রৌদ্দুরে প্রেমের বৃষ্টি পর্ব-২৪+২৫

0
3013

#রৌদ্দুরে_প্রেমের_বৃষ্টি
#পার্টঃ২৪
#রুবাইদা_হৃদি(sheikh ridy)

নিস্তব্ধতার মাঝে সুখ দুঃখ একে অপরকে জড়িয়ে থাকে৷ হুট করে সব শেষ হওয়ার মাঝে অশান্তি জড়িত ভালোলাগা আছে৷ তপ্ত নিশ্বাসের উঠানামা গুলো বড্ড ভারী হলেও এক চিলতে সুখ আষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে৷ আমি কাঁদছি..! চোখ বেয়ে নেমে পড়া পানির ফোঁটা গুলো জানান দিচ্ছে অজানা সুর৷ বুকের মাঝে প্রশান্তির বাতাস বইছে৷ আমার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা কাব্য ভাইয়ার মুখেও উঁপচে পড়া খুশি৷ উনি হয়তো বড়রা সামনে না থাকলে শক্ত করে জড়িয়ে ধরতো আমায়৷ গুটিগুটি পাঁয়ে আমার পাশ ঘেষে দাঁড়ালেন উনি৷ আমি একটু ভয় পেলাম সবার সামনে কিছু করলে লজ্জায় মাথা কাঁটা যাবে৷ উনি আমাকে ভুল প্রমাণিত করে দিয়ে বললেন,
–‘ এতো জলদি সব কিছু এরেঞ্জ করলে কি করে আব্বু? ‘
ফুঁপা আর আব্বু হাসলেন৷ উনাদের মুখে হাসি দেখে আমাদের মুখেও হাঁসি ফুঁটে উঠলো৷ কাগজ টা আমার হাতে দিয়ে ফুঁপা বলল,
–‘ আমাদের ছেলে-মেয়ের কষ্টের ভাগীদার তো আমরা হতে পারি না৷ আর তুমি এডাল্ট..!কথাটা বারবার ভুলে যাই৷ তোমার আম্মু কথাটা না মনে করালে আমি হয়তো মেনেই নিতাম না৷ আর আমরা জানি তুমি নীতুকে ভালো রাখবে৷ আমাদের চেয়ে হয়তো ওর ভালো তুমি’ই চাও বেশি৷ কিন্তু বাবারা খারাপ চায় না, তাদের মাথায় হাজারো ভাবনা থাকে..! ছেলে-মেয়ের ভালো থাকবে কি ভাবে সেই ভাবনা থাকে৷ তোমরা যতই বড় হও না কেন,আমাদের চোখে এখনো সেই ছোট’ই আছো৷ ‘
কাগজটা মূলত আমার ভার্সিটির ট্রান্সফার সার্টিফিকেট ছিলো৷ কাব্য ভাইয়া ফুঁপার কাছে গিয়ে জড়িয়ে ধরলেন৷ ফুঁপি তার পিঠে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে৷ আর আব্বু আমার কাছে এসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,
–‘ তোমাকে ওর কাছে দিয়ে দিয়েছি সেই কবেই৷ আমি চাই ভালো থাকো..! তোমার আম্মু বেঁচে থাকলে হয়তো সবকিছু আরো সুন্দর হতো৷ সেই সুন্দর পৃথীবিটা না হয় কাব্যের সাথে থেকেই হোক তোমার৷ ‘
আমি কাঁদলাম আব্বুর বুকের মাঝে মাথা রেখে..! হয়তো ভালোর জন্যই বাবারা কঠোর হয়৷ বাবাদের কঠোরতায় ভালোবাসা থাকে,আগলে রাখার প্রচেষ্টা থাকে৷ একমুঠো সুখের অংশ বাবারা বিলিয়ে তাদের সন্তানদের জন্য৷ কিছু কিছু ক্ষেত্রে সেটা আমাদের কাছে বারাবাড়ি মনে হলেও দিনশেষে তারা সঠিক..!
______________________
হাতে মাএ ছয় ঘন্টা সময় আছে৷ আর উনি এখনো ঘুমুচ্ছেন৷ গত দুইদিনের ঘুম৷ আমি নিজের জিনিসপত্র গোছাচ্ছি..! তার লাগেজ প্যাঁক করা৷ একরাশ মন খারাপের সাথে ভালোলাগা আছে আজ৷ বাড়ি ছেড়ে, ফুঁপি-ফুঁপা,বাবা, জিনিয়াকে ছেড়ে যেতে অনেক কষ্ট হচ্ছে৷ কিন্তু যেতে যে হবেই..! আমাকে ছাড়া সে যাবে না আর সে না গেলে তার সপ্ন পূরণ হয়েও হবে না৷ আমি চাই না দিনশেষে এইটার জন্য সে আফসোস করুক৷ আমি তার প্রত্যেকটা ভালো জিনিসের মাঝে বেঁচে থাকতে চাই৷ এতোটা আবেগ তার প্রতি কবে জমা হয়েছে আমার? যাকে দেখলে ভয়ে পিছিয়ে থাকতাম আজ তার সাথে সারাজীবন থাকার আপ্রাণ চেষ্টার মাঝে আছি৷ আমাকে তার কবে থেকে ভালো লাগে? এই একটা কথা ঘুরেফিরে ভেবে যাচ্ছি৷ ইশ..! সে কি আমায় সেই আগে থেকেই ভালোবাসে? যদি তাই হয় এই অসভ্য বলে নি কেনো৷ এখনো কোথায় বলেছে..! একদম বলে নি৷ ঘড়ির কাঁটায় আটটার ঘন্টা বেজে উঠতেই আমার ভাবনার সুতো ছিড়ে৷ আমি তাড়াহুড়ো করে নিজে ফ্রেশ হয়ে এসে উনার সামনে গিয়ে দাঁড়াই৷ ডাকবো কিভাবে? হাত দিয়ে ধাক্কা দিবো..! মুখ দিয়ে আওয়াজ বের হচ্ছে না একদম৷ শার্ট খুলে শুয়ে আছেন উনি৷ ফর্সা বুকের লোম গুলো দেখা যাচ্ছে৷ আমি দুই পাঁ পিছিয়ে গেলাম৷ ছিঃ! এইভাবে কেও শোয়? উনার লজ্জা নেই আমার তো আছে৷ কিন্তু উনায় তো ডাকতে হবে৷ আমি নিজের গলার স্বর পরিষ্কার করে বললাম,
–‘ ক..ক..কাব্য ভ… উচ্চারণ করতেই নিজেই লজ্জায় মিইয়ে যাই৷ সে আমার বর৷ এতোদিন পর ব্যাপারটা খেয়াল হলো৷ ইশ! মানুষ কি ভাববে৷ তাহলে ডাকবো কি বলে?
— ‘ এইযে..এইযে শুনছেন..! ‘
আমার ডাকে সারা না দিয়ে উলটোদিকে মুখ ঘুরিয়ে আবার শুয়ে পড়লেন উনি৷ লাগিয়েছেন টা কি? উফফ! অসহ্য ব্যাক্তি..! আমি রেগে বেডের উপর উঠে তার সামনে বসে বললাম,
–‘ শুনছেন? উঠুন..! ফ্লাইটের টাইম আর কিছুক্ষণ বাকি৷ ‘
–‘ তো?’ উনি ঘুম জড়ানো কন্ঠে বললেন৷ আমার হার্ট বিট একবার মিস হলো মনে হচ্ছে৷ এতো সুন্দর কারো ঘুম জড়ানো কন্ঠ হয় বুঝি৷ সব ভুলে আমি উনার দিকে তাকিয়ে আছি৷ ঘুমের মাঝেও তার ভ্রু কুচকানো৷ আমি তার মতো আঙুল দিয়ে স্লাইড করে গম্ভীর ভাবে বললাম,
–‘ নীতু, তুই আমাকে বুঝিস না কেন? শাস্তির অপশন তোর জন্য দুইটা..! ফার্স্ট অপশ…
কথা শেষ করার আগেই সে একটানে আমাকে শুয়িয়ে আমার উপর ঝুঁকে শুয়ে পড়লেন৷ আমি ভয় পেয়ে তার গলা আঁকড়ে ধরে রেখেছি৷ এইটা কি হলো? অসভ্য তো ঘুমিয়ে ছিলো৷ উনার সম্পূর্ণ ভার আমার উপরে ছেড়ে দিয়েছেন৷ আমি উঠতে চেয়েও পারলাম না৷
–‘ কি হচ্ছিলো? ‘ উনি আমার গালে স্লাইড করে বললেন কথাটা৷ আমি কেঁপে উঠে আমতা আমতা করে বললাম,
–‘ কো..থায় কি হচ্ছিলো? আমি তো ডাকছিলাম৷ ওহহ হ্যাঁ আপনার ফ্লাইট ছেড়ে চলে গেছে৷ ‘
অস্থিরতায় উল্টাপাল্টা কি বলছি নিজেই জানি না৷ উনি নিজের মুখ সামনে এগিয়ে আনতেই আমি চোখ মুখ খিঁচে বন্ধ করে নেই৷ আজ হাত দিয়ে ঢেকে ফেলার উপায় নেই৷ কারণ একহাত বাঁধা আরেক হাত তার গলায় আঁকড়ে রাখা৷ উনি স্থির দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন৷ আমি একচোখ খুলে তাকিয়ে আবার বন্ধ করে নেই৷ উনি আমার চোঁখের উপর ছুঁয়ে দিতেই আমি উনার থেকে হাত নামিয়ে নেই৷ উনি ঘোর লাগানো কন্ঠে বললেন,
— ‘ তোর চোখের মাঝে ডুবিয়ে আমাকে মারতে চাস?
তোর গোঁলাপি ঠোঁটের কাঁপুনি তে আমি যে হারিয়ে ফেলেছি নিজেকে..!
তোর লাল হওয়া গালের ডানপাশের ছোট কালো তিলটার অধিকারে মাঝে নিজেকে কেন খুজে বেড়াই বলতে পারবি? ‘
আমার হাত ডানপাশে যেতেই উনি হেসে উঠেন৷ হাসতে হাসতে বলল,
–‘ চালাক হয়ে গেছিস..! ‘
আমি দুদিকে মাথা দিয়ে না করতেই উনি আবার হেসে ফেললেন৷
–‘ আপনি হাসবেন না তো..! হিংসে হয় আমার৷ ‘
উনি আরো হেসে উঠলেন৷ আমি বিরক্ত হলাম৷ আমার হাসির চেয়ে তার হাসি সুন্দর৷ অনেক সুন্দর..! উনি আমার গালে হাত রেখে বললেন,
–‘ কারো হাসির তালে নিজেকে হারিয়েছি তো আমি সেই আগেই৷ আর সে কিনা বলে আমার হাসিতে তার হিংসে হয়৷ দ্যাটস নট ফেয়ার..! আমি তো তার হাসির ঝংকারে পুড়ে যাচ্ছি..! সেই হাসির কারণ আমি হতে চাই বলেই এতোশত কাহিনী৷ তা কি জানে সে?’
আমি নিজেই হেসে ফেললাম এইবার৷ আমার হাসি নিজের দেখতে বড্ড ইচ্ছা হচ্ছে৷ তার হাসির চেয়ে আমার টা সুন্দর..! ভাবতেই একরাশ লজ্জা এসে ভীর করলো আমার মাঝে৷ উনি এগিয়ে এসে আমার গালে নিজের গাল দিয়ে স্লাইড করতেই আমি ভড়কে যাই৷ আবারও এতোটা কাছে৷ আমি চোখ বন্ধ করে নিতেই সে আমার নাকের সাথে তার নাক ঘষে উঠে দাঁড়ায়৷ আমি সেখানে সেইভাবেই আছি৷ ঘোরের মাঝে৷ আমাকে উঠতে না দেখে সে বলল,
–‘ রোম্যান্সের মুড এখন থাকলে লাভ নেই বেবি..! এখন রোমান্স করতে গেলে বাচ্চা সহ জার্মান যেতে হবে৷ ‘
আমি উনার কথা শুনে উঠে বসে একটা বালিশ ছুড়ে মারি৷ ছিঃ! অসভ্য..!

গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছি সবাই৷ আজ শুধু মোস্তাকিম ভাইয়া আমাদের সাথে যাবেন৷ তার ধারণা, আজ আবার কিছু একটা কাব্য ভাইয়া ঘটাবেন৷ আবার গাছের সাথে গাড়ি ধাক্কা লাগিয়ে বলবেন,সে বাচ্চা নিয়ে জার্মান যেতে চায়৷ তার উপর উনার হাতের ব্যাথা এখনো আছে৷ দুজনের মাথায় ব্যান্ডেজ করা৷ এইটা কোনো কথা?সবার থেকে বিদায় নিতে কান্না পাচ্ছে আমার৷ জিনিয়াকে ছেড়ে যেতে বেশি কষ্ট হচ্ছে৷ যদিও ও ফুঁপির সাথে থাকবে৷ তাও ভালো লাগছে না৷ সেও সবার থেকে বিদায় নিয়ে গাড়িতে উঠে বসেন৷ আমি উঠছি না দেখে আবার নেমে আসেন৷ মিষ্টি স্বরে বললেন,
–‘ বউ তোকে কি কোলে করে গাড়িতে উঠাবো? ‘
উনার কথা শুনে আমি জলদি গাড়িতে উঠে বসি৷ বউ তোকে..কথাটা বড্ড আপন মনে হলো৷ আমি এক কোণায় বসতেই উনি আমার দিকে এসে বসলেন৷ মোস্তাকিম ভাইয়াকে উদ্দেশ্য করে বলল,
–‘ বিয়ে শাদী করে ফেলিস..! তোর মেয়ের সাথে আমার প্রথম ছেলের বিয়ে দিবো৷ এর পরে মেয়ের সাথে রাহুলের ছেলের বিয়ে দিবো৷ সিনানের ছেলের সাথে আবার মেয়ে বিয়ে দিবো আরেকটা৷ ‘
আমি উনার পেটের উপর জোরে চিমটি দিতেই৷ উনি মুখ দিয়ে শব্দ করতেই মোস্তাকিম ভাইয়া হেসে উঠলো৷ আমি লজ্জায় মাথা নীচু করে উনায় ইচ্ছা মতো বকে চলেছি৷ ছেলে -মেয়ে হবে কবে তার ঠিক নেই এখুনি তাদের বিয়ের ব্যাবস্থা করে ফেলেছেন৷ একমাএ তার দ্বারাই সম্ভব এইগুলা৷ নিমিষেই মন খারাপ উধাও হয়ে গেছে৷ আমাকে রাগ করতে দেখে উনি ফিসফিস করে বললেন,
–‘ আমার বাচ্চাকাচ্চার আম্মুর মুড এমন পানসে থাকলে তাদের বাবা কিন্তু ভুল ভাল কাজ করে বসবে৷ পরে দোষ দিলে আমি মানবো না..! ‘
আমি উনার কথা শুনে মুচকি হাসলাম৷ এখন উনি কতটা পরিবর্তন হয়েছে..! রুড স্বভাবের মানুষ এতোটা অসভ্য হয় কি করে ভাবতেই অবাক লাগে৷
_________________
বিকেলের সূর্য প্লেনের জানালা দিয়ে আমাদের ছুঁতে চাচ্ছে৷ সব ফর্মালিটি শেষ করে অজানার উদ্দেশ্য পাড়ি জমাচ্ছি৷ একরাশ ভালোলাগা আর একটু খানি ভালোবাসায় মোড়া অনুভূতি গুলো মন ছুঁয়ে যাচ্ছে৷ আমাকে জানালার পাশের সিটে বসতে দিয়ে উনি আমার দিকে ঘুরে বসে আছেন৷ আমি ভ্রু কুচকে তাকাতেই উনি হাসেন৷ আমি ‘, কি হয়েছে জিজ্ঞেস করতেই উনি বললেন,
–‘ আমার বুকে মাথা রাখবি..? ‘
আমি অবাক চোখে তাকাতেই উনি মাথার চুল গুলো হাত দিয়ে ব্রাশ করলেন৷ আমি কিছু না বলেই উনার দিকে এগিয়ে চুপ করে তার বুঁকে মাথা রাখি৷ এইখানে শান্তি আছে..! এতোসময়ের মাথা ব্যাথা হঠাৎ করেই উধাও হয়ে মাথার ভেতর হালকা লাগতে শুরু করলো৷ উনি আমার মাথা আলতো করে চাঁপ দিয়ে ধরে রেখেছেন৷ একটু পর বললেন,
–‘ একরাশ বৃষ্টি এসেছে আমার ঘরে,,
সে বৃষ্টি শুধুই প্রেমের বৃষ্টি..! ‘
চলবে….!

#রৌদ্দুরে_প্রেমের_বৃষ্টি
#পার্টঃ২৫
#রুবাইদা_হদি(sheikh ridy rahman)
সপ্নের মতো বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে আছি আমরা৷ আমার একহাত শক্ত করে ধরে রেখেছেন উনি৷ মনে হচ্ছে ছেড়ে দিলেই আমি এই অচেনা রাজ্যে হারিয়ে যাবো৷ আমিও তার হাত ধরে চারদিকে তাকিয়ে দেখছি৷ আবারো সব ফর্মালিটি শেষ করে আমরা বাইরে বের হতেই অবাক হয়ে যাই৷ বার্লিনের কোল জুড়ে বৃষ্টি হচ্ছে৷ আঁকাশের কোলে হালকা মেঘের ভেদ করে একফালি রোদ এসে বৃষ্টির ফোঁটা গুলোকে রাঙিয়ে দিচ্ছে৷ রৌদ্দুরে বৃষ্টি..! এর চেয়ে বড় ওয়েলকাম আর হতেই পারে না৷ আমি উচ্ছ্বসিত চোখে তাকিয়ে আছি..মুখে হাসি৷ এতো সুন্দর একটা সারপ্রাইজ পাবো ভাবতেই পারি নি৷ আমিও কাব্য ভাইয়ার হাত ঠেসে ধরলাম৷ উনিও খুশি হয়েছেন..! সবাই দাঁড়িয়ে দেখছে রৌদ্দুর আর বৃষ্টির খেলা৷ আর আমাদের মনে প্রেমের ছোঁয়া লাগছে৷ কেন এতোটা সৃতিময় আজকের দিনটা? আমাদের স্বাগতম জানানোর জন্য? অচেনা ভালোবাসার শহরে প্রথম রৌদ্দুরে বৃষ্টি..! বার্লিনের প্রথম পাঁ রাখার অনুভূতি এতোটা সুখময় কেন? উনিও আমার মতোই উচ্ছ্বসিত..! যা তার চোখে-মুখে ফুঁটে উঠেছে৷ জার্মানি এক লোক এসে দাঁড়াতেই উনি লাগেজ গুলো গাড়িতে উঠাতে বলেন৷ সেইদিকে আমার কোনো খেয়াল নেই৷ রোদের আলো আর বৃষ্টির খেলার সাথে রঙধনুর সাত রঙ ফুঁটে উঠেছে৷ আমি উনার হাত ধরেই প্ল্যাটফর্মের একদম সামনে এগিয়ে গেলাম। একপ্রকার টেনেই উনায় নিয়ে যাচ্ছি। আমার এইভাবে টেনে নেওয়া দেখে উনি অবাক হয়ে গেলেও নিজেকে সামলে নিয়ে আমার সাথে দৌড়াতে থাকলেন। একটু রাগীস্বরে বললেন,
–‘ পাগলের মতো দৌড়াচ্ছিস কেন? আরে .. আরে পড়ে যাবো তো। ‘

আমি উনার কথা একদম পাত্তা দিলাম না৷ আমি রঙধনু ধরবো৷ এতোকাছে থেকে আগে কখনো দেখি নি৷ আমি বৃষ্টি মাথায় নিয়েই প্ল্যাটফর্মের বাইরে বেরিয়ে এলাম৷ মাথায় ব্যান্ডেজ করা সেইদিকে আমার কোনো খেয়াল নেই৷ আমিতো নিজের খেয়ালে আছি৷ বৃষ্টি মাথায় পড়তেই উনি হ্যাচকা টান দেন আমায়৷ আমি একদম উনার বুকের উপর হুমড়ি খেয়ে পড়তেই উনি নিজেকে পড়ে যাওয়া থেকে সামলিয়ে নেন৷ রাগীদৃষ্টিতে তাকিয়ে শাসনের সুরে বলল,
–‘ পাগল হয়ে গেছিস? বার্লিনের হাওয়া লাগতেই মাথার তার সব ছিড়ে গেছে কি? এইভাবে বৃষ্টির মধ্যে বেরিয়ে এলি কেন? মাথা ভিজে যাচ্ছে সে খেয়াল কি আছে..!’
উনার কথা শুনে বড্ড অভিমান হলো আমায়৷ এতোসুন্দর দেখি নি কখনো তাই বেশির এক্সসাইটেড হয়ে গিয়েছিলাম৷ আমি উনার থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে সামনে এগিয়ে যেতেই উনি আবার হাত ধরে টান দেন৷ আমি আবারও পিছিয়ে উনার বুকের সাথে গিয়ে ধাক্কা খাই৷ উনি আমার দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালেন৷ আমি চোখ ঘুরিয়ে নিলাম৷ কিছু বললাম না৷ উনার সাথে কথা বলবো না একদম৷ উনি চুপ করে আছেন দেখে আমি আবার তাকালাম উনার দিকে৷ চুলগুলো ব্যান্ডেজের উপর দিয়ে বেরিয়ে আছে৷ ফোঁটা ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ছে৷ আমার অভিমান মিশে গেলো মূহুর্তেই৷ মাথা ভিজে যাচ্ছে দেখে তাড়াহুড়ো করে বললাম,
–‘ সর‍্যি..আমি বুঝি নি! আপনার মাথা যে ভিজে যাচ্ছে..’ আমি নিজে উঁচু হয়ে তার মাথার উপর হাত দিলাম যাতে পানি না পড়ে৷ উনি আমার কাজ দেখে হাসলেন৷ আমি সেদিকে পাত্তা না দিয়ে বললাম,
–‘ ভেতরে চলুন,,আমি রঙধনু ছুঁবো না..! ‘
উনি এখন আমার কথায় পাত্তা না দিয়ে হাত উঁচিয়ে জার্মানি সেই ব্যাক্তিকে ডেকে বললেন,
–‘ hey man.. give me umbrella please..! ‘
আমি উনার কথা শুনে ভ্রুকুচকে ফেললাম৷ ছাতা দিয়ে কি হবে? গাড়িতে উঠলেই হয়৷ লোকটা কোথায় যেন হারিয়ে গেলো৷ আমাকে ভ্রুকুচকে থাকতে দেখে উনি আমাকে ছেড়ে নিজের ব্লেজার খুলে ফেললেন৷ আমি অবাক হয়ে বললাম,
–‘ খুলছেন কেন? এমনি ভিজে যাচ্ছেন আরো ভিজে যাবেন তো৷ ‘
–‘ হুশশ..! রৌদ্দুরের বৃষ্টির রঙে রাঙাবো তোকে৷ ‘
আমি উনার দিকে তাকিয়ে আছি৷ ব্লেজার খুলতেই সাদা শাদা শার্ট আর কালো জিন্সে তাকে অপূর্ব লাগছে৷ আশেপাশে তাকিয়ে দেখলাম প্ল্যাটফর্মে দাঁড়ানো কিছু জার্মানি মেয়ে উনার দিকে তাকিয়ে আছে৷ ভাব দেখিয়ে ব্লেজার খোলার কি দরকার ছিলো? ওহহ হ্যাঁ নিজের ফিটনেস বডি মেয়েদের দেখানোর জন্য৷ আমি মেয়েগুলোর দিকে রাগী চোখে তাকিয়েও লাভ হলো না৷ ওরা তাকিয়ে আছে৷ আমি রেগে উনার কাছে গিয়ে হুট করেই জড়িয়ে ধরি৷ আমার এহেন কাজে সে হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন৷ আমি জড়িয়ে ধরতেই ওরা হেঁসে দিলো৷ আমি সেদিকে পাত্তা না দিয়ে মনে মনে বললাম, ‘ সে আমার..! ‘
–‘ কে কার? ‘
–‘ আপনি আমার..!’
উনি এবার তার ব্লেজার আমার মাথার উপর দিয়ে হেসে উঠলেন৷ বললেন,
–‘ এই জন্যই তো বলি লাজুকলতা হুট করে আমায় জড়িয়ে ধরলো কেন..!’
উনার এতোটুকু কথা শুনে নিজে ছেড়ে চলে আসতে চাইলে উনি এবার আটকে ফেলেন৷ জার্মানি ছেলেটা ছাতা নিয়ে এগিয়ে আসতেই উনি ছাতা ছুড়ে মারতে আর তাকে গাড়িতে অপেক্ষা করতে বললেন৷ ছাতা ফুটিয়ে উনি আমাকে ছেড়ে দিলেন৷ তারপর আমার হাতে ছাতা দিতেই আমি থমথমে গলায় বললাম,
–‘ আপনার মাথায় ধরুন.. আমার দরকার নেই৷ ‘
উনি রাগী চোখে তাকাতেই আমি ফিচেল হেসে ছাতা হাতে নিয়ে বললাম,
–‘ ওহহ..!আপনার হাতে তো ব্যাথা, বুঝেছি আমি ধরে রাখবো তাই তো?’
–‘ কঁচু বুঝেছিস তুই..! বকবক না করে ছাতা ধর..!’
উনার ধমক শুনে আমি ভড়কে গেলাম৷ ছাতা ধরতেই উনি আমার পিছনে এসে দাঁড়ালেন৷ আমি ঘাড় ঘুরাতেই উনি কোলে উঠিয়ে নিলেন৷ আমি আবার ভয় পেয়ে তার কলার খাঁচমে ধরি৷ উনি ভ্রুকুচকে বললেন,
–‘ এক ছাতা উঠিয়ে আরেক ছাতাও আমাকে ধরতে বলিস? ‘
আমি উনার কথা মানে বুঝতে পেরে তার বাহুতে থাপ্পড় দিতে নিলেই নিজেকে সামলে নিলাম৷ বিরবির করে বললাম,
–‘ ঢং নিজে কোলে নিবে আবার নিজেই ভাব দেখাবে৷ যত্তসব..! আমার কি পাঁ নেই? ‘
উনি হাসলেন৷ হেসে বললেন,
–‘ তাহলে নামিয়ে দেই? প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে থাকা ওদের একজনকে উঠিয়ে নিয়ে আসি৷ ‘
এইবার আর হাত ফিরিয়ে নিলাম না৷ উনার বাহুতে থাপ্পড় মেরে বললাম,
–‘ আপনার চোখ একদম এয়ারপোর্টের চোরাস্তার মোড়ে ঝুলিয়ে দিবো উল্টাপাল্টা কথা বললে..! এখানে আসার সাথে সাথেই দি ডিসেন্ট কাব্য ভাই গ্রেট লুচু তে পরিণত হয়ে গেছে..!’
উনি হা হা করে হাসলেন৷ আস্তে আস্তে হেঁটে যেতে যেতে বললেন,
–‘ লুচু গিরির কি দেখেছিস তুই?’
আমি হাওয়ায় দুলছি মনে হচ্ছে৷ ছাতা একহাতে শক্ত করে ধরে থেমে থেমে বললাম,
–‘ ক.. কই আমি তো কিছু দেখি নি..! ‘
–‘ কিন্তু আমি তো শুনেছি কেও একজন বলেছে..! ‘
আমি চুপ করে গেলাম৷ চোখ পিটপিট করে তার দিকে তাকিয়ে আছি৷ হুট করে একটা জায়গায় এসে উনি দাঁড়ালেন৷ আমায় নামিয়ে দিলেন৷ আমি এখনো উনার দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে আছি৷ সে আমার দিকে তাকিয়ে হাত ধরে ঘুরিয়ে নিজের বুকের সাথে মিলিয়ে নিলেন৷ আমার কোমরে হাত পেঁচিয়ে ধরে বললেন,
–‘ এতো শক পাচ্ছিস কেন? এখন থেকে অভ্যাস করে নে..!উঠতে বসেতে এইগুলা সহ্য করতে হবে তোকে৷ আর হ্যাবলার মতো অবাক না হয়ে সামনে তাকা৷ ‘
আমিও তার কথা বাধ্য মেয়ের মতো শুনে সামনে তাকাতেই অবাক হয়ে যাই৷ লেক..বৃষ্টির ফোঁটায় উন্মাদনা সৃষ্টি করছে৷ রোদের আলো প্রতিফলিত হওয়ার ফলে ছোট রঙধনু সৃষ্টি হয়েছে সেই পানির উপর৷ সুন্দর বললেও কম হবে…. আমি অবাক চোখে তাকিয়ে সেই রঙধনু ছুঁতে নিলেই আমার হাতের সাথে মিলিয়ে যায়৷ আমি খিলখিল করে হেসে উঠছি৷ উনি আমার কানের কাছে এসে বললেন,
–‘ চোখের গভীরতার মাপ জানিস কি? ‘
আমি ঘাড় ঘুরাতেই উনি গলা বাড়িয়ে চুমু দেন৷ তাড়াহুড়ো করে সামনে ঘুরে বললাম,
–‘ মাপ টাপ জানি না..! হুট হাট কাঁকের মতো ঠোঁট বাড়িয়ে চুমু টুমু দেওয়া কিন্তু লুচু গিরি..! ‘
উনার কি হলো জানি না আমার গালে আবার চুমু দিয়ে বললেন,
–‘ লুচু তো একজনের সামনেই হওয়া যায়..! আর সেই লুচু গিরি তে লুচ্চামি থাকে না থাকে ভালোবাসা..! ‘
আমি কিছু বললাম না৷ হাঁসলাম! এতো যুক্তি কোথায় পায় উনি? উনি গুণগুণ করে বললেন,

~” তুমি চোখের আড়াল হও,
কাছে কি’বা দূরে রও,,,,,
মনে রেখো আমিও ছিলাম,,,,
~” এই মন তোমাকে দিলাম,,,
এই প্রেম তোমাকে দিলাম,,,,
চলবে,,

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে