মন শহরে তোর আগমন পর্ব -০৯

0
1136

#মন শহরে তোর আগমন
#লেখনীতে – Kazi Meherin Nesa
#পর্ব – ০৯

“বাবার শেষ ইচ্ছে পূরণের জন্যে আমি ওকে বিয়ে করেছিলাম। বাবাকে প্রমিজ ও করেছি যে ওর খেয়াল রাখবো, আমি জানি সুরভী ও একই প্রমিজ করেছিলো বাবাকে যে আমার খেয়াল রাখবে। সেই হিসেবে এখন আমরা দুজনেই নিজেদের দায়িত্ব পালন করছি। এতদিন শুধু ও এক তরফা দায়িত্ব পালন করে গেছে, এখন থেকে আমিও করবো। সুরভী আমার কাছে বাবার দিয়ে যাওয়া একটা বড় রেসপনসিবিলিটি যেটা আমি পালন করছি আর ফিউচারেও করবো। ওর প্রতি দায়িত্ব পালনের ব্যাপারে কোনো ত্রুটি রাখবো না”

কথাগুলো বলে একটু থামলো জাফরান, জিনিয়া অবাক হয়ে শুনছে ভাইয়ের কথা। আমিও নিশ্চুপ হয়ে শুনে যাচ্ছি সব। ভেবেছিলাম উনি আমায় হয়তো মেনে নিয়েছেন, আমি তো কখনো শুধু ওনার কাছে দায়িত্ব হিসেবে থাকতে চাইনি। কিন্তু আজ উনি তো আমার সব ভাবনা ভুল প্রমাণ করে দিয়েছেন ফোনের ও পাশে থাকা লোকটা! জাফরান আবার বলতে শুরু করে

“বাবা আমায় যখন বলেছিলো সুরভী আমার জন্যে পারফেক্ট, কেনো বলেছিলো তখন বুঝিনি কিন্তু এখন বুঝতে পারছি। মে বি বাবা বুঝতে পেরেছিল যে আমাকে যেকোনো পরিস্থিতি থেকে সুরভীই রেসকিউ করতে পারবে। বাবা চলে যাওয়ার পর যদি আমার পাশে সুরভী না থাকতো তাহলে হয়তো এতো তাড়াতাড়ি নরমাল লাইফের ব্যাক করতে পারতাম না। আমাকে ও যে পরিমাণ মেন্টালি সাপোর্ট দিয়েছে তার জন্যেই আমি ট্রমাতাইজড হইনি। বন্ধুর মতো আমার সাথে থেকে যেকোনো প্রব্লেম সলভ করার পুরো চেষ্টা করেছে। সবদিক থেকেই পুরোপুরি সাপোর্ট করেছে মেয়েরা আমাকে। এতোটা সময় ওর সাথে থাকার পর বুঝেছি যে ও আমার জন্যে কতোটা লাকি। আস্তে আস্তে রিয়ালাইজ করছি যে ও আমার নিত্যদিনের অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেছে”

“তাহলে ওর সম্পর্কে জানার জন্যে এতো উতলা হয়ে উঠেছিলি কেনো তুই? আর ও যদি শুধু তোর দায়িত্ব হয় তাহলে তো ওকে ছাড়া থাকতেই পারবি তুই”

“কাম অন জেনি, সি ইজ মাই ওয়াইফ এন্ড অলটাইম বেস্ট ফ্রেন্ড। তো ওর সম্পর্কে আমাকে তো জানতেই হতো। আর হ্যা, ও শ্ধ আমার দায়িত্ব না, আমার প্রয়োজনও। আমার ওকে দরকার, তাই ওকে ছাড়া থাকতে পারবো না”

“জাফরান, তুই নিজেই বলছিস সুরভীকে ছাড়া থাকতে পারবি না, ও তোর প্রয়োজন। একটা মানুষ যখন প্রয়োজন আর অভ্যাসে পরিণত হয় সেটাই তো ভালোবাসা”

“জেনি, আমি সবটা বললাম তোকে তারপরও তুই ভালোবাসার কথা বলছিস? ভালোবাসা একবার আমার জীবনে এসেছিলো, নাতাশার সাথে ব্রেআপের পর আর কারো সাথে সে সম্পর্কে জড়ানোর ইচ্ছে নেই আমার”

“তাতে কি? নাতাশার সাথে তোর যা ছিলো সেসব তো শেষ হয়ে গেছে। ও কথা ভুলে যা, এখন সুরভী আছে তোর জীবনে, নতুন করে ওকে ভালোবেসে দেখ। দেখবি এই ভালোবাসার অনুভূতি পার্মানেন্ট হবে। তোদের সম্পর্ক আরো মজবুত হবে”

“লাভ ইজ নট আ পার্মানেন্ট ফিলিংস, যদি হতো তাহলে আজ আমি আর নাতাশা একসাথেই থাকতাম তাইনা? আমি আর সুরভী এভাবেই ঠিক আছি”

“ভালোবাসা ছাড়া হাসবেন্ড ওয়াইফের মতো এতো সিরিয়াস সম্পর্ক টেকে না জাফরান, সবকিছু এতো সহজ না”

“সহজভাবে দেখলেই সম্পর্ক ও সহজ হয়ে যায়, আরেকটা কথা কি জানিস? সুরভী আমায় ভালোভাবেই বোঝে, ইন ফ্যাক্ট আমি মনে করি আমাদের সম্পর্কের ব্যাপারে ওর ও একিরকম ভাবনা যেমন আমার”

“নিজেই সবকিছু ভেবে নিস না, হতে পারে সুরভীর আর তোর ভাবনার মধ্যে আকাশ পাতাল তফাৎ আছে”

ভীষণ রেগে গেছে জিনিয়া, কিন্তু জাফরানের চিন্তাভাবনা দেখে কিছু বলতেও ইচ্ছে করছে না ওর। জাফরান কিছুটা অবাক হয়ে বলে

“তোর কথা শুনে তো মনে হচ্ছে তুই আমায় জেরা করছিস, আগে কোনোদিন তো এসব প্রশ্ন করিসনি। আজকে হঠাৎ কি হলো?”

উঠে দাড়ালো জিনিয়া

“আসলে আমি একটা ভুল ভাবনার মধ্যে ছিলাম, ভেবেছিলাম তুই সুরভীকে ভালবাসিস তাই মেয়েটার কেয়ার করিস কিন্তু আজ সে ধারনা ভুল প্রমাণ করে দিলি”

জাফরান চুপ রইলো, এতদিন এসব কথা নিজের মধ্যেই রেখেছিল ও। হয়তো কোনোদিন প্রকাশ করতো না যদি জিনিয়া আজ প্রশ্নগুলো করতো

“তাহলে সুরভী আর তোর সম্পর্কের ভিত্তি কি? কি সম্পর্ক তোদের দুজনের মাঝে?”

“বন্ধুত্ব আমাদের সম্পর্কের ভিত্তি। এছাড়া আমাদের সম্পর্কটা প্রয়োজনের, দায়িত্বের সম্পর্ক”

জিনিয়া আর একটা প্রশ্ন করলো না, বেরিয়ে এলো জাফরানের রুম থেকে। এইটুকু শুনেই মাথা গরম হয়ে গেছে ওর। কথার চক্করে জিনিয়া ভুলেই গেছে যে ফোনের ওপাশে সুরভী আছে, ফোন কাটতেই মনে নেই ওর। তাতে কি? আমি নিজেই ফোনটা রেখে দিয়েছি কিছুক্ষণ আগে, কি করবো আর যে কিছু শুনতে ইচ্ছে করছিলো না। দমটা কেমন বন্ধ হয়ে আসছে, কান্না আসছে খুব কিন্তু কান্না তো করতে পারবো না। মা বা সুহানা দেখে ফেললেই হাজার প্রশ্ন করবে। আমার মনের কষ্ট বোঝার জন্যে আল্লাহ ছাড়া যে আর কেউ নেই। আমি শুধুই জাফরানের প্রয়োজন আর দায়িত্ব এছাড়া কিছুই না ভাবলেই কেমন জ্বালা পোড়া হচ্ছে বুকের ভেতর। ফোনটা টেবিলের ওপর রেখে এক গ্লাস পানি খেলাম তারপর বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়লাম চোখ বন্ধ করে। কানে যে এখনও জাফরানের বলা কথাগুলো বাজছে, এতো সহজে কি আর এসব ভোলা সম্ভব!
____________________________

রাত নয়টায় ঘুম ভাঙলো আমার সূহা আর মায়ের ডাকে, সেই সন্ধ্যায় ঘুমিয়ে গেছিলাম। উঠে একটু ফ্রেশ হয়ে এলাম

“কীরে আপু, এই টাইমে ঘুমাচ্ছিলি কেনো? মাথা ব্যাথা করছে নাকি?”

“হ্যা ওই একটু ব্যথা করছিলো তাই শুয়েছিলাম। কখন ঘুমিয়ে গেছি বুঝিনি”

“আগে বলবি তো, বস তুই আমি এখুনি তোকে ম্যাসাজ করে দিচ্ছি সেই আগের মতো। দেখবি ব্যথা থাকলেও চলে যাবে”

বোনের আমার প্রতি কেয়ার দেখে হাসলাম আমি। সুহানা এই টুকটাক ব্যাপারে আমার অনেক যত্ন করে, আগেও করতো। আমি নিচে বসলাম আর সূহা বিছানায় বসে আমাকে হেড ম্যাসাজ দিতে শুরু করলো আস্তে আস্তে।আমার বিছানার পাশে দেখলাম দুটো প্যাকেট রাখা

“এগুলো কিসের প্যাকেট মা?”

“তোর ননদ বাড়িতে এসেছে শুনে তোর বাবা তাদের জন্যে জামাকাপড় এনেছে..এগুলোও ব্যাগে তুলে নিস.. পরে মনে থাকবে না”

“মা, এগুলোর কি দরকার ছিলো আবার? জিনিয়া আপু তো এগুলো দেখলে খুব বকবে আমাকে”

“বললেই হয় নাকি? জাফরান সেদিন আমাদের সবার জন্য জামাকাপড় নিয়ে এসেছিল। আমরা কি শুধু নিয়েই যাবো? আমাদের কি দেবার দায়িত্ব নেই?”

“কিন্তু মা..”

“কোনো কথা না এগুলো নিয়ে নিস!”

“হ্যা আপু নিয়ে নে, আর সব আমি পছন্দ করেছি তো তোর ননদের পছন্দ হবেই দেখে নিস”

আমি চুপ করে চোখ বন্ধ করে বসে রইলাম, সুহা খুব সুন্দর ভাবে হেড ম্যাসাজ দিচ্ছে! আরাম লাগছে আমার। হঠাৎ আমার মা বলে উঠলো

“তোর আর জাফরানের মধ্য সব ঠিকঠাক চলছে তো সুভী?”

“হঠাৎ এই প্রশ্ন কেনো মা? জাফরান নিজেই তো ঘুরে গেলো দুদিন আগে। দেখলেই তো সব নিজের চোখে”

“হুমম, সেটাও ঠিক। কিন্তু কি করবো বল? অস্বাভাবিকভাবে হুট করেই তো তোদের বিয়েটা হয়েছিলো। তারপর কতো কিছু হয়ে গেলো। মায়ের মন তো, মেয়ে কেমন আছে জানতে ইচ্ছে করে রে”

“আমি ভাবিনি যে এতো সহজে জাফরান আর তোর সম্পর্ক এতো স্বাভাবিক হয়ে যাবে। ছেলেটা কতো কেয়ার করে তোর। তোদের দুজনকে একসাথে দেখে চোখদুটো জুড়িয়ে গেছে আমার। দেখবি ছেলেটা তোকে অনেক ভালো রাখবে, দুজনে একসাথে খুব সুখী হবি”

জাফরানের প্রতি আমার মায়ের যে বিশ্বাসটা তৈরি হয়েছে, আমি চাইনা সেটা ভাঙুক! আমার আর জাফরানের পার্সোনাল বিষয়গুলো পরিবারের মধ্যে জানাজানি না হলেই ভালো বিধায় মাকে কিছু বলিনি! সত্যি বলতে এই মুহূর্তে তো আমার অন্য কোনো দিকে খেয়াল নেই। এখনও জাফরানের বলা কথাগুলো মাথায় ঘুরছে। আমাদের সম্পর্কটা তো সারাজীবন থাকবে, মনের মধ্যে একটাই প্রশ্ন জাগছে আমার যে স্ত্রী তো নামমাত্র সম্পর্ক আমার ওনার সাথে, কিন্তু সারাজীবন আমি কি শুধুই জাফরানের দায়িত্ব আর প্রয়োজন হয়ে কাটিয়ে দিতে পারবো? রাতে যথারীতি জাফরান ফোন করলো, আমিও রিসিভ করলাম! একটু কথা বলার পরই জাফরান প্রশ্ন করে বসলো

“তোমার ভয়েস লো শোনাচ্ছে! আর ইউ ওকে?”

আমি স্বাভাবিকভাবেই উত্তর দিলাম

“আসলে একটু আগেই ঘুম থেকে উঠেছি তাই হয়তো”

“একটু আগে ঘুম থেকে উঠলে মানে? এটা ঘুমানোর টাইম নাকি? তুমি ঠিক আছো তো সত্যি করে বলো”

“আমি ঠিক আছি, আসলে বিকেলে একটু বাইরে গেছিলাম। ক্লান্ত লাগছিলো বাড়ি ফিরে তাই ঘুমিয়েছিলাম”

“ওহ আচ্ছা! কিন্তু আজ তোমার কথায় অন্যদিনের মতো জোর পাচ্ছি না কেনো বলোতো? এতক্ষণে তো প্রায় অনেকগুলো প্রশ্ন করে ফেলতে আমার খাওয়া, কাজকর্ম নিয়ে”

আমি হাল্কা হাসলাম, লোকটার মনের মধ্যে এই মুহূর্তে কি চলছে, কি ভেবে যে এই প্রশ্ন করলেন জানিনা। কিন্তু আসলে ওনার মনে কি আছে সেটা যে জেনে গেছি আজ!

“রোজই তো করি একই প্রশ্ন, আপনি নিশ্চয়ই উত্তর দিতে দিতে হাপিয়ে উঠেছেন। তাই ভাবলাম আজ থাক”

“এভাবে বলছো কেনো? আমি তো কোনো অবজেকশন করিনি, বা বলিনি যে তুমি আর আমাকে এসব জিজ্ঞাসা করো না”

“সব কি আর মুখে বলতে হয় জাফরান? আমিও তো বুঝি! তাছাড়া রোজ কি করেন সে তো আমি জানি, নতুন করে আর জিজ্ঞাসা করে লাভ কি আছে?”

“এতে আবার লাভ লসের কথা এলো কোত্থেকে সুরভী? এটা তো একটা ডেইলি চেকআপের মতো তাইনা? তোমার সাথে তো এমনিতেও সব শেয়ার করি আমি”

“হুমম, তবুও আজ ভেবে দেখলাম এগুলো জিজ্ঞাসা করা বোকামি ছাড়া কিছুনা! রোজ আপনি কি করেন সে তো আর আমার অজানা নয়। ঠিক করেছি এখন থেকে রোজ এতো শেয়ার করতে হবে না। মাঝে মাঝে না হয় করবো তখন উত্তর দেবেন, শেয়ার করবেন”

জাফরান কিছুটা রাগাম্বিত স্বরে বললো

“অহেতুক কথাবার্তা বলতে শুরু করেছ দেখছি! শোনো আমাকে রোজই একি প্রশ্ন করবে তুমি, আমি উত্তর ও দেবো! আমি যদি উত্তর দিতে গিয়ে হাপিয়ে না উঠি, তাহলে তোমার ক্ষেত্রে নিশ্চয়ই প্রশ্ন করা খুব একটা কঠিন হবেনা রাইট?”

“হুমম”

“আচ্ছা বাড়ি ফিরতে চাও কবে বলো! তুমি একবারও কিন্তু বাড়ি ফেরার কথা বললে না! আবার পার্মানেন্টলি থাকার ধান্ধা করছো নাকি?”

“ভাবছি তাই করবো! থেকেই যাই এখানে। বেশ সুবিধাতেই তো আছি, তাছাড়া আপনাকে তো একটুও মিস করছি না। থেকেই যাই বলুন?”

“আর ইউ সিরিয়াস?”

“হ্যা, ফিরতে চাইনা আমি আপনার কাছে! নিজেই নিজের মতো জীবন সাজিয়ে নিন না”

কয়েক সেকেন্ড উনি চুপ রইলেন তারপর মারাত্মক শান্ত কণ্ঠে বললেন

“এরকম মজা আমার পছন্দ নয়! তোমাকে এখানেই ফিরতে হবে, তুমি না ফিরলে আমি জোর করে নিয়ে আসবো তোমায় মনে রেখো!”

কতোটা অধিকারবোধ মিশে ছিলো ওনার কথাগুলোর মাঝে বোঝাতে পারবো না, হৃদয় জুড়িয়ে গেছিলো আমার! লোকটার মাঝে কি আছে জানিনা। কখনো উনি আমায় নিজের কথার মাধ্যমে কষ্ট দেন আবার কখনো মুগ্ধ করে দেন! কিন্তু উনি যাই বলুক, আমার মস্তিষ্কের মধ্যে যে গেঁথে গেছে সবটা। আমাদের সম্পর্কটা দায়িত্ব আর প্রয়োজনের। কোনোদিন যদি দুটোই শেষ হয়ে যায় তখন কি উনি আমায় ছেড়ে দেবেন? ভুলে যাবেন আমায়? এমন অজানা আশঙ্কায় বুক কেপে উঠলো আমার!
___________________________

আমার খালামণি মানে রুহান ভাইয়ার আম্মু এসেছে বাড়িতে সাথে রুহান ভাইয়াও! মা দাওয়াত করেছে তার বোনকে আর কি! কিন্তু মনমেজাজ খারাপ ছিলো ভীষণ, কারণ জাফরানের কথাগুলো মাথা থেকে বের করতে পারিনি এখনও! সেটা আবার রুহান ভাইয়া বুঝেছে, তো সে আমাকে বাড়ির পাশেই একটা মেলা হচ্ছে সেখানে নিয়ে গেলো! ওখানে একটু ঘুরাঘুরি করে সাময়িক সময়ের জন্য মেজাজটা একটু ঠাণ্ডা হয়েছিলো আমার

“কি হয়েছে সুভী? অনেক ডিস্টার্ব মনে হচ্ছে”

“কিছুনা”

“কিছু তো একটা হয়েছে নাহলে তোর মতো এতো জলি টাইপের মেয়ে এরকম গুম মেরে যেতেই পারেনা! জাফরানের সাথে ঝগড়া হয়েছে?”

আমি এবার হাসিমুখে জবাব দিলাম

“না তো, উনি না সব হাসবেন্ডদের মতো ছোটো বিষয়ে একদম ঝগড়া করতে পারেন না। উল্টে আমি কিছু বললে চুপ করে শোনেন!”

রুহান ভাইয়া আমার কথা শুনে খানিক চুপ রইলেন। আমরা দুজনেই হাঁটছিলাম, হুট করে ভাইয়া আমায় বললো

“একটা কথা বলবো?”

“হ্যা বলো না”

“জানি অনেকটা দেরি হয়ে গেছে তবুও একটা কথা জানাতে চাই তোকে সুভী, অনেকদিন ধরে মনের মধ্যে লুকিয়ে রেখেছি! আর পারছি না”

“কি কথা ভাইয়া?”

দাড়িয়ে গেলো রুহান ভাইয়া, আমিও দাড়িয়ে পড়লাম। তার মুখ দেখে মনে হচ্ছে সিরিয়াস কিছু বলবে!

“লোকে ঠিকই বলে জানিস? কিছু বিষয়ে দেরি করতে হয় নেই নাহলে মূল্যবান কিছু হারিয়ে ফেলতে হয় যেমন আমি হারিয়ে ফেললাম তোকে”

চমকে উঠলাম রুহান ভাইয়ার কথা শুনে, বুঝতে পারছিলাম না শুরুতে যে উনি কি বলতে চাইছেন। মলিন হেসে রুহান ভাইয়া বললো

“সুভী, আমি তোকে গত ছয় বছর ধরে ভালোবাসি। ভেবেছিলাম আমার একটা চাকরি হলেই তোকে আমার মনের কথা জানাবো, তোর বাড়িতে জানাবো কিন্তু তার আগেই..”

“কিন্তু ভাইয়া তুমি তো কোনদিন..”

“তুই যে কোনোদিন এভাবে হারিয়ে যাবি ভাবিনি রে সুভী, তাহলে তোকে হারাতে দিতাম না। যদি আগেই জানিয়ে দিতাম তোকে সবটা, হয়তো তাহলে আজ জাফরানের জায়গায় আমি থাকতাম তোর পাশে”

অবাক হলাম ওনার কথায়, সত্যি বলতে আমার ধারণা ছিলো না যে রুহান ভাইয়া আমাকে পছন্দ করতো বা ভালোবাসতো, কোনোদিন আমায় বুঝতেও দেয়নি সেভাবে! কিন্তু আজ যখন জানলাম তখন কষ্ট হচ্ছিলো ভাইয়ার জন্যে! একটু হলেও আমি ওনার কষ্টটা অনুভব করতে পারছিলাম। ভাইয়া আমায় ভালোবেসেও হারিয়ে ফেললো, আর আমি হয়তো যাকে ভালোবাসি সে কোনোদিন আমায় ভালোবাসবে না! নিয়তি এতো নিষ্ঠুর হয় কেনো কে জানে!
____________________________

জাফরান নিজের কেবিনে কাজে ব্যস্ত ছিলো, সেক্রেটারিকে কিছু ব্যাপারে ইনস্ট্রাকশন দিচ্ছিল তখনই নাতাশার আগমন ঘটে! সেক্রেটারি যেহেতু ইনস্ট্রাকশন পেয়ে গেছে তো উনি চলে যান। চেয়ার থেকে উঠে সামনে এসে দাড়ায় জাফরান

“হেই নাতাশা! তুই আমার অফিসে?”

“এখান দিয়েই যাচ্ছিলাম, তাই তোকে সারপ্রাইজ দিতে চলে এলাম”

নাতাশা জড়িয়ে ধরার জন্যে উদ্যত হতেই বাধা দেয় জাফরান, কিছুটা দূরত্ব বজায় রেখে দাড়ায়! ওর এহেন কাণ্ডে অবাক হয় নাতাশা

“বিহেভ ইওরসেলফ নাতাশা”

“কি হলো তোর? সরে গেলি কেনো?”

“ভুলে যাস না, আমি এখন ম্যারেড সো আমি তোকে হাগ করার জন্য অ্যালাউ করবো না”

“বাট উই আর ফ্রেন্ডস! আর বন্ধুদের মধ্যে তো এটা কমন! হতেই পারে। তুই এতো সিরিয়াস হচ্ছিস কেনো এইটুকু ব্যাপার নিয়ে?”

“ইটস নট ওকে নাতাশা, এটা কানাডা না যে তুই আমায় হাগ করলে কেউ কিছু মনে করবে না! এই দেশের ব্যাপারটা আলাদা। তাছাড়া আমি ম্যারেড! একটা অন্য মেয়েকে আমি আমায় জড়িয়ে ধরতে দিতে পারিনা”

“আমি অন্য মেয়ে জাফরান?”

” ডোন্ট গেট মি রং! তুই আমার ফ্রেন্ড আছিস থাকবি! কিন্তু আমরা হাগ ছাড়াও কথা বলতে পারি। তাছাড়া আমি চাইনা কোনো ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হোক!”

অসন্তুষ্ট হলো নাতাশা। আজ জাফরান ম্যারেড বলে ওকে জড়িয়ে ধরা থেকে বাধা দিলো এটা ভাবতেই রাগ হচ্ছে নাতাশার! একেই তো জেদ চেপে বসেছে ওর মাথায় জাফরানকে পাওয়ার তার ওপর এমন কথা শুনে আরো মাথা গরম হয়ে গেলো ওর! কিন্তু নাতাশার রাগটা যে জাফরানের জন্যে না, ওর রাগ হচ্ছে সুরভীর ওপর! আপাতত স্বাভাবিকই রইলো নাতাশা। জাফরান নিজের জায়গায় বসে পড়লো, নাতাশা ওর সামনের চেয়ারে বসলো

“বল এবার, হঠাৎ তুই এখানে কি করছিস? কোনো দরকার ছিলো নাকি?”

“আগে তুই এটা বল আজ কি খুব বিজি আছিস?”

“অতোটাও না, কিন্তু কেনো?”

“একচুয়ালী এখানে আসার পর তোর সাথে সেভাবে টাইম স্পেন্ড করার স্কোপ পাইনি, সবার সাথেই মোটামুটি সময় কাটিয়েছি শুধু তুই ছাড়া! তাই ভাবছিলাম আজ একসাথে লাঞ্চ করলে কেমন হয়?”

“লাঞ্চ তো পসিবল হবেনা নাতাশা! হ্যা আমি বিজি নই এখন তবে অফিস থেকে বেরোব না। আজ একটু ইম্পর্ট্যান্ট কাজ আছে, তার জন্যে আমার দরকার পড়তে পারে”

“ওহ! দ্যান হাউ অ্যাবাউট ইভেনিং স্ন্যাকস ? তাতে তো তোর প্রব্লেম নেই তাইনা?”

“ওকে! সন্ধ্যায় তাহলে চলে আসিস! আমরা না হয় একটু আড্ডা দেবো!”

নাতাশা অনেক খুশি হয়, আজ ও ঠিক করেছে নিজেদের ভাঙ্গা সম্পর্ক জোড়া লাগানোর প্রস্তাব রাখবে জাফরানের সামনে! সুরভীর সাথে যে জাফরানের একটা সম্পর্ক আছে সেটা যেনো বাদই দিয়ে দিয়েছে নাতাশা, ওর শুধু জাফরানের সাথে লেনাদেনা। জাফরানকে না জানিয়েই হুট করে একাই বাড়ি ফিরেছি আমি! সকালে রওনা দিয়েছিলাম, আসতে আসতে দুপুর হয়ে গেলো। আমি বাড়িতে ঢুকতেই জিনিয়া আপুর চার বছরের মেয়ে রুমি ছুটে এসে আমার কোলে উঠলো। পিচ্ছিটা অনেক ভালোবাসে আমাকে

“কি মজা, মামী চলে এসেছে! কিন্তু মামা বললো তুমি আরো পরে আসবে?”

আমি পিচ্চির গালে চুমু দিয়ে বললাম

“হ্যা আসার কথা তো কয়েকদিন পরে ছিলো কিন্তু আজ এসে আমার রুমি মাম্মামকে সারপ্রাইজ দিয়ে দিলাম!”

রুমিও আমার গলা জড়িয়ে চুমু দিলো আমায়, পরে কোল থেকে নামিয়ে ওর জন্যে আনা চকোলেট চিপসগুলো দিয়ে দিলাম। জিনিয়া আপুও আমাকে দেখে অবাক হয়েছে!

“সুরভী, তুমি আজই চলে এলে?”

“হ্যা আপু, ছুটির কয়েকদিন তো হলোই আর কত? তাই ভাবলাম আবার ডিউটিতে ফিরি”

“ডিউটি মানে?”

জিনিয়া আপু আমার কথা বুঝতে পারেনি, মুচকি হাসলাম আমি!

“জাফরান আমাকে আরো দুদিন পর আনতে যেতো কিন্তু আমি আর ফাঁকি দিতে পারছিলাম না তাই নিজেই ফিরে এলাম প্রয়োজন আর দায়িত্বের ডিউটি পালন করতে!”

চমকে উঠলো জিনিয়া, সুরভীর কথায় বুঝতে আর বাকি নেই যে সেদিন ফোনে জাফরানের সব কথাই শুনেছিলো

“সুরভী তুমি সেদিন সব শুনে ফেলেছো?”

“শুনেছিলাম বলেই তোমার ভাইয়ের মনের খবর জানতে পেরেছি আপু, নাহলে হয়তো মিথ্যে আশায় বুক বাধটাম আমি। আরো দেরিতে যদি মন ভাঙতো তাহলে নিজেকে সামলানো কষ্ট হয়ে যেতো! ভালোই হয়েছে যে অল্পের ওপর দিয়ে গেছে! নিজেকে সামলে নিয়েছি আমি”

চলবে….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে