মেঘসন্ধি পর্ব-১২

0
1370

#মেঘসন্ধি
#লেখনীতে:সারা মেহেক

১২

” তোর তো নিজের কোনো পছন্দ নেই। তাহলে মৌ কে বিয়ে করতে দোষ কোথায়?” আফসার খানের গর্জে উঠা কণ্ঠে আয়ান খানিকটা ভড়কে গেলো। আমতাআমতা করে বললো,
” আমার নিজের পছন্দ নেই মানে এই না যে আমি মৌ কে বিয়ে করবো। ও এখনও সেদিনকার ঘটনা নিয়ে পরে আছে। আমাকে ক্ষমাই করতে পারেনি। সেখানে ওর সাথে সংসার করা কি করে সম্ভব? ”

” দোষ তো তোর। একটা মেয়েকে ওভাবে অপমান করলে সে কি কষ্ট পাবে না? তার গায়ে লাগবে না? তোকে অপমান করলে কেমন লাগতো?”

” তাই বলে এতোদিন এ নিয়ে পড়ে থাকবে?”

আফসার খান এবার চোখ গরম করে বললেন,
” উল্টো হাতে থাপ্পড় খাবি তুই। নিজের দোষ স্বীকার না করে গলা চওড়া করিস!”

আয়ান একটু দমে গেলো। অসহায় চেহারা বানিয়ে বললো,
” আমি কি নিজের দোষ স্বীকার করছি না? করছি তো। কিন্তু বলছি যে, অতীতের একটা ঘটনা নিয়ে এতো পড়ে থাকলে হয় নাকি!”

” এ বিষয়ে আমি আর কথা বাড়াতে চাই না। শুধু বলে রাখলাম, আগামী শুক্রবার তোর আর মৌ এর বিয়ে। সেভাবে মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে রাখ।”
এই বলে আফসার খান চেয়ার ছেড়ে উঠে যেতে নিলেন। কিন্তু আয়ান তাঁর হাত ধরে আটকে নিলো। বাচ্চাদের মতো অসহায় সুরে বললো,
” কিন্তু আব্বু…..ওর প্রতি আমার তেমন কোনো ফিলিংস নেই। ”

আয়ানের এমন চেহারা দেখে আফসারের খানের ভারী মায়া হলো। ছেলের সাথে তাঁর সম্পর্ক খুব একটা গভীর না। বাবা ছেলে যেমনটা হাসিখুশি সময় কাটায়, তেমন সময় কাটাননি তিনি ছেলের সাথে। সবসময় কাজ নিয়ে পড়ে থাকতেন৷ এজন্য আয়ানের সাথে তাঁর অদৃশ্য এক দূরত্ব তৈরী হয়ে যায়। অবশ্য সময় সুযোগ পেলে তিনি আয়ানের সাথে কথা বলার চেষ্টা করেন। আয়ানের মনের কথা জানার চেষ্টা করেন। ভালোমন্দ পরামর্শ দেন। আজ তিনি নিজ দায়িত্বে আয়ানের বিয়ে ঠিক করে এসেছেন। তিনি মনে করেন, ছেলের প্রতি তাঁর সবচেয়ে বড় দায়িত্ব এটাই যে, তাকে একজন ভালো পাত্রী, ভালো সঙ্গী খুঁজে দেওয়া। তিনি এ নিয়ে একদম নিশ্চিত যে, আয়ানের জীবন সঙ্গিনী হিসেবে মৌ একদম উপযুক্ত মেয়ে।
আফসার খান আয়ানের দিকে তাকিয়ে হালকা হেসে দিলেন। এরপর এমন একটি কাজ করে বসলেন, যা আয়ান কখনও চিন্তা করেননি।

আফসার খান হুট করে আয়ানের কাঁধে হাত রেখে নরম সুরে বললেন,
” ব্যালকনিতে চল। একটু কথা বলি। ”

আয়ান এখনও বিস্মিত হয়ে রয়েছে। পরিস্থিতি বুঝতে পেরে সে হালকা মাথা দুলিয়ে বললো,
” আচ্ছা, চলো আব্বু। ”

আফসার খান এবং আয়ান এসে ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে পরলো। বাইরের আকাশ এখন রাতের অন্ধকারে ডুবে যেতে ব্যস্ত। তবে ব্যস্তময় শহরের প্রতিটি দালানকোঠায় বসবাসরত জনগণের ব্যবহৃত আলো নিকষ কালো আঁধারকে চিঁড়ে এক ঝলক উজ্জ্বলতা ছড়িয়ে দিতে ব্যস্ত। আফসার খান আয়ানের দিকে এক নজর তাকালেন। এরপর এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে আকাশ পানে চেয়ে বললেন,
” তোর আম্মু আর আমার বিয়েটা পারিবারিক ভাবেই ঠিক হয়। আমি তখন শহরে চাকরি করি। একদিন আমার বাবা আমাকে জরুরি ভিত্তিতে গ্রামে ডেকে পাঠালেন। আমি গ্রামে যাওয়ার পর তিনি আমার হাতে তনিমার ছবি ধরিয়ে দিয়ে বললেন, ‘দেখ তো মেয়েটাকে চিনিস নাকি? পছন্দ হয়? ওর সাথে তোর বিয়ে ঠিক করেছি আমি।’ বাবার প্রথম দুটো কথা আমি স্বাভাবিকভাবে নিলেও শেষ কথাটা স্বাভাবিক ভাবে নিতে পারেনি। বাবাকে এ নিয়ে প্রশ্ন করলে বাবা বললো, আমার ভালোর জন্যই সে তনিমার সাথে আমার বিয়ে ঠিক করেছে৷ ওর ছবি ভালোমতো দেখে পছন্দ হলে যেনো উনাকে বলি। তাহলে বিয়ের কথা একদম পাকাপাকি করে দিবেন৷ এই বলে বাবা চলে গেলেন আমি তনিমার ছবি দেখি৷ কিছুক্ষণ ভালোভাবে ছবিটা দেখার পর চিনতে পারি যে, তনিমা আমাদের বাড়ির কয়েক বাড়ি পরেই থাকে। আমি গ্রামে থাকতে ওর সাথে টুকটাক কথাবার্তা হতো। তখন আমার মনে ওর জন্য একটু আধটু অনুভূতি তৈরী হয়েছিলো। তবে সে অনুভূতি স্থায়ী হওয়ার আগেই আমি শহরে চলে আসি। এর কয়েক বছর পর ওর সাথে বিয়ে ঠিক হয় আমার। তখন ওর প্রতি আমার কোনো অনুভূতি ছিলো না৷ কিন্তু তারপরও বাবার কথায় বিয়েতে রাজি হয়ে যাই। আর এখন দেখ, বুড়ো বয়স পর্যন্তও ওকে সেই আগেকার মতো ভালোবাসি আমি।” এই বলে তিনি ছোট্ট এক নিঃশ্বাস ফেলে আয়ানের দিকে তাকালেন। আয়ান তাঁর দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। তিনি এর অর্থ বুঝতে পেরে শব্দ করে হেসে বললেন,
” এসব বলার কারণ হলো, আমার আর তোর পরিস্থিতি অনেকটাই একরকম। আমার বাবা বিয়ে ঠিক করেছিলেন আমার পূর্বপরিচিত এক মেয়ের সাথে। তোর ক্ষেত্রেও এমন৷ অবশ্য ফিলিংসের একটু হের ফের আছে৷ সে যাই হোক, যেহেতু আমার আর তোর পরিস্থিতি কিছুটা একই ছিলো, সেহেতু এমনও তো হতে পারে যে, ভবিষ্যতের রূপরেখাও আমাদের দুজনের একই হতে পারে।”

” যদি এক না হয়?”

আফসার খান হালকা হেসে দিলেন। বললেন,
“এটার সম্ভাবনা খুবই কম। ” এই বলে তিনি কিছুক্ষণ চুপ রইলেন। এরপর ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললেন,
” তোর মনে যে মৌ এর জন্য বিন্দুমাত্র অনুভূতি নেই এটা আমি বিশ্বাস করি না। অবশ্যই কোনো না কোনো অনুভূতি আছে। তবে তুই হয় সেটা উপলব্ধি করতে পারিসনি, নাহয় তুই সেটাকে উপলব্ধি করেও হেলাফেলা করেছিস। এতোটা বছর ধরে তুই মৌ কে চিনিস। কখনও কি মৌ এর জন্য সামান্য ভালোলাগার অনুভূতি তৈরী হয়নি তোর মনে? হ্যাঁ, আমি জানি, সবসময় ওর প্রতি তোর একটা দায়িত্ববোধের সম্পর্ক হয়ে এসেছে। কখনও হয়তো এমন পরিস্থিতি তৈরী হয়নি যে পরিস্থিতিতে তুই ওকে পছন্দ বা ভালোবাসতে পারিস৷ কিন্তু বিয়ের পর এটা সম্ভব এবং এর সম্ভাবনা অনেক বেশি। এ সম্ভাবনাকে শতভাগের কাঠগড়ায় দাঁড় করাবে তোর প্রতি মৌ এর ভালোবাসা। ও তোকে ভালোবাসে এবং বিয়ের পর স্বামী হিসেবে ওর প্রতি তোরও ভালোবাসা তৈরী হবে। এটা আমি নিশ্চিত। ”

আয়ান নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে রইলো। আপাতত বলার মতো কিছুই পাচ্ছে না সে। আফসার খান তার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললেন,
” আজ রাতটা তুই সময় নে৷ মৌ কে নিয়ে ভাব। ওর প্রতি তোর কোনো অনুভূতি আছে কি না বা তৈরী হওয়ার কোনো সম্ভাবনা আছে কি না সেটা আমাকে জানাবি। তাহলে আমি খুশিমনে তোর বিয়েটা দিতে পারবো। আর হ্যাঁ, এটা একটু মনে রাখিস, এতোদিন যে মেয়েটাকে তুই দেখেশুনে রেখেছিস তার প্রতি সবচেয়ে বড় দায়িত্বটা এখন তোকে পালন করতে হবে। মেয়েটার মান সম্মান রক্ষার্থে তোকেই মাঠে নামতে হবে। ” এই বলে আফসার খান ব্যালকনি হতে বেড়িয়ে চলে গেলেন। আয়ান তখনও সেখানে ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো। বেশ কিছুক্ষণ যাবত সে আকাশ পানে তাকিয়ে থেকে নিজের বাবার বলা কথাগুলো ভাবতে লাগলো। তার মনে কি আসলেই মৌ এর প্রতি কোনো অনুভূতি আছে? যদি এমনটাই হয় তাহলে সে এ ব্যাপারে জানে না কেনো? নাকি জেনেশুনেও সে তার অবচেতন মনের কথাগুলোকে প্রাধান্য দেয়নি?
আয়ান জানে, মৌ এর দিকে সে সবসময় দায়িত্ববোধের নজরে তাকিয়েছে। কখনও কোনো মেয়ের প্রতি তার তেমন কোনো টান অনুভব হয়নি। তবে মৌ এর প্রতি সবসময় সে একটা টান অনুভব করেছে। মৌ কোনো বিপদের পরলে সে ছুটে চলে গিয়েছে। সাধ্যমত মৌ এর পাশে দাঁড়িয়েছে। মৌ ভুল করলে তাকে ধমকে-ধমকে সঠিক পথে এনেছে। মৌ এর প্রতি সে সবসময় প্রতিরক্ষামূলক আচরণ করেছে। মৌ কে দেখে কোনো অনুভূতির আভাস পেলে সাথে সাথে সে তা পাশ কাটিয়ে গিয়েছে। এজন্য সময় যেতে যেতে মৌ এর হাসি, মৌ এর সৌন্দর্য তার উপর কোনো প্রভাব ফেলেনি। কারণ সে এসবকে উপেক্ষা করতে পারদর্শী হয়ে গিয়েছিলো। কেননা আজ সে পারদর্শিতাকে পিছে ফেলে দেওয়া হোক? আচ্ছা? তা কি আদৌ সম্ভব? নিজের ভেতর থেকে সেই অনুভূতিশীল আয়ানকে বের করা কি আদৌ সম্ভব? চেষ্টা করা উচিত কি?
এ নিয়ে আয়ান খানিক সময় ভাবলো। তারপর মনের তীব্র মিছিল প্রতিবাদে সে অসহায় হয়ে নিজের ফোন হতে মৌ এর ছবি বের করে নিজের সামনে ধরলো। গভীর মনযোগ সহকারে পর্যবেক্ষণ করে সে ছবিটা দেখলো। এরপর ছবিতে মিষ্টি হাসি হেসে দাঁড়িয়ে থাকা মৌ এর উদ্দেশ্যে সে জিজ্ঞেস করলো,
” মৌ? তুই আমাকে বিয়ে করতে রাজি হয়ে গিয়েছিস? আমার মনে হয় তুই রাজি হবি না। তুই যেমন ঢিট মেয়ে…..অবশ্য আংকেলকে তুই তো অনেক ভালোবাসিস। উনার কথা ভেবে হয়তো রাজি হয়ে যাবি। আচ্ছা? তাহলে আমাদের মধ্যকার সম্পর্ক কি জোরজবরদস্তিমূলক সম্পর্ক হবে? মানে, তুইও আংকেলের কথা ভেবে রাজি হয়ে যাচ্ছিস আর আমিও আব্বুর কথা মেনে রাজি হয়ে যাচ্ছি৷ অদ্ভুত! আমাদের নিজেদের মতামতের কোনো প্রাধান্য নেই! অবশ্য পরিবেশ পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে হয়তো আমাদের নিজেদের মতামতের প্রাধান্য থাকতো। কিন্তু পরিস্থিতি তো বেগতিক। এ বিয়েটা এখন মান সম্মানের ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রতিটা মানুষই মানসম্মানের সাথে বেঁচে থাকতে চায়। কেউই মাথা নিচু করে বাঁচতে চায় না। এখন এ বিয়েটা না করায় যদি সমাজে মাথা নিচু করে বাঁচতে জোর করে তাহলে তো বিয়েটা করেই নেওয়া উচিত। ঠিক না মৌ? অবশ্য আমি আমার অনুভূতিকেও প্রাধান্য দিচ্ছি। আমার অনুভূতি কি বলে জানিস? আমার অনুভূতি বলে…….উমম….একটু ভাবতে হবে। রাতে ঘুমানোর আগে বলবো তোকে। আমার অনুভূতিগুলো তো একটু উপলব্ধি করতে হবে তাইনা? সো পরে কথা বলি। ” এই বলে আয়ান মুচকি হেসে ফোনটা পকেটে পুরে মৌ এর ব্যালকনির দিকে তাকালো। মৌ এর রুমের আলো জ্বলছে। ব্যালকনির দরজাও খোলা। পর্দা দেওয়া আছে। আয়ান কিছুক্ষণ সেদিকে তাকিয়ে রইলো। তার মনটা মৌ কে এক ঝলক দেখার জন্য অপেক্ষা করছে। কিন্তু মৌ এর দেখা মিলছে না…….

বেশ কিছুক্ষণ যাবত অপেক্ষা করার পর আয়ান রুমে চলে যাওয়ার পূর্ব প্রস্তুতি নিচ্ছিলো মনে মনে। তখনই হঠাৎ ব্যালকনিতে মৌ এর আগমন ঘটলো। মৌ কে দেখে আয়ান বেশ স্বস্তি অনুভব করলো। সে হাত নাড়িয়ে মৌ কে নিজের উপস্থিতির প্রমাণ দিলো। কিন্তু মৌ তা দেখেও না দেখার ভান করে মেকি হাই তুললো। কিছুক্ষণ ভ্রুকুটি করে সে আয়ানকে পর্যবেক্ষণ করলো। আয়ানের এমন নিজের উপস্থিতি জানান দেওয়ার ঘটনা এই প্রথম। মৌ এ বিষয়টা খেয়াল করেছে। কিন্তু উপর উপর দিয়ে সে এটাকে পাত্তা দিচ্ছে না।

মৌ এখনও ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে আছে। আয়ান মৌ কে কিছু বলবে কি না এই ভাবতে ভাবতে সে মৌ এর দিকে তাকিয়ে বিস্তৃত এক হাসি দিলো। মৌ তা দেখে তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে রুমে যাওয়ার প্রস্তুতি নিলো। তবে রুমে যাওয়ার আগে আয়ানের দিকে রাগী দৃষ্টি নিক্ষেপ করে একটা ভেঙচি কাটলো সে। আয়ান এতে থতমত খেয়ে গেলো। মৌ এর কাছে এমনটা মোটেও আশা করেনি সে। মৌ কখনও তার সাথে উঁচু গলায় কথা বলেনি। চোখ গরম করেনি এবং ভেঙচিও কাটেনি। কিন্তু তার অপমান পাওয়ার পর থেকে এর সবটাই করছে সে। অদ্ভুত তো!

.

রাতের শোবার পর আয়ান আবারো মৌ এর ছবির সাথে কথা বলা শুরু করলো,
” আচ্ছা? তোকে আমার বউ হিসেবে কেমন দেখাবে? সুন্দর নাকি খারাপ? উমম…..অবশ্যই সুন্দর দেখাবে। কারণ সবার মুখে শুনেছি তুই দেখতে অনেক সুন্দর। ” এই বলে সে শব্দ করে হেসে ফেললো। আবারো বললো,
” আমি নিজেও উপলব্ধি করেছি তোর ছবিগুলো দেখে। এতো সুন্দর একটা পরী আমাকে ভালোবাসে! বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে। তুই হয়তো ভাবতে পারিস, আমি তোর সাথে এতো ভালো ব্যবহার কিভাবে করছি, এতো নরম দেখাচ্ছি কেনো? সো….তোর অবগতির জন্য জানিয়ে দিচ্ছি, আমি সবটা ভেবেচিন্তে আব্বুকে বিয়েতে রাজি হওয়ার কথা বলে এসেছি। আর নরম হওয়ার কথা বললে বলবো, আমি সবসময়ই নরম। তবে রাগ উঠলে আমি গরম হয়ে যাই। আর এ রাগটা ক্ষেত্র বিশেষে আসতে সময় নেয়, আবার ক্ষেত্র বিশেষে হুটহাট চলে আসে। সে যাই হোক, যেহেতু পরিস্থিতির শিকার হয়ে তোকে বিয়ে করতেই হচ্ছে সেহেতু তোর প্রতি নরম হতেই হবে। অবশ্য এ কয়দিন তোর পিছনে আমাকে যা ঘুরিয়েছিস! তাতে তো আমার নরম মনের পরিচয় পেয়েই গিয়েছিস৷ এখন……তোর আর আমার বিয়ে হবে। সো, তোর প্রতি আমার অনুভূতিগুলোকে বুঝতে হবে। প্রাধান্য দিতে হবে। উফ….. যেখানে তোকে শাসন করল নিজের নিচে রাখতাম সেখানে তোকে এখন আমার বরাবরে রাখতে হবে। হয়তো তোর কথায় উঠবস করতে হবে। কি এক সম্পর্ক হয়ে যাবে আমাদের! বন্ধুর বোন হতে সোজা বউ! যাই হোক, অনেক কিছু মানিয়ে চলতে হবে আমাকে। অনেক কিছু স্যাক্রিফাইস করতে হবে। তবে এটফার্স্ট, তোর কাছ থেকে ক্ষমাটা চেয়ে নিতে হবে। এখনও, আমি এটা ভুলিনি যে তুই আমাকে ক্ষমা করতে পারিসনি। তো, আজকে এ পর্যন্তই কথা বলা। তোর সামনাসামনি হয়ে অনেক কথাই বলবার আছে। দেখা যাক, সুযোগ পাই কি না।” এই বলে আয়ান হালকা হেসে ফোনটা রেখে দিলো। কিছুক্ষণের মাঝেই পাড়ি দিলো ঘুমের রাজ্যে।

.

সকল রীতিনীতি মেনে মৌ কে বাসর ঘরে বসিয়ে দিয়ে গেলো অহনা। অহনা প্রথম প্রথম এ বিয়েতে দ্বিমত পোষণ করলেও পরে সবটা হাসিমুখে মেনে নেয় এই বিশ্বাস করে যে, আজ নয়তো কাল আয়ান এবং মৌ এর মধ্যকার ঝগড়ার মিমাংসা হবেই হবে৷ সেদিনকার পরের দিন আয়ান, মৌ এর সাথে কথা বলার চেষ্টা করেছিলো। সে কথা তো বলতে পেরেছিলো তবে প্রয়োজনীয় কথাবার্তা সে বলতে পারেনি। এর পরের দিন যখন দু বাড়ির হলুদের আয়োজন একসাথে করা হলো, তখন আয়ান মৌ কে জিজ্ঞাস করেছিলো, “তাহলে ক্ষমা করেছিস আমাকে?” তখন মৌ মুখ ঝামটা মেরে জবাব দিয়েছিলো, “বিয়ে করছি এর মানে এই না যে আপনাকে ক্ষমা করে দিয়েছি।” এই বলে সে আর কথা না বাড়িয়ে চলে গিয়েছিলো। আয়ান পরবর্তীতে আর কিছু বলতে পারেনি।

আয়ান আর মৌ এর বিয়ে নিয়ে পরিচিত কয়েকজন সন্দেহ প্রকাশ করেছিলো। তবে তাদের সন্দেহকে নানারকম মিথ্যা কথা বলে দূর করে দেওয়া হয়। সবদিয়ে বিয়েটা তেমন কোনো ঝামেলা ছাড়াই হয়ে যায়।

অহনা, মৌ কে বাসর ঘরে বসিয়ে দিয়ে চলে আসার পর পরই আয়ান রুমে ঢুকে যায়। আয়ানের রুমে প্রবেশের আগে অহনা আয়ানকে হাসিমুখে বেস্ট অফ লাক জানিয়েছে। কারণ সে আয়ানকে ক্ষমা করে দিয়েছে। এখন মৌ এর পালা। এ নিয়ে অহনা একটু সন্দেহ প্রকাশ করলেও সে জানে, মৌ অতি শীঘ্রই আয়ানকে ক্ষমা করে দিবে। তবে সে মৌ এর মনের কথা তো জানে না। মৌ বিয়েতে রাজি হওয়ার পরপরই মনে এঁটে নিয়েছিলো, আয়ানকে আরো নাকে দড়ি দিয়ে ঘুরাবে সে। প্রতিটা কষ্টের হিসাব নিবে সে।

আয়ান রুমে এসেই দেখলো মৌ এক এক করে বিয়ের গহনা খুলছে। সে ক্লান্ত শরীর বিছানায় এলিয়ে দিয়ে মৌ কে বললো,
” অনেক ক্লান্ত হয়ে গিয়েছিস তাই না? তোর সাথে কিছু কথা বলার ছিলো। কিন্তু আজকে আর তা বলা হলো না৷ কালকে বলবো। আপাতত আমি ঘুম দেই।” এই বলে সে কাত হয়ে শুয়ে পরলো। মৌ গহনা খুলতে খুলতে আয়ানের দিকে ফিরে নরম সুরে বললো,
” আগে শেরওয়ানি খুলে নিতেন৷ নষ্ট হয়ে যাবে তো। আর আপনার ঘুমাতেও অসুবিধা হবে। ”

মৌ এর কথায় আয়ানের টনক নড়লো। সে তড়িঘড়ি করে বিছানা ছেড়ে উঠে বললো,
” হুম। তা ঠিক বলেছিস। ক্লান্তিতে চোখ বুজে আসছিলো তো, তাই অমনিই শুয়ে পরেছিলাম। ” এই বলে সে আলমারি হতে একটা টিশার্ট আর ট্রাউজার বের করে ওয়াশরুমে চলে গেলো। দশ মিনিট বাদে সে ওয়াশরুম থেকে বেড়িয়ে এলো। মৌ তখন মেকাপ উঠাতে ব্যস্ত। আয়ান এক নজর মৌ এর দিকে তাকিয়ে বিছানায় শুয়ে পরলো।

কিছুক্ষণ বাদে, মৌ আয়ানের কাছে এসে নরম সুরে বললো,
” বিছানা থেকে উঠুন৷ আপনার জন্য ফ্লোরে চাদর বিছিয়ে শোবার ব্যবস্থা করেছি। ”

আয়ান মাত্রই ঘুমের জগতে পাড়ি জমাতে চেয়েছিলো। তবে মৌ এর কথায় সে কাঁচা ঘুম ছেড়ে উঠে বসলো। আশেপাশে তাকিয়ে নিজেকে ধাতস্থ করে বললো,
” কি বলছিস তুই?”

মৌ জোরপূর্বক মেকি হাসি দিয়ে বললো,
” যা বলেছি ঠিক বলেছি। আপনার বিছানা ফ্লোরে হবে। ”

আয়ান এবার খানিকটা রেগে গেলো। এভাবে কারোর কাঁচা ঘুম ভাঙানো হলে সে অবশ্যই রেগে যাবে। আয়ানও এর ব্যতিক্রম নয়। খানিকটা রাগত স্বরে সে বললো,
” এসবের মানে কি?”

মৌ এবার যেনো নিজের আসল রূপে ফিরে এলো। চোখ গরম করে, গাল দুটো শক্ত করে সে বললো,
” এসবের মানে হলো, আপনি নিচে ঘুমাবেন।”

আয়ান বিস্মিত হয়ে বললো,
” আমি নিচে ঘুমাতে যাবো কোন দুঃখে! তোর মাথা ঠিক আছে?”

” অবশ্যই ঠিক আছে। আমি আপনার সাথে এক বিছানায় ঘুমাবো না বলেই আপনার বিছানা ফ্লোরে বিছিয়ে দিয়েছি।”

আয়ান এবার তড়াক করে উঠে বসলো। চোখ কপালে তুলে বললো,
” বিয়ে হয়েছে, তো এক বিছানায় ঘুমাতে কি প্রবলেম! ”

মৌ দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
” আমার অনেক প্রবলেম। আপনি বিছানা থেকে না নামলে খারাপ হবে বলে দিলাম। ”

আয়ান তেড়ে গিয়ে বললো,
” কি খারাপ হবে শুনি?”

মৌ ভ্রু নাচিয়ে বললো,
” আপনাকে এখনও ক্ষমা করেনি, মনে আছে আপনার? আমার ক্ষমা না পেলে বলে আপনি নিজের কাছে নিজেই ছোট হয়ে থাকবেন।”

আয়ান কথার মোড় ধরতে না পেরে বললো,
” হুম, মনে আছে। তুই হঠাৎ এ কথা আনছিস কেনো?”

” আপনি আমার কথা না শুনলে আপনাকে কখনই ক্ষমা করবো না আমি।”

মৌ এর কথা শুনে আয়ান যেনো আকাশ থেকে পরলো। সে তড়িঘড়ি করে বিছানা ছেড়ে উঠে মৌ এর সোজাসুজি দাঁড়িয়ে পরলো। কণ্ঠে আকাশ সমান বিস্ময় নিয়ে বললো,
” তুই আমাকে ব্ল্যাকমেইল করছিস!”

মৌ দু হাত বুকে গুঁজে ভাব নিয়ে বললো,
“যা ভাববার ভাবুন। আপনি আজ নিচে না ঘুমালে আমার কাছ থেকে ক্ষমা পাওয়ার আশা ছেড়ে দিন। আর সারাজীবন গিল্ট নিয়েই বাঁচুন।”

আয়ান এবার খানিকটা রেগে গেলো। বললো,
” সেদিনকার ঘটনা নিয়ে আর কতদিন পরে থাকবি তুই? দু সপ্তাহ হয়ে গেলো প্রায়। এখনও তুই ঐ ছোট্ট ঘটনাকে ভুলতে পারছিস না কেনো? এক প্রপোজের…….”

মৌ মেজাজ এবার দপ করে জ্বলে উঠলো। প্রচণ্ড রাগ নিয়ে সে বললো,
” আপনার জন্য ছোট্ট ঘটনা হতে পারে। কিন্তু আমার জন্য না৷ আপনাকে প্রপোজ করেছিলাম বলে আপনি ওভাবে সবার সামনে আমাকে অপমান করেছিলেন৷ এ ঘটনা আমার ক্লাসমেটদের কানে পৌঁছানোর পর তারা আমাকে নিয়ে কত কথা বানিয়েছে জানেন? আমাকে নিয়ে সবার সাথে হাসাহাসি করেছে। এসব কিভাবে সহ্য করেছি আমিই জানি৷ আর আপনি বলছেন, ছোট্ট একটা ঘটনা! এরপর থেকে নিজের উপর প্রচণ্ড রাগ হতো আমার। শুধু নিজেকে দোষারোপ করতাম আমি। কেনো সেদিন আপনাকে প্রপোজ করেছিলাম! কেনো আপনাকে আগে ভালোবেসে ছিলাম৷ আপনাকে ভালো না বাসলে আজ এ দিন দেখতে হতো না আমাকে।” এই বলে মৌ চোখের কোলে জমে থাকা নোনাজল মুছে ফেললো। কথা বলতে বলতে সে কান্না করছিলো। আয়ানের এ দেখে ভারী মায়া হলো। সে মৌ এর দিকে এগিয়ে নরম সুরে বললো,
” সরি মৌ। আমি আসলে ওভাবে বলতে চাইনি। ”

মৌ মুখ ঝামটা মেরে বললো,
” আপনার সরি শুনতে চাইনি আমি। চুপচাপ নিচে শুয়ে পরুন৷ আমি বেশ টায়ার্ড আজকে। এখন চেঞ্জ করে এসে ঘুমিয়ে পরবো। ”
এই বলে সে চেয়ারের উপর থেকে থ্রিপিছ নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেলো। এদিকে আয়ান অসহায় দৃষ্টিতে একবার ফ্লোরের দিকে তাকালো এবং আরেকবার খাটের দিকে তাকালো। নিজেকে বড্ড নিরুপায় লাগছে নিজের কাছে। প্রচণ্ড অনিচ্ছা সত্ত্বেও সে দাঁতে দাঁত চেপে ফ্লোরে শুয়ে পরলো আর মনে মনে নিজেকে গালি দিয়ে উদ্ধার করে ফেললো। (নোট: কেউ নিচের নোট দেখে না বলে বাধ্য হয়ে এখানে লিখতে হচ্ছে। আমি সেই ৪নং পার্টেই বলে দিয়েছিলাম, বর্ষার অংশ আমি ডিলিট করে দিয়েছি। বর্ষা নামের কেউ নেই গল্পে। এরপরও সবাই বলে, আয়ানের তো গার্লফ্রেন্ড আছে!🤦‍♀️🤦‍♀️ তাদের আর কি বলবো….🤦‍♀️)

®সারা মেহেক

#চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে