ময়না পাখির কথাগুলো পর্বঃ- ০৪ এবং শেষ পর্ব

0
1865

#ময়না পাখির কথাগুলো।
#পর্বঃ- ০৪ (শেষ)

মিলির যখন জ্ঞান ফিরেছে তখন আসরের নামাজ হয়তো মসজিদে শেষ হয়ে গেছে। কারণ মসজিদ থেকে জামায়াতে নামাজ আদায় করে তালুকদার সাহেব মাত্র বাড়ির মধ্যে ঢুকলেন। সাইফুল তখন গেইটে দাঁড়িয়ে ছিল, তার কানে মোবাইল দেখে বোঝা যাচ্ছে সে কথা বলছিল কারো সাথে।

– মিলির জ্ঞান ফিরেছে তাই সাইফুল তাড়াতাড়ি করে তার কাছে গেল। প্রথমে কীভাবে কথা শুরু করবে সেটা সিদ্ধান্ত নিতে বিড়ম্বনা হচ্ছে।

তারপর কিছু না ভেবে বললো, আপনার মায়ের জানাজা অনুষ্ঠিত হয়ে গেছে জোহরের নামাজের পরেই। আমি মাহাতাবুর রহমান মুহিত সাহেবের কাছে আপনি আসার খবর পাঠিয়েছিলাম। কিন্তু তিনি বললেন যে আপনার জন্য লাশ দাফন করা নাকি বন্ধ রাখা যাবে না। আপনার সাথে লাশের দেখা হোক বা না হোক তাতে কোন সমস্যা নেই।

– মিলি কিছু না বলে শুধু চুপচাপ করে জানালা দিয়ে বাহিরে তাকিয়ে রইলো।

– সাইফুল বললো, আপনি বলেছিলেন যে যিনি মারা গেছে তিনি নাকি আপনার মা, তাহলে কেন আপনাকে দেখানোর দরকার নেই তাদের? আর আপনার বিষয় সেখানের কেউ আগ্রহ প্রকাশ করে নাই।

– মিলি বললো, আমি আমার বাবার সঙ্গে কথা বলতে চাই, আপনি কি আপনার মোবাইলটা কথা বলার জন্য দিবেন?

– হ্যাঁ হ্যাঁ অবশ্যই দেবো। গতকাল রাতে যে নাম্বারে কল দিয়ে কথা বলেছেন সেই নাম্বার তো?

– জ্বি সেটাই।

– তিনি সকাল থেকে অনেকবার কল দিয়েছেন আমার নাম্বারে। আপনার জন্য তার খুব টেনশন হচ্ছে সেটা বোঝা যাচ্ছে ভালো করে। কিন্তু আমার মনের মধ্যে অনেক প্রশ্নের জট পাকিয়ে যাচ্ছে তাই সেগুলো নিয়ে অস্বস্তি হচ্ছে।

– আমি বাবার সঙ্গে কথা বলে তারপর আপনার সকল জট ছাড়িয়ে দেবো।

– আচ্ছা।

মিলির বাবার কাছে কল দেবার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে কল রিসিভ করে মিলির বাবা বললোঃ-

– হ্যালো হ্যালো।

– বাবা আমি মিলি।

– মা মিলি? কেমন আছো তুমি? শুনলাম সকাল থেকে তুমি অসুস্থ কিন্তু এতদূর থেকে আমি কিছু করতে পারি না। আমি রওনা দিতে চেয়েছিলাম কিন্তু সাইফুল নামের এই ছেলেটা নিষেধ করলো। তবুও আমি ভেবেছিলাম আজ রাতেই রওনা হয়ে যাবো বাগেরহাটের উদ্দেশ্যে।

– তুমি শান্ত হও বাবা, আমি ঠিক আছি। সকাল বেলা হঠাৎ করে মায়ের মৃত্যুর খবর পেয়ে মাথাটা কেমন হয়ে গেল। এখন ঠিক আছে।

– আমি রাতের মধ্যে তোমাকে নিতে আসতেছি।

– কেন শুধু শুধু কষ্ট করবা? আমিই চলে আসবো তোমার কাছে। সম্ভব হলে আজকে রাতেই রওনা দিলাম আর নাহলে আগামীকাল সকালে নিশ্চিত।

– তোমার মায়ের কাছে যাবে না?

– না বাবা, আজকে আমার মায়ের মৃত্যুর খবর ছাড়াও অন্য একটা স্মৃতি মনে পরেছে বাবা। আর সেই স্মৃতির জন্য আমার খুব বেশি খারাপ লাগে।

– কিসের স্মৃতি? সজীব এর বিষয় কিছু?

“এখনই জয়েন করুন আমাদের গল্প পোকা ডট কম ফেসবুক গ্রুপে।
আর নিজের লেখা গল্প- কবিতা -পোস্ট করে অথবা অন্যের লেখা পড়ে গঠনমূলক সমালোচনা করে প্রতি সাপ্তাহে জিতে নিন বই সামগ্রী উপহার।
আমাদের গল্প পোকা ডট কম ফেসবুক গ্রুপে জয়েন করার জন্য এখানে ক্লিক করুন

– না বাবা, বছর খানিক আগে আমার একটা ময়না পাখি ছিল তোমার মনে আছে?

– হ্যাঁ মনে আছে। সারাদিনের সকল কাজ ছিল একদিকে আর সেই ময়না পাখি ছিল একদিকে। কিন্তু হঠাৎ করে তুমি নিজের হাতে তাকে গলা টিপে মেরে ফেললে, কারণটা অজানা।

– আজকে আমার সেই ময়না পাখির কথা খুব বেশি মনে পরেছে বাবা।

– কিন্তু কেন? আর তুমি কি তোমার মায়ের দেহ শেষ দেখা দেখতে পেরেছ?

– না বাবা মায়ের সঙ্গে এ জীবনে আর দেখা হবে না বাবা। তার কবর দেখতে ইচ্ছে করছে না তাই সেটাও দেখতে যাবো না।

– তাহলে?

– বললাম যে ফিরে আসবো তোমার কাছে।

– আচ্ছা ঠিক আছে।

– বাবা আমি ময়না পাখিটা কেন হত্যা করেছিলাম জানতে চাও?

– আগে তুমি সুস্থ শরীরে ঢাকায় ফিরে আসো তারপর সবকিছু শুনতে পারবো।

– কিন্তু আমার যে এখনই বলতে ইচ্ছে করছে।

– কিন্তু আমার শুনতে ইচ্ছে করছে না কারণ আমি জানি তুমি এখন খুব অদ্ভুত কথা বলবে আর সেই অদ্ভুত কথার তীব্রতা অনেক গভীর। আমি এখন তোমার সাথে কোন কথা বলবো না, তুমি কালকে সকালে উঠে রওনা দিয়ে চলে আসো তারপর তোমার সাথে কথা হবে।

– ঠিক আছে বাবা।

মোবাইল কেটে দিয়ে মিলি কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে ছিল, তার সামনে সাইফুলসহ আরো কিছু মানুষ কৌতুহল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এমন দৃশ্য সহজে গ্রামের বাড়িতে দেখা যায় না, গ্রামের মানুষের জীবন হচ্ছে প্রাকৃতিক জীবন। তাদের সেই জীবন চলার মধ্যে কোন সমস্যার স্থান নেই। সারাদিন পরিশ্রম করে পাখি যেমন করে নিজের বাসায় ফিরে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে যায়। ঠিক তেমনি করে গ্রামের মানুষগুলো দিনের ব্যস্ততা শেষ করে ক্লান্ত শরীর নিয়ে রাতের প্রথম প্রহরে সুষুপ্ত। অদ্ভুত সব দৃশ্য দেখা যায় ইট পাথরের শহরে প্রতিটি গলিতে গলিতে। সম্পুর্ন শহরটা যেমন কৃত্রিম ইট-পাথরের দালান-কোঠা রাস্তা দিয়ে তৈরী, তেমন করে সব মানুষের জীবন অন্যরকম লাগে। শহরের প্রতিটি মানুষের ভিন্ন ভিন্ন গল্প আছে, কারো জীবনের গল্প খুব মধুর আবার কারো জীবন খুব করুণ।

সাইফুল এক এক করে প্রশ্ন করে যাচ্ছে আর মিলি খুব সংক্ষিপ্ত আকারে সেই প্রশ্নের জবাব দিচ্ছে। যদিও মিলির জবাব খুব ছোট কিন্তু সেটা সাইফুল ঠিকই বুঝতে পারছে। সবকিছু শুনে সাইফুল শুধু একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল ঠিকই কিন্তু কিছু বলার মতো ছিল না। সকল কথার মধ্যে সজীব এর সাথে বিয়ের বিষয়টা নিয়েও আলোচনা করা হয়েছে। সজীব সেদিন রাত থেকে আর কল করেনি আবার মিলিও নিজে ইচ্ছে করে বিরক্ত করে নাই।

—-

সকাল ৭ঃ৩০ মিনিট।
মিলি আর সজীব দুজনেই একসাথে বাসের মধ্যে পাশাপাশি বসে আছে। বাস চলছে আপন গতিতে আর সবাই অপেক্ষা করছে রাজধানী ঢাকা শহরে পৌঁছে যেতে। অনিচ্ছা সত্ত্বেও সাইফুল মিলির সঙ্গে এসেছে কারণ এমন একটা ঘটনার পরে তাকে একা পাঠানো ঠিক নয়। কথাটা বলেছিলেন সাইফুলের দাদা মানে তালুকদার সাহেব। তাই সে বাধ্য হয়ে মিলির সঙ্গে এসেছে, সাইফুল বলেছিল যে বাসের সুপারভাইজারকে ভালো করে বলে দিলে ঠিক মতো পৌঁছে দেবে। আর সমস্যা হলে মিলির বাবা বা সাইফুলকে যেন কল করে। কিন্তু সাইফুলের এই আবেদন তার দাদার আদালতে মঞ্জুর হলো না।

মিলি বাসের মৃদু ঝাঁকুনিতে ঘুমিয়ে গেছে। মিলির মাথা জানালার সাথে মিশে আছে, চোখ দুটো বন্ধ কিন্তু স্বপ্নে মনে হচ্ছে তার মায়ের সঙ্গে কথা বলতে যাচ্ছে। মিলি দেখলো যে তার পাশের সিটে তার মা বসে আছে যিনি পান খেয়ে ঠোঁট আর দাঁত লাল করে ফেলেছে। মিলি মন খারাপ করে জানালা দিয়ে বাহিরে তাকিয়ে তাকিয়ে রাস্তার পাশের সবুজ গাছগুলো পিছনে সরে যাচ্ছে সেগুলো মন দিয়ে দেখছে।

– মিলির মা বললো, কি ভাবছো মা মিলি?

– কিছু না।

– নিশ্চয়ই ময়না “পাখির কথাগুলো” ?

– কীভাবে জানলে?

– তোমার বিষন্নতা প্রকাশ করছে।

– তুমি তো মারা গেছো মা, তাহলে তুমি কীভাবে আমার পাশে এলে? আর আমি কি ভাবছি সেটা কীভাবে জানলে তুমি?

– আমার মেয়ে আমাকে দেখার জন্য এতদূর ছুটে এসেছে কিন্তু আমি আজও স্বার্থপরের মতো তাকে ফেলে অনেক দুরে চলে গেলাম। সেই ছোটবেলা তাকে ফেলে চলে এলাম, আজ এতবছর পরে সে আমার সন্ধান পেয়ে আসলো তবুও আবার আমি চলে গেলাম। খুব খারাপ মানুষ আমি।

– এসব কথা কেন বলছো মা? ভালো লাগে না শুনতে।

– তোমাকে অসুস্থার কথা জানিয়ে এখানে আসতে বলা উচিৎ ছিল না। আমি তো জানতাম না যে আমি এত তাড়াতাড়ি মরে যাবো। মৃত্যুর কথা কি কেউ জানতে পারে রে? তবুও একটা বিষয় ভালো হয়েছে মিলি।

– সেটা কি?

– আমি তো তোমার বাবার আর তোমার কাছ থেকে অনেক দুরের ছিলাম। আমার ঠিকানা বা অন্য কিছু যোগাযোগ তোমরা জানতে না। আমি যদি এভাবেই চুপিচুপি মরে যেতাম তাহলে তো খবরটাও জানতে না কোনদিন। জীবনে আর কভু দেখা তো হতোই না, আবার তোমরা বাবা-মেয়ে জানতেই পারতে না।

– হ্যাঁ তা ঠিক।

– তুমি তোমার ময়না পাখিটা খুব ভালবাসতে তারপর একদিন সেই পাখিটিকে তুমি আমার কথা জিজ্ঞেস করলে। আমার সাথে দেখা হবে কবে সেটা তার কাছে জানতে চাইলে। কিন্তু সেই সময় ময়না পাখিটা সত্যি বলছিল।
” সে বলেছিলঃ- তুমি তোমার মায়ের সঙ্গে আর কোনদিন দেখা করতে পারবে না। তোমার মা খুব শীঘ্রই মারা যাবে আর তুমি খুব কাছাকাছি গিয়েও তোমার মায়ের সঙ্গে দেখা করতে পারবে না। ”
পাখিটির কথা শুনে তোমার খুব কষ্ট হলো, বুকটা ভরে কান্না আসলো। তাই রাগান্বিত হয়ে তুমি তখনই সেই পাখির মাথা টেনে ছিড়ে ফেললে। তোমার সেই পাখির অপরাধ ছিল যে সে সত্যি কথা বলেছিল। সত্যি বলার অপরাধে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হলো তাকে তাই না মিলি? আর তুমি আজ যখন দেখলে “ময়না পাখির কথাগুলো” সবই সত্যি হয়ে গেছে তখন তার কথা খুব মনে হচ্ছে।

– মিলি কিছু না বলে শুধু একটা নিঃশ্বাস ফেললো।

মোবাইলের শব্দে কল্পনার জগৎ থেকে বেরিয়ে গেল মিলি। তার মোবাইল এখনো ঠিক হয়নি কিন্তু সে তার একটা সিমকার্ড অন করেছে সাইফুলের বাটন মোবাইলে। সেই মোবাইলে হঠাৎ করে সজীব কল দিয়েছে দেখে অবাক হলো মিলি।

– রিসিভ করে চুপচাপ রইল মিলি।

– সজীব বললো, কেমন আছো তুমি? কোথায় আছো এক্ষুনি বলো আমাকে। আমি তোমাকে নিয়ে আসবো গিয়ে।

– মিলি বললো, কেন ব্যস্ত হচ্ছ? তোমার সবকিছু ঠিক আছে তো? বাসার সবাই ভালো তো?

– সবাই ভালো, আর আমি সরি মিলি। তোমাকে এভাবে কষ্ট দিতে চাইনি কিন্তু তবু কেন যেন হয়ে গেছে না চাইতেই, প্লিজ ক্ষমা করো। তুমি আজই ঢাকা চলে আসো, আমি খুব তাড়াতাড়ি তোমাকে বিয়ে করতে চাই মিলি।

– মিলি চুপচাপ।

– তুমি কি আমার কথা শুনতে পাচ্ছ মিলি? আমি তোমাকে যা যা বলছি শুনছো?

– নাহহ।

– কেন?

– আমি এই মুহূর্তে শুধু একটা কথা শুনতে পাচ্ছি।

– কি কথা?

– আমার সেই ময়না পাখির কথাগুলো।

– মানে কি?

– কিছু না, রাখলাম তাহলে? আমি গাড়ির মধ্যে বসে আছি তাই পরে কথা হবে।

—— সমাপ্ত ——

লেখাঃ-
মোঃ সাইফুল ইসলাম (সজীব)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে