মন শহরে তোর আগমন পর্ব -০৭

0
1167

#মন শহরে তোর আগমন
#লেখনীতে – Kazi Meherin Nesa
#পর্ব – ০৭

দুপুরে সবাই মিলে একসাথে খাবার খেলাম আমরা। জাফরানের এই বাড়িতে অ্যাডজাস্টমেন্ট নিয়ে যত চিন্তা করছিলাম সব ব্যর্থ হয়ে গেলো আমার, কারণ উনি খুব সুন্দরভাবে নিজেকে মানিয়ে নিয়েছেন সবার সাথে। তারপর সারাটাদিন আমার আমার বোনের সাথে এমন আড্ডা জুড়ে দিয়েছিলো যে আমাকে পাত্তাই দেয়নি। একটু হিংসে হচ্ছিলো বটে, তবে ওনাকে উৎফুল্ল দেখেই আমি খুশি। রাতের খাবার শেষে জাফরান বারান্দায় দাড়িয়েছিলো। সুরভীর বাড়ির সবার সাথে সময় কাটিয়ে বেশ ফ্রেশ ফিল করছে ও

“জাফরান, আপনি এখানে? আর আমি আপনাকে কোথায় কোথায় খুঁজে এলাম”

উনি পেছনে ফিরে দেখলেন আমায়। লোকটার মুখখানায় এক অদ্ভুত আনন্দের ঘনঘটা বিদ্যমান। সেটা উপলব্ধি করতে পারে সস্তির এক নিঃশ্বাস ফেললাম আমি। আর যাই করি না কেনো, দিনশেষে এই মানুষটাকে খুশি দেখতে চাই

“হঠাৎ আমাকে খোঁজার কারণ কি?”

“তেমন কিছু না, ওই আমার মা স্পেশাল একটা সুইট ডিশ বানিয়েছে, আর সেটা আপনার খুব পছন্দের। তাই ডাকতে এসেছিলাম। টেস্ট করবেন চলুন”

“আজকে এতকিছু বানিয়েছিলো অ্যান্টি, আবার আজকেই সুইট ডিশ বানানোর কি দরকার ছিলো? না করতে পারলে না? কাল বানাতে পারতো”

“আমি মানা করলেই বুঝি মা শুনতো? আপনি হলেন বর্তমানে তার একমাত্র মেয়ে জামাই তাই অ্যাপায়নে কোনো ত্রুটি রাখতে চান না। আমিও আর বাধা দেইনি”

“তোমার মা তোমার থেকে আমাকে বেশি টেক কেয়ার করছে। হিংসে হচ্ছে নাকি তোমার?”

“শুনুন আমি না অতো হিংসুটে নই যতটা ভাবেন। বরং আমি খুশিই হয়েছি যে মা আমার থেকে বেশি আপনাকে প্রাধান্য দিচ্ছেন”

মুচকি হেসে উনি আবার সামনের দিকে তাকালেন, আমি উকি দিয়ে দেখছিলাম ওনার দিকে। ভাবলাম উনি বুঝি এখন খেতে চান না তাই আমি আর কিছু না বলে চলে আসতে যাচ্ছিলাম

“একটু দাড়াও এখানে”

দাড়িয়ে পড়লাম আমি, উনি যখন একান্তে সময় কাটান তখন কারো উপস্থিতি পছন্দ করেন না সে আমি জানি, কিন্তু আজ অদ্ভুতভাবে থাকতে বললেন। আমি ওনার পাশে গিয়ে দাড়ালাম

“কি হয়েছে জাফরান? আপনার কি এখানে ভালো লাগছে না?”

“নিজে নিজেই সব ভেবে নেওয়ার বদ অভ্যাস ও দেখি আছে তোমার। আমাকে তোমার মা বাবার সামনে খারাপ প্রমাণ করতে চাও নাকি?

“না না, ভুল বুঝবেন না আমায়। আপনি তো এখানে আসার পর কিছু বলেননি, ভালো লাগছে নাকি খারাপ সেটাও বোঝার উপায় নেই”

জাফরান আমার দিকে তাকিয়ে ছোট্ট হাসলেন, আমি আড়চোখে একনজর ওনাকে দেখে নিলাম। এখানে আসার পর একফোঁটা বিরক্তির উপস্থিতি দেখিনি ওনার মাঝে, বুঝলাম হুট করে এইরকম একটা কথা বলা ঠিক হয়নি

“তোমার কি মনে হয়? ভালো আছি না খারাপ?”

আমি মিনমিন করে বললাম

“আমি কিভাবে জানবো আপনার মনের মধ্যে কি চলছে?”

“দেখছো তো নিজের চোখেই সব। গেস করেই না হয় বলো”

আমি শুকনো ঢোক গিললাম, কি না কি বলে দেবো আর তাতে ওনার মুড অফ হয়ে যেতে পারে এই ভয়ে উত্তর দিলাম না

“জাফরান, এসব কথা বাদ দিন এখন। চলুন আমরা যাই, মা অপেক্ষা করছে। তারপর আবার বলবে আপনাকে ডাকতে এসে আমি নিজেই হাওয়া হয়ে গেলাম”

আমি এক প্রকার তাড়াহুড়ো করে চলে আসার জন্যে তৈরী হতেই উনি আমার হাত ধরলেন

“প্রশ্ন করেই পালাচ্ছ? উত্তর শুনে যাবে না?”

নিরব হয়ে দাড়িয়ে গেলাম আমি, উনি এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন

“সবসময় আমি আর জেনি একসাথে খাবার খেতাম, বাবা বিজি থাকতো। সেভাবে আমাদের সাথে খেতে পারতো না। আমরা ফুল ফ্যামিলি সেভাবে কোনোদিন একসাথে বসে খাবার খাইনি। কিন্তু আজ যখন তোমার মা বাবা বোন সবার সাথে বসে লাঞ্চ করলাম, মনে হলো আমার অনেকদিনের অপূরণীয় একটা উইশ পূরণ হয়েছে। আই অ্যাম ফিলিং ভেরি হ্যাপি”

কথাগুলো বলতে গিয়ে উনি যে কতোটা খুশি ছিলেন সেটা বোঝাতে পারবো না, তবে এইটুকু বলতে পারি এতদিনে এতটা প্রশান্তি অন্তত আমি দেখিনি ওনার মধ্যে। খানিক চুপ থেকে এক তৃপ্তির হাসি হাসলো জাফরান

“থ্যাংক ইউ সুরভী। তোমার জন্যেই আমি এতো সুন্দর একটা কমপ্লিট ফ্যামিলি পেলাম, তাদের সাথে অন্তত একদিন হলেও তো টাইম স্পেন্ট করতে পারবো”

আচমকা উনি জড়িয়ে ধরলেন আমায়, আর আমি ঠায় দাঁড়িয়ে রইলাম। দ্বিতীয়বার উনি আমায় জড়িয়ে ধরলেন। প্রথমবারের তুলনায় এবারের অনুভূতিটা একটু অন্যরকম। সে মুহূর্তে কিছু না ভেবে আমিও জড়িয়ে ধরলাম ওনাকে

“এই সরি,সরি। আসলে আপু যাচ্ছিলো না বলে মা আমাকে ডাকতে পাঠালো, কিন্তু তোমরা তো এখানে। সমস্যা নেই, ইউ গাইজ ক্যারি অন”

হুট করে সুহানার গলার আওয়াজ পেয়ে জাফরানের থেকে ছিটকে সরে এলাম আমি, সঙ্গে সঙ্গে দরজার দিকে তাকিয়ে দেখলাম পালিয়েছে শয়তানটা। ও সব দেখে নিলো? এটা যদি গিয়ে আবার কাওকে বলে দেয় এইটা ভেবেই মুখটা কালো হয়ে গেলো। জাফরান হেসে বললেন

“সুহানা দেখি তোমার থেকেও স্মার্ট, কখন কি করতে হয় ভালোভাবেই জানে”

“এইসব আপনার জন্যে হয়েছে, আপনি যদি আমার এক ডাকে চলে যেতেন তাহলে এমন কিছুই হতো না”

“কেনো? তোমার ভালোলাগেনি যে আমি তোমায় হাগ করলাম? থ্যাংকস বললাম?”

উত্তর দিলাম না আমি, সব উত্তর দেওয়া কি খুব দরকার? হ্যা আমার ভালোলেগেছে কিন্তু ওনাকে বলবো না। কিছু ভালো লাগা অপ্রকাশিতই থাক না
________________________________

সূহা, আমি আর জাফরান মিলে জমিয়ে লুডু খেলছিলাম। বেশ মজাই লাগছিলো। জাফরান যে এই ইনডোর গেমসে এতো ভালো জানা ছিলো না, এমনভাবে মাথা খাটিয়ে খেলছে যে আমি আর সূহা তো ওনার একটা গুটিও খেতে পারছি না। একটা বিষয় লক্ষ্য করলাম উনি আমার পাকা গুটিগুলো বেশি খাচ্ছেন! এই নিয়ে জাফরান ছয়বারের মতো যখন পাকা গুটিটা খেয়ে দিলো খুব রাগ হলো আমার

“জাফরান, আপনার কি একটুও দয়া হয় না? বারবার আমার গুটিগুলোই কেনো খাচ্ছেন? সুহার গুটি খান না, আমার আগে তো ওর গুটি ছেড়ে যাচ্ছেন”

“একদম না, সুহানা একবারও আমার গুটির পেছনে ধাওয়া করেনি। ও তো শান্তমতো যাচ্ছে, তুমি আমার গুটি খাওয়ার চেষ্টা করছো”

মুখ ফুলিয়ে নিলাম আমি, এতো দয়ামায়াহীন মানুষ যে উনি জানা ছিলো না। সুহানা খুশিতে গদগদ হয়ে উঠলো

“থ্যাংক ইউ ভাইয়া, আমি একটাও গুটি খাবো না তোমার প্রমিজ। তুমি শুধু আমাকে যেতে দাও আস্তে আস্তে”

“ওফ কোর্স, তুমি একটু একটু করে এগিয়ে যাও। তোমার আপুকে আমি দেখে নেবো”

“বাহ বাহ! দুজনে দেখছি ভালোই টিম আপ করা হয়েছে! আমাকে হারানোর চেষ্টা তো? পারবে না। কাওকে ছাড়বো না আমি”

“হয়েছে, মুখে কথা না বলে খেলে দেখাও”

আমরা খেলা কনটিনিউ করছিলাম, তখনই মা এসে হাজির হলেন রুমে

“এই সুহা, এখনও ওদের জালাচ্ছিস কেনো? রাত কতো হয়েছে সে খেয়াল আছে? চল এখান থেকে”

“ইটস ওকে, থাকুক না ও আরো কিছুক্ষণ এখানেই”

“না না বাবা, তোমরা বিশ্রাম করো। ও থাকলে আর আজ রাতে ঘুমাতে দেবে না তোমাদের। সুহানা চল”

মা সূহাকে নিয়ে গেলো, তাকিয়ে দেখলাম সত্যি অনেক রাত হয়েছে। জলদি করে মশারী টাঙিয়ে শুয়ে পড়লাম। আমার আবার বেশি রাত করে ঘুমালে পরে ঘুম আসতে চায় না। আমি ঘুমানোর চেষ্টায় ছিলাম তখনই হুট করে উনি বলে উঠলেন

“তুমি কি আমার পছন্দ – অপছন্দ সম্পর্কে সব জানো সুরভী?”

চোখ দুটো খোলার একটুও ইচ্ছে ছিলো না কিন্তু হঠাৎ ওনার প্রশ্ন শুনে বন্ধ করেও রাখতে পারলাম না

“হঠাৎ এই প্রশ্ন কেনো?”

“ইচ্ছে হলো তাই”

“ইচ্ছে হলে তো হবে না, এখন প্রশ্ন উত্তর খেলার সময় না। ঘুমান জাফরান। কালকে কথা হবে এই নিয়ে”

“আমি আজকেই জানতে চাই, বলো তুমি জানো আমার ব্যাপারে সবকিছু?”

“আপনার সন্দেহ আছে মনে হয়। ঠিক আছে বলুন কি জানতে চান?”

“আমার ফ্যাভরেট কালার কি?”

“এটা কোনো প্রশ্ন হলো? আপনি সাদা কালো রং দুটোই পছন্দ করেন, মানে ওই ফিফটি – ফিফটি টাইপ। তাইতো আপনার আলমারি ভর্তি কালো আর সাদা শার্ট শুধু”

কিছুটা অবাক হলেন উনি, এরপর একে একে আমাকে আরো অনেককিছু জিজ্ঞাসা করলেন। সবগুলোর উত্তর দিলাম, আমার উত্তর যেনো ওনাকে আরো অবাক করলো। উনি হয়তো ভাবেননি এসব উত্তর দিতে পারবো। ক্লান্ত হয়ে উঠেছি ওনার প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে, পরে কাঁথাটা গায়ে টেনে উল্টপাস ফিরে শুয়ে পড়লাম, তখন শুনলাম উনি বিড়বিড় করে বলছেন

“সবগুলোর উত্তর দিয়ে দিলো? আমি মনে হয় ইজি প্রশ্ন করে ফেলেছিলাম। আরো টাফ করা দরকার ছিলো। আমার লাকি নাম্বার কোনটা সেটা জিজ্ঞাসা করলে বলতেই পারতে না”

“এতগুলো উত্তর দিলাম তাও আপনার সন্দেহ দেখছি একটুও কমেনি। জানি আমি এটাও”

“সত্যিই জানো?”

“হুমম! টু আপনার লাকি নাম্বার। আপনি একবার বলেছিলেন যে টু সম্পর্কিত সব কিছু ভালো হয় আপনার জন্যে। এটা লাকি একটা নাম্বার আপনার জন্যে”

বিস্মিত হয়ে গেলো জাফরান, ও এতদিন ভাবতো সুরভী বুঝি কিছুই জানেনা ওর ব্যাপারে। কিন্তু আজ সেই ধারণা ভুল প্রমাণ হয়ে গেলো, তবে এটা জেনে আনন্দিত হয়েছে ও যে সুরভী ওর ব্যাপারে সবটা জেনে নিয়েছে! মেয়েটার প্রতি সদ্য জন্মানো ভালো লাগার অনুভূতিটা যেনো আরেকটু বেড়ে গেলো
_______________________________

ড্রইং রুমে বসে নিজের খালাতো ভাই রুহানের সাথে কথা বলছে সুরভী, জাফরান সরু দৃষ্টিতে একবার সুরভী আরেকবার রুহানকে দেখছে। হোক সে খালাতো ভাই, তারপরও হাসবেন্ড এর সামনে বসে অন্য একটা ছেলের সাথে সুরভীর হেসে হেসে কথা বলাটা ঠিক মানতে পারছে না জাফরান। ও নিজের ফোন বের করে মাইন্ড ডিস্ট্র্যাকট করার চেষ্টা করলো

“রুহান ভাইয়া? কেমন আছো তুমি!”

“তুই কেমন আছিস সেটা আগে বল!”

“আমি তো খুব ভালো আছি। ওহ হ্যা পরিচয় করাতে তো ভুলেই গেছিলাম। হি ইজ জাফরান, মাই হাসবেন্ড”

উনি অবাক হয়ে তাকালেন আমার দিকে

“ওহ ওয়াও!আমি যে এখানে আছি সেটা তাহলে মনে আছে তোমার? আমি তো ভেবেছিলাম ভুলেই গেছো”

“এটা আবার কি বলছেন? মনে কেনো থাকবে না? তাইতো পরিচয় করিয়ে দিলাম আপনাকে! রুহান ভাইয়া হলো আমার খালাতো ভাই বুঝেছেন?”

রুহান ভাইয়া হাসিমুখে হ্যান্ডশেকের জন্যে হাত বাড়ায় জাফরানের দিকে

“হ্যালো জাফরান, নাইস টু মিট ইউ”

জাফরান হ্যান্ডশেক করলেন না, বরং শুধু মুখেই “হ্যালো” বললেন। বুঝলাম না ব্যাপারটা, মেয়েদের সাথে হাত মেলায়না ঠিক আছে কিন্তু রুহান ভাইয়া তো ছেলে। এখানে সমস্যা কোথায় ছিলো? রুহান ভাইয়া ও কিছু আর বললেন না। হাতে থাকা প্যাকেটটা আমার দিকে এগিয়ে দিলো ভাইয়া

“এতে কি আছে ভাইয়া?”

“খুলেই দেখ না, তোর ফ্যাভরেট কিছু আছে”

খুলে দেখলাম বড় বড় সাইজের দুটো শন্ পাপড়ির প্যাকেট। এই একটা জিনিষ যেটা আমার পছন্দ আর লোভ সহজে আমি সামলাতে পারি না

“আমার শন্ পাপড়ি এনেছো? তোমার মনে ছিলো এটার কথা ভাইয়া? থ্যাংক ইউ”

“তোর পছন্দের কিছু, আর সেটার কথা আমি ভুলে যাবো এটা হতে পারে সুভী? এতদিন পর এলাম তাই ভাবলাম এটাই নিয়ে আসি”

জাফরান একরাশ বিরক্তি নিয়ে রুহানের দিকে দেখছে, এদিকে সুরভী তো শন্ পাপড়ি পেয়ে যেনো ভুলেই গেছে সব। রাগ হচ্ছে জাফরানের, সামান্য একটা খাবার নিয়ে এতো উত্তেজিত হবার কি আছে?

“সুরভীর পছন্দ সম্পর্কে ভালো নলেজ আছে দেখছি তোমার”

মুচকি হাসে রুহান

“অবশ্যই আছে! যেখানে পুরো মানুষটাই পছন্দের, সেখানে তার সম্পর্কে একটু জ্ঞান থাকা তো বাঞ্ছনীয় তাই নয় কি মিস্টার জাফরান?”

ভ্রু কুঁচকে ফেলে জাফরান, সুরভীর ক্ষেত্রে “পছন্দের মানুষ” কথাটা ব্যবহার করাটা জাফরানের মোটেও পছন্দ হলো না

“কি বলতে চাইছো তুমি?”

“এটাই যে আই লাইক হার অ্যা লট”

জাফরান কয়েক সেকেন্ডের জন্যে হতবিহ্বল হয়ে যায়, সেই মুহূর্তে আমিও হেসে রুহান ভাইয়ার তালে তালে বলে উঠলাম

“আই লাইক ইউ টু”

জাফরান তৎক্ষণাৎ ধমক দিয়ে ওঠেন

“হোয়াট দ্যা হেল আর ইউ সেয়িং সুরভী!!”

চমকে উঠলাম আমি, মজাই তো করছিলাম আমরা দুজনে। তাহলে জাফরান এভাবে ধমকাচ্ছেন কেনো আমায়? রুহান ভাইয়া তখন বলে উঠলেন

“হেই,ডোন্ট গেট রং। আসলে সুভী আমার সব বোনদের মধ্যে সবথেকে ক্লোজ। তাই ওর সম্পর্কে একটু বেশিই জানি, অ্যাম আই রাইট সুভী?”

মুখে হাসি ঝুলিয়ে হ্যা সূচক মাথা নাড়লাম আমি, জাফরান তিক্ত হয়ে যাচ্ছে এসব দেখে। রুহান ছেলেটার দুটো কথা শুনেই কেমন যেনো সুবিধার মনে হচ্ছে না ওর। তখন আমার মা কি জন্যে যেনো ডাকলো রুহান ভাইয়াকে, রুহান ভাইয়া চলে গেলো। আমি পাপড়ির প্যাকেট খুলেই আগে একটা মুখে দিলাম, অনেকদিন পর নিজের পছন্দের খাবার খেতে পারলাম।

“জাফরান, টেস্ট ইট! ভীষণ ভালো খেতে, বিশেষ করে এই শন্ পাপড়ির গুড়াগুলো খেতে আরো মজা”

আমি এক পিস তুলে জাফরানকে খাওয়াতে গেলেই হাত সরিয়ে দেন উনি, বিরক্তিকর ভঙ্গিতে প্রশ্ন করে ওঠে

“তোমার পছন্দের কথা ও জানে কিভাবে?”

“কেনো? জানতে পারে না?”

“পাল্টা প্রশ্ন করো না, কিভাবে জানে ও?”

“আমি যখন খালামনির বাড়ি যেতাম তখন রুহান ভাইয়াকে সবসময় শন্ পাপড়ি আনতে বলতাম, তখনই জেনেছে এটা আমার খুব পছন্দ। এরপর থেকে ভাইয়া যখনই আমাদের বাসায় আসে নিয়ে আসে এগুলো কিনে”

উনি আমার দিকে বিস্ময়কর চাহনি ক্ষেপণ করলেন, আমি ভ্রু কুঁচকে শন্ পাপড়ি মুখে পুরে বোঝার বৃথা চেষ্টা করতে লাগলাম এই চাহনির দ্বারা কি বোঝাতে চাইছে জাফরান!

“হোয়াট? তোমার খালাতো ভাই তোমার পছন্দের কথা জানে আর আমি তোমার হাসবেন্ড হয়ে জানিনা? সিরিয়াসলি?”

“আপনি কি কোনোদিন এসব বিষয়ে জানতে চেয়েছেন, বা আমি বলেছি যার থেকে জানবেন? ও তো আমায় ছোটো থেকে দেখছে তাই টুকটাক জানে”

নিশ্চুপ হয়ে গেলো জাফরান, সত্যিই তো এতগুলো দিন হয়ে গেল ওরা একসাথে আছে। এর মধ্যে কোনোদিন ও সুরভীর সম্পর্কে কিছু জানার চেষ্টাই করেনি, নিজের প্রয়োজন ছাড়া সুরভীর সাথে আর কিছু নিয়ে আলোচনা করেনি। যে মেয়েটা এতকিছু করছে ওর জন্যে তার পছন্দ অপছন্দ সম্পর্কে কোনো ধারণাই নেই জাফরানের। মেয়েটা সব জানে ওর ব্যাপারে তার প্রমাণ গত রাতেই পেয়েছে, সেখানে ও সামান্য একটা পছন্দের খাবারের কথাও জানেনা। প্রথমবার সুরভীর বিষয়ে জানার ইচ্ছা হচ্ছে জাফরানের
_______________________________

জাফরানের বাড়ি থেকে সবে ফিরে এলো নাতাশা, যখন জানতে পেরেছে ও সুরভীর বাবার বাড়িতে গেছে তখন থেকেই লাগাতার ফোন করে যাচ্ছে জাফরানকে কিন্তু ফোন ধরছে না। নাতাশার বাবা অফিসে যাচ্ছিলেন, মেয়েকে পায়চারি করতে দেখে দাড়িয়ে পড়েন উনি।উনি প্রশ্ন করার আগেই নাতাশা বলে ওঠে

“বাবা, আমি ভেবেছিলাম আজ জাফরানের সাথে মিট করবো। ওর বাড়ি গিয়ে সারপ্রাইজ দেবো সেখানে ও ওই মেয়েটার বাবার বাড়িতে গেছে। আমার ফোন ধরছে না, বাবা এসবের মানে কি?

“মানে আবার কি? শ্বশুরবাড়ি যেতেই পারে ও”

“কেনো যাবে ও? তারমানে কি জাফরান সুরভীকে মেনে নিলো? এটা তো অসম্ভব! আমি তো শুনেছি মাত্র তিনমাস হয়েছে ওদের বিয়ের, আর জাফরান এতো সহজে কোনো মেয়ের প্রতি অ্যাট্রাক্তেড হতেই পারে না”

“এসব কি পাগলামি করছিস তুই নাতাশা? বন্ধ কর এসব! জাফরান বিয়ে করে নিয়েছে, তুইও বিয়ে করে সংসার শুরু কর”

“না বাবা, অন্য কাউকে বিয়ে করবো না আমি। আমার জাফরানকেই চাই। তুমি আমাকে হেল্প করবে না আমার ভালোবাসা ফিরে পাওয়ার জন্যে?”

রায়হান সাহেব মেয়ের পাগলামিতে সায় দিলেন না, চলে গেলেন। নাতাশার রাগ হচ্ছে এখন। জাফরানের সঙ্গে দেখা হওয়া, ওর সাথে কথা বলার পর থেকেই আবার পুরনো দিনগুলোর মতো জাফরানের সাথে কাটাতে ইচ্ছে করছে ওর। কিন্তু হুট করেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে জাফরান আর সুরভীর খাবার নিয়ে খুনসুটির দৃশ্যটা। মুহূর্তের মধ্যেই মেজাজ গরম হয়ে যায় নাতাশার

“আবার যখন চেয়েছি তখন জাফরানকে আবার নিজের করে নেবো আমি, এতো সহজে ওকে অন্য কারো হতে দেবো না”
___________________________________

আমাদের বাড়িটা শহর থেকে দূরে, মফস্বলের ভেতর বিধায় শহরের মতো এতো শব্দদূষণ এখানে হয় না। নিরব পরিবেশ, দুপুরের পর গাছের ছায়াতলে হাটতে ভালোই লাগে। দুপুরে খাবার পর হাটতে হাটতে জাফরানকে নিয়ে এসেছি আমাদের মফস্বলের সৌন্দর্য দেখাতে

“এই দেখুন জাফরান, এই পুকুরটাতে আমি ছোটবেলায় সাঁতার কাটতাম। অবশ্য তখন এটা আরো সুন্দর আর স্বচ্ছ ছিলো। এখন তো পানিও অনেক কমে গেছে”

জাফরান কোনো উত্তর দিলেন না, আমি ওনার দিকে তাকিয়ে দেখলাম অন্যমনস্ক হয়ে কিছু একটা ভেবে চলেছেন উনি

“কি ব্যাপার! আজ এতো চুপচাপ কেনো?”

ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছেড়ে উনি বলে উঠলেন

“কি বলবো?”

“কি বলবেন মানে? আমি আপনাকে এতকিছু দেখাচ্ছি। সবকিছুর বিস্তর বর্ণনা দিচ্ছি,আর আপনি চুপ করে আছেন। কিছু নিয়ে চিন্তায় আছেন নাকি?”

না সূচক মাথা নাড়লেন উনি!

“তাহলে?”

উনি কয়েক সেকেণ্ড সময় নিলেন, কিছু একটা ভাবলেন। তারপর প্যান্টের পকেট থেকে ছোট্ট একটা পেন আর পেপার বের করে বললেন

“এখানে বসি একটু”

উনি আমায় পুকুরের পাশে বসালেন, আমিও বসলাম কিন্তু এই কাগজ কলমের এখানে কি কাজ সেটা আয়ত্ত করে উঠতে পারলাম না

“এগুলো দিয়ে কি করবেন?”

“সুরভী, আমি এখন একে তোমাকে কিছু প্রশ্ন করবো তোমার ব্যাপারে আর কি। সেগুলোর সিরিয়াসলি উত্তর দেবে”

“কিন্তু কেনো?”

“বিকজ আই ওয়ান্ট টু নো অ্যাবাউট ইউ”

চলবে….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে