মন শহরে তোর আগমন পর্ব -১৭ (শেষ পর্ব)

0
1952

#মন শহরে তোর আগমন
#লেখনীতে – Kazi Meherin Nesa
#শেষ পর্ব

সেদিন নাতাশাকে বারবার জিজ্ঞাসা করেও উত্তর পাইনি যে কেনো আমার কাছে ক্ষমা চাইলো, জাফরানের বিরক্তি দেখে তাকেও প্রশ্ন করার সাহস পাইনি। তবে জাফরানের আচরনেই বুঝেছিলাম দুজনের বন্ধুত্বে হয়তো কোনো ফাটল ধরে গেছে! তবে মেয়েটার জন্যে কেনো যেনো খারাপ লেগেছিলো সেদিন, হয়তো জাফরানের থেকে কিছু শুনতে চাইছিলো কিন্তু আফসোস উনি কিছুই বলেননি। দেখতে দেখতে এভাবেই সময় অতিবাহিত হতে থাকলো। সেই সাথে চলছে আমার আর জাফরানের টোনাটুনির সংসার। লোকটার পাগলামি দিনদিন যেনো বেড়েই চলেছে, তবে আমিও হাসিমুখে সব মেনে নিচ্ছি। আমি তো জানি ওনার পাগলামিগুলো শুধু আমার জন্যে, আমায় ঘিরেই। আজ জাফরানের জন্মদিন। আমার জন্মদিনটা উনি এতো সুন্দর করে পালন করেছিলেন, হয়তো আমি সেভাবে পারবো না তবে ওনাকে আজকের দিনে খুশি করার মতো আয়োজন তো অবশ্যই করতে পারবো!
______________________________

আজ অফিসের কাজের ব্যস্ততা একটু বেশিই ছিলো। জাফরানের বাড়ি ফিরতে ফিরতে রাত প্রায় আটটা বেজে গেছে। এক্সট্রা কি ওর কাছেই থাকে তাই কলিং না দিয়ে চাবি দিয়ে খুলেই ভেতরে এসেছে। কিন্তু ড্রইং রুম অন্ধকার দেখে কিছুটা অবাক হয় ও

“কি ব্যাপার! রাত হয়ে গেছে সুরভী এখনও ড্রইং রুমে লাইট জ্বালেনি কেনো! বিকেলে ঘুমিয়ে আর ওঠেনি নাকি?”

জাফরান কি ভেবে লাইট অন করলো না, সোজা রুমে চলে গেলো। সুরভী রুমে নেই, কোথায় গেলো মেয়েটা এই সময়? বাড়িতেই হবে কোথাও! ক্লান্ত লাগছে জাফরানের তাই ও জলদি করে আগে ফ্রেশ হয়ে নিলো। রুমে এসে দেখলো এখনও সুরভী আসেনি। এবার কিছুটা চিন্তা হতে থাকে ওর। আবার নিচে ড্রইং রুমে আসে ও, ড্রইং রুমে দাড়াতেই হঠাৎ লাইট জ্বলে ওঠে। সামনে তাকিয়েই শুভ্র শাড়ি পড়া মেয়েটাকে দেখে থমকে যায় জাফরান!

স্থির নজরে আমার দিকে দেখছেন উনি, আমি ভাবলাম উনি বুঝি স্তব্ধ হয়ে গেছেন। একটু একটু করে আমার দিকে এগোতে শুরু করলেন উনি, আমার সামনে এসে দাড়ালেন। আমি হেসে রজনীগন্ধা ফুলের স্টিকত টেবিল থেকে হাতে তুলে জাফরানের দিকে এগিয়ে বললাম

“আপনার রজনীগন্ধা ফুল ভালো লাগে তাইনা? এই দেখুন, আমি নিজে গিয়ে দোকান থেকে কিনে এনেছি। আর আজকে আপনার..”

পুরো কথা শেষ করতে পারলাম না, তার আগেই আমায় শক্ত করে নিজের বাহু জোড়ায় চেপে ধরলো লোকটা! অনুভব করলাম ওনার হার্টবিট অস্বাভাবিকরকম বেড়ে গেছে। আমি ওনার পিঠে আস্তে আস্তে হাত বুলিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম

“কি হয়েছে জাফরান? আপনি ঠিক আছেন তো?”

“আই অ্যাম ফাইন”

আমার মনে হচ্ছে না উনি ঠিক আছেন, কিন্তু এখন আর কোনো প্রশ্ন করতে চাইনা। উনি আবার কোনো কোনো সময় পাল্টা প্রশ্ন করলে ভীষণ বিরক্ত হন! কিছু সময় পর উনি আমায় ছেড়ে দাড়ালেন, এবার কিছুটা স্বাভাবিক লাগছে ওনাকে। ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে উনি আমার দিকে ভালোভাবে তাকালেন, তারপর টেবিলের ওপর কেকটা দেখে বললেন

“কি ব্যাপার! তুমি আজকে এভাবে রেডি হয়েছ, আবার কেকও আছে দেখছি। আজ কিছু আছে নাকি?”

ওনার নিজের জন্মদিনের কথা মনে নেই দেখে আরো খুশি হলাম। জেনি আপুকেও সকালে বলেছিলাম ওনাক যেনো উইশ না করে। বার্থডে উইশ তাহলে আমিই প্রথম করতে পারবো ওনাকে। আমি চওড়া একটা হাসি দিতে শাড়ীর আঁচলটা দোলাতে ওনার চারদিকে ঘুরতে ঘুরতে বললাম

“আছেই তো, আজ আমার স্পেশাল একজনের স্পেশাল দিন। তাই সেলিব্রেট করার জন্য এতো আয়োজন। দেখছেন না আজ তাকে ইমপ্রেস করার জন্যে কতো সুন্দর করে শাড়ি পড়েছি?”

ভ্রু কুঁচকে ফেলে জাফরান, আমাকে টেনে নিজের সামনে দাঁড় করিয়ে প্রশ্ন করে বসে

“স্পেশাল একজন মানে? কার কথা বলছো তুমি!”

আমি হা হয়ে তাকিয়ে আছি ওনার দিকে, লোকটার কথায় হাসবো কাঁদবো বুঝতে পারছি না। এতদিন হয়ে গেলো অথচ এখনও আমার এমন কথার মানে বুঝলেন না!

“অদ্ভুত প্রশ্ন করলেন তো। আমার জীবনে আপনি ছাড়া আর স্পেশাল কে আছে জাফরান?”

“আমি? আমার আবার কিসের স্পেশাল দিন আছে আজকে?”

জাফরান ভাবতেই যাচ্ছিলো, তখন ওনার ভাবনার কষ্ট লাঘব করতে আমিই বলে উঠলাম

“হ্যাপি বার্থডে জাফরান”

চমকে উঠলেন উনি, আমার দিকে কয়েক সেকেণ্ড স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলেন। তারপর কপালে আঙ্গুল ঘষতে ঘষতে ছোট্ট একটা হাসি দিয়ে বললেন

“ওহ গড! আমি তো ভুলেই গেছিলাম”

আমি মুচকি হেসে ওনার গাল দুটো টিপে দিয়ে বললাম

“আপনি ভুলতেই পারেন, তাতে অপরাধ নেই কিন্তু আমি ভুলে গেলে মস্ত অপরাধ হয়ে যেতো”

“থ্যাংক ইউ সুরভী”

“আরে, আগেই থ্যাংকস কেনো বলছেন? এখনও তো কেক কাটা বাকি। তারপর আপনার জন্যে আপনার পছন্দের খাবার বানিয়েছি, সেগুলো আগে খাবেন। কেমন হয়েছে বলবেন। যদি ভালো হয় তাহলেই থ্যাংকস বলবেন তার আগে নয়”

জাফরান সরু হেসে আমার কপালে চুমু খেলেন

“আমার তোমাকে থ্যাংকস বলতে কোনো সুযোগের দরকার পড়ে না, যখন খুশি আমি নিজের মিসেসকে থ্যাংকস বলতেই পারি”

“হ্যা সে তো অবশ্যই পারেন, কিন্তু এখন কেক কাটা যাক আগে! সারাদিন তো পার হয়ে গেলো। আর দেরি করতে চাইনা। বসুন”

জাফরান সোফায় বসে পড়লো, সুরভী টেবিলটা সোফার একদম কাছে এগিয়ে এনে জাফরানের কাছে বসলো

“এবার আপনার যদি কিছু চাওয়ার থাকে সেটা মনে মনে চেয়ে নিন, ছোটবেলায় আমি এই কাজটা করতাম। যদিও এটা শুনতে একটু স্টুপিড লাগে তবে আমার ভালো লাগতো”

“আমার চাওয়া একটাই, আর যা চাই তা আমার সাথেই আছে। নতুন করে আর কি চাইবো বলোতো?”

হাসলাম আমি। এমন কথার মাধ্যমেই উনি আমাকে প্রতি মুহূর্তে ফিল করান যে ওনার জীবনে আমার গুরুত্ব ঠিক কতোটা! এরপর কেক কাটলেন উনি! আমি ওনাকে কেকের একটা পিচ তুলে খাওয়াতে গিয়েও মুখের সামনে থেকে সরিয়ে আনলাম। ভ্রু কুঁচকে ফেললেন উনি

“এটা কি হলো? বার্থডে বয়কে কেক খাওয়াবে না?”

“খাওয়াবো, তার আগে আমার আপনাকে কিছু বলার আছে”

“কি?”

“আমি নিজের হাতে অনেক কষ্টে কেকটা বানিয়েছি আপনার জন্যে। এই প্রথম ট্রাই করলাম, যদি কোনোকিছু একটু এদিক ওদিক হয় তার জন্য আগেই সরি বলে নিচ্ছি”

কয়েক সেকেন্ড আমার দিকে চেয়ে থেকে খপ করে আমার হাত থেকে কেকটা খেয়ে নিলেন উনি, চিবোতে চিবোতে বলতে লাগলেন

“তুমি নিজের হাতে ভালোবেসে আমার জন্যে কিছু বানিয়েছো আর সেটা আমার কাছে বেস্ট”

কেকটা সবে মুখে তুলেছেন উনি, আমি ওনার মুখভঙ্গি দেখে বোঝার চেষ্টা করছি সত্যিই ভালো হয়েছে নাকি মিথ্যে প্রশংসা করছেন? খাওয়া শেষে উনি আরেকটা পিস নিজেই কেটে খেতে খেতে বললেন

“উম্ম, ইটস ইয়াম্মি! অনেক ভালো হয়েছে”

“সত্যি এতো ভালো হয়েছে?”

“নিজেই ট্রাই করে দেখো”

উনি আমাকে একটু খাইয়ে দিলেন, টেস্ট করে দেখলাম প্রথমবারের তুলনায় বেশ ভালোই হয়েছে। জেনি আপুকে ভিডিও কলে রেখে তারপর কেকটা বানিয়েছিলাম, ভয়ে ছিলাম কেমন না কেমন হবে। অবশেষে আমার কষ্ট সার্থক হলো

“এবার বলো আমার গিফট কই?”

“গিফট?”

“হ্যা গিফট! বার্থডে সেলিব্রেট করলে আর গিফট দেবে না? এটা হয় নাকি?”

জাফরানের কথায় থতমত খেয়ে গেলাম আমি। কোনো উপহার তো আনিনি ওনার জন্যে, এই কথা তো মাথা থেকেই বেরিয়ে গেছিলো। আমি চোখ নিচু করে কাচুমাচু হয়ে বললাম

“সরি জাফরান। আমি তো তোমার জন্য গিফট আনিনি, ভুলে গেছিলাম গিফটের কথা। আর এখন আমার কাছে তোমাকে দেওয়ার মতো নেই ও কিছু”

“আমি নিজে যদি কিছু চাই দেবে?”

আমি সঙ্গে সঙ্গে চোখ তুলে তাকালাম ওনার দিকে

“হ্যা বলুন না, কি চাই আপনার?”

একটা হাতখোঁপা করা ছিলো সুরভী, ছোটো চুলগুলো কানের দুপাশে বেয়ে পড়ছে। জাফরান আলতো চুলগুলো কানের পিঠে গুজে দিয়ে বললো

“তুমি কি জানো আজ এই রূপে তোমায় অপ্সরা থেকে কোনো অংশে কম লাগছে না?”

কেমন এক ঘোর লাগা কণ্ঠে কথাটা বললেন উনি। এরই মাঝে আস্তে আস্তে উনি আমার কাছের কাছে মুখ এনে অসম্ভব শীতল কণ্ঠে বললেন

“আজ আমার তোমাকে চাই”

কথাটা শুনেই আমার বুকের ভেতর ঢিপঢিপ করতে শুরু করে দিয়েছে। শ্বাসের গতিও প্রচণ্ড বেড়ে গেছে। চোখ তুলে জাফরানের দিকে তাকাতেই তার চাহনির ধরনের মধ্যে ফারাক লক্ষ্য করলাম, এ চাহনি আমায় স্পষ্ট বুঝিয়ে দিচ্ছে উনি কি চাইছেন! জাফরান আমার হাতের ওপর হাত রাখলো

“মে আই?”

প্রতিউত্তর স্বরূপ মুচকি হাসি দিলাম। সঙ্গে সঙ্গে উনি হেসে আমায় এক ঝটকায় কোলে তুলে নিলেন। আমি ওনার গলা জড়িয়ে তাকিয়ে দেখছি ওনার আনন্দিত মুখখানি। আমার সম্মতি পেয়ে উনি যেনো একটু বেশিই খুশি হয়ে গেছেন! বাঁকা হেসে উনি ইশারায় ওপরের দিকে ইশারা করে চোখ মারলেন, আমি লজ্জায় চোখজোড়া বন্ধ করে ওনার বুকে মুখ লুকালাম। আমায় নিয়েই উনি ওপরে চললেন। সেই সাথে আমার মনে বেড়ে চললো ভয় – ভালোলাগা এক মিশ্রিত অনুভূতি। মানুষটাকে তো আমি ভালোবাসি। তাহলে সেই ভালোবাসা আজ যদি পরিপূর্ন হয় অসুবিধা কি? আজ রাতটা হয়তো খুব সুখের হবে, অনেক ধৈর্য্যের পর আমার পাওয়া পূর্ণতা হবে!
_______________________________

খুনসুটি আর ভালোবাসা মিশিয়ে বিবাহিত জীবনের এক বছর অতিবাহিত করেছি আমরা দু সপ্তাহ আগে। গত সপ্তাহে জাফরানের বাবার প্রথম মৃত্যু বার্ষিকী ছিলো, আর সেদিনই আমি জানতে পেরেছিলাম যে আমার আর জাফরানের ভালোবাসার অংশ আমার মাঝে বেড়ে উঠছে। কিন্তু এ কদিন জাফরানের মানসিক অবস্থা খুব একটা ভালো ছিলো না বলে আর ওনাকে বলার সাহস করে উঠতে পারিনি। জাফরানের ফুপি, জিনিয়া আপু সবাই এক সপ্তাহ হলো এই। বাড়িতেই আছে। আগামীকাল চলে যাবে সবাই। বড় ফুপি ছোটো ফুপি ড্রইং রুমে বসে কথা বলছিলেন, আমি ওনাদের জন্যে চা করে এনেছি। ওনাদের চা দিয়ে জাফরানের সাথে এই খুশির খবরটা শেয়ার করবো, তাহলে মনটা ভালো হয়ে যাবে ওনার! চা দিয়ে আসছিলাম তখনই বড় ফুপি আমায় জিজ্ঞাসা করলেন

“তুমি কি অসুস্থ সুরভী?”

ফুপির কথায় একটু চিন্তায় পড়ে গেলাম। শুনেছি আগের মানুষেরা নাকি প্রেগনেন্ট মেয়েদের দেখলেই বুঝে যেতেন, উনিও আবার বুঝে গেলেন নাকি? খবরটা যে আমি আগে জাফরানকে দিতে চাই

“কেনো ফুপি?”

“না মানে তোমার মুখটা কেমন শুকিয়ে গেছে। এমন তো ছিলে না তুমি, আগের বার আমরা যখন এলাম তখনও তো অন্যরকম ছিলে”

বড় ফুপির কথার তালে ছোটো ফুপি ও বলে উঠলেন

“হ্যা আমিও লক্ষ্য করেছি আপা। ওর মুখটা কেমন শুকিয়ে গেছে! ঠিকমতো খাওয়া দাওয়া করো বুঝলে সুরভী। এই বয়সে এমন হলে তো পরে সমস্যা হবে”

আমি সস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম, ওনারা তাহলে বোঝেননি কিছু!

“জ্বি ফুপি! খেয়াল রাখবো”

রুমে এসে দেখলাম জাফরান চুপচাপ বারান্দায় বসে আছেন। ওনার মনটা গত সাতদিন ধরেই ভালো নেই, বাবাকে যে ভীষণভাবে মিস করছেন বুঝতে পারছি! আমি ওনার পাশে গিয়ে বসলাম, কফি কাপটা টেবিলের ওপর রেখে বললাম

“এখনও মন খারাপ করে আছেন?”

“একটা বছর কেটে গেলো বাবাকে ছাড়া। জাস্ট ভাবতে পারছি না। মানুষ এভাবে চলে যায় কেনো বলতে পারো?”

“জন্ম যখন হয়েছে মৃত্যু তো অবধারিত তাইনা? আর বাবা কি বলেছিল মনে নেই? উনি কিন্তু আপনাকে কষ্ট পেতে বারণ করে গেছেন। ওনার কথা ভেবে আপনি কষ্ট পাচ্ছেন, মন খারাপ করছেন। বাবার খারাপ লাগবে না বলুন?”

দীর্ঘশ্বাস ফেললেন জাফরান, আমি চাইলেও ওনার কষ্টটা কমাতে পারবো না। কারণ যার মা বাবা নেই তার থেকে বেশি কষ্ট কি আর আছে? কিছু সময় চুপ রইলেন উনি। ওনার মুড অফ থাকলেই মাথা ভার হয়ে যায়। আমি জিজ্ঞাসা করলাম

“মাথা টিপে দেবো?”

“লাগবে না। তুমি শুধু আমার পাশে একটু বসে থাকো”

“হুমম! আপনার জন্যে কফি এনেছি, খেয়ে নিন নাহলে ঠান্ডা হয়ে যাবে”

“আমার খেতে ইচ্ছে করছে না। আজ তুমি খেয়ে নাও”

আমি পেটের ওপর হাত বুলাতে বুলাতে ঠোঁট উল্টে বললাম

“অন্য সময় হলে না হয় আমি খেয়ে নিতাম কিন্তু এই সময়ে কফি অ্যাভয়েড করাটাই ভালো। আমি এর বদলে এক গ্লাস দুধ জ্বাল দিয়ে খেয়ে নেবো না হয়”

“এই সময় মানে?”

উনি এবার তাকিয়ে দেখলেন আমার পেটের ওপর রাখা হাতটা, কিন্তু বুঝতে পারেননি

“তোমার পেটে ব্যথা হচ্ছে নাকি?”

“একটু ব্যথা হবে, তবে এখন না। দেরি আছে”

“মানে?”

আমি মুচকি হেসে ওনার হাতটা আমার পেটের ওপর এনে রাখলাম

“কিছু ফিল হচ্ছে?”

বিষয়টা বোঝার জন্যে মিনিট কয়েক চুপ রইলো জাফরান, যখন ফিল করলো সুরভী কি বোঝাতে চাইছে তখন স্তব্ধ হয়ে গেলো ও! কাপা কাপা কণ্ঠে প্রশ্ন করলো

“ইজ ইট ট্রু?”

হ্যা সূচক মাথা নাড়লাম আমি, সঙ্গে সঙ্গে দেখলাম কাচের পেছনে থাকা ওনার অক্ষিজোড়া টলটল করছে। হোয়াট এতো তাড়াতাড়ি এমন একটা খবর পাবেন আশা করেননি! সঙ্গে সঙ্গে আমায় উঠিয়ে বসালেন নিজের কোলের ওপর! আলতো করে পেটের ওপর হাত রেখে কাপা কাপা কণ্ঠে প্রশ্ন করলেন

“সত্যিই আমার বেবি আসছে?”

আমি ওনার চুলে হাত বুলিয়ে বললাম

“হুমম! আর মাত্র আট মাস, তারপরই আপনাকে আব্বু ডাকার জন্যে ছোট্ট একজন চলে আসবে জাফরান”

সঙ্গে সঙ্গে চোখের পানি গড়িয়ে পড়লো ওনার, এক বছর আগে ওনাকে এইসময় কষ্টে চোখের পানি ফেলতে দেখেছি। বছর ঘুরেছে ঠিকই কিন্তু আজও ওনার চোখে পানি, পার্থক্য এইটুকুই সেদিন কষ্টের ছিলো আর আজ আনন্দের! জাফরান জানার পর এই খবরটা আর চাপা রইলো না। উনি নিজেই বাড়ির সবার সামনে গুড নিউজটা রিভিল করলেন, তারপর আমার মা বাবাকেও ফোন করে জানালেন। জাফরানের আনন্দ যেনো আর ধরছে না। জিনিয়া আপু মিষ্টি এনে সবাইকে মিষ্টি মুখ করালেন, সবাই অনেক খুশি। বড় ফুপি কিসিরা অভিমান করে বলে উঠলেন

“আমার তো আগেই সন্দেহ হয়েছিলো, একটু আগেও তো ওকে জিজ্ঞাসা করলাম আমি। ও তো এড়িয়ে গেলো”

জেনি আপু হেসে বললো

“হয়তো জাফরানকে প্রথম নিউজটা দিতে চেয়েছিল তাই তোমায় বলেনি, ঠিক বললাম কি সুরভী?”

হ্যা সূচক মাথা নাড়লাম আমি

“কোনো ব্যাপার নাহ! তবে এখন থেকে নিজের বেশি বেশি খেয়াল রাখতে হবে বুঝলে? আর আমরা সবাই তো আছি, সবাই মিলে তোমার অনেক কেয়ার করবো”

জাফরান আমার হাতের ওপর হাত ওপর হাত রেখে বাকিদের উদ্দেশ্যে বললো

“তোরা কেনো কষ্ট করবি? আমি আছি তো জেনি, আমাদের বেবি আর সুরভীর জন্যে আমি একাই যথেষ্ট!”

এখন থেকেই জাফরানের মাঝে একজন কেয়ারিং বাবার আদল দেখতে পাচ্ছি। বাবাকে দেওয়া কথা রাখতে সক্ষম হচ্ছি আমি, ওনার ছেলের জীবন থেকে দুঃখের ঘনঘটা কিছুটা হলেও দুর করতে পেরেছি। প্রথমবার জাফরানকে এতোটা খুশি দেখছি, এতেই আমার স্বার্থকতা!
______________________________

ঘুমের মধ্যেই উল্টপাশে ফিরতে গিয়ে চোখটা হাল্কা খুলে গেলো, দেখলাম জাফরান বেডে হেলান দিয়ে বসে আছে। আমি ভালোভাবে চোখ খুলে তাকিয়ে দেখলাম সত্যিই উনি বসে আছেন

“কি হয়েছে?”

উনি এক নজর তাকালেন আমার দিকে

“ঘুম আসছে না”

“কেনো?”

“এমনি! তুমি ঘুমাও সুরভী! এখন তোমার প্রপার রেস্ট দরকার”

“আপনি আগে বলুন কি হয়েছে। নাহলে আমি ঘুমাবো না”

আমি উঠে বসলাম, উনি আমায় নিজের কাছে টেনে নিলেন। আমিও বাধ্য মেয়ের মতো ওনার বুকের মাথা দিলাম

“কেনো ঘুম আসছে না আপনার?”

“এতোটা হ্যাপিনেস কখনো আশা করিনি সুরভী, আমার যে একটা হ্যাপি ফ্যামিলি হবে। ছোট্ট একটা বেবি হবে সেসব স্বপ্ন কোনোদিন দেখেছি কিনা সন্দেহ। আজ যেনো না চাইতেই সব পেয়ে গেলাম”

“নিজেকে আজ পূর্ন মনে হচ্ছে জানো?”

“আমারও! এবার আমাদের একটা কমপ্লিট ফ্যামিলি হবে। আপনি আমি আর আমাদের ছোট্ট বেবি। একটা ছোট্ট হ্যাপি ফ্যামিলি”

আমার হাতটা মুঠো করে ধরে চুমু খেলো জাফরান। আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলতে লাগলেন

“বাবা যাওয়ার পর আর কিছু থাকতো না আমার যদি তুমি আমার লাইফে না আসতে। এতো বড় শহরে আমার বসবাস, এতো মানুষ তবুও আমি একলা রয়ে যেতাম যদি না আমার #মন_শহরে_তোমার_আগমন ঘটতো। তুমি আসার পরেই লাইফের আসল মানে বুঝেছি আমি, দায়িত্ব নিতে শিখেছি। ধৈর্য্য ধরা শিখেছি। আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করি তোমার মতো একজন লাইফ পার্টনার আমায় দিয়েছেন বলে। থ্যাংকস ফর এভরিথিং সুরভী। আর আজ যে গুড নিউজ দিলে তার জন্যে তো থ্যাংকস ও কম পড়ে যাবে”

ওনার বুকে মাথা ঠেকিয়ে চোখ বুজে শুনছিলাম কথাগুলো, ওনার জীবনে আমি এতোটা গুরুত্তপূর্ণ জেনে কেমন এক প্রশান্তি কাজ করলো মনের মধ্যে!

“আপনার মেয়ে চাই না ছেলে জাফরান?”

“আল্লাহ যা দেবে তাতেই খুশি! শুধু এইটুকুই চাওয়া আমাদের বেবি যেনো সুস্থ থাকে”

“তবুও, ইচ্ছে তো একটা থাকে তাইনা?”

“আমার বেবি গার্ল পছন্দ, তো আমার যদি একটা মেয়ে হয় মন্দ হবেনা”

“ওহ! কিন্তু আমার তো একটা ছেলে চাই”

“তো এখন তুমি টিপিক্যাল হবু মা – বাবার মতো ছেলে হবে না মেয়ে এই নিয়ে ঝগড়া করবে নাকি?”

“মোটেই না, সবারই নিজস্ব ইচ্ছে থাকে। আপনারাও আছে, আমারও আছে। এই নিয়ে ঝগড়া করার কিছুই নেই”

“বাহ! তুমি তো দেখছি অন্যান্য ওয়াইফের মতো নও, এইজন্যেই তো আমার সুরভী এক পিসই আছে। শুধু আমার জন্যেই অ্যাভেইলেবল”

কথাটা বলেই উনি আমার দিকে তাকালেন, দুজনেই একসাথে হেসে ফেললাম। জাফরানের চাওয়াগুলো সীমিত, আর আমি সবসময় আল্লাহর কাছে দোয়া করি যেনো ওনার এই সীমিত চাওয়াগুলো আল্লাহ পূরণ করে দেন। ওনার সাথে যেনো আমার অনেক বছরের পথচলা হয়। পুরোটা প্রেগনেন্সি জাফরান আমার এতোটা টেক কেয়ার করেছে যা বর্ণনায় প্রকাশ করা যাবে না, সব মেয়েরাই হয়তো এমন একজন হাসবেন্ড এর স্বপ্ন দেখে। আর আমি না চাইতেই পেয়ে গেছি! বাড়ির সবার আর জাফরানের টেক কেয়ার এবং ভালোবাসায় মাতৃত্বকালীন সময়টা খুব সুন্দরভাবেই অতিবাহিত করলাম!
____________________________

জাফরানের কথাই সত্যি হয়েছে, আমাদের একটা মেয়ে হয়েছে। ওর বয়স এখন পাঁচ বছর। জাফরানের আহ্লাদ আর আদরে আমাকে এখন পাত্তাই দেয়না আমার মেয়ে। উল্টে বাপ – মেয়ে মিলে আমায় পাগল করে। একা হাতে আমায় দুজনকেই সামলাতে হয়! আজ বিকেলের পর থেকে লক্ষ্য করলাম মেয়ে আমার কেমন মুখ গোমড়া করে বসে আছে, কিছু বলছে না। এর রহস্য উদঘাটন করতে পারিনি এখনও। জাফরান অফিস থেকে ফিরে এসে মেয়েকে ঐভাবে দেখেই আমাকে শক্ত গলায় প্রশ্ন করে

“জারা ঐভাবে বসে আছে কেনো! কি হয়েছে! সুরভী, তুমি ওকে আবার বকেছো?”

“না তো, আজ তো ওকে পড়তেও বলিনি। সকাল থেকে খেলছিলো, একটু আগে থেকে দেখি এইভাবে চুপ করে আছে”

আমার বক্তব্য শুনে জাফরান মেয়ের কাছে গিয়ে বসলো, রোজকার মতো আজও জারার চকোলেট আনতে ভোলেনি ও! মেয়ের সামনে চকোলেটগুলো দেখাতেই সোফা থেকে উঠে দাড়ালো জারা। আমি আর জাফরান দুজনেই অবাক হয়ে একে অপরের দিকে তাকালাম। জারা চকলেটের পাগলী,আর আজ দেখেও নিচ্ছে না? জাফরান আহ্লাদী গলায় মেয়েকে কাছে টেনে এনে বললো

“আমার আম্মুটার আজ চকোলেট খেতে ইচ্ছে করছে না? অন্য কিছু এনে দেবো?”

জারা মুখ ফুলিয়ে বড়দের মতো দু হাত ভাঁজ করে করে বলে

“কিছু চাইনা”

“কেনো আম্মু? রাগ করে আছো আমার ওপর? আমি কি কোনো মিসটেক করেছি?”

নাক ফুলিয়ে আছে মেয়েটা, বাপের ওপর আজ হুট করে এতো রাগ কেনো হলো বুঝলাম না। আমি এগিয়ে এসে জারার সামনে বসলাম, ওকে আমার দিকে ঘুরিয়ে প্রশ্ন করলাম

“আমার আম্মুটার কি হলো দেখি! আব্বুর ওপর রাগ করেছো?”

“আব্বুর সাথে আড়ি, তোমার সাথেও আড়ি আম্মু, তোমরা দুজনেই অনেক পচা”

একরাশ অভিমান নিয়ে আমার ছোট্ট মেয়েটা কথাগুলো বলল, আমি আর জাফরান একে অপরের দিকে তাকিয়ে মনে করার চেষ্টা করছি কি এমন করলাম যার জন্যে জারা আমাদের পচা বলছে? জাফরান প্রশ্ন করলো

“আমরা আবার কি করলাম আম্মু?”

“আব্বু, তুমি আর আম্মু মিলে ঘুরতে গিয়েছিলে। আমি ফুপির ফোনে ছবি দেখেছি। তোমরা নিজেরাই ঘুরতে গেছো, আমায় নিয়ে যাওনি। আড়ি আড়ি তোমাদের সাথে”

মেয়ের কথা শুনে আমরা দুজনেই অবাক! সেই ছয় বছর আগে একবার জাফরানের জোরাজুরিতে ঘুরতে গেছিলাম কক্সবাজার, জার্নি করতে পারিনা বলে তার পর আর কোনোদিন দূরের কোনো রাস্তায় পা বাড়াইনি। আজ এতো বছর পর সেই ছবির কথা তুলেছে জারা, কিন্তু তখন তো জারার জন্মই হয়নি! জাফরান পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্যে বললো

“সমস্যা নেই, আমরা এই ফ্রাইডেতেই না হয় গিয়ে ঘুরে আসবো। এতে এতো রাগ করার কি আছে?”

“আমি এখন যেতে চাইনা আব্বু। তোমরা তখন কেনো নাওনি আমায়?”

“কিন্তু আম্মু তুমি তো তখন ছিলে না, তাহলে কিভাবে নিয়ে যেতাম বলো?”

“মিথ্যে বলছো, তোমরা আমাকে রেখে চলে গেছিলে তাইতো আমি এখানে নেই!”

এবার মেয়ের কথার কি উত্তর দেবো আমরা দুজনের কেউই ভেবে পেলাম না। বাচ্চা মানুষ, ওকে বোঝালেও তো বুঝবে না। আজব এক ফ্যাসাদে পড়ে গেলাম। জিনিয়া আপু যে কেনো ওকে ওই ছবিগুলো দেখালো! মেয়ে আমার অভিমান করে রুমের দিকে ছুটলো, জাফরান ও পেছন পেছন গেলো! উনি পারবেন মেয়ের মান ভাঙাতে, সবটা ভেবে হাসি পাচ্ছে আমার। জাফরান আর জারা ওপরে চলে যাওয়ার পর বসার ঘরে বড় করে টাঙানো আমাদের তিনজনের ছবিটার দিকে নজর দিলাম, আমাদের তৃতীয় বিবাহ বার্ষিকীতে জিনিয়া আপু এটা গিফট করেছিলো। একটা কমপ্লিট ফ্যামিলি ফ্রেম হিসেবে পারফেক্ট! হঠাৎ মনে পড়লো আমাদের বিয়ের দিনের কথা, কিভাবে শুরুটা হয়েছিলো আমাদের সম্পর্কের। যেখানে অ্যাডজাস্টমেন্ট করবো ভেবে সম্পর্ক শুরু করেছিলাম সেখানে আজ শুধু ভালোবাসা আছে, সব মান অভিমানের পালা দুর হয়ে গেছে। একে অপরের পরিপূরক হিসেবে এভাবেই চলছে আমাদের পথচলা!

______ সমাপ্ত ______

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে