ভালোবাসি পর্ব-০৮(শেষ পর্ব)

0
1267

গল্পঃ- ভালোবাসি
লেখকঃ- সাব্বির আহমদ
পর্বঃ- শেষ

প্রায় ১ ঘন্টা পর আমার সাজ কমপ্লিট হলো.আয়নায় নিজেকে দেখে চমকে উঠি.হলুদ কালারের একটা ভারী লেহেঙ্গা পড়েছি সাথে হলুদ কালারের সব ফুলের অর্গামেন্টস .নিজেকে নিজেই চিনতে পারছি না.সাবু আমার দু কাঁধে হাত রেখে বলে ,

-কিরে কেমন সাজালাম!দেখ তোকে কি কিউট লাগছে.

আমি মুচকি হেসে বললাম ,

-আমি তো বরাবরই কিউট !

সাবু ব্রু কুঁচকে বলে ,

-জিনা আমি এত সুন্দর করে সাজিয়ে দিয়েছি বলেই তোকে কিউট লাগছে নয়তো পার্লারে সাজলে নির্ঘাত পেত্নীর মতো লাগতো .

সাবুর কথা শুনে আমি ওর দিকে ব্রু কুঁচকে তাকাই.আমার তাকানোর স্টাইল দেখে সাবা বলে,

-কি এভাবে কি দেখছিস?

আমি তাচ্ছিল্লের স্বরে বলি,

-না আমার বান্ধবী যে এত বড় মেকাপ আর্টিস্ট তা আগে আমার জানা ছিল না.ভাগ্যিস তুই এতো ভালো মেকাপ করতে জানিস নয়তো আমাকে তো পার্লার থেকে পেত্নীর মতো সেজে আসতে হতো .কি দুঃখের ব্যাপার বলতো.আমান তো আমার পেত্নীর মতো চেহারাটা দেখে নির্ঘাত অজ্ঞান হয়ে যেত.আল্লাহ বাঁচিয়েছে বল ,নয়তো আজ আমার বিয়েটাই হতো না.

আমার কথা শুনে সাবা আমার দিকে সরু চোখে তাকিয়ে বলে
-আমি বেশ বুঝতে পারছি যে তুই আমার মজা নিচ্ছিস!

আমি সাবার দিকে তাকিয়ে মুখে একটা সিরিয়াস ভাব এনে বললাম ,
-এসব কি বলছিস বলতো!আমি তো তোকে নিয় গর্ব করছি এই যে তুই এত ভালো মেকাপ করতে পারিস।দেখবি একদিন তুই তোর এই মেকাপের জন্য নোবেল পুরস্কার পাবি
.
আমার কথা শুনে সাবা মুখ শক্ত করে বলে
-মেকাপের জন্য কেউ আজ অবধি নোবেল পায়নি ।

আমি ভাবার এক্টিং করে বললাম
-কেউ পাই নি .তো কি হয়েছে তুই পাবি.সর্বপ্রথম মেকাপ আর্টিস্ট হিসেবে নোবেল বিজয়ী হবে আমার এক মাত্র বেস্টি সাবা চৌধুরী.ইয়ে হাত তালি.

কথাটা বলে দুটো হাত তালি দিতে আম্মু হুড়মুড়িয়ে রুমে আসে.আমাকে দেখে বলে ,

-তাড়াতাড়ি স্টেজে চল .মেহমানরা সবাই অপেক্ষা করছে.তারপর সাবার দিকে তাকিয়ে বলে ,

-সাবু ওকে একটু তাড়াতাড়ি নিয়ে আয় তো মা।

সাবা মাথা হেলিয়ে বললো
– ঠিক আছে মামনি নিয়ে আসছি.

সাবার কথা শেষ হতেই আম্মু আবার তাড়াহুড়ো করে রুম থেকে বেড়িয়ে যায় ।

আম্মুর ব্যবহারে আমি খুব অবাক হই।আমি সামান্য একটা জামা পড়লেও আম্মু আমাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে আর আজ এত সাজলাম তাও একবার ভালো করে তাকালো না.আম্মুর চোখ মুখটাও যেন কেমন লাগছিলো.আম্মুকি কান্না করেছে তাই হয়তোবা আমার চোখে চোখ রেখে কথা বলেনি যদি আমি ধরে ফেলি.হাজার চিন্তা মনে এসে ভিড়ছে.আমাকে গভীর ভাবে কিছু ভাবতে দেখে সাবা আমাকে হালকা ধাক্কা দিয়ে বলে,

-কিরে প্রত্তু কি ভাবছিস.চল স্টেজে যাই।

-হুম চল.।

রাত২.৩০টা ,

ক্লান্ত শরীরটা বিছানায় এলিয়ে দিলাম.উফফ এই বিয়ে মানেই হলো একটা ঝামেলা.খুব বিরক্ত লাগছে.হলুদ দিয়ে পুরো গোসল করিয়ে দিয়েছে.অসহ্য.ভীষণ রাগ লাগছে আমার.বিশেষ করে ওই পেত্নী সাবাটার উপর কি অবস্থা করেছে আমার হলুদ দিয়ে.১ ঘন্টা ধরে ঘষে মেজে বোধ হয় এই দাগ উঠেছে .সারারাত এতো হৈচৈ করে এখন খুব টায়ার্ড .রাজ্যের ঘুম এসে চোখে ভীড় করেছে.চোখের পাতাটা বুজে আসতেই মোবাইলটা বেজে উঠলো.উফফ এখন আবার কে কল দিয়েছে !মানুষের কি সামান্য কমন সেন্স নাই.এত রাতে কল দিয়ে কেন আমার ঘুমের বারোটা বাজাচ্ছে .কিসের এত শত্রুতা সবার আমার সাথে কে জানে.একরাশ বিরক্ত নিয়ে ফোনটা হাতে নিয়ে দেখি কিউট বর কল দিচ্ছে.আমানের নাম্বারটা ওই পেত্নী সাবুটাই এই নাম দিয়ে সেইভ করেছে.কিন্তু উনি কেন এখন কল দিচ্ছে .উফফ!আমার ঘুম.

-হ্যালো!আস্সালামুআলাইকুম !

-ওয়ালাইকুমসসালাম.কেমন আছেন ?

-আলহামদুলিল্লাহ ভালো .আপনি ?

-আমিও আপনার মতোই আছি .কি করছেন?

-এই তো ফ্রেশ হয়ে এসে শুলাম ।

-ওহ আপনাদের এখানে অনুষ্ঠান শেষ ?

-হুম.এখন সবাই ঘুমের প্রস্তুতি নিচ্ছে.আপনাদের কি এখনো হলুদ চলছে .

-এখানে এখন পিচ্চিরা সবাই মিলে নাচানাচি করছে.আমি আমার রুমে চলে এসেছি.ভাবছি এখন ফ্রেশ হয়ে রেস্ট নিবো.

-ওহ.

-হুম .আআ.আপনাকে হলুদ লেহেঙ্গায় কিন্তু খুব ভালো মানিয়েছে ।

আমি অবাক হয়ে বলি
-আপনি আমায় দেখলেন কিভাবে ?

-সাবা পিক পাঠিয়েছিল ।

-উফফ এই মেয়েটা না .আমাকে বলেওনি কখন পিক পাঠিয়ে দিয়েছে আল্লাহই জানে.

আমান কিছুক্ষন চুপ থেকে বললো ,
-আপনার গালের হলুদ দেখে আমারও খুব ইচ্ছে করছিলো আপনাকে একটু হলুদ ছুঁইয়ে দিতে.

আমি চুপ হয়ে রইলাম .উনি একটু গলা ঝেড়ে বললেন ,

-আচ্ছা তো ঘুমিয়ে পড়ুন.কাল ও তো ঘুমের ডিস্টার্ব হবে তাই আজকে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়ায় ভালো .।

কাল ঘুমের ডিস্টার্ব হবে.কিন্তু কেন.মনে মনে নিজেকেই প্রশ্নটা করলাম।তারপর উনাকে বললাম ,

-আচ্ছা.আল্লাহ হাফেজ.

-ওকে.আল্লাহ হাফেজ.

ফোনটা কান থেকে নামিয়ে বালিশের পাশে রেখেই আমি ঘুমের রাজ্যে তলিয়ে যাই.
.
ছাদের এক কোণে মুখ ফলিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সাবা.তার পাশেই পকেটে হাত দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ইরফান .বেশ কিছুক্ষন এইভাবে দাঁড়িয়ে থেকে ইরফান বলে উঠে ,

-এই মেয়ে আর কতক্ষন এভাবে মুখ ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে.অবশ্য তুমি এভাবে মুখ ফুলালে না তোমাকে একদম রসগোল্লার মতো লাগে.ইচ্ছে করে এক্কেবারে কামড়ে খেয়ে ফেলি .
কথাটা বলে ইরফান সাবাকে চোখ মারে.সাবা ইরফানের কথা হজম করতে না পেরে ওর দিকে হা করে তাকিয়ে থাকে .সাবার তাকানোতে ইরফান বলে ,

-কি হলো এইভাবে তাকিয়ে আছো কেন.মানছি আমি একটু বেশিই হেন্ডসাম তাই বলে এইভাবে তাকিয়ে থাকবে আমারও তো লজ্জা শরম আছে নাকি!

ইরফানের এমন আগা গোড়া হীন কথায় সাবা গোল গোল চোখ করে ওর দিকে তাকায় .পরক্ষনেই নিজেকে শক্ত করে বলে ,

-আমি আপনার সাথে কোনো কথায় বলবো না .আমি তো আপনার কেউ না .সারাদিন তো আমার সাথে একবারও কথা বলার সময় পান না .আমি যেচে কথা বলতে গেলেও আপনি আমাকে ইগনোর করেছেন.তাই আমি আর আপনার সাথে কথা বললো না ।হুহ (মুখ ফুলিয়ে বলে সাবা)

সাবার এই বাচ্চা বাচ্চা কথা গুলো শুনে ইরফান সাবার সামনে দাঁড়িয়ে ওর দুপাশে রেলিং-এর উপর হাত রেখে সাবার খুব কাছে এসে বলে ,

-জানো আজ কেন তোমাকে এত ইগনোর করছিলাম.কারণ তোমাকে যখন এই হলুদ শাড়িতে দেখি তখনি আমার মাথা কাজ করা বন্ধ করে দেয়.ইচ্ছে করছিলো সব কিছু ফেলে রেখে তোমার কাছে যেতে .কিন্তু তা করলে তো হবে না বোনের বিয়ে বলে কথা আমাকেই তো সব কিছু দেখতে হবে তাই ইচ্ছে করেই তোমাকে ইগনোর করছিলাম যাতে করে তুমি আমার উপর রাগ করে আমার সামনে না আসো আর আমিও আমার সম্পূর্ণ মনোযোগ এই কাজে দিতে পারি.কিন্তু এখন যে আর আমি নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারবো না ডিয়ার।

কথাটা বলে সাবা কিছু বুঝে উঠার আগেই সাবার ঠোঁটে ইরফান ঠোঁট ডুবালো.
.
সকাল ৭.৩০টা

ঘুমের মধ্যে মনে হচ্ছে আমি কোনো মাছের বাজারে চলে আসছি .উফফ এতো চিৎকার চেঁচামেচি করছে কেন সবাই .সবাই কি দেখছে না আমি ঘুমাচ্ছি.পাশ থেকে কুশনটা কানে চেপে ধরতে কে যেন সেটা ছো মেরে নিয়ে নেয়.রাগে বোম হয়ে সেই মানুষটার দিকে তাকাতেই দেখি সাবু এক হাতে কোমর অন্য হাতে কুশনটা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে.আমাকে তাকাতে দেখেই ও বলে উঠে ,

-আর কত ঘুমাবি এবার তো উঠ.ফ্রেশ হয়ে পার্লারে যেতে হবে নাকি!

আমি ঘুমু ঘুমু কন্ঠে বললাম ,

-তুই থাকতে পার্লারে যাবো কেন ?

সাবা কুশনটা আমার পাশে রাখতে রাখতে বলে ,

-বিয়ের সাজ খুব গর্জিয়াস হয়.আমি তো আর এত ভালো সাজাতে পারবো না ।

সাবার কথা শুনে আমি উঠে বসি .তারপর ঠোঁট উল্টিয়ে বলি ,

-নোপ বেবি .তুমিই আমাকে সাজিয়ে দিবে আমি কোনো পার্লারে যাচ্ছি না ,ব্যাস!

-কিন্তু প্রত্তু ,

-কোনো কিন্তু না আমি যা বলছি তাই হবে.

-আচ্ছা বাবা ঠিক আছে এখন তো আগে ফ্রেশ হতে যা.

-হুম যাচ্ছি.
.
বিকেল ৪.৩০

মা ভাইয়াকে ছেড়ে শশুর বাড়িতে চলে এলাম.বুকের ভেতরটা কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে.জানি না মা আর ভাইকে ছেড়ে কিভাবে থাকবো.এই মানুষ দুটোই যে আমার পুরো পৃথিবী.ওদেরকে ছেড়ে আসতে যে বুকটা ফেটে যাচ্ছিলো.মাকে এত করে ডাকলাম আসার সময় কিন্তু উনি একবারও আমার সামনে এলেন না জানি আড়াল থেকে চোখের পানি ফেলেছেন .আমি না উনার চোখের পানি দেখে ফেলি সেই ভয়ে আমার সামনে আসেনি .আর ভাইয়া সে তো আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলেছে’তোর মতো একটা বোন পেয়েছি বলেই ভাই হিসেবে আমি সার্থক.ওই বাড়িতে গিয়ে তুই আরেকটা মা পাবি.আর বাবাও পাবি দেখবি তোর আর কোনো কষ্ট হবে না.’বেশ বুঝতে পারছিলাম কথা গুলো বলার সময় ভাইয়ার গলা আটকে যাচ্ছিলো.কিন্তু আমাকে বুঝতে দেয়নি.আর আমার ওই পাগলিটা আছে না সাবা সে তো আমার কবুল বলা থেকে কান্না.মনে হচ্ছিলো আমার বিয়ে হচ্ছেনা আমাকে ফাশিতে চড়ানো হচ্ছে।আসার সময় ওকে জড়িয়ে ধরে বলে এসেছিলাম.’আমার ভাই আর মায়ের খেয়াল রাখিস.’
.
নতুন বউকে পেয়ে এই বাড়ির মানুষ গুলো যেন তাদের খুশি ধরে রাখতে পারছে না .বাড়ির পিচ্চি গুলো বেশ মনোযোগ দিয়ে আমায় দেখছে .যেন আমি কোনো এলিয়েন.বেশ কিছুক্ষন উনাদের সাথে সময় কাটানোর পর মা(আমানের আম্মু)আমাদের রাতের খাবারের জন্য ডাকলেন.সবাই একসাথে খাওয়া দাওয়া শেষে আমাকে আমানের রুমে রেখে আসা হলো.

পুরো রুম ফুলেতে ভরপুর.যেদিকে তাকাই সেদিকেই ফুল.অন্যরকম একটা পরিবেশ.বাইরে হঠাৎই বৃষ্টি শুরু হয়েছে .সাথে ঝড়ো বাতাসও বইছে.বাইরের ঝড়ের সাথে তাল মিলিয়ে আমার মনেও ঝড় বয়ে যাচ্ছে.এক অজানা অনুভূতি আমাকে ধীরে ধীরে গ্রাস করছে.কিছুক্ষন বাদে দরজা ঠেলে আমান ভেতরে আসে .উনাকে দেখে আমি সালাম করতে গেলেই উনি আমাক বাহুতে ধরে বলে,

-পা ধরতে হবে না.মুখে সালাম দিলেই হবে ।

আমিও উনার কথা মতো মুখে সালাম দিলাম .তারপর উনি আমাকে উযু করে আসতে বলেন.আমিও তাই করি .দুই রাকাত নফল নামাজ শেষে আমি বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ায়.ঝড়ো বাতাসটা বন্ধ হয়েছে তবে বৃষ্টি এখনো পড়ছে.হঠাৎ পেটের উপর ঠান্ডা কিছুর স্পর্শে কেঁপে আমি উঠি.আমান আমাকে আলতো করে জড়িয়ে ধরে বলে .

-এখনো তো কিছুই করেনি তার মধ্যেই এত কাপাকাপি.

উনার শীতল কণ্ঠে আমি লজ্জা পেয়ে যাই উনি আমার কানের পিঠে চুমু দিয়ে বলে .

-আজ থেকে আমি প্রতিটা বৃষ্টি ভেজা রাতে এইভাবেই তোমাকে কাছে চাই.

তারপর উনি আমাকে আরেকটু শক্ত করে জড়িয়ে ধরে আমার ঘাড়ে আলতো করে চুমু দিয়ে বলে ,

-কি হবে তো আমার প্রতিটা বৃষ্টি ভেজা রাতের সঙ্গী?
আমি লজ্জা মাখা কণ্ঠে বলি ,

-হুম।

—————-সমাপ্ত—————

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে