“মেঘলা আকাশ”পর্ব ৪.

0
1139

“মেঘলা আকাশ”পর্ব ৪.

মায়া হাতে থাকা প্লেটটা টেবিলে রাখতে গিয়ে তা পড়ে গেল। এক মুহূর্তের জন্য সবাই তার দিকে তাকায়। সে তাড়াতাড়ি কাচের টুকরোগুলো কুড়াতে শুরু করল। বিয়ের আর মাত্র তিনদিন বাকি। তাই মায়ার এমন খামখেয়ালি হওয়ার কারণটা কী তা কেউ বিশেষভাবে ভাবল না। তার একটাই চিন্তা, তার ভয়টা সত্যি হয়ে যাবে না তো?
সে রান্নাঘরে ভাঙা কাচের টুকরো নিয়ে যেতেই আতিকা ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল, “কী? কিছু বুঝতে পেরেছিস কে ছিল সেখানে?”
মায়াও তদ্রূপ ফিসফিস করে বলল, “নিশ্চয় ভাইয়া নয়। নইলে ভাইয়া আমাকে এতক্ষণে বকা দিয়ে আমার নামসুদ্ধ ভুলিয়ে দিত। হাবীব ভাই হবে না। তিনি নিজের বোনকে রক্ষা করতে চাইবে না? মনে হচ্ছে, নয়ন ভাই। সকাল থেকে বেশ কয়েকবার আমার দিকে বিরক্তির সাথে তাকিয়েছে। আর আমিও তাকে কথা বলার সুযোগ না দিয়ে পালিয়ে বেড়িয়েছি। লোকটা দেখি পুরোপুরি শুভ নয়।”
মায়ার কথার ধরনে আতিকা হেসে ফেলল। মায়াও হাসল। হাসার কারণে ভেতরের দিকটা হালকা হয়ে এসেছে। তাদের হাসির আওয়াজে রাইসা আর জেরিনও রান্নাঘরে এলো।
মায়া বলল, “মা তো ডেকোরেশন কিছুই করবে না বলছে। এখন কী করা যায়? আমার কিন্তু ভেতরটা ফেটে যাচ্ছে। ভাইয়ার হলুদের রাতটা বিশেষ না হলে কিন্তু সব মজাই ভেস্তে যাবে।”
“আরে মুখ কালো করিস না।” রাইসা বলল, “আন্টি তো এসবে থাকতে চাইবেন না। সবই আমাদের হাতে আছে। আমরা ছাদে করতে পারি অনুষ্ঠান।”
“ছাদে?”
“হু। নিচে বেডশিট বিছিয়ে করতে পারি। তাছাড়া আকাশ তো মাথার উপর ছাদ হিসেবে থাকছেই।”
“হায়রে, আকাশ পাগলী।” বাকি তিনজন একসঙ্গে বলে উঠল।
কিন্তু আইডিয়া মন্দ নয়। আপুদের রুমে গিয়ে সে কথাটা বলল। বীথি আপা বলল, “আমার কিছু চাওয়ার নেই। আত্মীয়রা এলে আমার ভালো লাগবেই। তোরা ওসব করলে আরও ভালো লাগবে। তোদের যাই ইচ্ছা হয় কর। কিন্তু মাকে জ্বালাস না।”

এখনই জয়েন করুন আমাদের গল্প পোকা ফেসবুক গ্রুপে।
আর নিজের লেখা গল্প- কবিতা -পোস্ট করে অথবা অন্যের লেখা পড়ে গঠনমূলক সমালোচনা করে প্রতি মাসে জিতে নিন নগদ টাকা এবং বই সামগ্রী উপহার।
শুধুমাত্র আপনার লেখা মানসম্মত গল্প/কবিতাগুলোই আমাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হবে। এবং সেই সাথে আপনাদের জন্য থাকছে আকর্ষণীয় পুরষ্কার।

গল্পপোকার এবারের আয়োজন
ধারাবাহিক গল্প প্রতিযোগিতা

◆লেখক ৬ জন পাবে ৫০০ টাকা করে মোট ৩০০০ টাকা
◆পাঠক ২ জন পাবে ৫০০ টাকা করে ১০০০ টাকা।

আমাদের গল্প পোকা ফেসবুক গ্রুপে জয়েন করার জন্য এই লিংকে ক্লিক করুন: https://www.facebook.com/groups/golpopoka/?ref=share

“আর সাথী আপাকেও।” বলেই মায়া সাথী আপা কিছু বুঝে উঠার আগে রুম থেকে দৌড়ে বেরিয়ে গেল। নইলে সে এমনভাবে মায়ার দিকে তাকাত না– মনে হবে চোখ থেকে এই আগুন বেরুবে।
মায়া বেরুতেই কার সাথে যেন ধাক্কা খেল।
“সরি।” একসাথে দু’জন বলে উঠল।
মায়া অবাক হয়ে হাবীব ভাইয়ের দিকে তাকালো। লোকটার মুখে সহজে সে কোনোকিছু শুনতে পায় না। সামান্য যেসব শব্দ শুনতে পাওয়া যায়, তা শুনে মনে হয়, শব্দগুলো যেন কোনো এক প্রতিযোগিতায় জেতা বিশেষ পুরষ্কার। এক মুহূর্ত দু’জন একে অপরের দিকে তাকিয়ে রইল। মায়া বুঝতে পারছে না, হাবীব ভাইয়ের মুখের অভিব্যক্তিটা কেমন। চোখে কোনো প্রশ্ন নেই, কোনো ভিন্ন অনুভূতি নেই। লোকটা যখন পাশ কাটিয়ে চলে গেল, তখন মায়ার চোখের পলক পড়ে। মায়া যেন নিজের উপরেই রাগ হচ্ছে। তুই কি দেখতে আরেকটু বিশেষ হতে পারতি না? নইলে লোকটা আরেকটু তাকাত। তবুও আমার সাথে উনি ধাক্কা খেয়েছেন। তাকানো উচিত ছিল। তার কি কোনো অনুভূতি জাগেনি? মায়া ভেবে অবাক হলো, ও নিজেই লোকটার কাছে আকর্ষণীয় হতে চেয়েছে। এ কি হলো তার? এমন অ্যাটেনশন সীকার তো সে ছিল না।
আচ্ছা এমন ব্যাখ্যাও তো দাঁড় করানো যায়। রাজীব ভাইয়া সরল প্রকৃতির। তার এই গুণের ফলে তার বন্ধুগুলোও হয় এই প্রকৃতির। যেমনটা পারভেজ ভাই, নয়ন ভাই। হাবীব ভাই কি এমন হতে পারে না? হয়তোবা ব্যক্তি হিসেবে তিনি আরেকটু ভিন্ন। তবে যাই হোক না কেন, লোকটার নীরবতাটাও আকর্ষণীয় একটা দিক।
সেই একই দিনে মায়া আরেকটা প্লেট ভাঙল। কিন্তু এবার অন্য এক ধরনের খামখেয়ালির বশে। যেই কাচ ভাঙার আওয়াজ হয়েছে, টেবিলের সবাই তার দিকে তাকিয়েছে। কিন্তু স্বয়ং তার চোখ শুরুতে পড়ল হাবীব ভাইয়ের উপর। মায়া খুব আস্তে আস্তে বসে ভাঙা টুকরোগুলো তুলে নেয়। ঠিক সেভাবেই উঠে দাঁড়ানোর পর আবারও হাবীব ভাইয়ের দিকে সে তাকালো। তারপর রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ায়। সে রান্নাঘরে ঢুকতে গিয়েও অজান্তে দরজার খাপে বাড়ি খায়। কারণ তার ভেতরে আচমকা চারিদিকটা মেঘাচ্ছন্ন হয়ে তুমুল হাওয়া বইতে শুরু করেছে। আর চোখের সামনে যেন একটাই দৃশ্য ভাসছে। আচ্ছা, সে ভাঙা কাচ নিয়ে উঠে দাঁড়ানোর পর হাবীব ভাইয়ের ঠোঁটের কোণ কি বেঁকে গিয়েছিল? তিনি কি মুচকি হাসছিলেন? না, না, এসবই মায়ার নিছক মনের ভুল।
রাত আরেকটু ঘন হতেই মায়ারা ছাদে উঠে এসেছে। চাঁদের ম্লান আলো রাতটাকে আরও বিশেষ করে তুলেছে। মায়ার ইচ্ছে হচ্ছে, সামনের জ্বালানো মোমবাতিটা নিভিয়ে দিতে। কিন্তু জেরিনের পড়ার ডিস্টার্ব হবে। তাছাড়া বান্ধবীরা তার হঠাৎ এহেন কাণ্ডের সম্বন্ধে ভাববে। মোমবাতি কেন নিভিয়ে দিতে চায়, সে তা জানে না। কেবল ইচ্ছে হচ্ছে এই রঙিন আলোকে নিভিয়ে ওই অন্ধকারাচ্ছন্ন আকাশের গহ্বরে ঢোকে যেতে। আজ ইচ্ছাটা এতো তীব্র কেন তার ব্যাখ্যাও নেই। আজকের দিনের সময়গুলোরও কোনো ব্যাখ্যাই নেই। আফরা আপা ছিল কিনা সেই খবরই হয়নি। বাসার কাজ করেছে ঠিক, কিন্তু কী কী করেছে তা মনে নেই। আজকের দুপুরে দেখা সিনেমার অনেককিছুই মনে নেই।
“তোরা দেখিস, আমি বিয়ে করব আমার পছন্দের লোককে। রাজীব ভাই যেমন একটা চাচাকে নিয়ে বউ পছন্দ করতে গেল, সে তো কখনই করব না। আমি..”
কারও সিঁড়ি দিয়ে আসার আওয়াজ হচ্ছে। জেরিনের মুখে একরাশ বিরক্তি ছেয়ে গেছে। রাইসা আকাশ থেকে চোখ ফেরাল। তবে আতিকা অনর্গল কথা বলে চলেছে।
“এভাবে হাঁসের মতো অবিরাম প্যাঁকপ্যাঁক করছে কে?”
রাজীব ভাইয়ার কথায় আতিকা চুপ হয়ে গেল। সে আবার জেরিনের মতো ভাইয়ার সাথে নির্বিঘ্নে কথা বলতে পারে না। কিন্তু মায়ার নিজের আওয়াজও যেন বেরুচ্ছে না। নয়ন ভাইও এসেছে। দু’জনই আসতে পারলে অন্যজন কেন আসেনি?
অশুভ! অশুভ! একরাশ বিরক্তি নিয়ে নয়ন ভাইয়ের কাছ থেকে চোখ ফেরাতে যাবে, এমন সময় নয়ন ভাই পাটিতে বসতে গেলে তার চেহারার দিকে মায়ার নজর পড়ে। আশ্চর্য, লোকটার মুখ হঠাৎ এতো কঠিন কেন মনে হচ্ছে? আর আজ তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়েনি, তাও আবার এখানে তার তিন বান্ধবীর সামনে আসার কারণটা কী? আজ রাত কি খাবার তেমন খায়নি? এমনটাই হবে। নইলে এতক্ষণে নাক ডেকে ঘুমোত।
নয়ন ভাই বসার পর পর তিন বান্ধবীই তার দিকে তাকালো। তারা হয়তোবা ভাবছে কীভাবে মজা করা শুরু করবে। কিন্তু মায়াকে অন্যমনস্ক দেখে তারা কিছুই বলল না।
রাজীব ভাইয়া ফিসফিস করে বলল, “আত্তু গাত্তু, কিসের কথা বলছিলি? বিয়ের কথা? বিয়ে করবি? তবে শোন, আমি একটা ছেলের সম্বন্ধে জানি।”
আতিকাও বলল, “ঠিক আছে। কিন্তু আমাকে জানানো লাগবে না। আপনার পছন্দকে আপনিই রাখুন।”
“শুনেই তো দেখ।” সবাইকে অবাক করিয়ে নয়ন ভাই বলল, “আজকাল মেয়েরা সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। যার ফলে তাদের জীবনে নানা কিছুর সম্মুখীন হতে হয়। সেকেলে যুগটা এদিক থেকে ঠিক ছিল। মেয়েদের পরিবারের পছন্দে বিয়ে হতো। অন্তত তালাক নিতে হতো না কোনো মেয়ের।”
ব্যস, জেরিনের সাথে বিতর্ক হওয়ার মতো একটা প্রসঙ্গ এসে গেল। সে বলল, “তখনকার মেয়েরা ছিল অবলা। নিজের স্বাধীনতায় আরেকজন হস্তক্ষেপ করত, অথচ কিছু বুঝতই না। মনে করত এটাই নিয়ম।”
“যদিওবা ওরা অবলা ছিল, এটাই তো ঠিক ছিল। শুধু নিজের পছন্দ নিয়ে তো মানুষ টেকে থাকতে পারে না। পরিবারের সবার পছন্দে বর পেলে বিয়েটা সবচে ভালো হয়।”
“কিন্তু যাদের বিয়ে হবে তারা?”
“শুনো, আজকাল অতিরিক্ত বাচবিচার করতে গিয়েই মানুষ আসল রত্ন হারায়। যখন এক বিষয়ে দশজনের মত পাওয়া যাবে তখন সেখানেই মঙ্গল নিহিত। আজকাল কিছু মেয়ে সাময়িক মোহ দেখে তার পিছু ছোটে, ব্যস লাইফটা উজাড় করে দেয়। তখনকার সময়ে ছিল মাথা নিচু করে থাকা ঘোমটাপরা লাল টুকটুকে বউ, যাকে দেখলে প্রতিটা পুরুষের মন গলে যেতে বাধ্য। এসব এখন কমে যাওয়ায়, একটা মেয়ের লজ্জাবোধ কমে যাওয়ায় সবকিছুই প্রেকটিক্যাল হয়ে গেছে। ছেলেরাও অভ্যস্ত হয়ে গেছে ম্যাচিউর মেয়েদের দেখে। সবাই ম্যাচিউর হয়ে যাওয়ায় জীবন থেকে লাবণ্যময়তা উঠে যাচ্ছে। আমি অন্তত এটাই মনে করছি।”
তবু জেরিন তার প্রসঙ্গটা তোলে ধরল। কিন্তু অন্যদিকে মায়া স্তব্ধ। এই ব্যক্তিকে সে চেনে না। এভাবে কখনো নয়ন ভাই তার দৃষ্টিভঙ্গি কারও সামনে তোলে ধরেনি। সবচেয়ে বড় কথা হলো, নয়ন ভাই তার চিরাচরিত ভঙ্গিতেও কথা বলেনি। আর কিছু ভাবার আগে সে একটা আওয়াজ শুনল।
“ঢালগুলো নে। আমি লাইটার বের করছি।”
এমা, হাবীব ভাই এসেছে। মায়ার হুঁশ হতেই সে দেখে, সামনের মোমবাতিটি শেষ হয়ে গেছে। হাবীব ভাই কয়েকটা গাছের ঢালকে দাঁড় করিয়ে তাবুর মতো করেছে। এবার এক পা গেঁড়ে আরেক পা ভাঁজ করে নিচু হয়ে বসে পকেট থেকে লাইটার বের করলো। লোকটা সম্ভবত সিগারেট খায়।
মায়া মুগ্ধ হয়ে চেয়ে রইল।
“মোমবাতি আরেকটা আনলেই তো হতো হাবীব। এতো ঝামেলার কি দরকার।”
“এই আগুনের আলোয় যে মজাটা আছে সেটা মোমের কম আলোয় পাবি না।”
নয়ন ভাই নির্লিপ্ত ভাবে বলল, “এই আগুন আর ওই আগুন একই ধরনের।”
“কিন্তু কেউ বেশি বিস্তার লাভ করে, আর কেউ কম।”
হাবীব ভাই মুচকি হাসল। সেই হাসি আগুনের এই পার থেকে বড়ই রহস্যময় মনে হলো। অথচ এরচেয়ে মিষ্টি ভাবে কতবারই না নয়ন ভাই হেসেছে, মায়ার তা মনে বিঁধেনি। এই লোকটাকে এখন তার পরই মনে হচ্ছে। নইলে সামান্য একটা প্র‍্যাংকের কারণে কেউ এতটা রেগে থাকে? তাও আরেকজনের বোনের ব্যাপারে? নাকি আফরা আপার সম্বন্ধে তার কোনো মনোভাবনা ছিল? যাইহোক, এসব নিয়ে এখন মায়ার কিছু আসে যায় না। সে কেবল হাবীব ভাইয়ের কথা বলাটা দেখে থাকতে চায়।
রাইসা গলার স্বর নিচু করে বলল, “মায়া, একটু আমাদের দিকেও তাকা। দেখ, আমরা কত সুন্দর।”
বাকিরা খিলখিল করে হেসে উঠল।
“তোরা হবি না। আমি তো আগুনের দিকে তাকাচ্ছিলাম।”
আতিকা বলল, “মাইয়্যা আমাদের কিছু কইতে না চাইলে আমরা আর কী করবার পারি?”
জেরিন চিন্তিত হয়ে বলল, “হাবীব ভাইয়ের এখানে আসার মানেটা কী বল তো। তিনি তো আমাদের সামনে আসেন না।”
“কে জানে ভাই।” মায়া নয়ন ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বলল, “কেউ দেখা দেওয়ার লোক, আর কেউ দেখা না দেওয়ার। ক্ষেত্রবিশেষে হয়তো ইন্টারেস্ট পালটায়। দেখা দেওয়ারটা দেখা দেয় না, আর দেখা না দেওয়ারটা দেখা দেয়। জটিল রোগ ছেলেমানুষেরও থাকে।”
মেয়েরা আবারও হাসল। এই ফাঁকে বিনা অনুমতিতে কেন যেন মায়ার চোখ হাবীব ভাইয়ের দিকেই গেল। কিন্তু তিনি আগে থেকেই যে মায়ার দিকে চেয়ে আছেন। এরপর কীভাবে যেন হাবীব ভাইয়ের আশেপাশের ব্যাকগ্রাউন্ডটা ধূসর হয়ে গেল।
(চলবে..)
লেখা: ফারিয়া কাউছার

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে