মন শহরে তোর আগমন পর্ব -১৬

0
1300

#মন শহরে তোর আগমন
#লেখনীতে – Kazi Meherin Nesa
#পর্ব – ১৬

প্রথমবার নিজে থেকে কিস করলাম আর উনি এমন কথা বললেন? অনেকটা খারাপ লাগলো আমার। চুপটি করে সরে আসতে যাচ্ছিলাম তখনই হ্যাঁচকা টান দিয়ে আমায় নিজের কোলের ওপর বসিয়ে নিলেন উনি। দু হাতে কোমড় জড়িয়ে ধরে গলায় নাক ঘষে বললেন

“প্রথমবার কিস কেউ এইভাবে কিস করে? করার হলে ভালোভাবে করবে”

শরীর শিউরে উঠলো ওনার স্পর্শে, লোকটা কোনোদিন আমায় নিজের এতোটা কাছে টানেননি! জানিনা আজ কি হলো, তবে ওনার এহেন আচরণে নিশ্চিত হচ্ছি যে রুহান ভাইয়ার কথাই সত্যি, আমাকে উনিও ভালোবাসেন!

“আমি ভাবলাম আপনার ভালো লাগেনি”

“ভালো তো তখন লাগেনি যখন রুহানের জন্যে তুমি আমার সাথে তর্ক করছিলে। সত্যিই একটুও ভালো লাগেনি”

জাফরান কোলে বসানো অবস্থাতেই আমার বুকে মাথা ঠেকিয়ে সন্দেহ মিশ্রিত কণ্ঠে বলে ওঠেন

“আমার কেনো যেনো মনে হয় রুহানের তোমার প্রতি ইন্টারেস্টটা একটু বেশিই, সব জেনে বসে আছে তোমার ব্যাপারে। আর মাঝে মাঝে সেই সুযোগ নিয়ে ইমপ্রেস করার চেষ্টা করে তোমায়”

মুখ টিপে হাসলাম আমি। সারাদিন পেরিয়ে গেলো অথচ এখনও উনি সেই রুহান ভাইয়ার প্রসঙ্গেই আটকে আছেন

“আপনি এসব নিয়ে একটু বেশিই ভাবছেন, ভাইয়া তো আগে থেকেই আমার পছন্দের কতকিছু আনতো”

উনি মুখ তুলে তাকালেন আমার দিকে, চোখ দুটো গরম করে বলে উঠলেন

“আগের আর এখনকার ব্যাপার আলাদা সুরভী, রুহানের মাথায় রাখা উচিত তুমি এখন ম্যারেড আর একটা ম্যারেড মেয়ের জন্যে অন্য একটা ছেলে ফুল, চকোলেট এসব আনতে পারে না। হোক যতোই সে তোমার ফ্যাভরেট ব্রাদার”

“কিন্তু জাফরান”

“তুমি ওর হয়ে একদম সাফাই গাইবে না সুরভী, আই ডোন্ট লাইক দিস”

চুপ করে গেলাম আমি, বাব্বাহ! এতো রাগ মনের মধ্যে পুষে রেখেছিলেন তাহলে? একে একে ওনার করা সকল অভিযোগ শুনছি আর হাসছি। লোকটা ভাঙবে তবুও মচকাবে না, এতকিছুর পরও এটা স্বীকার করছেনা যে উনি ভাইয়াকে দেখলে উনি জেলাস ফিল করেন। মুখ তুলে তাকালেন উনি আমার দিকে, বাচ্চাদের মতো মুখ গোমড়া করে বলে উঠলেন

“এই শোনো, এরপর থেকে তোমার রুহান ভাইয়া কেনো, আর কোনো ছেলের সাথে যেনো কথা বলতে না দেখি তোমায় নাহলে অনেক বকা খাবে আমার থেকে”

“আপনি কি জানেন এই মুহূর্তে একটা পাঁচ বছরের বাচ্চার মতো আচরণ করছেন আপনি?”

“বিরক্ত লাগছে! অবাক হচ্ছো? তবুও সহ্য করতে হবে। তোমাকেই আমার সব জ্বালাতন, অভিযোগ, রাগ ,শাস্তি সহ্য করতে হবে। পালাতে পারবে তুমি কখনো এসব থেকে। যেভাবেই হোক, পরিস্থিতি যেমনি হোক তুমি আমার সাথেই থাকবে!”

প্রথমবার মনে হচ্ছে হাসবেন্ড হিসেবে উনি আমায় আদেশ করছেন। অধিকারবোধ এর ছোঁয়া বিদ্যমান ওনার কথাগুলোর মাঝে। মুচকি হেসে দু হাতে আকড়ে ধরলাম ওনাকে

“থাক থাক! অনেক রাগ করা হয়েছে। এবার একটু শান্ত হন, রুহান ভাইয়াকে আপনার বলা কথাগুলোই কপি পেস্ট করে দেবো না হয়”

ছোট্ট একটা হাসি দিলো জাফরান। কিছু সময় ঐভাবে থাকার পর নরম কণ্ঠে আমায় প্রশ্ন করে উঠলেন

“সুরভী, কোনোদিন ছেড়ে যাবেনা তো আমায়? এভাবেই আমার সাথে থাকবে সবসময়!”

একদিন না একদিন ওনার তরফ থেকে এমন প্রশ্ন আসবে, জানতাম। উত্তর আমার কাছে তৈরিও আছে, কিন্তু এই সুযোগে আমার মাথায় একটা বুদ্ধি এলো!

“একটা প্রশ্ন করার আছে আমার, যদি আপনি ঠিকঠিক জবাব দেন তাহলে আমি আপনাকে ছেড়ে যাবো না”

“কি প্রশ্ন?”

আমি ওনার কোল থেকে উঠে দাড়ালাম। উনি আগ্রহ ভরা নজরে আমার দিকে চেয়ে আছেন। দু হাত ভাঁজ করে দাড়িয়ে শক্ত গলায় প্রশ্ন করে উঠলাম

“আমাকে অন্য কোনো ছেলের সাথে দেখলে আপনি জেলাস ফিল করেন তাইনা?”

সঙ্গে সঙ্গে কপালে বিরক্তির রেখা ফুটে উঠলো ওনার

“তুমি আবার..”

“একদম টালবাহানা করবেন না বলে দিলাম, আজকে আপনাকে স্বীকার করতেই হবে নাহলে কালকেই আমি বাবার বাসায় চলে যাবো”

মুখ বাঁকিয়ে বলেই ফেললাম কথাটা, আজ জাফরানের মুখ থেকে শুনেই ছাড়বো জেলাসির কথাটা! কোনো ছাড়াছাড়ি নেই। উনি সরু চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বলে উঠলেন

“ব্ল্যাকমেইল করছো আমায়! তোমার সাহস দেখে অবাক হয়ে যাচ্ছি সুরভী!”

“ধরে নিন তাই! কিন্তু আজ আমি জেনেই ছাড়বো! আপনাকে বলতেই হবে”

কিয়ৎক্ষণ আমার দিকে দৃষ্টি ক্ষেপণ শেষে উঠে দাড়ালেন জাফরান, একটানে আমাকে নিজের কাছে টেনে ধরে বললেন

“নিজের বউকে অন্য ছেলের জন্যে এতো পরোয়া করতে দেখলে জেলাস ফিল করাটা কি স্বাভাবিক নয়? হ্যা রুহানের সাথে তোমায় দেখে জেলাস ফিল করেছি আমি। স্বীকার করাটা প্রয়োজন মনে করিনি”

মুচকি হাসলাম আমি, যাক অবশেষে স্বীকার করলেন তাহলে মহাশয়!

“আপনি স্বীকার না করলেও আমি ঠিক বুঝেছি, শুধু আপনার মুখে শুনতে চাইছিলাম কথাটা”

“তুমি ছাড়া আর কে বুঝবে আমায়?”

আজ জাফরানের কথা শুনে, আচরণ দেখে সত্যি নিজেকে বউ বউ লাগছে। বিয়ের পর এই প্রথম মনে হচ্ছে হ্যা আমি সত্যিই

“এবার বলো, ছেড়ে যাবে না তো আমাকে কখনো?”

স্বযত্নে ওনার হাতদুটো নিজের হাতের মুঠোয় ধরলাম! আশ্বাস দিয়ে বলে উঠলাম

“আমি ওয়াদা পালনে বিশ্বাসী জাফরান। একজন বৌমা হিসেবে বাবাকে দেওয়া কথা রাখবো, আর স্ত্রী হিসেবে সারাজীবন পাশে থাকবো। আর সেসব শুধু দায়িত্বের জন্যে নয়। ধরে নিন কারণটা আরো গভীর, গুরুতর কিছু”

জাফরান কিছু বললেন না, হুট করেই জড়িয়ে ধরলেন আমায়। হয়তো বুঝেছেন আমি কি বলতে চাইছি, আমিও চাই উনি যেনো আমার না বলা কথাগুলো নিজে থেকেই বুঝে যান। আমাদের সম্পর্ক এতোটা মজবুত হোক যেখানে একে অপরের কাছে অপ্রকাশিত জিনিসও বুঝতে পারবো, একে অপরের মনের কথা জানতে পারবো
_______________________________

পাইপ দিয়ে গার্ডেনে গাছে পানি দিচ্ছিলাম। আমার লাগানো গোলাপ গাছটায় খুব সুন্দর ফুল এসেছে। এই বাড়িতে প্রথম আসার পর এই গোলাপ গাছটা নিজের হাতে লাগিয়েছিলাম আমি! তখনই জাফরান এসে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরলেন আমায়

“কি করছো?”

“ফুল গাছে পানি দিচ্ছি, এই দেখুন জাফরান। এই গাছে কতো সুন্দর গোলাপ ফুটেছে!”

“ওহ ওয়াও, আমার তো সুবিধা হলো তাহলে”

ভ্রু কুঁচকে নিলাম আমি

“ফুল ফোটায় আপনার কি সুবিধা হলো শুনি?”

“এখন তোমাকে এখান থেকেই গোলাপ দিতে পারবো, বাইরে থেকে কিনে আনতে হবে না”

“একদম না, এই ফুল ছেড়ার কথা ভুলেও ভাববেন না। আমায় গোলাপ দোকান থেকে কিনে এনে দেবেন”

হাসলো জাফরান, তারপর আমায় ছেড়ে পানির পাইপ নিতে উদ্যত হলো

“দাও তো, আমি পানি দিচ্ছি”

“আপনাকে করতে হবে না। আমি করছি তো”

“তুমি তো রোজ দাও, আজ আমি দেই। তোমায় একটু হেল্প করি। দাও”

জোর করেই আমার হাত থেকে পাইপ নিলেন উনি। প্রতিদিন আমাকে টুকটাক কাজে বেশ সাহায্য করেন জাফরান। হেল্পার হাসবেন্ড পাওয়াটা সৌভাগ্যের ব্যাপার! মনে মনে জাফরানের প্রশংসায় মত্ত ছিলাম আমি, হুট করেই পানির পাইপ গাছের দিক থেকে সরিয়ে আমার দিকে ধরলো জাফরান। যার দরুন পুরো ভিজে গেলাম

“একি! আমাকে ভিজিয়ে দিলেন কেনো!”

উনি হেসে বললেন

“ইচ্ছে হলো তাই”

“এটা কিন্তু ঠিক হলো না জাফরান, ঠিক করলেন না”

ভিজে চুপসে গেছি আমি, চুলগুলো মুখের ওপর থেকে সরিয়ে নাক ফুলিয়ে তাকালাম জাফরানের দিকে! জাফরান পা থেকে মাথা অব্দি আমায় স্ক্যান করে বললেন

“ওয়াও! ইউ আর লুকিং সো হট”

কথাটা বলেই চোখ মারলেন উনি। ওনার বেহায়া মার্কা কথায় হা হয়ে গেলাম আমি! এরপর নিজেকে সামলে কোমরে ওড়নাটা বেধে নিলাম

“দাড়ান আপনি। আজ বুঝিয়ে দেবো আপনাকে যে কতটা হট আমি!”

পানির পাইপ ছেড়ে দিয়ে উনি ছুটলেন, আমিও ছাড়বো নাকি ওনাকে? ভিজিয়ে দিয়েই ছাড়বো!
___________________________________

আজ আমার স্কুলের পুনর্মিলনী অনুষ্ঠান, সোজা বাড়ি থেকে এখানে এসেছি। সবথেকে বড় কথা জাফরানও আমার সাথে এসেছে। ইদানিং মনে হচ্ছে লোকটা একরকম চিপকে থাকতে চাইছে আমার সাথে। যাই হোক স্কুলে আসার পর অনেক পুরাতন সহপাঠীদের দেখা পেলাম, টিচারদের সাথে মিট করলাম। ক্লাসরুম গুলো ঘুরে ঘুরে দেখলাম, অনেকটা একরকম আছে। মনে হচ্ছিলো যেনো সেই ছোটবেলায় সময়ে ফিরে এসেছি আবার। আমি আর কেয়া মিলে আমাদের ক্লাসরুমে এসেছি, সেই পুরোনো ব্ল্যাকবোর্ডটাই আছে, আমি গিয়ে প্রথম সারির তৃতীয় বেঞ্চটায় গিয়ে বসে পড়লাম। বেঞ্চগুলোও আগের মতোই সারি করা। কেয়া উত্তেজিত হয়ে বলে উঠলো

“আমার মনে হচ্ছে একটা ব্যাগ ঝুলিয়ে এলেই পুরো স্কুল লাইফ ফিরে পেতাম তাইনা রে?”

“হ্যা রে কেয়া, মনে হচ্ছে পুরনো দিনগুলো আবার ফিরে পেয়েছি। মনে আছে তোর আমরা দুজন এই সিটে বসতাম?”

“মনে থাকবে না আবার? কিন্তু বেঞ্চগুলো বদলে গেছে রে। নাহলে আমাদের দুজনের নাম লিখা থাকতো”

তখনই হুড়মুড় করে জাফরান এলো, আমায় দেখে কপাল কুচকে বললো

“তুমি এখানে? আর আমি তোমাকে কোন কোন রুমে খুঁজে এলাম। আমাকে একবার বলবে না এখানে এসেছো?”

“আমি তো স্কুল ঘুরে দেখছি। পুরনো স্মৃতিচারণ করছি সেখানে আপনি আমার সাথে সাথে এসে কি করবেন?”

“কি করবো মানে? এতো বড় স্কুল, এতো বড় মাঠ। সামনেই রাস্তা। লাস্ট পনেরো মিনিট যাবত তোমায় দেখছি না। চিন্তা হবেনা?

তাজ্জব বনে গেলাম ওনার কথায়! দিনদিন যেনো ওনার পাগলামি সব সীমা অতিক্রম করে ফেলছে!

“তাতে কি? আমি বাচ্চা নাকি যে হারিয়ে যাবো?”

“যেতেই পারো, এখন তুমি সত্যিই হারিয়ে গেলে খুঁজে এনে কে দেবে?”

হা হয়ে তাকিয়েছি আছি ওনার দিকে, আমি নাকি হারিয়ে যাবো। মানছি জাফরান আমায় নিয়ে একটু বেশিই ভাবে তাই বলে বাচ্চাদের মতো হারিয়ে যাবো এটা বলা বেশি হয়ে গেলো না? কেয়া হো হো করে হেসে উঠলো

“একি রে সুভী! জাফরান ভাইয়া তো তোকে পুরো বাচ্চাদের মতো ট্রিট করছে। মনে হচ্ছে তুই তার বাচ্চা বউ”

কেয়ার মশকরা শুনে ঠোঁট উল্টে জাফরানের দিকে তাকালাম, লোকটার কোনো হেলদোল নেই। উল্টে মনে হচ্ছে কেয়ার কথা শুনে প্রাউড ফিল করছে”

“আর ভাইয়া, আপনি তো দেখছি বউকে চোখে হারাচ্ছেন! আপনার মতো বউ পাগলা জামাই থাকলে বউ হারিয়ে যাবেনা, নিশ্চিন্ত থাকুন”

“নিশ্চিন্ত থাকতে চাই বলেই তো তোমার বান্ধবীর সাথে সাথে থাকছি!”

একটু বাদে জাফরান কেয়া দুজনেই হাসতে শুরু করলো, আমি রেগে জাফরানকে বললাম

“এবার হলো তো শান্তি? জাফরান, দেখুন এখন আপনার গার্ডের জন্যে আমাকে নিয়ে মজা করছে। এখন কেয়া করছে পরে সবাই করবে”

“আরে, তোমার তো প্রাউড ফিল করা উচিত যে তোমার হাসবেন্ড সব জায়গায় তোমাকে কোম্পানি দিতে চলে আসে। নাহলে খোজ নিয়ে দেখো গিয়ে হাসবেন্ড রা খোজ ও রাখে না যে তাদের ওয়াইফ কোথায় গেছে”

“তাই বলে প্রাইমারীর বাচ্চাদের মতো এমন করবেন! আমার অন্যান্য বান্ধবীরা মনে হয় এতক্ষণে মজা করতে শুরু করে দিয়েছে এসব দেখে”

জাফরান আমার গাল টেনে দিয়ে মিষ্টি হেসে বললো

“বাকিদের কথা বাদ দাও তো, তুমি শুধু আমার কথা ভাবো”

“কিন্তু ভাইয়া আমার একটা প্রশ্ন আছে, তুমি তোমার বউকে এতো গার্ড দিয়ে রাখো কেনো বলোতো? ওর তো কোনো লাভ কেস ও নেই, কোনো ছেলেও ওর পেছনে পড়ে নেই”

“শালী সাহেবা, তুমি যদি আমার জায়গায় থাকতে তাহলে বুঝতে কেনো ওর সাথে সাথে থাকি। তোমার বান্ধবীর ওপর পুরো বিশ্বাস আছে আমার, তবে ওর সাথে থাকলে নিশ্চিন্ত থাকি। ও ঠিক থাকাটা অনেক ম্যাটার করে আমার কাছে”

সত্যিই জাফরানের আমাকে নিয়ে চিন্তাটা একটু বেশিই। বিশেষ কোনো কাজ না থাকলে আমার সাথে সাথেই থাকে লোকটা। আমিও সেফ ফিল করি। যতো বেশি সময় আমরা একসাথে কাটাই, ততোই ওনার অপ্রকাশিত গভীর ভালোবাসাটা ও উপলব্ধি করতে পারি! মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে একটু ওনার মুখে “ভালোবাসি” কথাটা শুনতে। পরমুহূর্তেই ভাবি প্রকাশিত ভালোবাসা তো সবারই হয়, আমাদেরটা অপ্রকাশিত থাকলে ক্ষতি কি?
______________________________

দু সপ্তাহ আগে আমার এম.বি.এ এর রেজাল্ট বেরিয়েছে। যতটা খারাপ ভেবেছিলাম ততটা খারাপ হয়নি। আলহামদুলিল্লাহ রেজাল্ট ভালোই এসেছে! জাফরান ও খুশি! এবার আমি ভেবেছি কিছু করবো, আমার শিক্ষকতা করার স্বপ্নটা পূরণ করবো এবার! তবে তার আগে জাফরানের সাথে আলোচনা করতে হবে। চলে এলাম ড্রইং রুমে, জাফরান বসেছিলো ড্রইং রুমে, ম্যাগাজিন পড়ছিলো তখন আমি খুশি খুশি মনে গিয়ে দাড়ালাম ওর সামনে

“জাফরান, আপনি আমায় জিজ্ঞাসা করেছিলেন না এক্সামের পর যে আমার কি করার প্ল্যান আছে ভবিষ্যতে? সেদিন আমার কাছে কোনো উত্তর ছিলো না, কিন্তু আজ আছে। আমি জব করতে চাই”

ম্যাগাজিন থেকে চোখ তুলে আমার দিকে তাকালো জাফরান, ছোট্ট হাসি দিয়ে বললো

“গুড ডিসিশন, আমিও চাইছিলাম তুমি বেকার ঘরে বসে না থেকে কিছু একটা করো, তো কেমন জব করতে চাও?”

আমি সার্কুলারের পেপার ধরে মার্কার দিয়ে মার্ক করতে করতে বললাম

“এইযে সার্কুলার দেখেছি, তার মধ্যে থেকে তিনটা সিলেক্ট করেছি। ইন্টারভিউ দিলে একটা না একটাতে ঠিক পেয়েই যাবো”

“তাই নাকি? দেখি কি চুজ করেছো তুমি”

জাফরান সার্কুলারের পেপার কাটিং নিয়ে দেখতে শুরু করলো, আমি ওনার পাশে বসলাম। কয়েক সেকেন্ড যেতে না যেতেই একরাশ বিস্ময় নিয়ে তাকালেন আমার দিকে

“এটা কি! প্রফেসর হতে চাও তুমি?

“হ্যা, কেনো জানেন? কলেজে আমাদের অ্যাকাউন্টিং এর প্রফেসর ছিলো সে অনেক অনেক মোটিভেটেড ছিলো। সবাইকে কতো ফ্রেন্ডলী ট্রিট করতো, আর সে ছিলো আমার ফ্যাভরেট প্রফেসর। শেখানোর ইচ্ছেটা বরাবরই আমার একটু বেশি, আর সেটা যদি হয় শিক্ষা বিষয়ক তাহলে তো আরো ভালো। এখন সেই সুযোগ আছে আর সময়ও। সবটা ভেবেই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমি”

ছোটো ছোটো চোখ করে জাফরান আমার দিকে দেখছে, আমার কথাটা যে ওনার পছন্দ হয়নি বেশ বুঝতে পারছি

“আপনি এভাবে দেখছেন কেনো? আমি কিন্তু জব করবোই, আপনি আমাকে না করতে পারবেন না”

উনি মুখ গোমড়া করে পেপার কাটিং রাখলেন টেবিলের ওপর

“আরো কতো রকমের জব আছে সুরভী, সেগুলো থেকে কিছু চুজ করো, প্রফেসর কেনো? তারপর দেখা যাবে রোজ রোজ স্টুডেন্টদের সাথে রাগারাগি করে কলেজ থেকে মাথা গরম করে ফিরবে আর তার রিয়েকশন হবে বাড়িতে”

মাঝে মাঝে উনি এমন বাচ্চাদের মতো কথা বলে ফেলেন যে হাসবো না কাঁদব বুঝে উঠতে পারিনা

“এমন কিছু হবেনা, আমি মস্তিষ্ক বড়ই শান্ত। সহজে রাগটা আসে না তাই আপনাকে এই চিন্তা করতে হবে না, তাছাড়া কলেজে অতো রাগারাগি ও করতে হয় না। বাচ্চারা তো বড় হয়ে যায় তখন অনেকটা তাইনা?”

উনি বিরক্তিপূর্ন মুখভঙ্গি করলেন, তারপর কিছু সময় নিয়ে কোনো একটা ব্যাপারে ভাবলেন

“আচ্ছা সুরভী, আমি যদি তোমাকে একটা অফার দেই অ্যাকসেপ্ট করবে?”

“কেমন অফার?”

“তুমি আমার কোম্পানিতে জয়েন করে যাও, তোমাকে কোনো হার্ডওয়ার্ক করতে হবে না। আর তোমার জব করার ইচ্ছেও পূরণ হবে তাইনা?”

“হ্যা, তারপর আপনার অফিসের সবাই কি বলবে? বাড়ি ছেড়ে একজন বস তার বউকে অফিসেও নিয়ে এসেছে! জাফরান, তাকে সুযোগ দিন যে আপনার কোম্পানীর যোগ্য। আমি ওখানে শোপিস হিসেবে যেতে চাইনা”

“শোপিস হিসেবে কেনো থাকবে তুমি? অবশ্যই কাজ করবে। ভেবে দেখো আমার কোম্পানিতে জব করলে তোমার এক্সট্রা প্রেসার পড়বে না, ইচ্ছেমতো কাজটা করতে পারবে”

“জাফরান, কাজের ক্ষেত্রে আরাম খুঁজলে হয় বলুনতো? সবাই যেখানে পরিশ্রম করছে সেখানে আমি শুধু নিজের আরামের জন্য নামমাত্র কাজ করবো এটা হয়? তাছাড়া প্রফেশন চুজ করার ক্ষেত্রে সবার একটা নিজস্ব ইচ্ছে থাকে পছন্দ থাকে। যেমন আপনি বিজনেস পছন্দ করেন, এখন আপনাকে অন্য কিছু করতে বললে তো ইচ্ছের বিরুদ্ধে করবেন না তাইনা? আমার ব্যাপারটাও তেমন, বিজনেসের প্রতি ইন্টারেস্ট নেই। আমি শুধু নিজের ছোট্ট ইচ্ছেটা পূরণ করতে চাই”

“ফাইন, তুমি যখন এতো করেই চাইছো আমি মানা করবো না। তুমি আমাকে সবরকম বিষয়ে হেল্প করো সাপোর্ট করো সো দিস টাইম অলসো আই উইল সাপোর্ট ইউ”

আমাদের কথা শেষ হবার আগেই কলিং বেজে উঠলো, নাতাশা এসেছে। আমি আজও ওকে দেখে অবাক হলাম কিন্তু জাফরান কেমন যেনো বিরক্ত! আমি

“তুই হঠাৎ এখানে কি করছিস?”

আমি সোফা থেকে উঠে দরজার কাছে এসে দাড়ালাম

“ওনাকে ভেতরে তো আসতে দিন জাফরান, বাইরে দাঁড়িয়ে কথা বলবে নাকি?”

নাতাশা মলিন একটা হাসি দিয়ে বললো

“নাহ সুরভী, আজ আর ভেতরে আসবো না। নাহলে দেরি হয়ে যাবে যেতে”

“কোথাও যাচ্ছেন নাকি আপনি?”

“হুমম! আসলে আমি আজ কানাডা ব্যাক করছি, দুঘন্টা বাদেই আমার ফ্লাইট। জানিনা আবার কবে দেশে ফিরব তাই ভাবলাম তোদের সাথে লাস্ট টাইমের মতো দেখা করে যাই”

নাতাশার কথার ভঙ্গি দেখে অবাক হলাম, সেদিন আমার সাথে একটু অন্যভাবে কথা বলছিলেন আর আজ ওনার কথা বলার ধরন অন্যরকম শোনাচ্ছে। জাফরানের মাঝে কোনো রিয়্যাকশন না দেখে অবাক হচ্ছি!

“হঠাৎ ফিরে যাচ্ছেন যে? আমি তো শুনেছি আপনার বাবা একা থাকেন, আপনি গেলে তো উনি আবারও একা পড়ে যাবে”

“ডোন্ট ওরি, বাবার সাথে সব কথা বলেই নিয়েছি। হি উইল বি ফাইন, আর তোমাদের দুজনের যদি সময় হয় মাঝে মাঝে একটু বাবাকে দেখতে চলে যেও। বাবা খুশি হবে”

কথার ফাঁকে ফাঁকে নাতাশা বারবার জাফরানের দিকে তাকাচ্ছিলো, কিন্তু জাফরান ওর দিকে পাত্তাই দিচ্ছে না। চুপচাপ হাত ভাঁজ করে দাড়িয়ে আছে! আমি একবার নাতাশা আরেকবার ওনার দিকে দেখছি। কি হয়েছে বুঝতে পারছি না। নাতাশা তখন একটু এগিয়ে এসে আমার কাঁধে হাত রেখে বললো

“সুরভী, তুমি অনেক ভালো মেয়ে। আর তোমার সাথে অন্যায় করে আজ আমি একজনের চোখে অনেক নিচে নেমে গেছি। আই অ্যাম সরি। ঝোঁকের মাথায় আমি হিতাহিতবোধ হারিয়ে ফেলেছিলাম। তোমার কাছে ক্ষমা চাইবার মুখ আমার নেই, তবুও বলবো আমাকে ক্ষমা করে দিও”

চলবে….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে