মুঠোবন্দী লাজুকলতা পর্ব-৩৫+৩৬

0
331

#মুঠোবন্দী_লাজুকলতা
#অপরাজিতা_মুন
#পর্ব_৩৫

নৈশভোজের জন্য রান্নাবান্নার কাজে শাশুড়ীকে সাহায্য করে নিজ রুমে প্রবেশ করতেই বিছানার উপর রাইফের ভাঁজকরা কাপড় চোপড় গুলো দেখে ক্ষানিক অবাকই হলো মীরা। অফিস হতে এই তো এলেন একটু আগে। এখনি আবার এসব বের করছেন কেনো? হাতে ধরে রাখা সাদা রংয়ের কফি মগটা নিয়ে ছোট ছোট কদমে আলমারি থেকে শার্ট-প্যান্ট বের করতে থাকা রাইফের পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। গলা খাঁকারি দিয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টাও করল সে। সক্ষম হলো, মীরার অস্তিত্ব বুঝতে পেরে পিছু ফিরে তাকালো রাইফ। মীরা কফি মগটা রাইফের দিকে এগিয়ে দিয়ে স্বাভাবিক স্বরে শুধালো,

-‘কোথাও যাবেন?’

মীরার হাতে ধরে রাখা কফিপূর্ণ মগটা রাইফ হাতে নিয়ে বিছানায় বসল। মীরার প্রশ্ন শুনেও আমলে নিলো না সে। কফির কাপে ছোট্ট চুমুক দিয়ে তৃপ্তিদায়ক অনুভূতি মুখে ফুটিয়ে বলল,

-‘দশে দশ।’

-‘কি?’

-‘কফি।’

-‘ভালো লেগেছে?’

-‘নাহ।’

পূর্ণ রেটিং পেয়ে খুশি হওয়া মীরার রাইফের মুখে ‘না’ বাচক উত্তর শুনে আগডুম বাগডুম করা মন টা ফুটা বেলুনের মতো চুপসে গেলো। কন্ঠ কিঞ্চিৎ উঁচু করে শুধালো,

-‘তাহলে দশে দশ হয় কি ভাবে?’

তৃপ্তি সহকারে কফির পরিপূর্ণ স্বাদ গ্রহণ করা রাইফের ঝটপট জবাব,

-‘তুমি লজ্জা পাও যে ভাবে।’

লজ্জাজনক কোনো কাজ না করেই শুধুমাত্র কথার জালে ফাঁসিয়ে মীরাকে ফের লজ্জায় ফেলল রাইফ। মুখোমুখি দাঁড়িয়ে কথা বলতে থাকা মীরা ঘুড়ে দাঁড়ালো রাইফের থেকে। ঠোঁটের কোণে ফুটে ওঠা মৃদু হাসি লুকাতে এগিয়ে গেলো আলমারির সামনে। শুধু শুধু এটা সেটা নাড়াচাড়া করে কন্ঠে কিঞ্চিৎ রাগ মিশিয়ে শুধালো,

-‘আপনি কি কোনো দিনও সোজা কথা বলবেন না?’

বিছানায় বসে থাকা রাইফ উঁচু করে রাখা বালিশে হেলান দিলো আরামের খোঁজে। কন্ঠে জোর দিয়ে বলল,

-‘অবশ্যই বলবো। এখনি শুনতে চাও নাকি পরে?’

মীরা মনে মনে আগ্রহ প্রকাশ করল। এই ক’দিনে তো খুব বেশি একটা সোজা কথা বলেননি, আজ যখন বলতে চাচ্ছে তখন শুনতে আর দেড়ি কিসের। ঝটপট জবাব দিলো সে,

-‘এখনি।’

মীরার স্পষ্ট জবাব শুনেও রাইফ আরেকবার নিশ্চিত হতে প্রশ্ন করলো,

-‘এখনি?’

-‘হ্যাঁ এখনি।’

রাইফ উপর নিচ ঘাড় নাড়িয়ে পাশের জায়গাটুকু ইশারা করে বলল,

-‘এদিকে আসো। দূর থেকে ভুলভাল শুনে ফের দোষ দিবা আমার।’

আলমারির কপাট বন্ধ করে ছোট্ট ছোট্ট পা ফেলে রাইফের সামনে এসে দাঁড়ালো মীরা। মীরার আগাগোড়া পরখ করে রাইফ কিছু বলল না, শান্ত চোখে তাকিয়েই রইলো শুধু। মীরা যেনো বুঝতে পারল রাইফের তীক্ষ্ণ নজরে ধমকে বলা উহ্য কথাটুকু। রাইফের বাম দিকে ফাঁকা জায়গাটুকু তে বসে নিরবে নিজের অবস্থান জানান দিলো। ডান হাতে মগ ধরে রাখা রাইফ পিঠ টানটান করে সোজা হয়ে বসল। কাছাকাছি এসে দুজনের মাঝের দূরত্বটুকু ঘুচিয়ে দিলো মুহুর্তের মাঝে। পেশিবহুল বাম হাতটা দিয়ে জড়িয়ে নিলো সহধর্মিণীকে। ঘাড় ঘুরিয়ে মীরার মায়াবী মুখশ্রীতে গভীরভাবে তাকালো। এই মেয়েটার মায়া ভরা মুখটাতে রাইফ যতোবার তাকায় ততবারই তার বক্ষ পিঞ্জর ছলাৎ করে ওঠে।
এই তো গুনে গুনে দশদিন আগে মীরাকে ঘরে তুলে এনেছে সে নতুন পরিচয়ে। চাইলে প্রথম দিন-ই স্বামীর অধিকারটুকু আদায় করে নিতে পারত রাইফ। কিন্তু সুখকর মুহূর্ত গুলোর এক তরফা অনুভূতি নিতে ইচ্ছুক নয় সে। এতো তাড়াহুড়ো নেই রাইফের মাঝে। জীবনের উনত্রিশ টা বসন্ত যেখানে মীরাহীন ছিলো সেখানে আর কয়েকটা দিন সময় দিলে মন্দ কি?
এই কয় দিনে না হয় ভাব জমুক দুজনের, প্রেম হোক, প্রেমালিঙ্গণ হোক। মীরার প্রতি যেমন রাইফের টান, তার প্রতিও মীরার টান তৈরি করা আবশ্যক লেগেছে রাইফের। অবশ্য যাথেষ্ট সফল ও হয়েছে সে। গতকাল অর্থাৎ দূর্ঘটনার সময় মীরার মুখশ্রী হতে কণ্ঠনালীতে নিজের জন্য যে আতংকিত রুপ দেখেছে সে, তাতেই প্রকাশ পায় মীরার অস্তিত্ব জুড়ে এখন শুধুই রাইফের বসবাস। রাইফের প্রতি ভালোবাসা কিংবা ভালোলাগা সমূহ ইন্ট্রোভার্ট স্বভাবের মেয়েটা সহজে প্রকাশ করতে পারে না শুধু। এই যে এক বাহুতে আবদ্ধ হয়ে আছে মেয়েটা, চাইলে রাইফ এক লহমায় পুরোপুরি নিজের করে নিতে সক্ষম। কিন্তু মীরার অনুভূতি গুলো এতে ফিকে হতে পারে কিছুটা। এক বিন্দুও ফিকে হতে দিতে ইচ্ছুক নয় সে। সঠিক ক্ষণ যে খুব নিকটে তা রাইফ জানে। এতো দিন যখন অপেক্ষা করতে পেরেছে সেখানে অসুস্থ মীরার সুস্থ হয়ে ওঠা পর্যন্ত আরেকটু অপেক্ষা করায় যায়। সে পর্যন্ত না হয় চুটিয়ে প্রেম ই করুক দুজন।
পেছন দিয়ে আগলে রাখা রাইফের হাত টা মীরার পিঠের ক্ষততে হালকা করে ছুঁয়ে দিলো। শান্ত স্বরে মোলায়েম কন্ঠে শুধালো,

-‘ব্যাথা আছে?’

মীরা উপর নিচ মাথা নাড়লো শুধু। রাইফের এই সামান্য স্পর্শও মীরার শিরা উপশিরায় শিহরণ জাগায়। কেঁপে তুলে ক্ষণে ক্ষণে। রাইফ হাতের কফি মগটা পাশের টেবিলে রাখলো। পুরুষালী ভরাট কন্ঠটা শীতল কন্ঠে শুধালো,

-‘মীরা, একা থাকতে পারবা না?’

হঠাৎ রাইফের এমন প্রশ্নে বিস্ময় প্রকাশ করলো মীরা। প্রশ্নের জবাব না দিয়েই উদ্দিগ্ন কন্ঠে জিজ্ঞাসা করলো,

-‘কেনো, একা কেনো থাকবো?’

-‘ইমার্জেন্সি অফিসিয়াল কাজ পরে গেছে মীরা। চার দিনের জন্য ঢাকা যেতে হবে। খুব ইম্পোর্টেন্ট। জরুরি না হলে এই অবস্থায় তোমাকে এভাবে রেখে যেতাম না।’

উত্তর শুনে মীরা রাইফের এতো ক্ষণ ধরে আলমারি থেকে কাপড় চোপড় বের করার ব্যাপারটা বুঝলো সাথে একা থাকতে বলা কথাটাও। শরীর যেমন মীরার খারাপ, তেমন রাইফেরও তো খারাপ। লোকটির মাথার পেছনে পাওয়া আঘাতটা যে অনেকাংশে ফুলে জখম হয়েছে, নীলচে বর্ণ ধারণ করেছে পুরোটাই। মীরা মিনমিন করে প্রশ্ন সূচকে বলল,

-‘শুধু আমার কথা চিন্তা করছেন, আপনার কথা ভাবছেন না কেনো? আপনার শরীরটা ও তো ভালো না। এই অবস্থায় আপনার যাওয়াটা উচিত হবে না।’

মীরার কথায় স্পষ্টরূপে রাইফের জন্য উৎকন্ঠা প্রকাশ পাচ্ছে। ক্ষণিকের মাঝেই ভালো লাগার আবেশ ছড়িয়ে গেলো রাইফের হৃদয় জুড়ে। ঠোঁটের কোণায় মুচকি হাসি ফুটিয়ে শুধালো,

-‘চিন্তা হচ্ছে?’

সাথে সাথেই মীরার নিঃসংকোচ দ্বিধাহীন জবাব,

-‘হুম।’

অর্ধাঙ্গিনীর এই ছোট্ট জবাবে রাইফের মুখের মুচকি হাসি বিস্তৃত হলো। জড়িয়ে ধরে রাখা হাতটা দিয়ে নিজের কাছে আরেকটু চেপে নিলো। দীঘল কালো কেশরাশি গুলো লম্বা বেণী করে রাখা মীরার মাথায় ছোট্ট করে চুমু এঁকে দিলো রাইফ। গাঢ় কন্ঠে বলল,

-‘ভালো লাগছে, সত্যি ভীষণ ভালো লাগছে। আমার জন্য চিন্তা করার মানুষ বেড়েছে, এক থেকে আজ দুই হয়েছে।’

___________________

দশটার বাস। নৈশভোজ সেরে গন্তব্যের উদ্দেশ্যে তৈরি হয়েছে রাইফ। কালো রংয়ের টিশার্ট এর সাথে জিন্স পরেছে লম্বাচওড়া পুরুষটি। শেষ সময়ে নিত্য দিনের ব্যাবহৃত পারফিউম টা দিয়ে নিলো।
পানি ভর্তি ছোট্ট মাম পটটা এনে রাইফের ব্যাগে দিয়ে দিলো মীরা। রাইফ এগিয়ে এলো তার দিকে। কেনো যেনো আজ মীরাকে রেখে যেতে ইচ্ছা করছে না রাইফের। কলিগরা সাথে না থাকলে নিশ্চিত সাথে করেই নিয়ে যেতো। পিছু ফিরে রাইফ কে দেখে বলল মীরা,

-‘চার্জার আর পাওয়ার ব্যাংক এই সাইডে, মেডিসিন এখানে। পানির মামপট এখানে আর…’

-‘আর তুমি কোথায়?’

রাইফের মুখে হুটহাট অন্য দিকে মোড় ঘুরিয়ে বলা কথাটা শুনে মীরা স্তব্ধ হয়ে গেলো, তবে ঘাবড়ালো না। এতোক্ষণ বসে থাকা মীরা উঠে দাঁড়ালো। এতো দিনের গুটিয়ে থাকা মীরা সাহসিকতার পরিচয় দিয়ে এক পা এগিয়ে গিয়ে সম্মুখে দাঁড়িয়ে থাকা রাইফের বুকের বা পাশে কোমল হাতটা রাখল। রাইফের তীক্ষ্ণ চোখে চোখ রাখতে চেয়েও পারল না। খুব নিকটে দাঁড়িয়ে থাকা সুপুরুষটির গলায় দৃষ্টি আবদ্ধ করে নিচু আওয়াজে বলল,

-‘এখানে। আমি আছি ঠিক এখানে, খুব যতনে। সাবধানে যাবেন। এখানে রাখা আমি টাকে যেভাবে পাঠাচ্ছি সেভাবেই ফেরত আনবেন।’

রাইফ অবাক হলো অনেক। ভেবেছিলো হয়তো এবারও তার থেকে পালাতে চাইবে মীরা। কিন্তু ভুল প্রমানিত করে কি দারুণ কয়েকটা বাক্য উচ্চারিত করল। রাইফ বুকে রাখা মীরার ক্ষত হাতটা আলতো করে নিজের হাতে নিলো সতর্কতার সহিত। ছোট করে অধরের পরশ দিতে ভুলল না। উহু, একবার দিয়ে কেনো যেনো মনটা ভরলো না রাইফের। পুনরায় অধর ছুঁয়ে চুম্বন এঁকে দিলো মীরার হাতের উল্টো পিঠে। নিচু করে রাখা মীরার মুখ আরো নিচু হয়েছে রাইফের ক্ষুদ্র সংস্পর্শে। অপর ব্যাক্তিটির উপর শুধু নিজের অবস্থান দৃঢ় করলে তো হবে না, নিজের উপর অপর ব্যাক্তিটির অবস্থান ও দৃঢ় করার সুযোগ দিতে হবে। রাইফ ও ঠিক তাই করলো। একত্রিত করা দুজনের হাত দুটোর মধ্যে উপরে রয়েছে মূলত মীরার হাত।সুকৌশলে ধরে রাখা মীরার হাত হালকা ঘুরিয়ে রাইফ নিজের হাতের উল্টো পিঠ উপরে আনলো। শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো মীরার প্রতিক্রিয়া দেখার জন্য। ফ্লোরে দৃষ্টি নিবদ্ধ করা মীরা তড়িৎগতিতে সচকিত দৃষ্টিতে তাকালো রাইফের পানে। সেকেন্ডের ব্যাবধানে নজর সরিয়েও নিলো সে। রাইফের এমন কাজের অর্থ বুঝতে সময় লাগলো না বুদ্ধিমতী মীরার। পরবর্তী সময়ের কথা চিন্তা করেই ঘামতে শুরু করলো, হৃদ স্পন্দন স্বাভাবিক থেকে ক্রমশ অস্বাভাবিক হতে শুরু করল। সময় গড়ালো মিনিট খানেক, রাইফ একই ভাবে নিজের হাতের উল্টো পিঠ উপরে রেখে নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে। রাইফের সাড়াশব্দ আশা করেছিলো মীরা, কিন্তু কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে ধীরে ধীরে মুখাবয়ব উপরে তুললো। সম্পূর্ণ দৃষ্টি দিলো অনড়ভাবে দাঁড়িয়ে থাকা রাইফের উজ্জ্বল শ্যাম বর্ণের মুখাবয়বে। এক নিমিষেই বুঝতে পারলো, আজ আর কোনো ভাবেই রক্ষা নেই লোকটির থেকে। রাইফ যতোটা স্বাভাবিক মীরা তার সম্পূর্ণ বিপরীত। এক আকাশ পরিমাণ লজ্জা আষ্টেপৃষ্টে ঘিরে ধরেছে তাকে। রাইফের ঘায়েল করা চাহনি ভেদ করে কিছুতেই আগাতে পারছে না পরবর্তী পদক্ষেপের জন্য। শুষ্ক ওষ্ঠজোড়া জিহ্বার ডগার সাহায্যে ভিজিয়ে বাম হাতটা উর্ধ্বে তুলল সে। ধীরে ধীরে কোমল হাতটা রাইফের চক্ষুদ্বয় এর উপর রাখল, নিজেকে আড়াল করলো রাইফের নিষ্পলক চাহনি হতে। রাইফের হাতে আবদ্ধ হওয়া ডান হাতটা টেনে আনলো নিজের কাছে, কাঁপা কাঁপা গোলাপি অধর ছুঁয়ে দিলো পুরুষালি হাতের উল্টো পিঠে। তাৎক্ষণিক এক প্রস্থ হাসি ফুটলো রাইফের ঠোঁটে। লজ্জায় পালিয়ে যাবে মীরা এমন সময় তাড়াহুড়ো করে বলে উঠলো সে,

-‘আরেক বার। মীরা, আরেক বার প্লিজ। শুধু একটা বার।’

বুকের ভেতর ডামাডোল বাজতে থাকা মীরা থমকে গেলো। রাইফের এমন আকুতিভরা কন্ঠে পিঠের শিরদাঁড়ায় শীতল স্রোত বয়ে গেলো। এবার আর ঠোঁট কাঁপছে না মীরার, রাইফের চোখের উপর ধরে রাখা হাত থেকে শুরু করে পুরো শরীর কাঁপছে। এমন অনুভূতি যেনো আজ মীরাকে অবশ করে তুলেছে। এর থেকে যত দ্রুত সম্ভব রেহাই পাওয়া উচিত। দেড়ি করলো না মীরা, রাইফের হাতে পুনরায় অধর ছোঁয়াতে মুখ এগিয়ে আনবে এমন সময় উচ্চস্বরে রাইফকে ডেকে ওঠা রাজিয়া বেগমের কন্ঠস্বর ভেসে আসলো। চমকে উঠলো মীরা, দ্রুততার সহিত হাত ছাড়িয়ে নিয়ে পিছু ফিরে বদ্ধ দরজার দিকে তাকালো। রাইফের হাস্যজ্বল মুখ হতে হাসি উড়ে গেলো মায়ের আচমকা ডাকে। হতাশ গলায় দাঁতে দাঁত চিবিয়ে বলল,

-‘ডাকার আর সময় পাইলা না আম্মা! এমনিতেই লেট লতিফ হয়ে পরে আছি। তোমার পুত্রবধুর কাছ থেকে একটু তো আদর-যত্ন নিতে দাও।’

এতোক্ষণের লজ্জা মিশ্রিত অনুভূতি পূর্ণ মীরা শব্দ করে হেসে দিলো রাইফের মৃদু আওয়াজে বলা কথা শুনে। ধীরে ধীরে সেই হাসি বিস্তর হলো। নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করার পরেও নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছে না বাঁধভাঙা হাসিটুকু। রাইফ শান্ত এবং স্থির। বিছানায় রাখা ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে চলে যাওয়ার আগ মূহুর্তে মীরার হাস্যজ্বল মুখে টুপ করে অধর ছোঁয়ালো আচমকা। মিষ্টি চুম্বনে সিক্ত করলো মীরার গোলাপি আভাযুক্ত ফর্সা গাল।

চলবে……

#মুঠোবন্দী_লাজুকলতা
#অপরাজিতা_মুন
#পর্ব_৩৬

পর পর কেটে গেছে তিন দিন। দুই দিন হলো স্বামী এবং শাশুড়ীর অনুমতিতে আপন নীড়ে ফিরে এসেছে মীরা। অনেক দিন পর মেয়েকে কাছে পেয়ে শওকত রহমান যেনো একটুকরো চাঁদ হাতে পেয়েছেন। চোখের আড়াল হতে দিচ্ছেন না কিছুতেই। একটু এদিক সেদিক গেলেই রাশভারি বয়োজ্যেষ্ঠ লোকটা ‘আম্মাজান, আম্মাজান। কই গেলো আমার আম্মাজান?’ বলে ডেকে ওঠেন। এই তো কিছুক্ষণ আগে শাশুড়ীকে এক পলক দেখতে পাঁচতলায় গিয়েছিলো মীরা, তার অনুপস্থিতিতে পুরো বাসা সুদ্ধ খুঁজে বেরিয়েছেন তিনি। স্বামীর এমন কার্যকলাপে বিরক্ত হয়ে খাদিজা বেগম যখন বললেন, মীরা উপরে গেছে তখনি ক্ষান্ত হয়েছেন।

মসজিদ হতে মাগরিবের সালাত আদায় করে বাসায় ফিরেই শওকত রহমান উঁকি দিলেন মেয়ের রুমে। দরজা খোলা তাই আর নক করার প্রয়োজন বোধ মনে করলেন না। বিছানার মাঝ বরাবর বসে আছে মীরা। তার চারিপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে অনেক গুলো শাড়ি। সুতী, জামদানী, টাংগাইল শাড়ী বেশি। বেশির ভাগ শাড়ির রং সাদা, সবুজ কিংবা ঘি’য়ে।
মেয়েকে এক পলক দেখে শওকত রহমান গলা খাঁকারি দিয়ে রুমে প্রবেশ করলেন। পিতার পরিচিত কন্ঠস্বর কর্ণকুহরে প্রবেশ করতেই নুইয়ে রাখা মাথাটা তুলে মীরা সামনে তাকালো, চোখে চোখ পরতেই মিষ্টি একটা হাসি ছুড়ে দিলো প্রাণপ্রিয় আব্বাজানের জন্য। সালাম বিনিময় করে বাবাকে বসার ব্যাবস্থা করে দিতে বিছানা হতে কিছু শাড়ি সরিয়ে একপাশে রাখলো মীরা। রাশভারী প্রবীণ জ্ঞানসম্পন্ন মানুষটি মেয়ের কাছাকাছি এসে বসলেন। গাম্ভীর্য পূর্ণ চেহারায় সুন্দর একটা হাসি ফুটিয়ে বললেন,

-‘কি করছে আমার আম্মাজান?’

-‘দাদীজানের শাড়িগুলো গোচাচ্ছি আব্বাজান। অনেক দিন তোলা ছিলো, আজ রোদে দিয়েছিলাম। ভাঁজ করা শেষ হলেই আলমারিতে রাখবো।’

-‘রেখে আর কি হবে? আম্মাজানের অনুপস্থিতিতে এগুলো সব তো আপনারই। সাথে নিয়ে যাবেন, মাঝে মাঝে পরবেন।’

মীরার মুখে মিঠে হাসিটা ফুটে উঠল আবারও। শুধু শাড়ি কেনো, বেঁচে থাকা কালীন পুরো মানুষটাই যে তার ছিলো। হাসির আড়ালে চাপা দীর্ঘশ্বাস টা বুকের মাঝেই চাপা রেখে হালকা বেগুনি রংয়ের একটা শাড়ি নাকের কাছে নিয়ে আঁখি পল্লব বন্ধ করে লম্বা একটা শ্বাস গ্রহণ করল মীরা। রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবেশ করলো নূর জাহান বেগমের শরীরের মমতাময়ী ঘ্রাণ। শাড়িটা শওকত রহমানের হাতে দিয়ে হাসি-হাসি মুখে বলল মীরা,

-‘দাদীজান আমাদের সাথেই আছে তাই না আব্বাজান। এই যে দেখেন, কতো গভীর ঘ্রাণ। এখনও ঠিক আগের মতোই।’

শওকত রহমানের আদলখানি মলিন হলো কিছুটা। নিজের মেয়ের মাঝে মায়ের প্রতিচ্ছবি দেখতে পেলেও মায়ের শূন্য স্থান যে কখনোই পূরণ হবার নয়। সময়ের তালে তালে বয়স বাড়লেও মাতৃস্নেহের জন্য তার মন কাঁদে মাঝে মাঝেই। ভেতরের হাহাকার টা আড়াল করলেন মীরার থেকে। শাড়িটা আলতো হাতে ছুঁয়ে বুকে চেপে ধরলেন। মায়ের স্নেহময় কোলটাকে অনুভব করলেন সংগোপনে। অনেক গুলো ভাঁজ করা শাড়ি থেকে গাঢ়
সবুজ-কালো রংয়ের সংমিশ্রণে সুতোর বুননে কারুকার্যখচিত জামদানী শাড়িটা হাতে নিলেন। মীরার ন্যায় তিনিও নাকের কাছে নিয়ে ঘ্রাণ নিলেন। আগের থেকে কমে গেলেও, মায়ের সেই পরিচিত ঘ্রাণ ঠিকি বুঝতে সক্ষম হলেন তিনি।

-‘আম্মাজান?’

শাড়ি ভাঁজ করতে থাকা মীরার ব্যাস্ত হাত থেমে গেলো বাবার ডাকে। শাড়িতে নিবদ্ধ থাকা নজর ও ঘুড়ে গেলো আব্বাজানের দিকে। চোখে চোখ পরতেই শওকত রহমান এক গাল হেসে বললেন,

-‘নেন, এই শাড়িটা আলাদা করে রাখেন। সময় করে একদিন পরবেন। ভালো লাগবে।’

মীরা হাসি মুখে বাবার হাত থেকে শাড়িটা নিলো। শওকত রহমান আরো বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলাপ-আলোচনা করে তবেই প্রস্থান করলেন রুম হতে।

_____________

মধ্যরাত্রি। পিনপিতন নিরবতা চারিদিক। গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন মীরার ঘুম ভাঙ্গল আকস্মিক কলিং বেলের উচ্চশব্দে। একবার, হ্যাঁ একবার ই বেজেছে। কে আসলো এতো রাতে? গভীর ঘুম ভাঙ্গার ফলে বিরক্তির সহিত চিন্তার সুক্ষ্ণ ভাঁজও ফুটে ওঠেছে কপালে। কান খাড়া করে আরেক বার কলিং বেলের শব্দের জন্য অপেক্ষা করতে থাকলো মীরা। না, আর বাজছে না। বুক অব্দি জড়িয়ে রাখা কাঁথাটা মাথা অব্দি টেনে চোখ মুখ ঢেকে নিলো। নয়ন জোড়া বন্ধ করে যখনি ঘুমের জন্য প্রস্তুতি নিয়েছে তখনি পুনরায় উচ্চ আওয়াজে কলিং বেল বেজে উঠলো পর পর দুই বার। ধরফর করে উঠে বসল মীরা। পাশ হতে মুঠোফোনটা হাতে নিয়ে দেখলো রাত একটা বাজতে মাত্র মাঁচ মিনিট বাকি। আম্মা কিংবা আব্বাজান কে ডেকে তুলে দেখা উচিত কে এসেছে। চোখ কচলে ঠান্ডা ফ্লোরে পা রাখলো গমনের উদ্দেশ্যে।

তিন তলার সদর দরজার সামনে অস্থির ভাবে পায়চারী করছে রাইফ। শুধু বাহির টাই তার অস্থির না, সেই সাথে ভেতরটাও তুফানের ন্যায় অস্থির। অফিসিয়াল কাজে চারদিনের জন্য ঢাকা গেলেও আগে ভাগে কাজ শেষ হওয়াতে তিন দিনের মাথাতেই বাসায় ব্যাক করেছে সে। অনেক রাতে ফিরেছে বলে আর ফোন করে জানায়নি মীরাকে। জার্নি করে এসেছে, একেবারে সকালেই না হয় দেখা করবে। কিন্তু বিপত্তি ঘটেছিলো ঘুমাতে গিয়ে। এপাশ ওপাশ করেও রাইফ ঘুমাতে পারছিলো না কিছুতেই। মীরাকে স্মরণ হচ্ছিলো বার বার। ঘড়িতে ঘন্টার কাটা তখন বারোটার ঘরে আর মিনিটের কাটা পয়তাল্লিশে। রাত্রি বারোটা বেজে পপয়তাল্লিশ মিনিট। এখন মীরাকে আনতে যাওয়ার উপযুক্ত সময় না। সাত-পাঁচ ভেবে বেপরোয়া মনটাকে যা খুশি তাই বোঝ দিয়ে নাকে মুখে বালিশ চাপা দিয়ে ঘুমানোর চেষ্টা রত রাইফ পুনরায় ব্যার্থ হলো। নাহ, থাকা যাচ্ছে না নিদ্রাহীন ভাবে শুয়ে থাকতে। পিঠ টা টনটনে ব্যাথা করছে তার। সোজা উঠে বসলো সে। এভাবে নিজেকে শাস্তি দেওয়ার কোনো মানেই দেখছে না রাইফ। নিজের বউ, নিজের শশুড় বাড়ি। রাত আর বিরাত আছে নাকি? যখন মন চাই তখনি যেতে পারবে। সেই মূহুর্তে কি হলো কে জানে! আগা মাথা আর কিছুই তখন ভাবে নি রাইফ। ফটাফট উঠে লম্বা-লম্বি চেক চেক সাদা কালো টিশার্ট গায়ে জড়িয়েই ছুটে এসেছে শশুড় বাড়ির তিন তলার সদর দরজায়। এখানে আসার পর পর ই মনে হয়েছিলো বিশাল একটা ভুল কাজ করে ফেলেছে সে। ফোনটা সাথে আনা উচিত ছিলো। ফোনটা সাথে থাকলে এভাবে আর ঘর সুদ্ধ মানুষকে কলিং বেল চেপে জাগাতে হতো না। একটা কল করেই মীরাকে ফুরুৎ করে বেরিয়ে আনা যেতো। থাক ওসব, এসে যখন পড়েছে তখন আর ফিরে যাবে না সে। বউ কে সাথে নিয়েই যাবে। একবার কলিং বেল চেপে দাঁড়িয়ে থাকা রাইফ অধৈর্য হয়েছিলো কারো সাড়াশব্দ না পেয়ে। কতো ঘুম ঘুমায় রে বাবা! তিনজন মানুষের একজনও সজাগ পাচ্ছে না। ধৈর্য আর বাঁধ মানেনি তার। পর পর দু বার কলিং বেলের সুইচ চেপেই ক্ষান্ত হলো সে। সেকেন্ড দশেকের মাঝে অবশেষে রাইফের ধৈর্যের কঠিন পরীক্ষা নিয়ে দরজা খুললেন খাদিজা বেগম। ঘুম কাতুরে মধ্য বয়সী মহিলার চোখে মুখে বিস্ময়ের ছাপ। রাইফ কে দেখে মুখে জোর পূর্বক হাসি টেনে দরজা থেকে সরে গিয়ে বললেন,

-‘এতো রাতে রাইফ? আসো ভেতরে আসো। কোনো অসুবিধা হয়নি তো?’

অসুবিধা তো হয়েছে। অবশ্যই হয়েছে। কেনো হবে না? নতুন বউ ছাড়া এই রাইফের অসুবিধা তো হবেই। এটাই স্বাভাবিক। উল্টো অসুবিধা না হওয়াটাই অস্বাভাবিক। রাইফ অগ্রসর হলো, প্রবেশ করলো বাসার ভেতর। মীরার রুমের দিকে তাকিয়ে বলল,

-‘হ্যাঁ আম্মা। অসুবিধা একটু হয়েছে। মীরা কই?’

প্রশ্নটা করে বুঝতে পারলো প্রশ্নটা করা উচিত হয়নি। মীরা এতো রাতে কোথায় আর থাকবে? স্বামীকে আ’ঙ্গার করে, দু চোখের ঘুম কেড়ে নিয়ে নিজে আরামে ঘুমাচ্ছে নিশ্চয়ই। ছটফট করতে থাকা রাইফের মতিগতি বোঝার চেষ্টা করছেন খাদিজা বেগম। এতো দিন হলো জামাতা হয়েছে, ছেলেটার এমন আচরণ যে আজকেই প্রথম। কেমন যেনো অদ্ভুত আচরণ।

-‘দাঁড়িয়ে কেনো? বসো। কখন আসছো ঢাকা থেকে?’

-‘এইতো একটু আগে।’

কথাটা বলেই উচ্চস্বরে ‘মীরা’ নাম ধরে ডেকে উঠলো রাইফ। তার ধৈর্য আর কুলালো না সত্যি। এতোক্ষণে তো চলে আসার কথা। মীরা ঘুম কাতুরে ঠিক আছে। তাই বলে এতোটা? রাইফের ডাক কি তার কানে যাচ্ছে না? আজব ব্যাপার স্যাপার! খাদিজা বেগম রাইফের এমন আচরণের কূল কিনারা পাচ্ছেন না কিছুতেই। অস্বস্তি মূলক ভঙ্গিতে শুধালেন,

-‘রাইফ বাবা, এতো রাতে কোনো কিছুর কি দরকার?’

-‘হ্যাঁ দরকার তো আম্মা। মীরাকে দরকার। একটু ডেকে দেন না প্লিজ। এতো লেট করছে কেনো আসতে!’

পরপর কয়েক বার কলিং বেলের শব্দ এবং শেষে নিজের নাম রাইফের কন্ঠে শুনতেই মাত্র ফ্লোরে পা রাখা মীরা কোনো রকমে লাইট জ্বা/লিয়ে ধরফর করে দৌড়ে নিজ রুম হতে বাহিরে এসেছে। কিন্তু রাইফের মুখে ‘মীরাকে দরকার’ কথাটা শুনে চলমান পদক্রম শ্লথ হলো। এভাবে কেউ শাশুড়ীকে বলে নাকি যে তার মেয়েকে দরকার! দিন দিন লোকটা কেমন লাগামহীন হয়ে যাচ্ছে। মায়ের সামনে রাইফের মুখে এমন কথায় লজ্জা পেলো খানিক। স্বামীর ডাকে যতটা উৎসাহের সহিত ছুটে এসেছিলো, ততটাই নিভে গেলো রাইফের শেষ কথাটুকু শুনে। পায়ের আওয়াজে মীরার দিকে তাকালো রাইফ। পরিচিত সেই হাসিটা দিয়েই তাকিয়েছে সে। কিন্তু মীরার এমন রূপ তার জান ক/বজ করে নিলো যেনো। মোচড় দিলো ছোট্ট বক্ষপিঞ্জর। চক্ষুদ্বয় কোটর ছেড়ে বাহিরে আসবে যে কোনো সময়। অবাকের চরম পর্যায়ে পৌঁছে ঠোঁট জোড়াও ফাঁক হয়েছে কিঞ্চিৎ। সবুজ রঙের শাড়িতে মীরাকে সবুজ শ্যামল প্রকৃতির থেকেও যেনো সুন্দর লাগছে রাইফের কাছে। ঘুম থেকে ওঠা মীরার ফোলা ফোলা তৈলাক্ত চোখ মুখ সদ্য বৃষ্টিতে ভেজে দূর্বাঘাসের মতোই স্নিগ্ধ লাগছে। রাইফের নে/শা/লো দৃষ্টি মীরাকে আড়ষ্ট করলো বেশ। লোকটি কি ভুলে গেলো নাকি এখানে তার শাশুড়ীও আছে। মীরা নিজেই এগিয়ে এলো, অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে পরে নজর এদিক সেদিক ঘুরিয়ে শুধালো,

-‘কখন এসেছেন?’

মীরার রূপের মোহে আচ্ছন্ন হওয়া রাইফ যন্ত্রের ন্যায় জবাব দিলো,

-‘অনেক ক্ষণ’

মীরা রাইফের এমন জবাবে এবার সত্যি বিপাকে পরলো। ধ্যান ভাঙ্গাতে এসে নিজেই রাইফের এমন নে/শা/ময় চাহনিতে কাবু হচ্ছে। খাদিজা বেগম মীরার দিকে তাকিয়ে রাইফকে ঘরে নিয়ে যেতে আদেশ করলেন। ব্যাস, ধ্যান ভাঙ্গলো রাইফের। ঝটপট উঠে দাঁড়ালো সে। মীরার হাতটা খপ করে ধরে খাদিজা বেগমের দিকে তাকিয়ে এক গাল হেসে বলল,

-‘মীরাকে নিতে আসছিলাম। নিয়ে যাচ্ছি। চিন্তা করবেন না। এখন সব ঠিকঠাক আম্মা। ঘুমান।’

কথাটা বলে মীরার দিকে তাকালো রাইফ। কন্ঠস্বর কিছুটা চেপে মৃদ্যু আওয়াজে বলল,

-‘কি দেখছো? আসো। কি করবো বলো? তোমাকে ছাড়া ঘুম আসছিলো না তো। দিন দিন কেমন বাজে অভ্যাসে পরিনত হচ্ছো। ভালো ভালো। এভাবেই থেকো, পরিবর্তন করার প্রয়োজন নেই একটুও।’

চলবে……

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে