জন্য খাবার নিয়ে বসে থাকি।সে আসে।একসাথে খেতে খেতে আমাদের সারাদিনের টুকটাক কথা হয়।আর দিন শেষে একেঅপরকে আলিঙ্গন করে শান্তির ঘুম।এভাবেই চলতে লাগে আমাদের সাদা-মাটা সাংসারিক জীবন।পড়াশোনার খরচ আব্বুর থেকেই নেই।আর টুকটাক হাত খরচের টাকা ফালাক দেয়।সেখান থেকেই টাকা জমিয়ে জমিয়ে আমি ওকে ছোট ছোট গিফট দেই।

কিন্তু একটা জিনিস আমার খুব খারাপ লাগে।ফালাক আমায় কখনো কোথাও ঘুরতে নিয়ে যায় না।এইতো সেদিনই বললাম।কাছেই ধানমন্ডি লেক।একটু ঘুরে আসি।ওমা!সে মুখের ওপর না বলে দিলো।খুব রাগ হয়েছিলো সেদিন।কয়েকদিন ভালো করে কথাই বলিনি জিদ ধরে।কিন্তু ব্যাটা তো বহুত সিয়ানা। যাইতে আসতে সালাম দেয়।ঠাস ঠুস ফোন দিয়ে সালাম দেয়।সওয়াব কামাইয়ের লোভে সালামের জবাব দিয়ে বারবার কথা বলে ফেলি।

আজও শুক্রবার। সাতটায় উঠে নাস্তা বানানোর কাজে লেগে পড়ি।আমি রান্নাবান্না অতটা ভালো পাই না।পেট ভরানোর জন্য নুডলসটা পাই ভালো।আজ ভিন্ন ভাবে নুডলস বানানোর ট্রাই করবো।মানে নুডলস দিয়ে নতুন রেসিপি আর কি!সয়া সেদ্ধ বসিয়ে দিই। এটা একটু টাইম লাগে সেদ্ধ হতে।ঝামেলারও লাগে জিনিসটা।সেদ্ধ করো।চেপে চেপে পানি বের কর।এই পানি বের করতে গিয়ে কত যে ছ্যাকা খেতে হয়েছে তার হিসাব নেই।টেস্ট অত ভালো লাগে না আমার।কিন্তু ফালাকের পছন্দ তাই ওর সাথে আমায়ও খেতে হয়।এমনিতেই খোটা দেয় রান্না পাই না বলে!

সয়া সেদ্ধ হয়ে গেলে পানি ঝড়িয়ে সেগুলো ঠান্ডা হওয়ার জন্য আবার ঠান্ডা পানিতে ভিজিয়ে রাখি।তারপর নুডলস সেদ্ধ বসিয়ে দিই।
নতুন সংসার প্রয়োজনীয় অনেক কিছুই কেনা হয়ে উঠেনি।পাশের ঝুড়িতে দেখি দুটো ছোট গাজর আর ডিম আছে।এগুলো বাদ যাবে কেন?এগুলোও কাজে লাগিয়ে দিই।গাজর গ্রেটারের সাহায্য কিচি কিচি করে সেগুলোও নুডলসের সাথে সেদ্ধ বসিয়ে দিই।

তারপর ময়দার সাথে স্বাদমতো লবণ মিশিয়ে খামি বানাই।এতক্ষণে সয়াও ঠান্ডা হয়ে গিয়েছে।সেগুলো থেকে চিপে পানি বের করে নিই।

নুডলস গাজর সেদ্ধ হয়ে গেলে এজইউজুয়াল পেঁয়াজ,মরিচ,সয়া,ডিম,নুডলসের সাথে থাকা টেস্ট মেকার দিয়ে নুডলস রান্না করে নিই।সয়া অপছন্দের আরেক কারণ এটা মাত্রাতিরিক্ত তেল শুষে নেওয়া।সাশ্রয়ের জন্য সয়া বাদ দিতে বলি।তেলের যা দাম।তারমধ্যে এটা পুস করে তেল খেয়ে নেয়।আজকে স্পেশাল রেসিপি তো তাই একটু নাগা সস এড করি।

ময়দার খামি থেকে ছোট ছোট ল্যাচি কেটে নেই।তারপর সেগুলো বেলে ছোট সাইজের রুটি বানাই।রুটিগুলোর মাঝখানে নুডলস রেখে একটা মোমোর শেপ দিই।কাল এত করে দেখলাম মোমোর বিভিন্ন ডিজাইন।তাও হলো না।শেষে কোনো রকমে ভেতরে নুডলস পুরে আমি মোমো গুলো ভাপে বসিয়ে দিই।

নাস্তা রেডি হতে হতে সাড়ে আটটা বেজে যায়।গিয়ে দেখি ফালাক এখনো মরার মতো ঘুমাচ্ছে।আমি গিয়ে ওকে ডাকি।ও ওঠে না।বাম মাছের মতো মোচড়ামুচড়ি করতে লাগে।আমি ধমক দিই,,,

” ওই ব্যাটা ওঠ!নতুন রেসিপি বানালাম কষ্ট করে।ঠান্ডা হয়ে গেলে খেতে ভাল্লাগবে না।তখন আবার আমায় মেজাজ দেখাবি।”

আমার ধমক খেয়ে ফালাক লাফ দিয়ে উঠি।নিষ্পাপ চাহনিতে এদিক ওদিক তাকায় কিছুক্ষণ।অবাক কন্ঠে বলে,,,

” নতুন রেসিপি?”

” হু মোমো।নুডলসের মোমো।”

আমার কথা শুনে ফালাক ফিক করে হেসে দেয়।

” What the fu**k…! নুডলসের মোমো?গরীবের কেকাপা।”

ফালাকের কথা শুনে আমার রাগ হয়।প্রায়ই আমায় এভাবে খোঁচা মেরে কথা বলে ও।

” না খেয়েই। ফ্রেশ হয়ে আয়।গরম গরম খেয়ে তারপর কেকাপা যা খুশী বলিস।”

ফালাক ফ্রেশ হতে যায়।মেঝেতে পাটি বিছিয়ে প্লেটে করে মোমো গুলো আনি।আর একটা বাটিতে সয়াসস,নাগা সস,লেবুর রস মিশিয়ে আরেকটা সস বানাই।
ফালাক ফ্রেশ হয়ে এসে সব কিছুর ওপর একনজর চোখ বুলিয়ে নেয়।

” সুন্দর হইছে না মোমো গুলা?”

” মোমো কই?এগুলা তো পোটলা!”

” ফালাক….!”

দাঁত চেপে বলি আমি।

টাওয়েলটা জানালার গ্রিলে মেলে দিয়ে ফালাক খেয়ে বসে।

” ভাই সিরিয়াসলি?নুডলসের মোমো?খেয়ে যদি মা*রা যাই।”

” ম*রবি না।বদ মানুষ বাঁচে বেশিদিন দুনিয়ায়।”

ও আমার দিকে আড়চোখে তাকিয়ে থাকে।আমি একটা মোমো নিয়ে খেতে খেতে বলি,,,

” দেখ!খেলাম।আমি ম*রি নাই তার মানে তুইও ম*রবি না। ”

আমার দেখাদেখি ফালাকও মোমো নিয়ে খেতে লাগে।

” ভালোই তো হইছে গরীবের কেকাপার রেসিপি।ঝাল ঝাল।কি দিয়েছো?”

” নাগা সস দিছি শুধু আজকে বাড়তি।”

আমার কথা শুনে ফালাকের চোখ কপালে ওঠে।ও ঝাল একদম খেতে পায় না।নাগা সসকে ও বিষের মতো ভয় পায়।আমি খাই বলেই ও এনে দিয়েছে।ওর গলার স্বর খানিকটা চিকন হয়ে যায়,,

” আল্লাহ,বলো কি?নাগা সস?আজ আমি শেষ দোয়েল।”

” কমায় দিছি ছাগল।আমি যে সস দিয়ে খাচ্ছি এটা ঠোঁটে ছোঁয়ালেই তো তুমি চিৎকার চেঁচামেচি করবে।এত ঝাল।”

” তাই কি?ঝালকে হারিয়ে দেওয়ার জন্য তুমি আছো না?”

” মানে?”

” মানে তুম….”

” প্লিজ স্টপ ফালাক।”

ওর কথা শেষ হওয়ার আগেই আমি কথাটা বলে ওকে থামিয়ে দিই।ফালাক লাজুক হাসি দেয়।আমিও লজ্জায় চোখ মাটিতে নামিয়ে খেতে লাগি।
খাওয়া হয়ে গেলে আমরা যে যার মতো বাসন ধুতে লাগি।ডিল হয়েছে আমাদের মধ্যে নিজের কাজ নিজের কর‍তে হবে।ফালাক বাহিরে যাওয়ার জন্য রেডি হয়।শার্টের বোতাম লাগাতে লাগাতে বলে,,

” কিছু আনা লাগবে?”

” দুধ,আর ডিম আনিও।আজ পুডিং বানাবো নি।”

” এই একটা জিনিস তুমি ভালো বানাতে পারো।”

আমি চাপা হাসি দেই।ও বেরিয়ে যায়।আমি দরজা আটকে দিয়ে।বাথরুমে কাপড় ভেজাই।সারা সপ্তাহের কাপড় জমে রয়েছে।ফালাকেরই বেশি।ও একদিন ওই এক শার্টই পরবে।বাইরে থেকে এসেই ময়লা কাপড় রাখার চেয়ারে ঢেল দেবে সে।আর আমি একসেট জামা ঘাম শুকিয়ে এক সপ্তাহ পার করে ফেলি।তবে বৃষ্টির দিনে তা অন্য কথা! ভাবতেও অবাক লাগে সেদিনের অলস দোয়েল আজ কত্ত কাজ করে।ওপরওয়ালা যদি মেয়েদের সব পরিস্থিতিতে মানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা না দিতেন তাহলে সত্যিই, বিয়ের পরে মেয়েদের কষ্টের সীমা থাকতো না।

যুগের পর যুগ ধরে নারীরা স্যাক্রিফাইস আর এডজাস্ট করে আসছে।এই দুটো ওয়ার্ড যেন শুধু মেয়েদেরই জন্য।সংসারে সর্বস্ব দেওয়ার পরও,জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে থেকে একটা শিশু ভূমিষ্ট করে একজন পুরুষকে পিতৃত্বের স্বাদ দেওয়ার পরও দিনশেষে নারীরাই কলঙ্কিনী, বে*শ্যা।নারীরাই ছলনাময়ী। বাংলা অভিধানে আশি ভাগ নেগেটিভ শব্দই নারীকে নিয়ে লেখা।

চলবে,,,ইনশাআল্লাহ

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে