মিথু পর্ব-০৭ এবং শেষ পর্ব

0
1149

#মিথু
#সাহেদা_আক্তার
#পর্ব_৭ (শেষ পর্ব)

রবি চাচা আসলেই ভালো মানুষ। ছেলে মেয়ে নেই। স্ত্রী গত হয়েছে কয়েক বছর। একলাই থাকেন উত্তর কোরিয়ায়। কাজ করেন। কেয়ার টেকার আছে একজন দেখাশোনা করার। তাই ইহানকে নিজের কাছে নিতে তার কোনো আপত্তি নেই। ইশিতাকেও নিতে চেয়েছিলেন কিন্তু সে রাজি হয়নি। বলেছে ও তো ভালো আছে যেভাবে আছে কিন্তু ইহানের ভবিষ্যত নিয়ে সে চিন্তিত। বড়ো কেউ নেই যে ওকে গাইডলাইন দেবে। পরামর্শ দেবে। ওর অনেক শখ ডাক্তার হবে। তাই ও চায় ইহান রবি চাচার সাথে বিদেশে চলে যায়।

রাতে খেতে বসে রবি চাচা বললেন, আমার ভাগ্নেটা কতবার যে ফোন দিল সকাল থেকে। কেন যাইনি আগে ওর বাসায়। ইশিতা হেসে বলল, তা তো করবেই। তার প্রিয় চাচাকে কিডন্যাপ করে নিয়ে এসেছি। এক রাতই তো। কাল দিয়ে আসবো৷ চাচা হাসলেন। মিথিলা মনোযোগ দিয়ে চাচার কথা শুনছে। ওকে এত মনোযোগী হতে দেখে ইহান শাকভাজি ওর প্লেটে তুলে দিয়ে বলল, ঠিকমতো খাও। এমনিতেও তো শুকনো লাঠি। ওর কথা শুনে মিথিলার চোখ সাথে সাথে ছলছল করে উঠল। ইশিতা ধমকের সুরে বলল, দিচ্ছিস তো মেয়েটাকে কাঁদিয়ে।

– আমি কিছু বললেই কেঁদে দেয় আর না হলে সবার সাথে ভালো।

বেশ রাগ করে শেষটুকু খেয়ে ইহান উঠে গেল। ফ্রেশ হয়ে বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ল। ডাইনিং থেকে ওদের হাসির আওয়াজে হঠাৎ চোখ দিয়ে পানি পড়ল ইহানের। মনটা ভীষণ খারাপ। সবাই তাকে দূরে ঠেলে দিচ্ছে। সবাই তাকে ছাড়াই পূর্ণ।

সকাল সকাল ইশিতার ডাকে ঘুম ভাঙল। বলল, তাড়াতাড়ি উঠ তো। খেয়ে নে। চাচাকে দিয়ে আসবি। উনার ভাগ্নে আসবে নিতে। উঠ। ইহান অনিচ্ছার সত্ত্বেও উঠে গেল। চটপট খেতে বসল। রবি চাচা তৈরী হয়ে সোফায় বসে পত্রিকা পড়ছেন। ইহানের খাওয়া শেষ হতেই উঠে গেলেন। ইশিতা আর মিথু দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিল।

– আবার আসবেন চাচা। এক মাস তো আছেন দেশে।

মিথিলা ওর সাথে সায় জানালো। রবি চাচা হেসে বললেন, তা আছি। ইন শা আল্লাহ, আসবো। ইহান পোশাক পরিবর্তন করে বেরিয়ে এল। চাচার লাগেজটা নিয়ে নিচে চলে এল। চাচাও বেরিয়ে এলেন। দুইজনেই অপেক্ষা করছে। হঠাৎ রবি চাচা বললেন, তোমার বোন তোমাকে নিয়ে খুব চিন্তা করে জানো তো? কাল থেকে কয়বার বলল তোমাকে যাতে জোর করে হলেও নিয়ে যাই। তোমার স্বপ্ন যাতে পূরণ করতে সাহায্য করি। ইহান চুপ করে রইল। তিনি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, তবারক মারা যাওয়ার খবর পাই দুই বছর আগে। ততদিনে তোমরা তোমাদের কষ্টের জীবন কাটিয়ে উঠেছো। বহু খোঁজ খবর করে ইশু মায়ের সাথে যোগাযোগ করতে পারি। তখনই সে আমাকে বলেছিল তোমার কলেজ শেষ হলে যেন নিয়ে যাই আমার সাথে। তোমার পাসপোর্টও তৈরী করে রেখে দিয়েছে। এর মধ্যে ভিসাও তৈরী, জানো? ইহান একটু অবাক হলো। মাঝে মধ্যে কিসব কাগজে ওর স্বাক্ষর নিয়েছিল ইশিতা। সে এত পাত্তা দেয়নি। এখন বুঝতে পারল। এর মধ্যে রবি চাচার ভাগ্নে চলে এল সিএনজি নিয়ে। তিনি উঠতে উঠতে বললেন, যে বোন তোমার জন্য এত কিছু করেছে তাকে হতাশ কোরো না। সিএনজি চলে গেল তার গন্তব্যের উদ্দ্যেশে। ইহান সে দিকে তাকিয়ে রইল।

একমাস কিভাবে দেখতে দেখতে চলে গেল। ইহানেরও রেজাল্ট দিয়ে দিল। গোল্ডেন এ প্লাস পেয়েছে। রবি চাচাও জানালো তার যাওয়ার সময় হয়েছে। ইহানও যেন তৈরী হয়ে নেয়। কালই ফ্লাইট। ইশিতার ব্যস্ততার মধ্যে কাটল সারাদিন। বিকালে হঠাৎ ফারাবী তার বাবা মাকে নিয়ে হাজির। ফারাবী ইহানের বিদেশে যাওয়ার কথা শুনে বলল, আমরাও তো পরশু চলে যাচ্ছি লন্ডন।

– তুই যে লন্ডন যাবি বলিসনি তো।

– হুম। স্বপরিবারেই যাচ্ছি। আব্বু সব স্যাটেল করে ফেলেছে। তাই তো মিথুকে নিতে এলাম।

– মিথুকে নিতে এলি মানে?

– ও তো আমার ছোট বোন।

– কি বলছিস? আমার মাথায় কিছু ঢুকছে না। মিথু তোর বোন মানে?

ইশিতা তাদের নাস্তা দিতে দিতে বলল, এক মাস আগে ওনারা মিথুকে দত্তক নিয়েছে। ইহান মিথুর দিকে তাকালো৷ ও কাচুমাচু হয়ে দাঁড়িয়ে আছে একপাশে। ইহান হেসে বলল, আমার সাথে ঠাট্টা করছো সবাই? ফারাবী বলল, কেউ তোর সাথে ঠাট্টা করছে না। যেদিন মিথু কাঁদতে কাঁদতে পথের মধ্যে ঘুরছিল ওর কান্না দেখে মায়া লেগেছিল আর তোর উপর অনেক রাগ উঠেছিল। ভাবছিলাম ওর মতো একটা বোন থাকতো আমার। আম্মু আব্বুকে বলতেই তারা রাজি হয়ে গেলেন। ইশিতা আপুও ওর ভবিষ্যতের কথা ভেবে…। ফারাবীর কথার মাঝেই ইহান সোফা থেকে উঠে দাঁড়ায়। তারপর রুমের দিকে যেতে যেতে বলে, আমি রুমে যাচ্ছি। ও চলে গেলে দরজা মেরে দিও ইশুবু।

সন্ধ্যায় ওরা মিথিলাকে নিয়ে চলে গেল। যাওয়ার আগে অনেকবার দরজায় ধাক্কা দিয়েছিল মিথিলা কিন্তু ইহান দরজা খোলেনি। ঠাঁই দাঁড়িয়ে ছিল দরজার কাছে। সেখানে দাঁড়িয়ে মিথিলার কান্না শুনেছে। বিদায় শুনেছে। দরজা বন্ধ হওয়ার শব্দ শুনেছে। সাথে চোখ দুটো আবার ভিজে উঠেছে।

রাতে খাওয়ার সময় ডাকতে দরজা খুলল ইহান। মুখটা ধুয়ে নিয়েছে একটু। কিন্তু মোছেনি। এখনো পানি জমে আছে চোখের কোণায়। চোখের পানি না মুখ ধোঁয়া পানি জানে না। ইশিতা খাবার বাড়তে বাড়তে বলল, এতই যখন কেয়ার করিস শেষ বেলায় এত কঠিন হয়ে গেলি কেন? মেয়েটা কত কেঁদেছে জানিস? নাকটা লাল করে ফেলেছিল। ইহান কিছু না বলে একরাশ অভিমান নিয়ে খেতে বসল। ইশিতা পাশে বসে বলল, বুবুর উপরও অভিমান হয়েছে? ইহান চুপচাপ খেতে লাগল।

– জানিস তো ওকে আমরা ওর প্রাপ্যটুকু দিতে পারব না। ওর প্রতিভা বিকাশের জন্য একটা পরিবেশ দরকার যেটা ও আমাদের কাছে থাকলে কোনোদিনই পাবে না। তুই বিদেশে চলে গেলে আমি থাকতাম কাজে। ও একলা এই অন্ধকারে রয়ে যেতো। সেটা কি করে হতে দেই বল? ফারাবী আর ওর পরিবারকে অনেকদিন থেকেই চিনি আমরা। জানিস আঙ্কেল কি বলেছে? ওকে আর্ট কলেজে ভর্তি করাবে। ও অনেক ভালো থাকবে।

ইহান নাক টানতে লাগল। ইশিতা ওর দিকে মুখ ঘোরাতেই ও কেঁদে দিল। ইশিতা ওর বুকে টেনে নিয়ে বলল, আমার ছোট্ট বোকা ইনুটা। ইহান বোনকে আঁকড়ে ধরে কাঁদতে লাগল। ঐ অল্প কথা বলা মেয়েটার উপর বড্ড মায়া পড়ে গেছে যে।

সকাল আটটায় এয়ারপোর্টে পৌঁছে গেল। রবি চাচা আগে থেকেই ওদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। সাথে ওনার ভাগ্নে আর তার বউও এসেছে। রবি চাচা ওকে নিয়ে ঢুকে গেলেন ভেতরে। ঠিক সেই সময় মিথিলা দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে আসল। হাতে একটা বড়ো ফ্রেম। এসে হাঁপাতে লাগল। যখন বুঝলো দেরি করে ফেলেছে তখন সেখানে বসে কান্না করে দিল। ইশিতা এসে বলল, কি হয়েছে মিথু? ও ফ্রেমটা দেখিয়ে বলল, এটা ইনুর।
.
.
.
.
পাঁচ বছর পর দেশে ফিরল ইহান। তবে প্রত্যেক বছর একবার করে এসেছে ইশিতাকে দেখতে। সবার সাথেই দেখা হয়েছে। কেবল মিথিলা ছাড়া। তাই বলে এই নয় যে মিথিলা সম্পর্কে সে বেখবর। প্রতিনিয়ত মিথিলার খবর নিয়ে নিয়েছে ফারাবীর কাছ থেকে। যোগাযোগ ছিল ওর সাথে প্রতিনিয়ত। আজ প্রথম বিবাহ বার্ষিকী ইশিতার। বিয়েটা শেষ পর্যন্ত করেই ফেলল। সাথে সুখবরও আছে। সেই নিয়ে খুবই খুশি সবাই। ইশিতার শ্বশুরবাড়িতে পার্টি চলছে আজ। সেই হিসাবেই আজ ইহানের দেশে ফেরা।

ইহান গাড়ি থেকে নামতেই ফারাবী বলল, কি অবস্থা ব্রো? আগের থেকে দেখতে সেই হয়েছিস। ইহান হেসে বলল, ঢং করিস না। এসেছিস তাহলে। ইশুবু যে বলল তুই নাকি মানা করে দিয়েছিস। ফারাবী চোখ টিপে বলল, আমি না আসলে মাথা ফাটিয়ে দেবে বলেছে। তা তোমার যে আজ এক জায়গায় দাওয়াত আছে ভুলে গেছো? ইহান চিন্তা করে বলল, কোথায়!? ফারাবী অবাক হওয়ার ভান করে বলল, সেকি! ভুলে গেলি! আজ না মিথিলার চিত্রপ্রদর্শনী! তুই ভুলে গেলি! ইহানের একদম মাথায় ছিল না। মিথিলার সাথে কত দিন দেখা হয়নি! পাঁচটা বছর! অথচ এখনো সেই দিনের কথা মনে পড়ে যেদিন প্রথম দেখেছিল। কলিংবেল টিপছিল বাচ্চাদের মতো। হাসিতে মুখ ভরা ছিল। ফারাবীর ঠেলায় ইহানের হুঁশ ফিরল। সে জিজ্ঞেস করল, যাবি না?

– সবাই যাবে তো?

– জ্বি না। আমরা দেখে চলে এসেছি। তুমিই বাদ গেছো দেরি করছো বলে।

– ইশুবু…

– ইশিতা আপু জানে। তুই যা আগে। নইলে প্রদর্শনী শেষ হয়ে যাবে।

ফারাবী জোর করে ইহানকে পাঠিয়ে দিল। পথিমধ্যে থেমে একটা কোন আইসক্রিম নিয়ে গেল। পাগলীটার পছন্দ যে। গিয়ে ঢুকতেই টিকেট কাটল। বেশ ভালোই ছবি এঁকেছে মিথিলা। তাকে আর্ট কলেজে ভর্তি করা বিফলে যায়নি। আগের থেকে ছবি আরো সুন্দর আর বাস্তবের মতো ফুটে উঠছে।

হঠাৎ একটা জায়গায় নজর পড়তেই এক মুহূর্ত থমকে গেল ইহান। সেখানে লেখা ইনু কর্ণার। সেখানে যতগুলো ছবি প্রদর্শনী হচ্ছে সব ইহানের৷ বলতে গেলে অর্ধেকের বেশি ইহানের ছবি। ও মাঝে মধ্যে ফারাবীকে ছবি পাঠাতো। সেই ছবিগুলোকেই নিজের মতো ফুটিয়ে তুলেছে মিথিলা তার তুলিতে। এরমধ্যে একটা ছবি ওর নজর কাড়ল। মিথিলার আঁকার প্রথম ছবিটা যেটা রাইসা ছিঁড়ে ফেলেছিল। ফ্রেমে বাঁধা সুন্দর করে। ছিঁড়ে যাওয়া দাগগুলো স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে তাও৷ নিঃসংকোচে ছবিটা প্রদর্শনীতে রাখল! ইহান দাঁড়িয়ে আছে ছবিটার সামনে। পেছন থেকে কেউ বলল, আইসক্রিম গলছে।

ইহান পেছনে তাকিয়ে দেখল মিথিলা। আগের মতো বাচ্চাভাবটা থাকলেও ম্যাচিউর ভাবটা বেশ ছেয়ে গেছে ওকে। লাল রঙের একটা মণিপুরী শাড়ি পরে আছে। কানে মাটির ঝুমকো। মাথার খোলা চুলের আড়াআড়িভাবে বকুলের মালা দেওয়া। হাতেও আছে। পুরোই বাঙালী সাজ। আগের সেই সাধাসিধে মিথিলার যেন অন্যরূপ দেখছে ও। মিথিলা এগিয়ে এসে বলল, ই নু। ইহানের ঘোর কাটতেই বলল, ও হ্যাঁ। তোমার জন্য এনেছিলাম। মিথিলা এগিয়ে এসে কোন আইসক্রিমটা নিল। ইহান কিছুক্ষণ তাকিয়ে বলল, বেশ বদলেছো দেখছি।

– সত্যি?

– হুম। ভালো হয়েছে ছবিগুলো।

– থ্যাংকস।

– ফারাবীর কাছে শুনলাম তুমি এখন ফ্লুয়েন্টলি কথা বলতে পারো।

– নার্ভাস। পারি না।

– আমার সামনে নার্ভাস কেন?

মিথিলা চোখ নিচে নামিয়ে ফেলল। দেখে ইহানের মনে হল লজ্জা পেয়েছে। হঠাৎ মুখ উজ্জ্বল করে বলল, ওয়েট। এক দৌঁড়ে কোথায় যেন চলে গেল। তারপর র‍্যাপিং পেপারে মোড়ানো একটা জিনিস ধরিয়ে দিয়ে একটা ফাঁকা দেয়ালের কাছে টেনে নিয়ে গেল। মিথিলা খুলতে ইশারা করায় ইহান র‍্যাপিং পেপারটা খুলল। একটা ছবির স্কেচ বের হয়ে এল। মিথিলা, ইশিতা আর ওর। ছবির নিচে কোণায় পাঁচ বছর আগের একটা তারিখ লেখা। মিথিলা কাচুমাচু হয়ে বলল, পাঁচ বছর। তুলে রেখেছি। লাগাও। দেয়ালের ফাঁকা অংশে ইশারা করল। ইহান ছবিটা ঝুলিয়ে দিতেই মিথিলা খুশিতে বলল, কমপ্লিট। ইহান মাথা নাড়িয়ে বলল, এখনো কমপ্লিট হয়নি। আমাদের এখনো অনেক পথ এক সাথে চলা বাকি মিথু। মিথিলা মিষ্টি হাসি দিয়ে ইহানের কাঁধে মাথা রেখে ছবিটার দিকে তাকিয়ে বলল, ই নু।

সমাপ্তি……

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে