মিঠা রোদ পর্ব-১২+১৩+১৪

0
455

#মিঠা_রোদ
#পর্ব:১২
#লেখা:সামিয়া_খান_প্রিয়া

“আমাদের সম্পর্কটি অনুচিত কেন?বয়স নাকী বাবা-মায়ের সঙ্গে বন্ধুত্বটা কারণ?”

“যদি বলি দুটোই?তাছাড়া আমার আগেও..।”

কথাটি শেষ হওয়ার পূর্বে ওয়েটার এসে টেবিলে খাবার রেখে গেলো।কবীর নিজ উদ্যোগে লবস্টার ছাড়িয়ে তোশার প্লেটে তুলে দিলো।

“আপনি বেশী ভাবছেন কবীর।দেখবেন সকলে মেনে নিবে।সমস্যা হলো আমার প্রতি আপনার ভালোবাসা নেই।”

“ওহো তোশামণি।বয়স অনুযায়ী ভালোবাসা সম্পর্কে একটু বেশীই কৌতুহল হয়ে আছে তোমার মন।পড়াশোনা এতোটা পারো?ওয়েল চলো ধরি কয়েকটা প্রশ্ন।”

তোশার চোখদুটো ছোট ছোট হয়ে গেলো।এই সুদর্শন তামাটে বর্ণের অহংকারী পুরুষটি কী মনে করে তাকে?

“উহু,সবসময় আমি কেন পরীক্ষা দিবো?উল্টো আজ আপনাকে প্রশ্ন করবো আমি।বলেন গ্যালিলিও এর সূত্র কী?প্লবতা সম্পর্কে বলেন।উত্তল, অবতল দর্পণ কোনগুলো।কখন প্রতিবিম্ব বড়-ছোট হবে?বলেন বলেন কবীর শাহ।”

কবীর ঠোঁট কামড়ে নিজের হাসি সংবরণ করলো।উচ্ছ্বল প্রাণবন্ত কিশোরীর চোখদুটো জবাবের জন্য চকচক করছে।মেয়েটা কী ধরে নিয়েছে সে এসব প্রশ্নের জবাব জানেনা?নাহ,মেয়েটাকে আজ আবার হারাতে হবে।উষ্ণ শ্বাস ফেলে সবগুলো প্রশ্নের উত্তর দিলো কবীর।তোশামণি ঈষৎ বি র ক্ত হলো।মন খারাপের সুরে বলল,

“আপনি সবসময় জিতে যান।বয়সে বড় হলে সকলে জিতে যায় তাইনা?”

“ধরে নাও তাই।”

“যখন আমি বড় হবো।মানে ইউনির্ভাসিটিতে পড়বো তখব দেখবো কীভাবে হারিয়ে দেন আমাকে।”

কবীর শুধু হাসলো তোশার কথায়।সেই অবধি কী তাদের সম্পর্ক এগিয়ে যাবে?নিজের প্লেট থেকে কিছুটা উঠিয়ে তোশার প্লেটে দিলো কবীর।বিষয়টা নিছক অভ্যেসের ফলে হয়েছে।দিশাকেও সে এমনভাবে মায়া-মমতা দিয়ে আগলে রেখেছিলো।

“তোশা একটা কথা তোমার মাথায় আসেনা কেন আমি তোমার সাথে খেলায় নামলাম?চাইলে তো তাহিয়া কিংবা মায়ানকে বিষয়টা জানাতে পারতাম।তারা হ্যান্ডেল করে নিতে পারতো।”

কপালের একপাশে বিরক্ত করতে থাকা চুলগুলো কানের পিঠে গুঁজে নিলো তোশা।

“এসেছিল।আমি জিজ্ঞেস করবো ভেবেছিলাম।”

“কয়েকমাস আগে আমি যখন আমার বন্ধু এলেক্সের বিয়েটা এটেন্ড করতে গিয়েছিলাম তখন একজন লেখকের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল।নাম রিকার্দো কুয়ারেজমার।আমাকে ড্রিংক অফার করে।তখন বসে বসে আলাপের সময় রিকার্দো আমাকে নিজ জীবনের একই রকম ঘটে যাওয়া একটি ঘটনা শুনান।সে নিজেও সতের বছর বয়সী টিনেজারের সঙ্গে একমাস কম্পিটিশন করেছে।”

তোশা উত্তেজিত হয়ে বলল,

“তাদের বিবাহিত জীবন এখন কেমন চলছে?”

কবীর হেসে ফেললো তোশার কথায়।যে হাসিতে কিশোরীর মনের বাগানে সুগন্ধ মেখে প্রজাপতি উড়ে গেলো।আজও ব্যক্তিটার হাসি চোখ অবধি পৌঁছায়নি।

“তাদের বিয়ে হয়নি।এমনকি সম্পর্কও হয়নি।মেয়েটা চৌদ্দ দিনে নাকানিচুবানি খেয়ে পালিয়েছে।”

“আপনি ভাবছেন আমিও সেরকম করবো?”

“আমি জানি শেষটা রিকার্দোর সঙ্গে যা হয়েছে সেটি হবে।সত্যি বলি?তখুনি মনে মনে সিদ্ধান্ত নেই তুমি এগিয়ে এলে আমি এই প্রতিযোগীতা আনবো দুজনের মধ্যে।এতে সাপও ম র বে..।”

“আর লাঠিও ভাঙবেনা।তাইতো?”

“হ্যাঁ।”

তোশার শ্বাস ভারী হয়ে এলো।সাদা মুখটা ছোট্ট চেরি টমেটোর মতোন রক্তিম হয়ে উঠেছে।মেদুর গালটি টেনে দিলো কবীর।

“রাগলে তোমাকে পেঁকে যাওয়া চেরি টমেটোর মতোন লাগে।”

“ওই মেয়েটির মতোন আমি না।পালাবো না।ঠিক ত্রিশ দিন পুরো করবো।”

“করো সমস্যা নেই।শেষে দেখা যাবে আমি জিতবো।তবে বেশী কষ্ট না পেলে পিছিয়ে যাওয়া উত্তম।”

তোশা রেগে কবরীরের শার্টের কলার হাতের মুঠোয় ভরে নিলো।

“কবীর শাহ ওভার কনফিডেন্স খুব খারাপ জিনিস।এটা কী আপনার আম্মু শিখায়নি?”

“আমার মা তো অনেক কিছু শিখিয়েছে।যেমন ছোট্ট বাচ্চাদের সঙ্গে লাগতে নেই।”

“ইশ,ছোট বাচ্চা তাইনা?আম্মু, আব্বুর রিলেশন কতো বছরে হয়েছিল মনে আছে?আমি জানি সতের তে।”

“তাই?তোমার বাবার বয়স কতো ছিল তখন জানো?ঠিক সতের।ক্লাসমেইট ছিল মায়ান-তাহিয়া।আমার বয়স কতো থার্টি সিক্স।মানানসই হলো।ঠিক ওদের জন্য আমি তোমার সাথে কঠোর হতে পারছিনা।”

খুব কান্না পাচ্ছে তোশার।ব্যক্তিটা কেন বুঝতে পারছেনা কিছু।হুট করে মেয়েটির কী হলো।নিজ থেকে কবীরের বুকে মাথা রাখলো।পুরুষটির গায়ের তীব্র সুগন্ধ প্রাণভরে নিলো সে।বুকের অস্থিরতা তো কমছেনা।কবীর নির্বিকার বসে আছে।মেয়েটির প্রতি অবাঞ্চিত অনুভূতি গুলো বেড়ে উঠুক তা সে চায়না।যা সমাজ,নীতি, সম্পর্ক বিরুদ্ধ সেসব অনুভূতি শুধু দুঃখ ও ভাঙন বয়ে আনে।

“শুনেন কবীর শাহ।আমি তাইয়ুবা চৌধুরী তোশা সত্যিই আপনাকে ভীষণ ভীষণ ভালোবাসি।সরাসরি কখনো বলেছিলাম কথাটি?”

তোশার ছোট্ট ছিমছাম দেহের উষ্ণতায় বিভোর হয়ে থাকা কবীর বলল,

“এসব বাচ্চামো আবেগ,মায়া ছাড়া কিছু নয়।”

“আবেগ,মায়াও অনুভূতি।আর যেকোনো অনুভূতি ভাঙলে খুব কষ্ট হয়।”

তোশার এমন বড় ধরণের কথায় কবীর অবাক না হলেও ফোনের ওপাশে থাকা নারীটি ভীষণ অবাক হলো।এতো অনুভূতি নিয়ে কথাগুলো তার শেখানো নয়।তোশার নিজ থেকে বলা।ভালোবাসা চাওয়া পাওয়া মাঝেমধ্যে সত্যিই বড় বিচিত্র আচরণ করায় মানুষকে দিয়ে।

(***)

কবীরের কথাটি সত্য হলো।প্রতিযোগীতার দ্বিতীয় পর্বে খুব বাজেভাবে হেরে গেলো তোশা।যে মা তাকে বকেনা সে রে গে আজ অনেক কথা শুনিয়েছে।এমনকি লকেটটা আপাতত তাহিয়ার জিম্মায় আছে।কী অসহ্য যন্ত্রণা ভালোবাসায়।যেখানে বয়স না মিললে হবেনা।ত্বকের রঙে না মিললে হবেনা।টাকা পয়সায় না মিললে হবেনা।সম্পর্কে না মিললে হবেনা।তাহলে যে অনুভূতি না হওয়ার থাকে সেটা তৈরী হয় কেন?বড় বড় অশ্রুকণা মুছতে মুছতে কবীরের নাম্বারে ডায়াল করলো তোশা।ওপাশ থেকে রিসিভ হওয়ার পর কান্নার শব্দ শুনে আনমনা পুরুষালি শক্ত কণ্ঠে কবীর বলে উঠলো,

“হেরে গেলে তোশামণি।কাল আবারও কী তৃতীয় পর্বে সামিল হতে চাও?হেরে যাবে কিন্তু।”

তোশা কান্নারত কণ্ঠে জবাব দিলো,

“হেরে যাওয়ার জন্য হলেও আবার একই খেলা খেলবো।”

“আমাকে হারিয়ে ফেলার এতো ভয় তোশামণি?”

কবীর প্রশ্নটি করতে গিয়ে নিজেও কেমন অসহায় বোধ করলো।বুকের ভেতর থেকে শূন্য হয়ে আসছে তার।কেন অবাঞ্চিত মায়া জন্মে মানুষের?সেই প্রশ্নের জবাব নেই।

চলবে।

#মিঠা_রোদ
#পর্ব:১৩
#লেখা:সামিয়া_খান_প্রিয়া

“তোশামণি ক্লাসে চল।”

“যাচ্ছি দাঁড়া।”

বাতাসে তোশার মসৃণ চুলগুলো উড়ো উড়ি করছে।সেগুলো কানের পিঠে গুঁজে নিলো।বড্ড উত্তেজিত দেখাচ্ছে তাকে।মাঠের একদম শেষ মাথায় গেটের কাছে কবীর দাঁড়িয়ে আছে গাড়ী নিয়ে।নিশ্চয় তোশার জন্য এসেছে।কিন্তু এখনও তো ছুটির অনেকক্ষণ বাকী।কবীরের তামাটে শক্ত মুখখানার দর্শনে তোশার অশান্ত মন আরো জ্ব লে উঠলো।মেয়েটা যেন এতোদূর থেকেও তামাটে পুরুষটির গায়ের তীব্র সুগন্ধ পাচ্ছে।

“কী হলো তোশামণি ক্লাসে চল।কাকে দেখিস এভাবে?”

বান্ধুবীর সামনে প্রচন্ড লজ্জা অনুভব হলো তোশার।সে ঈষৎ কেঁশে বলল,

“কাওকে না।চল স্যার এসে পড়বে।”

ফিরে যাওয়ার সময় তোশা বারবার পিছন ফিরে দেখছিলো।বড্ড মন খারাপ হয়ে গেলো তার।ব্যক্তিটা একবার বারান্দায় তাঁকালে অন্তত কোনো ইশারায় অপেক্ষা করতে বলতো।অথচ ছোট্ট কিশোরী তোশামণি টের পেলো না কবীর শাহ নামক সবথেকে নিষ্ঠুর অঘোষিত গোপনীয় প্রেমিকটি তার জন্য নয়।অন্য কারো সঙ্গে দেখা করতে এসেছে।মিনিট দশেক পর কাঙ্ক্ষিত রমনীর দেখা পেলো কবীর।দিশা নিশ্চুপ হয়ে তার পাশে এসে দাঁড়ালো।

“গাড়ীতে উঠে বসো দিশা।”

দিশা উষ্ণ শ্বাস ফেললো।টিস্যু দিয়ে মুখবিবরে লেপ্টে থাকা ঘামগুলো মুছে নিয়ে বলল,

“কেন ডেকেছো সেটা বলো।”

“তুমি নিশ্চয় চাইবেনা সকলের সামনে আমার মেজাজ খারাপ আর তোমার সম্মানহানী হোক।”

“তাই?যে পুরুষ বিবাহ বন্ধনে থাকা অবস্থায় আমাকে সাধারণ ফুলের টোকাও দেয়নি সে প্রাক্তন হয়ে যাওয়ার পর বৃহৎ কিছু করবে বলে আমার মনে হয়না।”

কবীর এগিয়ে এলো দিশার দিকে।তার পুরু ভ্রু দুটো সদা প্রিয় ছিল দিশার নিকট।অতীতের অভ্যেস থেকে কীনা নিজের ব্যবহার করা টিস্যু দিয়ে কবীরের কপালের ঘাম মুছে দিলো দিশা।

“তুমি আরো তামাটে হয়ে গিয়েছো কবীর।”

প্রশ্নটির জবাব না দিয়ে দিশা টেনে সজোরে গাড়ীর ভেতর ফেললো কবীর।কোনোকিছু নিয়ে বড় রেগে আছে সে।কবীর নিজেও গাড়ীর ভেতরে গিয়ে বসলো।

“তোমাকে কী কোর্ট থেকে আহনাফের থেকে দূরে থাকতে বলা হয়নি?তবে এই স্কুলে এতো মাস ধরে চাকরি করার সাহস পেলে কোথায় থেকে?”

“কবীর নিজের ভুলটা শুধরে নাও।আমি একবারও আহনাফের সাথে কথা বলিনি।ইনফ্যাক্ট ও আমাকে দেখেওনি।আমি নাইন ও টেনে ক্লাস নেই।”

“ভুল বললে।গতকাল দেখেছে।এবং রাতে আমাকে জানিয়েছে।”

দিশা একটু মনক্ষুন্ন হয়ে বলল,

“আমাকে দেখেও ও কথা বলেনি কেন?”

দিশার মাতৃত্বের উপর পুরোদমে বিদ্রুপ করে হেসে কবীর বলল,

“তুমি ওর মা হওয়ার মতো কিছু করেছো?এক মিনিট তুমি বৃষ্টিদের ক্লাস নাও?”

“হ্যাঁ।”

“অথচ বৃষ্টি আমাকে জানানোর প্রয়োজন মনে করেনি।”

“একটা বিষয়কে বড় করে নিচ্ছো কবীর।বৃষ্টির কী দরকার তোমাকে বলার জন্য?এমন না ওর সাথে টিচার-স্টুডেন্টের বাহিরে কোনো সম্পর্ক আছে আমাদের।”

“না থাকুক।তোমাকে কেন আশেপাশে টলারেট করবো আমি?”

“তো কাকে করবে?মায়ানের মেয়ে তোশাকে?”

কথাটি সুঁচালো ছুঁ ড়ি র মতোন কবীরের বুকে এসে লাগলো।হুট করে উত্তেজিত হয়ে দিশার চোয়াল চেপে ধরলো সে।

“তোশার কথা আসছে কেন এখানে?ও শুধু তোমার স্টুডেন্ট।”

“লাগছে কবীর।”

“লাগুক।তোশার কথা মাথা থেকে সরিয়ে দাও।”

“কেন লজ্জা পাচ্ছো তুমি?ইশ যখন তুমি আমার সাথে ভালোবাসার রাত গুলো উদযাপনের করতে তখন তোমার বর্তমান মায়ের বুকে শুয়ে ঘুম পাড়ানি মাসি-পিসি শুনতো।কীরকম বিদঘুটে বিষয় হয়ে গেলো না কবীর?মায়ান জানে?তাছাড়া কী যাদুবলে মেয়েটা সুন্দর,ব্যক্তিত্ববান,আদর্শবান,নিজ নীতিতে অবিচল থাকা কবীর শাহকে মানিয়েছে।বাই এনি চান্স?”

“মুখ সামলে কথা বলো দিশা।তোশা খুব ভালো একটা মেয়ে।”

“থাকুক।কিন্তু যে তোমাদের কথা শুনবে সেই তো বলবে মেয়েটা তোমার সুগারবেবি।খরচ করো ওর পিছনে?”

“স্টপ দিশা।আমি কী করি সেগুলো তোমার দেখার বিষয় নয়।”

“অবশ্যই দেখার ব্যাপার আছে।ছেলেটা এখনও তোমার কাছে আছে।তার জন্য ভবিষ্যত দেখতে হবে তো নাকী?যদিও মনে হয়না তোশাকে তুমি বিয়ে করবে।শুধু শুধু চুইংগামের মতোন চিবানোর কী দরকার?”

“ও চুইংগাম না।জলজ্যান্ত একজন মানুষ।পৃথিবীর সবথেকে সুন্দর মানসিকতা আর মন ওরমধ্যে আছে।এইযে যেসব কথা বললে সব গুলো অনুচিত ছিল তোমার।যাই হোক কথাগুলো যেন আমার মধ্যে থাকে।ভুলক্রমে লিটল চেরির কাছে বললে আমি তোমাকে ছাড়বো না দিশা।

কবীর নিজের সীটে ফিরে এসে জোরে জোরে শ্বাস নিতে লাগলো।রাগে তার মুখটা রক্তিম হয়ে উঠেছে।দিশার চোখ দুটো অশ্রুসজল হয়ে উঠলো।এই ব্যক্তিটা একসময় শুধু তার ছিল।অথচ আজ সব পরিবর্তন কেন হয়ে গেলো?

” লিটল চেরি?ভালো নাম দিয়েছো তো।যাই হোক আমার ক্লাস আছে।তাও আবার তোমার লিটল চেরির ক্লাসে।ভালো থেকো।”

“দাঁড়াও দিশা।আহনাফ কিংবা তোশা দুজনের থেকে দূরে থাকবে।”

“তোমার তোশামণির সঙ্গে আমার কোনো দেনাপাওনা নেই।যদি আহনাফের কথা আসে তবে আমার বলতে হবে ছেলেটা আমারও অংশ।পেটে ধরেছি।তাই অধিকার আছে।”

দিশা গাড়ীর দরজাটি খুলে বাহিরে চলে গেলো।কবীর অবশ্য তাকে বিদায় দিলো না।চোখের কার্ণিশে জমে থাকা অশ্রুগুলো বাম হাতের পিঠের সাহায্য মুছে নিলো।হুট করে ঝুঁকে কবীরের উদ্দেশ্যে বলল,

“তুমি আমার ছিলে কবীর।সেখানে তোমার নতুন প্রেমিকাকে চোখের সামনে দেখতে পেয়ে খুব খারাপ লাগে।”

“নিজেদের দোষে প্রাক্তন হয়েছি দিশা।এখানে নতুন কারো দোষ নেই।”

(***)

স্কুল থেকে বড্ড দুঃখিত মন নিয়ে বাসায় ফিরে এলো তোশা।ভেবেছিল ছুটির পর কবীরকে দেখতে পাবে।কিন্তু ব্যক্তিটা তো ছিলনা তখন।এজন্য বাসায় ফিরে এসে রুমে দিকে ছুটতে লাগলো।তোশার নানী রাহেলা আড়চোখে নাতনিকে দেখলো।বড় চঞ্চল হয়ে উঠেছে ইদানীং।কবীরের নাম্বার ডায়াল করতেই রিং হতে লাগলো।সঙ্গে তোশার বুকের হৃদপিন্ডের লাব-ডাব শব্দের গতি বাড়ছে।রিসিভ হতে তোশা শুধালো,

“চলে গেলেন কেন?”

কবীর বিরক্তি হয়ে বলল,

“তুমি করিডোর থেকে দেখছিলে কেন আমাকে?”

“বাহ!দেখার মানুষ দেখবো না?”

অন্যসময় হলে কবীর হেসে ফেলতো একথায়।কিন্তু আজ দিশার কথায় বড় প্রভাবিত হয়েছে সে।

“আমাকে আর ফোন করবেনা তুমি।যা হচ্ছিলো তা বাদ।”

“কেন?কী হলো হঠাৎ?”

“সব তোমাকে বলতে হবে আমার?ইডিয়ট কোধাকার।”

ফোনটা কেঁটে গেলো।এরপর যতোবার ব্যাক করলো তোশা ততোবার বিজি পেলো।মানে লোকটা তার নাম্বার ব্ল্যাকলিস্টে রেখেছে।তীব্র যন্ত্রণায় বুকে ব্যাথা শুরু হয়ে গেলো।এমন সময় কল্লোল আপেল খেতে খেতে রুমে এসে তোশার পাশে বসলো।

“জানিস তোশামণি কলি খালামণিরা আসছে খুব তাড়াতাড়ি।”

নিজের কষ্ট লুকানোর জন্য তোশা হাসার প্রয়াস করে বলল,

“তাই?”

“হ্যাঁ।পাত্র দেখছে তার জন্য।ওইযে কবীর আঙকেল।সেই হচ্ছে পাত্র।”

শিউরে উঠলো তোশা।অনুভূতির আরশিমহলে কাঁপন সৃষ্টি হলো।সবটা ভেঙে পড়বেনা তো এবার?

চলবে।

#মিঠা_রোদ
#পর্ব:১৪
#লেখা:সামিয়া_খান_প্রিয়া

“আপনি কী নিয়মিত জিম করেন?আমি কিন্তু মটেও স্বাস্থ্য সচেতন নই।এই কারণেও স্বাস্থ্যও বেশী।”

নিজের এই অপারগতা প্রকাশ করতে বিন্দুমাত্র লজ্জা পেলো না কলি।মেয়েটা বেশ স্মার্ট।কথাবার্তায় মেকি ভাব কম।

“সকলে যে স্বাস্থ্য বিষয়ে সচেতন হবে এমন নয়।রেস্ট্রুরেন্টের বিজনেস তাহলে চলবে কীভাবে বলেন?”

কলি হাসলো।এতে তার শুভ্র মুক্তার মতোন দাঁতগুলো দৃশ্যমান হলো।

“বাই দ্য ওয়ে আমাদের নামের মধ্যেও কিন্তু মিল আছে ‘ক’ তে।সত্যি বলতে আমি এতো কথা বলিনা কখনো।”

“আমাকে দেখে বলতে মন চাচ্ছে এতো কথা?”

কলি লাজুক হেসে শাড়ীর আঁচল আঙুলের সঙ্গে লেপ্টে দিতে দিতে মাথা দুলালো।

“জি।’

“বেশ।”

কবীরের মটেও আলাপ করতে ভালো লাগছেনা।উল্টো চোরাচোখে দূরে বসে থাকা মিষ্টি কন্যাকে দেখতে ভালো লাগছে।ফোলা ফোলা গালের মধ্যে বিষন্নতা ছেয়ে আছে তোশামণির।এতে যেন আরেকটু সুন্দর লাগছে মেয়েটিকে। সে মাথাটা তুলতেই দুজনের দৃষ্টির মেলবন্ধন ঘটলো ।কবীরকে তার দিকে তাঁকিয়ে থাকতে দেখে মুখটা ঘুরিয়ে নিলো তোশা।

“কী দেখছেন ওদিকে?”

কবীর আস্তে করে জবাব দিলো,

“অভিমান দেখছি।”

“হু?কী বললেন?কে অভিমান করেছে?”

কলি সামনে চোখ তুলে তাঁকিয়ে তোশা ছাড়া আর কাওকে দেখতে পেলো না।সে ধরে নিলো নিশ্চয় এই বাচ্চা মেয়েটির অভিমান কবীর দেখছেনা।

“কলি আমি একটু আসছি।দুঃখিত আপনাকে একা ছাড়ার জন্য।”

কবীরের মিষ্টি হাসিটা সংক্রমিত হয়ে কলির মুখেও ছড়িয়ে গেলো।সে ঋণাত্মক মাথা দুলিয়ে বলল,

“সমস্যা নেই।আমি সেই অবধি তোশার সঙ্গে একটু গল্প করে নেই।”

কবীর সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠার আগে একবার পিছন ফিরে তোশাকে দেখলো।মেয়েটার মাথা থেকে নিশ্চয় এতোদিনে প্রেমের ভূত নেমে গিয়েছে।তা নয় সকালে এসেছে।অথচ একটিবারও তার সঙ্গে কথা বলেনি।উষ্ণ শ্বাস বের হয়ে এলো কবীর শাহ এর পাথর হৃদয় থেকে।

তোশামণির চুলগুলো ইদানীং বেশ বড় হয়েছে।মৃদুমন্দ হাওয়ার সঙ্গে সেগুলো উড়োউড়ি করতে ব্যস্ত।তোশাকে আত্মীয়রাও বেশ আহ্লাদ করে।কলি এসে পাশ থেকে জড়িয়ে ধরে বলল,

“কী ব্যাপার তোশামণি?মনটা খারাপ কেন তোমার?ভালো লাগছেনা এখানে?”

“ভালো লাগছে খালামণি।একটু আগে যারা এলো তারা কে?”

“কবীরের মা-বাবা।আপাতত তারা এসে আমাকে দেখে যাচ্ছে।পরবর্তীতে কথা এগিয়ে গেলে বাড়ীর সকলকে নিয়ে আকদ অনুষ্ঠিত হবে।”

“ওহ।”

শব্দটি অন্তত মনমরা হয়ে তোশার ভেতর থেকে বের হয়ে এলো।যার গভীরতা কলি মাপার প্রয়োজনবোধ করলো না।তোশা পুনরায় ব্যগ্র হয়ে শুধালো,

“তিনি তোমাকে পছন্দ করেছে খালামণি?”

“এখনও বলা যাচ্ছেনা।স্বাস্থ্য একটু বেশী দেখে কতোজন রিজেক্ট করলো।যদি তোমার মতোন সুন্দর থাকতাম তবে বিয়ে এতো দেরীতে হতো নাকী?”

কলির আক্ষেপটা তোশার মনে সুঁ চ হয়ে য ন্ত্র ণা দিলো।এতো রুপের ডালি মেলে ধরেও তো সেই মানুষটার হলো না।কিশোরী তোশার মনে আত্মসম্মান ফুঁটে উঠেছে।ঠিক এই কারণে আজ তেরো দিনেও সে কবীর শাহ এর সঙ্গে কথা বলেনি।থাকুক না দূরে।গোপনে আড়ালে সব বির্সজিত হয়ে যাক।কলি নিজ ফোনে মত্ত্ব হয়ে পড়লো।উষ্ণ শ্বাস ফেলে তোশা উঠে দাঁড়ালো।এই বাড়ীটাও তার নানার।কিন্তু সাভারের দিকে হওয়ায় খুব বেশী আসা হয়না।অনেকটা খোলামেলা বাগান বাড়ীর মতোন।বাড়ীটা নানার হলেও আপাতত এটা তোশার ছোট খালামণির নামে।দুই ধার দিয়ে সিঁড়ি উঠে যায় ছাদের দিকে।তোশা যেদিকে কবীর গিয়েছিল ঠিক তার বিপরীতের দিকে গেলো।পথিমধ্যে বড়দের হাসির আওয়াজ শুনতে পেলো সে।বিয়েটা হয়তো হয়েই যাবে।

(***)

একমনে বাহিরে তাঁকিয়ে আছে কবীর শাহ।বাড়ীর সবথেকে নির্জন ব্যলকনি এটা।বহু বছর আগে মায়ানের সঙ্গে এই বাড়ীতে পিকনিক করতে এসেছিল সে।আজও সেই স্মৃতিগুলো কতোটা রঙিন।যে ছেলেকে বন্ধু হিসেবে সে মানে তার মেয়ের প্রতি অবাঞ্জিত দূর্লভ অনুভূতিকে সে শাসন করতে করতে ক্লান্ত।একদম ক্লান্ত হয়ে গিয়েছে।এটা তো হওয়ার কথা ছিলনা।হুট করে নাকের ভেতর সুগন্ধীরা এসে ছুটোছুটি করতে লাগলো।Johnson Baby Powder এর।তোশা এখনও এটা গায়ে মাখে।যে মেয়ে ষোল বছরেরও বাচ্চামো ধরে রেখেছে তার সঙ্গে আসলেও তর্ক করে আগানো যায়না।মনের কৌতুহল দমাতে পারলো না কবীর।এগিয়ে গেলো সুগন্ধের দিকে।বাহিরের দিকে মুখ করে কাঁদছে তোশা।একটু পর পর হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে চোখ মুছে চলেছে।কবীর বাঁকা হেসে দেয়ালে বাহু ঠেকিয়ে দাঁড়ালো।আগমন বুঝতে পেরে তোশা শুধালো,

“কাঁদতে দেখে আনন্দ হচ্ছে?নিষ্ঠুর,পাষাণ,শক্ত হৃদয়ের মানুষ।”

“ভালো লাগছে সুন্দর,কোমল,নরম হৃদয়ের কন্যা।”

তোশা প্রচন্ড তেজ নিয়ে ঘুরে দাঁড়ালো।কান্না করতে করতে চোখ দুটো ফুলে গিয়েছে তার।কবীর হতাশামূলক শ্বাস ফেলে বলল,

“কিশোরী বয়সটা সত্যি ভয়ংকর আবেগের বয়স।যেখানে ভালো মন্দের বিচারে অনুভূতি প্রাধাণ্য বেশী পায়।”

“আবেগ?কেন এই বয়সে কারো মনে চাওয়া পাওয়া তৈরী হতে পারেনা?মানুষের তো ছোটবেলায় বন্ধুত্ব তৈরী হয়।যা পরবর্তী তে ভালোবাসা হয়ে উঠে।সেই বেলায় দোষ নেই।”

“ভীষণ বড় হয়ে যাচ্ছো তোশামণি।”

“হইনা বড়।তবে যদি আপনার মায়া হয়।”

কবীরের চোখ দুটো হেসে উঠলো।সে এগিয়ে এলো তোশার সামনে।মেয়েটি তার থেকে শারীরিকভাবে বেশ ছোটখাটো।নরম তুলতুলে হাত দুটো শক্ত হাতের মধ্যে নিয়ে নিলো সে।খুব ধীর আওয়াজে গেয়ে উঠলো,

ম্যেয়ে শায়ের তো নেহি মাগার এ হাসিন যাবসে দেখা
ম্যেনে তুজকো মুজকো শায়েরী আ গ্যেয়ি
ম্যেয়ে আশিক তো ন্যেহি মাগার এ হাসিন যাবসে দেখা
ম্যেনে তুজকো মুজকো আশিকি আ গ্যেয়ি

গানের লাইন গুলোর সমাপ্তিতে তোশার মাথাটি নিজের বুকের মধ্যে এনে রাখলো কবীর।মেয়েটির কান্না যেন এতে আরো বেশী বৃদ্ধি পেয়ে গেলো।ফিসফিস করে বলল,

“আমি নাটক করিনা কবীর শাহ।সত্যি মন থেকে বলি সব কথা।সকলে বলে খুব সুন্দর দেখতে আমি।তবে রুপের লোভে পড়েই আমাকে একবার পাওয়ার আশা করে দেখুন।”

শান্ত ধীরে তোশার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল,

“পৃথিবীতে এমন জায়গা খুঁজে বের করো যেখানে তোমার অনুভূতিকে অসম্মান করার মতো কেউ থাকবেনা।”

“এমন জায়গা নেই কবীর শাহ।আপনি এইমাত্র যে গান গাইলেন সেখানে আমার প্রতি অনুভূতি খুঁজে পেয়েছি।এটা কী যথেষ্ট নয় সব ঘৃ ণা কে পিছন ফেলে দেওয়ার।আমি এতো বড় বড় কথা বলতে জানতাম না।ধরে নিন শিখছি।”

কবীরকে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো তোশা।কবীর দুহাত দিয়ে মেয়েটির নরম মুখ উপরে তুলে ধরলো।চোখ দুটো অশ্রুসজল হয়ে আছে।দুহাতের বৃদ্ধা আঙুল দিয়ে মুছে বলল,

“আমার বুকে মাথা দিয়ে ইচ্ছামতো কেঁদে নাও তোশা।কখনো আর এই সুযোগ পাবেনা।যখন আমার চুল সাদা হওয়া শুরু হবে তখন তুমি পূর্ণ যুবতী হবে।বুঝতে পারবে বৃথায় অশ্রু ফেলেছিলে।”

তোশা কবীরের শক্ত বুকে পুনরায় কপাল ঠেকিয়ে বলল,

“এই কান্না কখনো থামবেনা আমার।কখনো না।”

চলবে।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে