মেঘের বাড়ি পর্ব-০৫

0
452

#মেঘের বাড়ি☁
#পর্ব-৫
#লেখনীতে_ফারহানা_আক্তার_ছবি
.
.
মেঘ চোখের সামনে গত দুইদিন ঘটে যাওয়া সব ঘটনা চোখের সামনে ভেশে উঠলো৷ কিছুটা অভিমান নিয়ে মেঘ বলে উঠলো,” আমি ওনার সাথে সংসার করবো চাচা তবে আমার একটা শর্ত আছে৷”

শর্তের কথা শুনে সোহেলের পরিবার বেশ নড়ে চড়ে উঠলো৷ সবার মাঝে কৌতুহল জমেছে মেঘ কী শর্ত দেয় সেটা জানার জন্য৷

মেঘ কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো,” আমার শর্ত হলো আমাকে নিয়ে আলাদা সংসার করতে হবে৷”

সোহেল মেঘের কথা শুনে সাথে সাথে বলে উঠলো,” অসম্ভব এটা সম্ভব না৷”

” তাহলে আমার সাথে সংসার করার কথা ভুলে যান৷”

মেঘের শর্ত শুনে সোহেলের মা বাবা ভাই বোন জামাই প্রত্যেকে রাগে ফুঁসছে কিন্তু কিছু বলতে পারছে না মেঘের ভাই আর তার বন্ধুদের ভয়ে৷ সোহেলে মা জায়েদা বেগম কিছুটা নরম কন্ঠে বলতে লাগলো,” বউ মা এইডা তুমি কী কইতাছো? আলাদা ক্যান সংসার পাতবা? আমরা আছি তো কথা দিতাছি তোমার কোন অযত্ন হইবো না৷ তুমি এই সংসারে রানী হইয়া থাকবা৷ ফিরে আসো বউ মা আর রাগ কইরা থাইকো না৷”

” না আম্মা এটা সম্ভব না৷ কারণ…” বাকিটা বলার আগে সোহেল বলে উঠলো ,” মেঘ আমাকে আবার বিদেশ চাকরিতে ফিরতে হবে৷ তিন মাসের ছুটিতে এসেছি৷ তুমি না হয় এই তিন মাস এখানে সবার সাথে রইলে তারপর না হয় মায়ের বাড়ি চলে গেলে৷ আমি না হয় বিদেশ থেকে ফিরলে তোমাকে নিয়ে আসবো৷”

সোহেলের কথায় যৌক্তিকতা থাকায় সোহাগ ও সাহ জানায়৷ মেঘ তার ভাইয়ের অনুমতি পেয়ে থাকতে রাজি হয়৷ মেঘের মা নিশ্চিন্ত হয় এটা ভেবে যে তার মেজ মেয়ের সংসার ভাঙে নি৷ সবটা ঠিক হয়ে গেছে৷ এখন আর কেউ কটু কথা বলবে না৷

সেদিনই সোহাগ তার মা’কে নিয়ে নিজেদের গ্রামে ফিরে আসে৷ আর মে৷ ওখানে থেকে যায়৷

১০.
নিজের রুমে বসে আছে মেঘ সোহেল চেয়ারে বসে কিছু একটা ভাবতে লাগলো৷ গতকাল মেঘ যা যা বলেছিলো সেটাই যে এভাবে খেটে যাবে এটা ভাবেনি সোহেল৷ সোহেলের মনে একটা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে কিছুতেই সে প্রশ্নের উওর সোহেল পাচ্ছে না৷ সোহেল ইতস্থবোধ করছে মেঘের সাথে কথা বলতে৷ মেঘ দীর্ঘশ্বাস ফেলে সোহেলকে বললো,” আপনি হয়তো কিছু বলতে চান আমায়?”

” হ্যাঁ মানে একটা প্রশ্ন ছিলো৷”

” জানি আপনি কী প্রশ্ন করবেন৷”

” তুমি জানো?” অবাক হয়ে বললো সোহেল৷

“জানি! এটাই তো তুমি জানতে চাইছো যে সত্যি আমরা মা মেয়ে এই জঘন্য ব্যবসা করি কীনা?”

” না মেঘ তুমি ভুল বুঝছো?”

” আমি কাউকে ভুল বুঝছি না ৷ তবে তোমার কথা ঠিক মা মেয়ে মিলে ব্যবসা ঠিকি করছে তবে সে মা মেয়ে আমি বা আমার মা নয়৷”

” তাহলে!”

” তোমার মনে আছে নিশ্চয়ই আমাদের বাড়িতে গিয়ে প্রথমদিন যে মেয়েটি একটি ছেলে বাবু কোলে নিয়ে আমাদের সাথে দেখা করতে এসেছিলো?”

” হ্যাঁ হ্যাঁ সাজিয়া নাম মনে হয় মেয়েটির?”

” আমি চাইলে ওই বড় বাড়িতে দাড়িয়ে তাদের কথা বলতে পারতাম কিন্তু বলি নি কারণ কী জানো? তারা আমাদের কোন ক্ষতি করে নি৷ কিন্তু ক্ষতি না করেও অনেক বড় ক্ষতি করে দিলো৷ যাই হোক তারাই এত বছর যাবত ব্যবসা করে আসছে৷”

সোহেল আর কিছু বললো না মেঘের কাছে সোহেল বেশ অনুতপ্ত৷ অন্যদিকে তিন বোন ছোট ভাইয়ের স্ত্রী এবং তার মা কে নিয়ে পুকুর পাড়ে মিটিং বসেছে৷ মিটিংয়ের মূল উদ্দেশ্য হলো মেঘ কে তাড়ানো৷ মেঘ এখানে থাকা মানে হলো তার ভাইয়ের সকল টাকা পয়সা জমিজমা নিজেদের হাত থেকে বেড়িয়ে যাওয়া৷ যেটা মা মেয়ে মিলে কখনো হতে দিতে পারে না৷

” আম্মা এখন কী হইবো? ভাবি তো এবার গাট হইয়া সংসারের হাল ধরবো?”(আখি)

” হ আম্মা বড় ভাবি তো দেখতাছি বেজায় চালাক৷ কি সুন্দর নিজের কথা বড় ভাইজানকে দিয়া মানায় নিলো৷ আর কোথায় দেখেন আপনার ছোট পোলা? আমারে এত বছর আগে বিয়া করলো৷ দুই পোলা মাইয়ার বাপ হইলো তবুও আইজ পযর্ন্ত আমার কথা হুনলো না৷ বড় ভাবি কি ভাইজানরে তাবিজ করছে?”

ছোট ছেলের বউয়ের কথা শুনে জায়েদা বেগম চমকে উঠলেন৷ কারণ বউ বাড়ি না থাকায় ছেলের আনমনা উদাসিনতা লক্ষ করেছে জায়েদা৷ এখন কেন যেন মনে হচ্ছে তার মেঘ হয়তো তার ছেলেকে তাবিজ করেছে৷

ছোট ভাবি মনির কথা শুনে মেজ বোন সাথী বলে উঠলো,” কী সব বাজে কথা কইতাছো ছোট ভাবি? বড় ভাবি ভাইজানরে তাবিজ করবো? অসম্ভব বেপার ৷ আমার মনে হয় না হের মত শিক্ষিত মাইয়া এই কাম করবো৷”

” থাম মেজ আপা আমার মনে হয় ছোট ভাবি যা বলছে ঠিক বলছে৷ এখন বুদ্ধি বার করো কেমনে হেরে তাড়াবা?”( মিলা)

মিলার কথা শুনে তাদের মা বলে উঠলো,” এই বার থেইক্কা তোরা কেউ বড় বউয়ের লগে ঝগড়া করবি না৷ ভালা কথা কবি৷”

” কি কও আম্মা হের লগে ভালা ব্যবহার মুই করতে পারুম না৷”

” তাইলে কথাই কবি না মিলা৷ আমি যা কমু তার বাইরে গেলে তোগো খবর আছে৷”

এই বলে জায়েদা পুকুর পাড় থেকে ঘরে গিয়ে দুপুরের খাবার বেরে মেঘকে ডাকতে লাগলো,” বড় বউমা কোথায় তুমি? এম্মে (এখানে) আহো৷”

শাশুড়ির গলা শুনতে পেয়ে সোহেলকে ধাক্কা দিয়ে নিজের উপর দিয়ে সরিয়ে শাড়ি ঠিক করে দ্রুত রুম থেকে বেড়িয়ে গেল৷

“আম্মা আমায় ডেকেছেন?”

” হ বউ মা বেলা তো আর কম হইলো না৷ সবার তো খাওন লাগবো৷ বিচারে জাওনের লিগ্গা ভাত রান্না করতে পারি নাই৷ আইয়া ভাত আর আলু সিদ্ধ দিছি তুমি জলদি কইরা আলু ভর্তা বানায় ফেলো৷ তোমার শশুরের খিদা লাগছে৷ আর বাকিরাও তো খাবো?”

” আচ্ছা আম্মা আমি এখুনি ভর্তা বানিয়ে ফেলছি৷”

” হ এই লও শুকনা মরিচ ভাজা৷”

শুকনা মরিচ দেখে মেঘ ঘাবড়ে গেল৷ একটা মাঝারি সাইজের একবাটি শুকনা মরিচ তাকে হাত দিয়ে ভর্তা বানাতে হবে৷ মেঘ সামান্য মরিচ ধরলে হাত জ্বালা করে সেখানে এত মরিচ দেখে ভেতরে ভেতরে প্রচন্ড ভয় পাচ্ছে তবে তা মুখে প্রকাশ করছে না৷ সাহস করে মরিচের বাটি হাতে নিতে কে যেন ছোঁ মেরে মেঘের হাত থেকে বাটিটা ছিনিয়ে নেয়৷ আচমকা এমন কান্ডে মেঘ আর তার শাশুড়ি ঘাবড়ে গিয়ে তাকিয়ে দেখে সোহেল৷

” আম্মা মরিচ ভর্তা আমি বানাচ্ছি মেঘ ততক্ষণে বাকি কাজ গুলো করে ফেলুক৷”

জায়েদা নিজের রাগটা দমন করে মুখে হাসি ফুটিয়ে বললো,” আইচ্ছা তুই তাইলে বড় বউমারে কাজে সাহায্য কর৷ আমি দেখি বাচ্চা গুলা কোন দিকে গেলো৷ ” বলতে বলতে চলে গেল জাবেদা৷ সোহেল কথা না বারিয়ে চুপচাপ মরিচ গুলো হাতে ভর্তা বানাতে লাগলো৷ সোহেল মেঘদের বাড়িতে গিয়ে একদিন জানতে পারে মেঘ ঝাল খেতে পারলেও মরিচ হাতে ধরে না৷ তার হাত জ্বালা করে৷ সেটা সহজে কমতে চায় না৷ তাই সোহেল চায় না মেঘ মরিচ ভর্তা বানাক৷ অন্যদিকে সোহেলের বোন গুলো আড়ালে দাড়িয়ে সবটা দেখে রাগে ফোঁস ফোঁস করতে লাগলো৷ মেঘের বেশ ভালো লাগলো সোহেলের এমন কেয়ার দেখে৷ সত্যি বলতে মানুষের রুপটাই আসল না যদি না চরিত্র ঠিক থাকে৷ তেমনি সোহেল একজন সুদর্শন সুপুরুষ না হলেও মনের দিক দিয়ে বেশ সুন্দর৷ মেঘ ভাবতে ভাবতে ঝটপট কাজ গুলো সেরে নিয়ে তার শশুড় সহ বাকিদের ডেকে খেতে দেয়৷ সবাই চুপচাপ খেয়ে উঠে চলে যায়৷ সবাই যাওয়ার পর মেঘ সহ বাকি মেয়েরা খেতে বসে৷ কেউ কোন কথা বললো না৷ মেঘ এটাই চাইছিলো কারণ এই সময় তার ননদরা যদি একটাও কটু কথা শুনাতো তাহলে মেঘ চুপ করে বসে থাকতো না৷

দুপুরের মত রাতেও পরিবেশ তেমনটাই ছিলো৷ তবে সোহেল আর মেঘের সম্পর্কটা বেশ উন্নতি হয়৷

এভাবে একমাস কেটে গেলো৷ এখন বাড়ির সব কাজই মেঘকে করতে হয়৷ মেঘও মুখ বুঝে সব কাজ করে৷ এমন কি গরুর গোবর দিয়ে ঘুটে দেওয়া সেটাও তাকে করতে হয়৷ তার ননদেরা একেক সময় এটা ওটা আবদার করে যা পূরন করতে মেঘের হিমসিম খেতে হয়৷ তার শাশুড়ি আগে রেগে কাজের ফরমায়েশ দিতো আর এখন মিষ্টি গলায় সে ফরমায়েশ দেয়৷ মেঘ চেয়েও না বলতে পারে না৷ সে সুযোগ নেয় তার ননদ এবং জা৷

সময় গড়াতে গড়াতে সোহেলের বিদেশ ফেরত যাওয়ার সময় হয়ে গেলো৷ মেঘের প্রচন্ড মন খারাপ সোহেল আবার বিদেশ চলে যাবে শুনে৷ কিন্তু এর মাঝে সোহেল আর মেঘের জীবনে সুখ নিয়ে আসলো একটি খবর যখন মেঘ জানতে পারলো সে মা হতে চলেছে৷ সোহেল খুশিতে প্রায় কেঁদে দিয়েছে৷ স্বামীর খুশি আনন্দ দেখে মেঘের মনে হলো দুনিয়া সব খুশি আনন্দ হয়তো আল্লাহ তার আচঁলে ঢেলে দিয়েছে৷ সোহেলে খুশিতে মেঘের কপালে চুমু দিয়ে বললো,” ভালোবাসি বউ৷ ভিষণ ভালোবাসি৷”

” ইস সোহেল ছাড়ো না কেউ দেখে ফেলবে৷”

” দেখুক বউ আমার আমি আদর করবোনা তো কে করবে হু?”

” হয়েছে এখন ছাড়ো হাতে অনেক কাজ আছে৷ সে গুলো করতে হবে৷”

” না আজ থেকে কোন কাজ করবে না তুমি৷ ”

” তাহলে কে করবে কাজ গুলো?”

” বাড়িতে অনেক মানুষ আছে মেঘ৷ আখি,সাথী,মিলা, মনি, মা আছে তারা করবে৷”

সোহেলের কথা শুনে মুখ অন্ধকার করে বললো,” এ বাড়িতে আসার পর থেকে বড় বউয়ের দায়িত্ব পালনে কোন অবহেলা করেনি কিন্তু …. দীর্ঘশ্বাস ফেলে বাকি কথা গিলে ফেললো মেঘ৷ মেঘ চায় না সংসারে অশান্তি বাধুক৷ এমন না মেঘ প্রতিবাদ করতে পারে না কিন্তু সব সময় সংসারে প্রতিবাদ করা কোন সমস্যার সমাধান না৷ তবে মেঘ তার ননদ বা জায়ের সব আবদার না মেনে নিজেদের করতে বলতো৷ তাতেই তাদের মুখ অন্ধকারে ঢেকে যেত তবে আজ যে বাড়িতে হিন্দি সিরিয়ালের মত বাড়িতে বাকি মানুষদের মাথায় বিনা মেঘে বজ্রপাত পড়বে এটা ভেবেই মেঘের ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠলো৷

১১.
রাতে খাবার টেবিলে সবাই এক সাথে খেতে বসলে সোহেল খেতে খেতে তার মায়ের উদ্দেশ্য বলতে লাগলো,” আম্মা একটা আনন্দের খবর আছে৷”

” কী খবর আব্বা? ”

” তুমি আর আব্বা দাদা দাদী হচ্ছো৷” কথাটা প্রত্যেকে শোনা মাত্র তাদের মুখের খাবার যেন গলায় আটকে গেলো৷ কারও মুখে কোন কথা নেই মেঘ এই রিয়েকশন টাই দেখতে চেয়েছিলো৷ মেঘ একটু দুরে দারিয়ে মিটিমিটি হাসছে মেঘ৷ তার ননদ আর জায়ের মুখটা দেখে মেঘের পেট ফেটে হাসি পাচ্ছে৷ কিন্তু এখানে হাসি এখন বেমানান তাই হাসি চেপে রাখলো৷ সোহেলের মা জায়েদা ঠোঁটের কোণে জোড় পূর্বক হাসি ফুটিয়ে তুলে বললো,” এই তো আনন্দের কথা৷ আমরা দাদা দাদী হবো৷ ”

মেঘ জানে তার শাশুড়ি খবর টা শুনে মটেও খুশি হয়নি শুধু খুশি হওয়ার ভান করছে৷ খাবার টেবিলে কেউ কোন কথা বললো না চুপচাপ খেয়ে উঠে গেল৷ মেঘ ও খেয়ে নিয়ে সব গুছাতে নিলে সোহেল এসে খপ করে মেঘের হাত ধরে বলে,” কি করছো মেঘ? এখন তোমার এত কাজ করলে চলবে না৷”

” তাহলে কাজ গুলো কে করবে তুমি?”

” না আমি করবো না তবে আখি, সাথী, মিলা , মনি আছে তারা করবে৷”

মেঘ তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললো, তাই নাকি? তাহলে বলে দেখো তোমার বোনদের দেখো তকরা কী বলে?”

সোহেল মেঘের হাত ধরে রুমে নিয়ে যেতে নিলে আখি এসে বলে,” একি ভাইজান ভাবি কে নিয়ে কই যাও৷ এটো থালা পরে আছে সে গুলা পরিষ্কার করা লাগবো না? আর ভাবি আমার পোলার জন্য দুধ টা গরম করছো?”

সোহেল সবটা শুনে বলে,” আখি তোর ভাবি অসুস্থ এখন থেকে তোর ভাবির কাজে হাত লাগাবি৷ আর এখন থেকে এই সব কাজ তুই আর বাকিরা মিলে করবি৷ এটো থালা গুলো ধুয়ে তোর ছেলের জন্য দুধটা গরম করে নিয়ে যাস৷ চলো মেঘ এখন বিশ্রাম নিবে৷” বলে মেঘের হাত ধরে গট গট করে হেটে রুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলো৷

এদিকে সোহেলের কথা শুনে তার বোন হতভম্ব হয়ে দাড়িয়ে রইল৷
.
.
.
#চলবে……………

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে