যখন আমি থাকবোনা পর্ব-০১

0
5016

#যখন_আমি_থাকবোনা
#সূচনা_পর্ব
#লেখক_দিগন্ত

বিয়ের পরের দিনই মুক্তির হাতে ডিভোর্সের পেপার ধরিয়ে দিল তার স্বামী বিপ্লব। মুক্তি বিয়ের পরের দিন যে এমন একটা সারপ্রাইজ পাবে সেটা কখনো ভেবে দেখেনি। অবাক নয়নে নিজের স্বামীর দিকে তাকিয়ে আছে মুক্তি।

বিপ্লবের কোন ভ্রুক্ষেপ নেই সেদিকে। মুক্তিকে চুপচাপ দেখে বিপ্লব রেগে যায়। বলে,
-“এভাবে সং এর মতো দাঁড়িয়ে আছেন কেন? আমি এক্ষুনি কি বললাম শুনতে পান নি?”

মুক্তির কাছে সবকিছু কেমন স্বপ্ন স্বপ্ন মনে হয়। বিপ্লবের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে মেয়েটা। ভেতর থেকে হাহাকারে ভরে যাচ্ছিল। মুক্তি অনেক কষ্টে নিজের চোখের জলকে আটকে রাখে৷ দৃঢ়তার সাথে বিপ্লবকে বলে,
-“আপনি কি আমার সাথে মজা করছেন?”

বিরক্তিতে বিপ্লবের ভ্রু কুচকে যায়৷ সে সিরিয়াসভাবে বলে,
-“বিপ্লব চৌধুরী কখনো মজা করে না। আমি যেটা বলছি সেটা একদম সত্যি। আমি ডিভোর্স চাই।”

মুক্তি আর নিজের চোখের জল আটকে রাখতে পারে না। এক নিমেষে তার এতদিনের দেখা স্বপ্ন ভঙ হয়। মুক্তির সাথে তো সেই কোন ছোটবেলা থেকে বিপ্লবের বিয়ে ঠিক হয়ে আছে।

বিপ্লব ও মুক্তির বাবা একে অপরের খুব ভালো বন্ধু। সেই খাতিরেই ছোটবেলাতেই তাদের বিয়ে ঠিক হয়ে আছে। মুক্তির মা সে অনেক ছোট থাকতেই মারা যায়। তারপর মুক্তির বাবা আরেকটা বিয়ে করে। মুক্তির সৎমা তাকে সহ্য করতে পারত না। সেই কারণে মুক্তির বাবা মুক্তিকে জোরপূর্বক তার ফুফুর কাছে লন্ডনে পাঠিয়ে দেয়।

এক সপ্তাহ আগে নিজের বাবার মৃত্যুর সংবাদ পেয়ে মুক্তি দেশে ফিরে আসে। এরপর কিছু বুঝে ওঠার আগেই মুক্তির সৎমা ও বাকের চৌধুরীর(বিপ্লবের বাবা) তৎপরতায় মুক্তি ও বিপ্লবের বিয়ে হয়ে যায়।

মুক্তি একের পর এক এরকম ধাক্কা আর সহ্য করতে পারছিল না। বিপ্লবের কথার কোন উত্তর না দিয়ে তাই সে দৌড়ে ছাঁদে চলে যায়। ছাঁদে এসে ডুকরে কাঁদতে থাকে মুক্তি।

এরমধ্যে মুক্তি শুনতে পায় আজানের শব্দ। ফজরের নামাজের সময় হয়ে গেছে। মুক্তি কোনরকমে চোখের জল মুছে, ওজু করে নামাজের সিজদায় লুটিয়ে পড়ে। আল্লাহর কাছে নিজের সব সমস্যার কথা বলে।

-“আমার সাথে কেন বারবার এরকম হয় আল্লাহ তায়ালা? আমি তো কারো সাথে কোন অন্যায় কিছু করিনি। প্রথমে নিজের বাবার মৃত্যু। হঠাৎ করে এভাবে বিয়ে, আর এখন বিয়ের পরের দিনই…আমি যে আর পারছি না।”

নামাজ শেষ করে বিছানায় এসে গা এলিয়ে দেয় মুক্তি। তার ভেতরটা একদম পুরে ছাঁই হয়ে গিয়েছিল। তন্মধ্যে বিপ্লব এসে বলে,
-“তখন ওভাবে কোথায় পালিয়ে গেলেন? আমার কথা কি আপনার কানে যায়নি?”

মুক্তি চোখ বন্ধ করে মনে শক্তি জোগায়। সে ভাবে,
-“না এত সহজে আমায় ভেঙে পড়লে চলবে না। শক্ত হতে হবে।”

এরপর বিপ্লবের সামনে এসে সরাসরি প্রশ্ন করে,
-“আপনি কেন বিয়ের পরের দিনই আমাকে ডিভোর্স দিতে চাচ্ছেন সেটা আগে বলুন। আমি যতদূর জানি কোন কারণ ছাড়া এভাবে ডিভোর্স হয় না। আমার কি কোন কমতি আছে?”

কথাটা শুনে বিপ্লবের চোখমুখ শক্ত হয়ে যায়। রাগে ক্ষোভে মুক্তিকে শক্ত করে ধরে সে বলে,
-“হ্যাঁ আছে। আমার কোন ইন্টারেস্ট নেই আপনার উপর। ছোটবেলা থেকে আমার ইচ্ছে ছিল, নিজে পছন্দ করে ভালোবেসে একজনকে বিয়ে করব। সেখানে না জানি আপনি কোথা থেকে উড়ে এসে জুড়ে বসলেন। যাকে আমি চিনি না, জানি না হুঠ করে বাবার কথামতো তাকে বিয়ে করতে হলো। এরকম সম্পর্কে আমি ইন্টারেস্টেড নই।”

বিপ্লব একনাগাড়ে কথাগুলো বলে। মুক্তি কথাগুলো শুনে কি প্রতিক্রিয়া করবে ভেবে পাচ্ছিল না। শেষে বাধ্য হয়ে মুক্তি এমন একটা কাজ করে বসল যা ধারণার বাইরে ছিল। সে সরাসরি বিপ্লবকে প্রস্তাব দেয়,
-“ঠিক আছে আপনার ইচ্ছেই পূরণ হবে। আপনি আমাকে একমাসের সময় দিন। আমি হরফ করে বলে দিলাম এই একমাসে আপনি আমাকে ভালোবেসে ফেলবেন। আর যদি ভালো না বাসেন তাহলে আমি নিজে আপনাকে ডিভোর্স দিয়ে চলে যাব।”

বিপ্লব মুক্তির কথাটা শুনে বেশ অবাক হয়। সে হেসেই ফেলে কথাটা শুনে। যেন খুব মজার জোকস শুনেছে। মুক্তি বিপ্লবকে এভাবে হাসতে দেখে জিজ্ঞাসা করে,
-“হাসছেন কেন আপনি?”

-“না দেখছিলাম যে লন্ডনে থাকা একটা মেয়ে কিভাবে এত বোকা হতে পারে। আমি ভেবেছিলাম আপনি অনেক আধুনিক আর স্মার্ট হবেন এখন দেখছি সবটাই উলটো।”

-“আমি লন্ডনে বড় হলেও একজন মুসলিম একজন বাঙালি হিসেবে বড় হয়েছি। আমার ফুফুমনি আমাকে কোন খারাপ শিক্ষা দেন নি। তার শিক্ষাকে কাজে লাগিয়ে আমি চলব। তবে আপনি আমাকে খুব বেশি সহজ সরলও ভাববেন না আমি। আমাকে বাইরে থেকে দেখতে যত নরম লাগে, ভেতর থেকে আমি ততোটাই শক্ত। আমি শুধু আপনাকে একটা সুযোগ দিতে চাইছি। কিংবা বলতে পারেন আপনার সাথে একমাসের একটা বাজি ধরছি।”

-“আপনাকে বেশ ইন্টারেস্টিং লাগছে। ঠিক আছে আমি আপনার প্রস্তাবে রাজি। দিলাম আপনাকে একমাস সময়। দেখি আপনি কি করতে পারেন।”

মুক্তি বিজয়ীর হাসি হাসে। মুক্তিকে এভাবে হাসতে দেখে বিপ্লব ভ্রু কুচকে ফেলে। মুক্তি কোন কিছু না বলে বেড়িয়ে যায় রুম থেকে। আজ থেকে যে মুক্তির নতুন লড়াই শুরু। জীবনে অনেক লড়াই করেই তো মেয়েটা বড় হয়েছে। সব লড়াইয়ে ধৈর্য ধরে আল্লাহর নাম নিয়ে গেছে৷ এবারও তাই করবে।
_____________
আলেয়া বেগম মন খারাপ করে রান্না করছিলেন। এই বয়সেও বাড়ির সব কাজ তাকে একা করতে হয়।

আলেয়া বেগম হলো বিপ্লবের মা। এই বাড়ির কর্তি। কিন্তু কেউই তাকে মানে না। স্বামী ব্যস্ত রাজনীতি আর ব্যাবসা নিয়ে। বড় ছেলে আশরাফ ডাক্তার। আশরাফের স্ত্রী স্নেহা পায়ের উপর পা তুলে সারাদিন বসে থাকে।

আলেয়া বেগম তাকে অনেক চেষ্টা করেও তাকে দিয়ে কোন কাজ করাতে পারেন না। বাড়িতে কাজের লোক আছে বৈকি কিন্তু আলেয়া বেগম চান সংসারের কিছু কাজ যেমনঃ-রান্নাবান্না অন্তত বাড়ির বউয়ের করা উচিৎ।

আলেয়া বেগম আশায় ছিলেন যে বিপ্লবের বউ এসে অন্তত এই সংসারের হাল ধরবে। কিন্তু যখন শুনলেন বিপ্লবের বউ লন্ডনে বড় হয়েছে তখন তার আশাটাও মাটি হয়ে গেল। তিনি ভাবলেন, এই মেয়ে আর যাই হোক সংসারী হবে না।

এসব ভেবেই একা একা রান্না করছিলেন তিনি। ততক্ষণে মুক্তিও রান্নাঘরে চলে আসে। আলেয়া বেগম মুক্তির দিকে অবাক হয়ে তাকান। মুক্তি এক বাঙালি বধূর মতো মাথায় ঘোমটা দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মুচকি হেসে বলে,
-“আমি কি আপনাকে কোন সাহায্য করতে পারি মা?”

মুক্তির থেকে এরকম মিষ্টি ব্যবহার একদম আশা করেন নি আলেয়া বেগম। তিনি তো ভেবেছিলেন এই মেয়ে তার বড় বৌমা স্নেহার থেকেও বেশি ফুটানি বাজ হবে। এখন দেখছেন হিসেব পুরো উলটে গেছে।

আলেয়া বেগম হাসি হাসি মুখ করে বলেন,
-“তোমার তো নতুন নতুন বিয়ে হয়েছে। তোমার এখন এসব কাজ করতে হবে না। তাছাড়া তুমি বিদেশে বড় হয়েছ। এসব কাজ কি তোমার দ্বারা হবে?”

মুক্তি বলে,
-“আমি বিদেশে বড় হলেও আমার ফুফুমনি আমাকে একজন সাধারণ বাঙালি মেয়ের মতোই বড় করেছেন। আমি ছোট থেকেই রান্নাবান্না শিখে আসছি।”

আলেয়া বেগম বেশ অবাক হন সাথে খুশিও। তিনি বলেন,
-“আলহামদুলিল্লাহ। তোমার ফুফুর কাছে আমি চিরকৃতজ্ঞ থাকব। কিন্তু মা তোমার তো নতুন বিয়ে হয়েছে। এখনই…”

-“এটা তো আমারই সংসার মা। আজ নাহোক কাল আমাকে তো এই সংসারের হাল ধরতেই হবে। আজ থেকেই নাহয় শুরু করি।”

মুক্তির ব্যবহার আলেয়া বেগমকে মুগ্ধ করে। তিনি আর মুক্তিকে বাধা দেন না।

মুক্তি আপনমনে সব কাজ করতে থাকে। আলেয়া বেগম মুক্তির কাজ দেখেই বুঝতে পারেন তার কাজের হাত খুব পাকা। কেমন উপযুক্ত গৃহিনীর মতো সব কাজ করে যাচ্ছে মুক্তি।

স্নেহা সকালে ঘুম থেকে উঠেই ডাইনিং টেবিলে এসে বসে। আর অর্ডার করে,
-“মা এক কাপ কফি দিয়ে যান তো।”

আলেয়া বেগম কফি নিয়ে যেতে যাবে তখন মুক্তি তাকে জিজ্ঞাসা করে,
-“কে কফি চাচ্ছে মা?”

-“স্নেহা। তোমার বড় জা। আমার বড় ছেলে আশরাফের বউ।”

-“আপনি দাঁড়ান আমি যাচ্ছি।”

আলেয়া বেগম মুক্তির হাতে কফি দেন। মুক্তি কফি নিয়ে গিয়ে স্নেহার হাতে দেওয়ার আগে তাতে অনেক বেশি পরিমাণে চিনি মিশিয়ে দেয়। আলেয়া বেগম কিছু বলতে চাইলে বলেন,
-“আমার উপর ভরসা রাখুন।”

মুক্তির কথাটা শুনে তিনি আর কিছু বলেন না। মুক্তি কফি নিয়ে গিয়ে সরাসরি স্নেহাকে গিয়ে দেয়। স্নেহা মুক্তিকে কফি নিয়ে আসতে দেখে অবাক হয়। বলে,
-“তুমি বিয়ের পরেরদিনই রান্নাঘরে ঢুকে গেছ। শুনেছিলাম তুমি লন্ডনে বড় হয়েছ। এসব কাজ কিভাবে যে করছ।”

কথা বলতে বলতে কফি মুখে দেয় স্নেহা। একটু মুখ দিয়েই বলে,
-“এসব কি? এত মিষ্টি কফি খাওয়া যায় নাকি?”

মুক্তি কফিতে চুমুক দিয়ে বলে,
-“আমার তো ভালোই লাগছে। তোমার যদি ভালো না লাগে নিজে রান্না করে খাও না। তুমি করে বলছি জন্য কিছু মনে করো না। তুমি তো আমার বড় জা তাই বড় বোনেরই মতো। যাইহোক এই বয়সে তোমার শাশুড়ি রান্না করে তোমার মুখের সামনে এনে দেবে। আর তুমি পায়ের উপর পা তুলে বসে খাবে সেটা তো হবে না।”

-“হাউ ডেয়ার ইউ? তুমি চিনো আমি কে? আমার বাবা কে জানো? মিনিস্টার আব্দুল মান্নানের মেয়ে আমি। আমার বাবার পাওয়ার সম্পর্কে কোন ধারণা নেই তোমার। আর তুমি কিনা আমাকে রান্না করতে বলছ।”

-“ও আচ্ছা। তুমি মিনিস্টারের মেয়ে জন্য পায়ের উপর পা তুলে বসে খাবে। ঠিক আছে তাহলে তোমাকে রান্না করতে হবে না। কিন্তু তোমার জন্য ওতো পার্ফেক্ট খারাব তৈরি হবে না। যেমন খাবার তৈরি হবে তেমনই কিন্তু তোমাকে খেতে হবে।”

স্নেহা রেগে গিয়ে গরম কফি মুক্তির দিকে ছু*ড়তে যাবে তার আগেই মুক্তি তার হাত ধরে ফেলে। যার ফলস্বরূপ কিছুটা কফি স্নেহার হাতে পড়ে। যন্ত্রণায় কুকিয়ে ওঠে স্নেহা। মুক্তি বাঁকা হেসে বলে,
-“তুমি মিনিস্টার আব্দুল মান্নানের মেয়ে হলে আমিও সাবেক প্রাইম মিনিস্টার মিরাজ হোসেনের মেয়ে। আমার সাথে পাঙ্গা নিতে এসো না ভাবিইই।”
(চলবে)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে