যে পাখি ঘর বোঝে না পর্ব-০৮

0
699

#যে_পাখি_ঘর_বোঝে_না
পর্ব-০৮
লেখনীতে-তানিয়া শেখ

ধোঁয়াটে মেঘে ঢেকে আছে আসমান। জানালায় বসে অনেকক্ষণ সেদিকেই তাকিয়ে রইল বহ্নিশিখা। সময়ের পরিক্রমায় কত কী বদলে যায়। অদূরের ওই মাঠ আজ কারো নিবাস হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। সবুজ ঘাসের ওপর চেপে বসেছে অসংখ্য ইট, সিমেন্ট আর লোহার রড। প্রানবন্ত ঘাসগুলো আস্তে আস্তে মরে যাবে। ওখানটাতে তখন দাঁড়িয়ে যাবে ইট পাথরের বিরাট দালান। ওই নগন্য ঘাসের মরে যাওয়াতে কারো কিছু এসে যায় না। তবে ওর কেন এত খারাপ লাগছে? আজকাল সামান্য ক্ষুদ্র জীবের প্রতিও বড্ড মায়া জন্মায় বহ্নিশিখার। বুকের মধ্যে নিগূঢ় এক শূন্যতা বিরাজ করে।

“ওখানে দাঁড়িয়ে আপনি এত কী দেখেন বলুন তো?”

বহ্নিশিখার ঠোঁটে ম্লান হাসি জেগে ওঠে। ছ মাস হতে চলল সংসার জীবনের, অথচ মানুষটা আজও বউকে আপনি বলে ডাকে। এই নিয়ে প্রায় ছেলেকে বকে ওর শাশুড়ী। বউকে আপনি বলা আবার কেমন কথা? আফরাজ তখন বলে,
“আপনি বলাতে দোষের কী? আপনার কি খারাপ লাগে আপনি বললে বহ্নিশিখা?”

বহ্নিশিখা সলজ্জে মাথা ঝাঁকিয়েছিল। আফরাজ আপাদমস্তক একটা ভালোলাগা হয়ে উঠেছিল ওর কাছে। গত ছ’মাস ছিল ওর জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়। এমন না এই ছ’মাসে ও খুব সুখী ছিল। অনেক চড়াই উৎরাই পেরিয়েছে এই ছ’মাসের সংসার জীবনে। সংসার জীবন শিখেছে। মানুষ প্রতি পদে পদে শেখে আর মেয়ে মানুষ সেকেন্ড সেকেন্ড শেখে।

“বহ্নিশিখা?”

“হ্যাঁ, শুনছি তো।” জানালার দিকে পিঠ করে দাঁড়াল ও। সামনে দাঁড়ানো আফরাজকে দেখতে লজ্জায় দৃষ্টি নামিয়ে নিলো। আধ ভেজা শরীরে সামান্য একটা তোয়ালে কোমরে জড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

“আপনি বড্ড বেহায়া মি.শেখ।”

রুষ্ট মুখে বলল ও। আফরাজ হাসছে। ক্লজেটের দিকে যেতে যেতে বলল,

“বউ যখন স্বামীকে খেয়াল না করে তখন একটু বেহায়া হলে দোষ কী? কখন রুমে ঢুকেছি জানেন? প্রায় আধঘন্টা হতে চলল। এত আনমনা হয়ে কী দেখেন জানালার বাইরে?”

“আকাশ, ওই দূর দিগন্ত আর মুমূর্ষু ঘাসগুলো।” আবার জানালার দিকে ঘুরে দাঁড়ায় ও। আফরাজ টিশার্ট পরে সবে টাউজার হাতে নিয়েছিল। বহ্নিশিখার কথা শুনে থমকে গেল। বুকের মাঝটা হঠাৎ ছ্যাঁত করে ওঠে ওর কথার ধরনে। টাউজার ফেলে এগিয়ে গেল বহ্নিশিখার দিকে। ঠিক ওর পেছনে দাঁড়াল।

“কী হয়েছে আপনার?”

“কিছু না তো।”

একটুখানি ইতস্তত করে হাত বাড়িয়ে ওর বাহুধরে নিজের দিকে ঘুরাল। বহ্নিশিখা এখনও মুখ নিচু করে আছে। আফরাজ থুতনিতে তর্জনী রেখে মুখ তুলল ওর। বহ্নিশিখার চোখ টলমল। এই বুঝি গড়িয়ে পড়বে গাল বেয়ে। আফরাজ উদ্বিগ্ন হলো।

“কাঁদছেন কেন আপনি?”

বহ্নিশিখা জবাব দেয় না। ওর টলমল জল এবার গড়িয়ে পড়ল গাল বেয়ে। আফরাজ অঞ্জলি ভরে ওর মুখটা তুলল। বহ্নিশিখার চোখের জল ওর বুকে যন্ত্রণার উদ্রেক করে।

“বলবেন না কী হয়েছে?”

“আমি বুঝতে পারছি না। কী যেন হয়েছে আমার। জানেন ওই ঘাসগুলো ইটের চাপে পড়ে মরছে। আমার কেন যেন ভীষণ কষ্ট হচ্ছে ওদের জন্য। মনে হচ্ছে আমিও মরে যাই। মিশে যাই ওদের সাথে।”

আফরাজ আচমকা ওকে বুকে টেনে নিলো। মাথাটা শক্ত করে চেপে ধরল বুকের ওপর।

“হুঁশ!” ব্যস এইটুকু বলতে পারল সহসা।

“আমি বোধহয় মরে যাব আফরাজ। আপনাকে ছাড়া আমি সত্যি মরে যাব।”

আফরাজ ওর মুখটা আবার আঁজলা ভরে তুলে বলল,

“আপনাকে ছাড়ছে কে? আপনি আমার বেঁচে থাকার, ভালো থাকার একমাত্র মাধ্যম হয়ে উঠেছেন বহ্নিশিখা। আপনাকে ছাড়া আমার এক মুহূর্ত চলবে না।”

বহ্নিশিখা সিক্ত দৃষ্টি ফের নামিয়ে নিতে হাতটা আরো সংকুচিত করল আফরাজ। কাছে টেনে আনল ওর মুখ।

“আপনি আমার কথা বিশ্বাস করছেন না?”

বহ্নিশিখা আফরাজের হাত ছাড়িয়ে সরে দাঁড়ায়। বিস্ময়হত আফরাজ। ওর ভয় হচ্ছে এখন। হারিয়ে ফেলার ভয়। বড়ো কষ্টে আজ এই স্বাভাবিক জীবনে ফিরেছে। স্বাভাবিক! হ্যাঁ তেমনই। এই সব সম্ভব হয়েছে বহ্নিশিখার কারণে। ওর সাপোর্টে আর বিশ্বাসের কারণে নিজেকে বদলাতে শুরু করেছে। খুব সয়েছে মেয়েটা। ওর মতো সংসার ভীরু পুরুষের সাথে জেনেশুনে সংসার করা তো চাট্টিখানি কথা নয়! অনেক বুঝতে হয়, অনেক কম্প্রোমাইজ করতে হয়। আফরাজ ওর সান্নিধ্যে এসেই ভীতি কাটিয়ে উঠছে। একটু একটু করে সহজ হচ্ছে বৈবাহিক সম্পর্কে। মুখে নয় আজ সে মন থেকে বিশ্বাস করে বহ্নিশিখাকে। সমস্ত দিয়ে ভালোবাসতে চায়।

“আমাকে বিশ্বাস করা ছেড়ে দিয়েছেন বহ্নিশিখা?” বড়ো কাতর শোনাল আফরাজের গলা। এই কাতরতা, দুর্বলতাকেই ও আজীবন ভয় পেয়ে এসেছে। বেডের পাশের ছোট্ট টেবিলের ড্রয়ার খুলে কিছু বের করে আনল বহ্নিশিখা। তুলে ধরল ওর সামনে। ভুরু কুঁচকে তাকায় আফরাজ।

“কী এ_!”

কণ্ঠরোধ হয়ে এলো ওর। বহ্নিশিখার হাত কাঁপছে ওর হতবিহ্বল মুখ চেয়ে। এই ছবির সত্যতা ফুটে উঠেছে আফরাজের পাণ্ডুর মুখে। ছবিগুলো ধরে রাখার মানে হয় না এখন। বিছানায় ছুঁড়ে ফেলে বসে পড়ল দপ করে। দু’হাতে মুখ ঢেকে খুব কাঁদল। আফরাজ তখনও তেমনই দাঁড়িয়ে আছে। ওর এখনও যেন নিজের চোখকে বিশ্বাস হচ্ছে না। এই ছবি বহ্নিশিখা পেল কোথায়? গলা শুকিয়ে এসেছে। শ্বাস টানতে কষ্ট হচ্ছে। মনে পড়ল এখনও মেডিসিন নেওয়া হয়নি আজকের। ছুটল বেডের পাশের টেবিলের দিকে। কাঁপা হাতে ড্রয়ার খুলতে আরেক ধাক্কা খেল। ওর কাউন্সিলিং এর কাগজপত্র। গত একমাস ও কাউন্সিলিং বন্ধ করেছে। কেন করেছে সে কথা বলার সাহস হয়নি বলেই চেপেছিল ও।

“আমি আপনাকে ভালোবাসি আফরাজ। এতটা ভালো কোনোদিন কাওকে বাসিনি। ধোঁকার ব্যথা মৃত্যুর চাইতেও বুঝি বেশি কষ্টের। আপনাকে ভালোবাসার আগে মরতে সাহস হতো না। ওই যে ওভার ব্রিজে সেদিন মরতে গিয়েও সাহসে কুলায়নি। মনে হয়েছিল মৃত্যুর থেকে বেঁচে থাকা সহজ। আপনি আমার সেই ধারণা ভুল প্রমাণিত করে দিয়েছেন আফরাজ। আই উইশ সেদিন একটু সাহস করে মরে যেতাম আমি।” বহ্নিশিখা কান্না থামিয়ে চোখ মোছে,”মনে পড়ে আমাদের বিয়ের দিনের কথা? আপনি বিশ্বাস করতে বলেছিলেন। নিজেকে সঁপে দিয়েছিলেন। তাহলে এমন কেন করলেন আমার সাথে? এই কী আমার প্রাপ্য ছিল আপনার কাছে? বিয়ে ভীতি এসব সব নাটক ছিল, হুম? সত্যিটা হলো আপনি রাহাকে ভালোবাসেন। আপনার বন্ধুর স্ত্রীকে ভালোবাসেন বলেই অন্য কারো সাথে বিয়েতে এত অনীহা ছিল, ঠিক বললাম তো?”

“না, ঠিক বলোনি। সব ভুল, সব।” আফরাজ চেঁচিয়ে ওঠে। এই ছবি দেখার পরও আফরাজের দৃঢ় অস্বীকার বহ্নিশিখাকে ক্ষিপ্ত করে তোলে।

“মিথ্যাবাদি, প্রতারক, কোনটা ভুল? এই যে দেখুন, আপনার ভালোবাসার মানুষটির সাথে জড়াজড়ি করে আছেন এটা ভুল? না কি দিনের পর দিন সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে হোটেলে বন্ধুর স্ত্রীকে নিয়ে সময় কাটানোর কথা জেনে যাওয়াটা ভুল? কোনটা?”

আফরাজের চোখ লাল হয়ে ওঠে। চোখের পলকে ও ছুটে এসে বহ্নিশিখার চোয়াল চেপে ধরে বিছানায় ফেলে দেয়। বহ্নিশিখার ভয় হচ্ছে ওর এই রূপ দেখে। হঠাৎ আফরাজের ডাক্তারের কথা মনে পড়ল।

“আফরাজ একটা সুপ্ত আগ্নেয়গিরি, বহ্নিশিখা। ওকে এমনিতে যতটা শান্ত মনে হয় ও কিন্তু তেমনটা নয়। ওকে কিছুতেই রাগাবেন না। ওর মতের বিরুদ্ধে যায় এমন কিছুতে জোর করবেন কখনও। নয়তো ফুঁসে উঠে সব ছাড়খার করে দেবে ওই সুপ্ত আগ্নেয়গিরি।”

আজ বহ্নিশিখা স্বচক্ষে দেখছে আফরাজের মধ্যে জেগে ওঠা আগ্নেয়গিরি। দু’হাতে ছাড়ানোর চেষ্টা করছে ওর হাত। আফরাজ শক্ত করে ধরে ঝুঁকে আসে।

“আমি মিথ্যাবাদি, প্রতারক নই বহ্নি। কেন বললে ওসব আমাকে কেন?”

ব্যথায় বিবর্ণ হয়ে এলো বহ্নিশিখার মুখ। রোজিনা ছেলের হুঙ্কার শুনে ছুটে এলেন। আফরাজকে ওই অবস্থা বহ্নিশিখা ওপর দেখে চিৎকার করে স্বামীকে ডাকতে লাগলেন।

“শুনছেন? তাড়াতাড়ি আসুন। ও আব্বু, এ কী করছ?”

ছেলেকে টেনে সরাতে ব্যর্থ হলেন তিনি। আলিম শেখ এসে কোনোমতে ঠেলে নিচে ফেলে দিলো আফরাজকে। বহ্নিশিখা নিস্তেজ মেরে গেছে। একফোঁটা বল অনুভব করছে না দেহে। গাল দুটো অসাড় যেন। রোজিনা ওকে বুকে জড়িয়ে নিলেন। আফরাজ উন্মাদের মতো করতে লাগল,

“আমি মিথ্যাবাদি, প্রতারক নই। রাহা আমার কিছু না, কিছু না। আপনি আমার প্রতি বিশ্বাস করা ছেড়ে দিলেন বহ্নিশিখা? জবাবের সুযোগ না দিয়ে আগেই দোষী সাব্যস্ত করলেন?” আলিম শেখ এবং রোজিনা ওর কথা শুনে মুখ চাওয়াচাওয়ি করলেন। তাঁরা যেন সব বুঝে গেলেন। আফরাজ উঠে দাঁড়িয়ে ফের বহ্নিশিখার কাছে যেতে চায়। আলিম শেখ ছেলেকে সমস্ত শক্তি দিয়ে জড়িয়ে ধরে আছে।

“আব্বু, ও আমার প্রতি বিশ্বাস করা ছেড়ে দিয়েছে। দুদিন পর ও আমাকে ধোঁকা দেবে এই অজুহাতে।”

“না, দেবে না ধোঁকা ও তোকে। শান্ত হ তুই।”

“দেবে, দেবে। মনে নেই এমন করেই তো আম্মু তোমাকে ধোঁকা দিয়েছিল। অন্য কারো হাত ধরে পালিয়ে গিয়েছিল রাতের অন্ধকারে। আমি, আমি এইটুকু ছিলাম আব্বু, এইটুকু।” আফরাজ ফ্লোরের দিকে ঝুঁকে চার ফুট ওপরে হাত রেখে দেখায়। ওর রক্তিম চোখদুটো বেয়ে অশ্রু গড়াচ্ছে। বহ্নিশিখা টের পেল রোজিনার আবিষ্ট হাত ঢিলে হলো। কৌতূহল জাগল ওর। আফরাজের মা মানে তো রোজিনা! তিনি এমন একটা অসামাজিক কাজ করতে পারেন? আফরাজের অশ্রুরুদ্ধ গলার স্বরে ওর ভাবনায় ছেদ পড়ে।

“সেদিন ঝড় উঠেছিল বাইরে। তুমি বাসায় ছিলে না। হঠাৎ বিদ্যুৎ চলে গেল। ঘরময় নিকষ কালো অন্ধকার। আমি চিৎকার করে ডাকলাম,”আম্মু, আম্মু?” আম্মু এলো না। আমি কাঁদতে লাগলাম। ভয়ে ভয়ে বসার, ঘর তোমাদের ঘর সবখানে আম্মুকে ডাকলাম। অন্ধকারে পড়ে গিয়ে হাঁটু কাটল, মাথা ভাঙল। পরদিন জ্ঞান ফিরল। আলো এলো চোখের সামনে, কিন্তু আম্মু আর এলো না। কীভাবে আসবে? পরপুরুষের হাত ধরে যে পালিয়ে গেছে রাতের অন্ধকারে। একমাত্র সন্তানের কথাও ভাবেনি যাওয়ার আগে। নিষ্ঠুর, পাপিষ্ঠা মহিলা।”

আলিম শেখ আর সহ্য করতে পারলেন না। সজোরে ছেলের গালে চড় বসিয়ে দিলেন।

“নিজের গর্ভধারিণীকে পাপিষ্ঠা বলতে তোর মুখে বাধল না রাজ?”

“কেন বাধবে? আমি একশবার বলব পাপিষ্ঠা, কুলটা_”

আবার ধেয়ে এসে পড়ল আলিম শেখের রুক্ষ কঠিন হাত ওর গালে। চিৎকার করে বললেন,

“আফিয়া পাপিষ্ঠা, কুলটা না রে রাজ। ও নিষ্পাপ, নিস্কলুষ। সব দোষ আমার। ও বিশ্বাস করা ছেড়ে দিয়েছিল কারণ ওর বিশ্বাস আমি ভেঙেছিলাম। অনৈতিক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছিলাম। পাপ যদি কেউ করে তবে সেটা আমি করেছি। আফিয়াকে আর দোষ দিস নে বাপ। ও বেচারীর আত্মাকে আর কষ্ট দিস না।”

“আত্মা!” আফরাজের বিস্মিত মুখ। রোজিনা ডুকরে কেঁদে ওঠেন। বহ্নিশিখা উঠে বসল। রোজিনা তবে ওর আপন মা নয়? রোজিনা বোধহয় পুত্রবধূর মনের কথা ধরতে পারলেন। মাথা নাড়ালেন তিনি।

“হ্যাঁ, আমি ওর মা নই। ওর মায়ের ছোটো বোন। বুবু সেদিন রাগ করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলেন ঠিকই কিন্তু পরপুরুষের হাত ধরে নয়। এ বাড়ির পুরোনো ড্রাইভারের খারাপ নজর ছিল ওর দিকে। সুযোগে সেদিন বুবুকে ও_” রোজিনা শব্দ করে কাঁদতে লাগলেন। আলিম শেখ ফ্লোরে বসে পড়লেন। চোখে তাঁর জল।

“আমি অর্থের নেশায় নষ্ট হয়ে গিয়েছিলাম রাজ। ভেবেছিলাম ও বুঝবে না। কিন্তু ও বুঝে গেল। ক্রমশ নিশ্চুপ হতে লাগল। আমি লক্ষ্য করিনি। আমার অবহেলার সুযোগ নিলো ড্রাইভার। লালসা মিটে গেল হুঁশ ফিরল ওর। মেরে ফেলল ওকে।নিজেকে বাঁচাতে মিথ্যা রটাল ওর নামে। আমার সম্পর্কে ড্রাইভার সব জানত। সুতরাং রটনা বিশ্বাসযোগ্য করে তোলা ওর জন্য সহজ হলো। রটিয়ে দিলো স্বামীর পরকিয়ার জের ধরে খান বাড়ির বউ আরেক পুরুষের হাত ধরে রাতের আঁধারে পালিয়ে গেছে। পাঁচটা বছর আফিয়ার কবরের ওপর দিয়ে হেঁটেছি আমরা। কথায় বলে না, সত্য দিনের আলোর ন্যায় প্রকাশ হয়ই একদিন। তোর কেনা সেই জার্মান শেফার্ডই আবিষ্কার করল আফিয়ার কবর। তদন্ত হলো। ড্রাইভার গ্রেপ্তার হলো। তুই তখন ফ্রান্সে ছিলি বলে ঘটনাটা সহজে লুকিয়ে গিয়েছিলাম।”

মাথা নুয়ে ফুপিয়ে কাঁদলেন আলিম শেখ। তারপর অপরাধী গলায় বললেন,

“আমাকে শাস্তি দে রাজ। আমার পাপে তোর মায়ের পবিত্র শরীরে কলঙ্কের কালি লাগল। অথচ, পাপী আমি। আমাকে শাস্তি দে।”

আফরাজের মনে হলো ও শ্বাস নিতে পারছে না। প্রচণ্ড ঘামছে শরীর। মিথ্যা! সর্বত্র যেন মিথ্যার জাল। এত মিথ্যা কেন পৃথিবীতে? বাবা মিথ্যা বলেছে। মামণি মিথ্যা বলেছে। রাহা মিথ্যা বলেছে। দু’হাতে চুল মুঠ করে ধরল আফরাজ। বহ্নিশিখার বড্ড মায়া হলো। ইচ্ছে হলো ছুটে গিয়ে ওকে বুকে জড়িয়ে সকল ব্যথা ভুলিয়ে দিতে। কিন্তু ওই ছবি! বহ্নিশিখা মুখ ফিরিয়ে নিলো ওর দিক থেকে। আফরাজ উঠে দাঁড়ায়। আলিম শেখ ছেলের কাছে শাস্তি চাইছেন। মামণির সিক্ত চোখেও স্বামীর ক্ষমা প্রার্থনার আকুতি। এই রমণী সব জেনেও আলিম শেখকে বিয়ে করেছিলেন। আপন বোনকে যে লোক ধোঁকা দিয়েছিল তাঁকে বিয়ে করেছিল কেবল আফরাজের মুখ চেয়ে। সেই দায়বদ্ধতার সম্পর্কে বিশ্বাস এলো, ভালোবাসা এলো। আফিয়ার মৃত্যু শরীরে আর আলিম শেখ মরেছিল মনে। রোজিনা সেই মৃত মনে একটু একটু করে প্রানরস ঢেলেছে। জীবিত মানুষের সব রোগ, বেদনা সময়ের আবর্তে সেরে ওঠে, একমাত্র ধোঁকার আঘাত ছাড়া। এত বছর যেই মাকে ঘৃণা করে সমস্ত নারী জাতি, বিয়ে আর সংসারকে অবিশ্বাস করেছে আজ তাঁরই ব্যথায় কাতর হতে লাগল আফরাজ। মায়ের প্রতারিত আত্মা যেন ভর করল ওর ওপর। মনে পড়ল মমতাময়ী মায়ের মুখ। কোনোদিন কাওকে কষ্ট দেননি তিনি। নিজে হাজার কষ্ট চুপচাপ সয়ে গেছেন। সেই মা’কে দিনের পর দিন তিরস্কার করেছে ও। আফরাজ টলতে টলতে রুমের দরজায় গিয়ে থেমে যায়। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায় বিছানার ওপর। বহ্নিশিখা এখনও মুখ ঘুরিয়ে আছে। বিশ্বাস করে না সে আফরাজকে। জীবনটা এই মুহূর্তে অসহ্য হয়ে উঠল আফরাজের কাছে। কোথাও একটু শান্তি নেই, কোথাও আশ্রয় নেই।

“আছে তো! মায়ের কোলে শান্তি আছে।”

আফরাজ রুম ছেড়ে বেরিয়ে যায়। বহ্নিশিখা দৌড়ে চলে গেল ব্যালকনিতে। হাঁটুতে মুখ গুঁজে কাঁদতে লাগল। খানিক পরেই রোজিনার আর্তনাদ শুনে চমকে উঠল ও।

“আব্বু গো। ও আমার আব্বু এটা কী করলে?”

বহ্নিশিখার শিরদাঁড়া বেয়ে শীতল স্রোত বয়ে গেল। ও উঠে দাঁড়াতে গিয়েও পারল না। শুনতে পাচ্ছে আলিম শেখ ড্রাইভারকে, দারোয়ানকে ডাকছেন। কথা জড়িয়ে যাচ্ছে তাঁর। তবুও একটা শব্দই বার বার বলছেন,

“অ্যাম্বুলেন্স, অ্যাম্বুলেন্স।”

চলবে,,,

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে