ভালোবাসি তোকে পর্ব-৫+৬+৭

0
4607

#ভালোবাসি তোকে ❤
#লেখিকা: অনিমা কোতয়াল
#পর্ব- ৫
.
সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি উনি আমার হাতের ওপর হাত দিয়ে রেখেছেন। আমি কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলাম ওনার ঘুমন্ত মুখটার দিকে কতো নিষ্পাপ লাগছে একদম বাচ্চা বাচ্চা। চিন্তাই করা যায়না এই লোকটা এতো বদরাগী। তারপর আস্তে উঠে বসে ওনার ফোনটার দিকে তাকালাম। গতকাল সকালের সেই ফোনের কথা মনে পরতেই কলটা কার ছিলো জানার আগ্রহ বেড়ে গেল। ফোনটা ধরতে যাবো তখনি উনি নড়েচড়ে উঠলেন। আমি চমকে গিয়ে সরে এলাম। কোনোরকমে নিজেকে সামলে নিয়ে ওয়াসরুমে চলে গেলাম ফ্রেশ হতে। শাওয়ার নিয়ে বেড়িয়ে এসে দেখি আদ্রিয়ান ভাইয়া উঠে গেছেন। আমি ওনার দিকে তাকিয়ে একটু গলা ঝেড়ে বললাম,

— “আপনি কফি খাবেন? মনিকে পাঠিয়ে দিতে বলবো?”

উনি আমার দিকে তাকিয়ে একটু হেসে বললেন,

— ” কেনো? তুমি আনতে পারবেনা?”

আমি মুখ গোমড়া করে বললাম,

— ” আমি নিয়ে আসলে আপনার মনে হবে আমি আপনার বউ হতে চাইছি।”

উনি শান্ত চোখে কিছক্ষণ তাকিয়ে রইলেন আমার দিকে। আমিও কিছু না বলে নিচে চলে গেলাম আর মনিকে দিয়েই ওনার কফিটা পাঠিয়ে দিলাম।

বিকেলে আমরা সবাই আমাদের বাড়িতে গেলাম। আপি আর ইফাজ ভাইয়াও এসছে। আদ্রিয়ান ভাইয়া বাড়ির সবার সাথেই ভালোভাবেই কথা বলেছে মিশেছে। ওনাকে দেখে কেউ অনুমানও করতে পারবেনা যে কী চলছে ওনার মনে। তবে সকাল থেকেই উনি ল্যাপটপে কোনো একটা কাজ নিয়ে খুব বেশিই বিজি। আমাদের বাড়িতে এসেও কাজ করছে। একটা কথা বরাবরই ভাবায় আমাকে উনি তো জাস্ট একজন ইঞ্জিনিয়ার কিন্তু ওনার অতিরিক্ত ব্যাবস্তার কারণ সবার কাছেই অজানা। ওনার একটা নিজস্ব ল্যাবও আছে যেখানে কিছু এমপ্লয় ছাড়া উনি আদিব, আর ইশরাক ভাইয়ারই ঢোকার অনুমতি ছিলো। রাতে ওনার পাশে হেলান দিয়ে বসে বসে এসবই ভাবছি আর উনি কাজ করছেন। হঠাৎ ল্যাপটপটা অফ করে উনি বললেন,

— ” চলো ছাদে যাই।”

আমি ভ্রু কুচকে তাকালাম ওনার দিকে হঠাৎ ছাদে যাওয়ার সখ কেনো হলো? তাও আমায় নিয়ে। আমি কথা না বাড়িয়ে মাথা নাড়লাম।ছাদে গিয়ে উনি ছাদের উঁচু করে রাখা দেয়ালটার সাথে হেলান দিয়ে নিচে বসে আমার দিকে তাকিয়ে ওনার পাশে বসতে বললেন।আমি ওনার কথামত ওনার পাশে গিয়ে বসলাম। আমি শুধু অবাক হয়ে ওনাকে দেখছি। আজ আবারও সেই মাসখানেক আগের আদ্রিয়ান ভাইয়াকে দেখতে পাচ্ছি। বেশ কিছুক্ষণ দুজনেই নিরব ছিলাম।নিরবতা ভেঙ্গে উনি আমার হাতে ওনার দুহাতের মধ্যে নিয়ে বললেন,

— ” আই এম সরি অনি। আসলে বিয়েটা হুট করে হয়েছে তারওপর ইশরাক.. সব মিলিয়ে মাথা ঠিক ছিলোনা আমার। তোমার সাথে ওরকম খারাপ ব্যবহার করাটা আমার ঠিক হয়নি।”

আমি শুধু তাকিয়ে আছি ওনার দিকে ওনার চোখদুটো লাল হয়ে আছে। উনি আবারও বললেন,

— ” জানো অনি আমি, আদিব আর ইশরাক বেশিরভাগ সময় একসাথে ছাদে আড্ডা দিতাম। আর ইশরাক তো সবসময় মাতিয়ে রাখতো। আমাদের আড্ডার প্রাণ ছিলো ও।”

আমি নিচের দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস নিলাম এগুলোর কিছুটা জানি আমি তবুও ওনাকে থামাচ্ছিনা, নিজের মনের কথা বলে অন্তত নিজেকে হালকা করুক। উনি আবার বললেন,

— ” আচ্ছা? এমন হওয়ার কী খুব দরকার ছিলো? বেশ তো ছিলাম আমরা। হাসি মজায় আনন্দে বেশ ভালো কাটছিলো। তাহলে ভুলটা কোথায় ছিলো? ভালো কিছূ করার পরিণাম কী এটাই হয়?”

আমি এতোক্ষণ ওনার কথার মানেগুলো বুঝলেও এখন বুঝতে পারছিনা। কী বলতে চাইছেন উনি? কী ভালো কিছু করতে চেয়েছিলেন ইশরাক ভাইয়া। এসব হিসেব মেলাতে মেলাতেই উনি আবার বললেন,

— ” জানো ইশরাকের বাবা মা কীভাবে তরপে তরপে মরছে? ইশরাকের বউটাও জীবন্ত লাশ হয়ে বেঁচে আছে। পুরো পরিবারটা শেষ হয়ে গেছে। সকালেও ফোনে প্রচুর কাঁদছিলো মেয়েটা। পাঁচ মাসের প্রেগনেন্ট ও। অথচ ওর বাচ্চাটা বাবা বলে ডাকার মতো কাউকে পাবেনা।”

আমি অবাক হয়ে গেলাম। তারমানে সকালে উনি নূর আপুর সাথে কথা বলছিলেন আর আমি কীসব ভাবছিলাম। ছিঃ! হঠাৎ করেই উনি বলে উঠলেন,

— ” সব দোষ আমার। সব আমার জন্যে হয়েছে। আমার জন্যেই ইশরাক আজ আমাদের মাঝে নেই। আমার ভুলের জন্যেই ওকে মরতে হয়েছে। কেনো আমি আগে থেকে কিছুই আন্দাজ করতে পারিনি? কেনো? আমি খুনি? এই তুমি জানো তোমার হাজবেন্ট একজন খুনি? তুমি এই খুনির সাথে থেকোনা অনি। হয়তো একদিন তোমাকেও খুন করে ফেলবো। তুমি আমার কাছে সেফ নও। সেফ নও তুমি আমার কাছে। আমি শেষ করে দিয়েছি একটা পরিবারকে। আমার পরিবারও আমার জন্যে শেষ হয়ে যাবে সব শেষ হয়ে যাবে। সব। ”

এসব আওরাতে আওরাতে উনি আমার কাধে মাথা রেখে দিলেন। আমি শুধু স্তব্ধ হয়ে ওনার কথাগুলো শুনছি। ইশরাক ভাইয়ার মৃত্যুর সাথে ওনার কী সম্পর্ক? উনি কেনো নিজেকে দায়ী করছেন। ইশরাক ভাইয়া যখন মারা গেছেন তখন তো উনি ওনাদের বাড়িতে ছিলেন। আমাদের সামনে, তাহলে? নিজেকে কেনো খুনী বলছেন উনি? কেনো?

ওনার দিকে তাকিয়ে দেখি উনি ঘুমিয়ে পরেছেন। দেয়ালে কিছুটা সাপোর্ট আছে তাই আমার প্রবলেম হচ্ছে না। আমি হাত দিয়ে ওনাকে একটু ধরে আবারও চিন্তায় মগ্ন হয়ে গেলাম। আর সেই দিনের কথা ভাবতে লাগলাম,

আপির রিসিপশনের অনুষ্ঠান। কালকে আমি বিয়ের আপির সাথেই এই বাড়িতে এসছি। সবাই মিলে বেশ মজাও করেছি কিন্তু উনি ওতটা সময় দিতে পারেননি আমাদের। কাজে ব্যস্ত ছিলিন। বাড়ির দায়িত্ববান ছেলে কী না। তাতে ভালোই হয়েছে ওনার লেগ পুলিং এর হাত থেকে তো বেঁচে গেছি। কাল আমার গলা থেকে হারটা খুলতে বাধ্য করেছে। আরে ভাই র‍্যাস হলে আমার হবে তাতে তোর কী? সবাই মিলে গল্প করতে বসেছি। সবাই থাকলেও ইশরাক ভাইয়াকে কোথাও দেখতে পাচ্ছিলাম না। আদ্রিয়ান, আদিব ভাইয়া দুজনেই কনটিনিউয়াসলি ফোন করছেন ওনাকে। ফোন বন্ধ। আদিব ভাইয়া বললেন,

— ” হঠাৎ কী হলো ওর? শালা সবসময় এমন করবে?”

আদ্রিয়ান ভাইয়াও নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে আবারও ফোনে ট্রায় করতে করতে বললেন,

— ” আসুক আজকে। যদি অবস্থা খারাপ না করেছি তো।”

প্রথমে সিরিয়াসলি না নিলেও পরে ওনারা চিন্তায় পরে গেলো। আমরাও ভাবছি যে যে লোকটা অনুষ্ঠানে থাকার জন্যে এতো লাফালাফি করছিলো হঠাৎ করে তার কী হলো? সবার আড্ডা দেওয়ার মুড শেষ হয়ে গেল। অতিথীরা খেয়ে চলে গেছেন। ইশরাক ভাইয়ার পরিবারকেও ফোন করা হয়েছে তারা কিছূই জানেননা। সময় যতো যাচ্ছে ওনাদের অবস্থা ততো বেশি খারাপ হচ্ছে। হঠাৎ করেই আদ্রিয়ান ভাইয়ার ফোন এলো উনি হকচকিয়ে ফোনটা ধরতেই ওপাশ থেকে কিছু একটা বলল যেটা শুনে ওনার হাত থেকে ফোনটা পরে গেলো। ওখানে বসে পরলেন উনি। ওনার সারা শরীর কাঁপছে, কপাল ঘেমে আছে। আদিব ভাইয়া তাড়াতাড়ি ফোনটা নিজের কাছে নিয়ে কানে নিয়ে বললেন,

— ” হ্যালো? হ্যালো? কে বলছেন?”

ওপাশ থেকে আবারও কিছু বলল যেটা শুনে ওনার চোখ দিয়ে একফোটা জল গড়িয়ে পরলো। আদ্রিয়ান ভাইয়া কিছূ একটা ভেবে উঠে দৌড় লাগালো। আদিব ভাইয়াও আঙ্কেলদের ইশরাক ভাইয়ার বাড়িতে যেতে বলে আদ্রিয়ানের পিছে পিছে দৌড় লাগালো। আমরা সবাই বোকার মতো দাঁড়িয়ে আছি। মানিক আঙ্কেল বললেন,

— “‘ নিশ্চয়ই কিছু হয়েছে, গিয়ে দেখতে হবে!”

আব্বুও মাথা নাড়লেন। আমরা সবাই গেলাম ঐ বাড়ি। গাড়ি থেকে নেমে দেখলাম বাড়ির গার্ডেন এরিয়াতে অনেক ভীর হয়ে আছে। আমার বূকের মধ্যে এক অজানা ভয় কাজ করছে কোনো গন্ডগোল হয়নিতো? আমরা ভীর ঠেলে ভেতরে গেলাম। যা দেখলাম তাতে চমকে গেছি আমি। একটা লাশ সাদা কাপড় দিয়ে ডেকে রাখা হয়েছে। আদ্রিয়ান শক্ত হয়ে বসে আছে লাশটার পাশে। আমাদের দেখানোর জন্যে লাশটা মুখ থেকে কাপড় সরাতেই আমি পুরো জমে গেলাম। আমার পা থরথর করে কাঁপছে। নিজের চোখকে আজ ভুল প্রমাণ করতে খুব ইচ্ছে করছে। ইশরাক ভাইয়ার রক্তাক্ত মুখটা দেখে সব কিছু অন্ধকার লাগছে।এই মানুষটাই কাল রাত অবধি আমাদের সাথে হাসি মজা করে বেড়িয়েছে, সবাইকে মাতিয়ে রেখেছে আজ সে নেই? ইশরাক ভাইয়ার বাবা মা ছেলে হারিয়ে পাগলের মতো করছেন। নূর আপু কাঁদতে কাঁদতে বারবার সেন্সলেস হয়ে পরছেন। ভালোবেসে বিয়ে করেছেন ওনারা, আপু এক মাসের প্রেগনেন্ট। এক সপ্তাহ আগেই জেনেছে। সেদিন কত্তো খুশি ছিলো ভাইয়া। সবাইকে ট্রিট দিয়েছিল। শুধু একটা কথাই বলছিলো বারবার “আমার বেবি হবে, আমাকে বাবা বলে ডাকবে, আমাকে?” অথচ সন্তানের মুখটাও দেখতে পারলোনা। কিছু কিছু দমকা হাওয়া আনন্দগুলোকে এক নিমিষেই ফিকে করে দেয়। তখন সেই আনন্দগুলোর কথা মনে পরলে আর আনন্দ হয়না, বুকের মধ্যে গ্রাস করে একরাশ বিষাদ আর যন্ত্রণা ।

#চলবে..

#ভালোবাসি তোকে ❤
#লেখিকা: অনিমা কোতয়াল
#পর্ব- ৬
.
সেদিন কিছুক্ষণের জন্যে বাকশক্তিই হারিয়ে ফেলেছিলাম আমি। সবাই যে চরমভাবে শকড সেটা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। ইশরাক ভাইয়ার মৃত্যুতে সবাই ভীষন আঘাত পেয়েছেন। ইশরাক ভাইয়া মানুষটাই এরকম ছিলেন। সবার সাথে মিশে গেছিলেন। সবার চোখের মনি ছিলেন উনি। আদিব ভাইয়ার চোখ দিয়ে নিরবে জল পরছে। সবচেয়ে অবাক করা বিষয় হচ্ছে আদ্রিয়ান ভাইয়া একদম পাথরের মতো বসে ছিলেন। সেই নিরবতা যে ওনার চরম কষ্টের কারণ সেটা বুঝতে বাকি নেই আমাদের কারো। শুধু একদৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলেন ইশরাক ভাইয়ার লাশটার দিকে। আমি আওয়াজ করেই কেঁদেছিলাম সেদিন। ইশরাক ভাইয়ার বলা একটা কথা বারবার কানে বাজছিলো। “অনি, এইচ এস সি টা দিয়েই বিয়েটা করে ফেলো তো? তোমার বিয়েতে জমিয়ে মজা করবো সবাই মিলে।”

সেইসব কথা ভাবতে ভাবতে না চাইতেও চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পরছে এখন। ইশরাক ভাইয়ার সেই দুষ্টুমি, মজা সব বেশিই মনে পড়ছে আজকে। আদ্রিয়ানের দিকে তাকিয়ে দেখি উনি চুপচাপ ঘুমিয়ে আছেন আমার কাধে মাথা রেখে। আমার আর ওনাকে ডাকতে ইচ্ছে করলো না। তাই ওনার মাথাটা আস্তে করে নিজের কোলে শুইয়ে দিলাম তারপর দেয়ালে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে ফেললাম। নানারকম কথা ভাবতে ভাবতে কখন ঘুমিয়ে গেছি নিজেও জানিনা। সকাল বেলা রোদের হালকা আলো চোখে পরতেই আস্তে আস্তে চোখ খুলে তাকিয়ে দেখি উনি এখনো ঘুমোচ্ছেন। আমি শুধু ওনার মুখের দিকেই তাকিয়ে আছি। এক অদ্ভূত মায়া আছে ওনার মুখে। হয়তো আমিও মায়ায় পরে যাচ্ছি। কিছু কিছু জিনিস আমাদের হাতে থাকেনা। অনেক সময় আমাদের অজান্তেই আবার কখনো না চাইতেও আমাদের সাথে অনেক কিছু ঘটে যায়, আমরা অনেককিছু করে ফেলি। অনেকে বলে, ‘যা করবে বুঝে শুনে জেনে তারপর করবে’ আবার একটা প্রবাদও আছে ‘ভাবিয়া করিও কাজ করিয়া ভাবিও না’। সত্যিই কী সবসময় এটা সম্ভব? মানুষের জীবণের সবকিছু কী ভেবেচিন্তে হয়? আবেগ, অনুভূতির মতো কিছু কারণে অনেকসময় ভাবতে ইচ্ছে করেনা। সবকিছু যদি সত্যিই আমাদের হাতে থাকতো তাহলে মানবজীবন এতোটা জটিল হতো না। হঠাৎ খেয়াল করলাম উনি নড়ে উঠছেন।রোদের জন্যে কপাল হালকা কুচকে আছে ওনার। উনি আস্তে আস্তে চোখ খুলে তাকালেন। আর ওনার দৃষ্টি সরাসরি আমার ওপরেই পরলো। উনি এখনো ভ্রু কুচকে রেখেছেন। কিছুক্ষণ ভ্রু কুচকে তাকিয়ে থেকে হয়তো বুঝলেন যে আমার কোলে শুয়ে আছেন তাই ঝট করেই উঠে বসলেন। আমি বোকার মতো তাকিয়ে রইলাম ওনার দিকে? এভাবে লাফিয়ে ওঠার কী ছিলো? আস্তেও তো উঠতে পারতেন। উনি এদিক ওদিক তাকিয়ে তারপর আমার দিকে তাকিয়ে ইতস্তত করে বললেন,

— ” সরি। আসলে কাল রাতে কখন ঘুমিয়ে পরেছি বুঝতেই পারিনি। সারারাত এখানেই ছিলাম। আমাকে ডাকলেনা কেনো?”

আমি ওনার দিকে তাকিয়ে বললাম ,

— ” ডাকতে ইচ্ছে করছিল না।”

উনি একটু অবাক হয়ে আমার দিকে তাকালেন। অবাক কন্ঠেই বললেন,

— ” সারারাত এভাবে বসে থাকতে কষ্ট হয়নি তোমার?”

আমার কী হলো নিজেই জানিনা। ওনার দিকে একদৃষ্টিতেই তাকিয়ে বললাম,

— ” একটুও কষ্ট হয়নি। তবে এটুকু বলতে পারি যে ভালোলেগেছে, ভীষণ ভালোলেগেছে। এক অদ্ভুত শান্তি পেয়েছিলাম।”

উনি স্লো ভয়েজে বললেন,

— ” কেনো?”

আমিও বিনা কোনো সংকোচেই স্পষ্টভাবে বললাম,

— ” আপনি কাছে ছিলেন তো।”

উনি একটু চমকে গেলেন। হয়তো আমার কাছে এতোটা স্পষ্ট উত্তর আশা করেননি উনি। তাই একটু অস্বস্তিতে পরে গেছেন। আমি ওনাকে আর অস্বস্তিতে রাখতে চাইলাম না তাই কথা কাটিয়ে বললাম,

— ” কফি পাঠিয়ে দেবো? নাকি নিচে গিয়ে খাবেন?”

— ” নিচেই চলো। ”

— ” আচ্ছা আসুন তাহলে।”

বলে আমি নিচে চলে এলাম উনিও আমার পেছন পেছনই আসছেন। সিড়ি দিয়ে নেমেই দেখি সজীব ভাইয়া,অর্ণব ভাইয়া, জাবিন এমনকি ইফাজ ভাইয়া আর আপিও দাঁড়িয়ে আছে আর মিটমিটিয়ে হাসছে। ওমা এরাও উঠে গেছে তারমানে বেশ ভালোই বেলা হয়েছে। এসব ভাবতে ভাবতে আদ্রিয়ান ভাইয়াও নেমে এলেন আর ওদের দেখে নিজেও থেমে গেলো। ওনাকে দেখে ওদের মুখের হাসি আরও প্রসারিত হলো। উনিও আস্তে আস্তে এসে আমার পাশে এসে দাঁড়ালেন। আমার মতো উনিও ওদের দিকে ভ্রু কুচকে তাকিয়ে আছেন। ইফাজ ভাইয়া ক্যাবলাকান্ত একটা হাসি দিয়ে বলল,

— ” কীরে ভাই? কোথায় গেছিলি? তাও জোড়া?”

আমি ওনার দিকে তাকালাম। উনি একটু বিরক্ত হয়ে বললেন,

— ” এই সিড়ি দিয়ে চাঁদে যাওয়া যায় বলে তো আমার জানা নেই।”

ইফাজ ভাইয়া একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলো। হয়তো বুঝতে পেরেছেন যে চিজ করতে গিয়ে একটা ভীষণ বোকা প্রশ্ন করে ফেলেছেন। এবার আপি বলল,

— ” সত্যিই ইফাজ কী জিজ্ঞেস করছো তুমি? দুজনেই যখন ছাদের সিড়ি দিয়ে নেমেছে তখন নিশ্চয়ই ছাদ থেকেই এসছে?”

জাবিনও তাল মিলিয়ে বলল,

— ” হ্যাঁ দা ভাই তুই আসলেই বোকা কীসব প্রশ্ন করিস। আচ্ছা তুই বল সকাল সকাল ভাবী কে নিয়ে ছাদে কী করতে গেছিলি?

আমি হেসে বললাম,

— ” না না সকালে নয় আমরাতো রাতে..”

ওপার দিকে চোখ পরতেই উনি চোখ রাঙালেন আর আমি চুপ হয়ে গেলাম। তখন হুট করে বলে ফেললেও এখন বুঝতে পারছি কী করেছি। আমার কথা শুনে সবাই একসাথে সুর দিয়ে বলে উঠল,

— ” ওওও।”

আমি হালকা লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করে ফেললাম। ইফাজ ভাইয়া আবার বলল,

— ” তা ভাই সারারাত কী ছাদেই কেটেছিল নাকি।”

উনি একটু ইতস্তত করে বললেন,

— ” হ্ হ্যাঁ তো কী হয়েছে?”

অর্ণব ভাইয়া পিঞ্চ করে বলল,

— ” কী বলো কী জিজু? বাসর রাতে কথা বলে শেষ করতে পারোনি?”

আদ্রিয়ান একটু গলা ঝেড়ে বললেন

— “অ্ আমি আসছি।”

বলে তাড়াতাড়ি ওখান থেকে চলে গেলো। উনি চলে যেতেই সবাই শব্দ করে হেসে দিলো। আমি লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করে আঙ্গুলে ওড়না পেঁচিয়ে যাচ্ছি। হঠাৎ করেই ইফাজ ভাইয়া হাসি থামিয়ে দিলেন। বাকিরাও আস্তে আস্তে চুপ হয়ে গেল। ওদের চুপ থাকতে দেখে আমি ওদের দিকে তাকালাম। ইফাজ ভাইয়া একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,

— ” মাসখানেক আগের আদ্রিয়ান হলে হয়তো আমাদের দুষ্টুমি দেখে নিজেও আমাদের সাথে দুষ্টুমি করে আমাদের পঁচিয়ে দিতো। ওর সাথে কথায় আমরা কেউ কখনো পেরে উঠতাম না।”

জাবিনও বলল,

— ” হ্যাঁ ভাবী। সেই ভাইয়াকে খুব মিস করি। একটা আসর জমানোর ও একাই যথেষ্ট ছিলো। অথচ ওকে একটু হাসতে দেখার জন্যেও আমাদের এখন চাতক পাখির মতো তাকিয়ে থাকতে হয়।”

আমি কিছু না বলে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। পুরোপুরি না দেখলেও কিছুটা তো দেখেছিলাম আগের আদ্রিয়ান ভাইয়াকে, সত্যিটা দুজনকে মেলাতে বড্ড কষ্ট হয়। এতোটা পরিবর্তন কীকরে? এর কারণ কী শুধুই ইশরাক ভাইয়ার মৃত্যু নাকি অন্যকিছু। অন্য কী কারণ থাকতে পারে?

__________________

দুপুর হয়ে গেছে। আম্মু অলরেডি লাঞ্চ এর জন্যে ডেকেও ফেলেছে। আদ্রিয়ান ভাইয়া সকালে সকালে বাজার করে এনে ঘুম দিয়েছেন এখনো ওঠেননি। আমারও কেনো জানিনা কখনোই ওনার ঘুম ভাঙাতে ইচ্ছে করেনা। তাই ওনাকে রেখেই লাঞ্চ টেবিলে গেলাম। ওখানে যেতেই আম্মু বলল,

— ” কী হলো একা এলে যে? আদ্রিয়ান কোথায়?”

— ” উনি তো ঘুমোচ্ছেন।”

— ” যাও ডেকে নিয়ে এসো। দুটোর বেশি বাজেতো। সেই সকালে কোনরকম একটু খেয়েছে ছেলেটা।”

আমি আর কথা না বাড়িয়ে ওনাকে ডাকতে চলে গেলাম। গিয়ে দেখি উনি এখনো ঘুমিয়ে আছেন। আমি ওনার পাশে গিয়ে বসে আস্তে করে ডাকলাম,

— ” শুনছেন? এই যে শুনছেন?”

দুবার ডাকতেই উনি ঘুম থেকে উঠে গেলেন। মানুষের ঘুম এতো পাতলা কীকরে হয় সেটাই বুঝতে পারিনা আমি। আমাকে টিওশনের জন্যে ডাকতে ডাকতে আপি আর আম্মু ক্লান্ত হয়ে যেতো। আর এই লোকটাকে ডাকতে না ডাকতেই ঘুম থেকে উঠে যায়। উনি উঠে চোখ পিটপিট করে তাকিয়ে বললেন,

— ” কী হয়েছে?”

— ” আপনাকে আম্মু খেতে ডাকছে।”

উনি উঠে দাঁড়িয়ে টাওয়েলটা হাতে নিয়ে বলল,

— ” তুমি যাও আমি আসছি।”

আমি মাথা নেড়ে চলে গেলাম। আমি টেবিলে গিয়ে বসার কিছুক্ষণের মধ্যেই উনিও চলে আসলেন। এরপর কেউ আর কোনো কথা না বাড়িয়ে খেতে শুরু করলাম আমরা। খাওয়ার সময় খেয়াল করলাম আব্বু আমাদের দুজনের দিকে বারবার তাকাচ্ছেন। হয়তো বুঝতে পেরেছেন আমাদের সম্পর্কটা স্বাভাবিক হয়নি। আমার চোখে চোখ পরতেই আব্বু চোখ সরিয়ে নিলেন। ওনার চোখে একটা অপরাধবোধ দেখতে পাচ্ছি আমি। কিন্তু আমার প্রথমে অভিমান হলেও এখন ওনাদের নিয়ে কোনো অভিযোগ নেই। আমি জানি ওনারা যাই করেছেন আমাদের ভালোর জন্যেই করেছেন।

__________________

আজ বিকেলেই আমাদের বাড়ি থেকে চলে এসছি আমরা। এ বাড়ি থেকে সবাই গেছিলো আমাদের আনতে। গতকাল সন্ধ্যায় আব্বু আমাকে নিজের রুমে ডেকেছিল। খুব ভালোকরে বুঝিয়ে দিয়েছিল আদ্রিয়ান ভাইয়ার অবস্থা, আর আমাকে কী করতে হবে সেটাও বুঝিয়ে দিয়েছেন। আমি চলে আসার সময় একটা কথাই বলেছিলেন, ‘ জানি তোমার মনে হচ্ছে আমরা তোমার সাথে অন্যায় করেছি, এটা সত্যিও। কিন্তু এটাও সত্যিই যে কারো প্রাণ বাঁচানোর চেয়ে বড় কিছু হয়না। তুমি ডক্টর হতে চাও কারণ মানুষের প্রাণ বাঁচানোর সুযোগ থাকে তাতে। আর তোমার এই ত্যাগ একটা জলজ্যান্ত প্রাণচ্ছল ছেলেকে বাঁচিয়ে রাখতে পারবে।’ মানে কী? বউ পেলেই উনি স্বাভাবিক হয়ে যাবেন? তাই যদি তাহলে আমিই কেন? দুনিয়াতে মেয়ের অভাব ছিলো? আদ্রিয়ান আবরার জুহায়েরকে তো যেকোনো মেয়ে বিয়ে করতে রাজি হয়ে যেতো? আমায় কেনো বলির পাঠা বানালো সবাই?

রাতে আপির সাথে গল্প করে রুমে এসে দেখি উনি বেডের এক সাইডে হেলান দিয়ে বসে ল্যাপটপে কাজ। উফফ সারাদিন ল্যাপটপে এতো কী কাজ? বাড়িতে যে ওনার ছোট, কিউট, সুইট একটা বউ আছে মাঝে মাঝে নজরটা সেদিকে দিলেও তো হয় নাকি? আমি ফ্রেশ হয়ে এসে বেডের ওপর সাইডে গিয়ে শুতেই উনি বলে উঠলেন,

— ” বিয়ে ঠিয়ের সব ঝামেলা তো শেষ? এবার এতো ঘোরাঘুরি লাফালাফি না করে এডমিশন প্রিপারেশনে মনোযোগ দাও। এসব বিয়ের ঝামেলায় অনেকটা সময় নষ্ট হয়েছে। মেডিকেলে কম্পিটিশন অনেক। সো নিজেকে প্রিপার্ড করো। কোচিং এ অনলাইনে ভর্তি করে দিয়েছি আমি। কাল সকালে বই চলে আসবে।”

আমি লাফিয়ে উঠে বসলাম। বলে কী? কালকেই? না আমিযে কোচিং করবো, মেডিকেল পরবো সেটা আগেই জানতাম। আর এ বাড়ির মানুষ মোটেও ব্যাকডেটেড নয়। না পড়তে চাইলে জোর করেই পড়াতো। কিন্তু অবাক হচ্ছি উনি নিজে এসব নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছেন? মানে আমাকে নিয়েতো ওনার কোনো ইন্টারেস্ট থাকার কথাই না। তাহলে? ভাবলাম বিয়ের চক্করে কটা দিন রেস্ট করব। দূর। আমি ওনার দিকে তাকিয়ে বললাম,

— “ভর্তিও করে ফেলেছেন? এডমিট কার্ড কোথায় পেলেন? আর কালকেই বই চলে আসবে?”

উনি ভ্রু কুচকে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,

— ” অবভিয়াসলি। আর তোমার সব পেপারস আসার সময় আঙ্কেলের কাছ থেকে তোমার বিয়ে হয়েছে সেই আনন্দে তো এডমিশন এক্সাম পিছিয়ে দেবেনা তাইনা? কোনো গাফিলতি চলবে না কিন্তু। আমি নিজে পড়াবো তোমাকে।”

আমি আরেকদফা অবাক হয়ে বললাম,

— ” আপনি তো ইঞ্জিনিয়ারিং এর স্টুডেন্ট মেডিক্যাল এডমিশনের পড়া কীকরে পড়াবেন?”

উনি চোক ছোট ছোট করে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,

— ” ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে এডমিশনের জন্যে আমাকে এইচ এস সি কম্প্লিট করতে হয়েছে।”

— ” আপনার এখনো এসব মনে আছে?”

উনি আবার কাজ করতে করতে বললেন,

— ” না থাকার কী আছে? ফিজিক্স, ক্যামেস্ট্রি, ইংলিশ, জিকে তো ইজিলি পড়িয়ে দিতে পারবো। বায়োলজিটা তেমন বুঝিনা বাট পড়া দেওয়া নেওয়ার কাজটা করতে পারবো।”

আমি হতাশ হয়ে শুয়ে পরলাম। আমার দুঃখের দিন যে শুরু হতে চলেছে বেশ বুঝতে পারছি। এই খবিশ আমায় পড়াবে? জীবনটা তেজপাতা হয়ে গেলো গো। কিছুক্ষণ পর উনিও লাইট অফ করে মাঝে কোলবালিশ দিয়ে ওপর সাইডে শুয়ে পরলেন। আমি কিছুক্ষণ বিরক্ত হয়ে তাকিয়ে থেকে বললাম,

— ” আচ্ছা কোলবালিশটা না দিলে হয়না?”

উনি হালকা চেঁচিয়ে বললেন,

— ” হোয়াট?”

আমি সাথে সাথেই হকচকিয়ে বলে উঠলাম,

— ” ন্ না না, কিছুই না। আপনি ঘুমোন, ঘুমোন।”

উনি আর কিছু বললেন না। বাপড়ে কার সামনে কী বলছিলাম। নিজের বুকে হালকা থুথু দিয়ে চোখ খিচে বন্ধ করে শুয়ে রইলাম।

#চলবে…

#ভালোবাসি তোকে ❤
#লেখিকা: অনিমা কোতয়াল
#পর্ব- ৭
.
সকালে মামনী, বড় আম্মু, আপি মিলে ডাইনিং টেবিলে খাবার সার্ভ করছেন। আমি আশেপাশে ঘুরঘুর করছি। আসলে ভাবছি যে কী করা যায়। সবাই কাজ করছে আর আমি আমি মামনীর দিকে তাকিয়ে বললাম,

— ” মামনী আমি প্লেটগুলো রেডি করে দেই?”

মামনী, বড় আম্মু, আপি তিনজনে একসাথে আমার দিকে তাকালেন। আমি একটু হকচকিয়ে গেলাম কী এমন বললাম রে বাবা? তিনজনই এভাবে তাকালো কেনো?মামনী একটু রাগী কন্ঠে বলল,

— “এক থাপ্পড় মারবো? বউ হতে এসছো? পাকা মেয়ে?”

বড় আম্মুও তাল মিলিয়ে বলল,

— ” হ্যাঁ তাইতো? পিচ্ছি মেয়ে একটা। এখনো তুমি এই বাড়ির মেয়ে। আগে বড় হও তারপর ভেবে দেখবো বউ বানানো যাবে কী না। তাই বাড়ির মেয়ে মেয়ের মতো থাক, বউ হওয়ার চেষ্টাও করিসনা।”

আমি বোকার মতো তাকিয়ে আছি ওনাদের দিকে। আপিদের দিকে তাকিয়ে দেখি আপি মিটমিটিয়ে হাসছে। আমি মাথা চুলকে চেয়ারে বসে পরলাম। কিছুক্ষণের মধ্যে সবাই চলে এলো খেতে। মামনী একটা প্লেটে খাবার বেড়ে আমার দিকে তাকিয়ে বলল,

— ” যা তো মা আদ্রিয়ানকে খাবারটা দিয়ে আয়?”

আমি একটু অবাক হয়ে বললাম,

— ” কেনো? উনি সবার সাথে বসে খায়না?”

সবাই একটু অন্যরকমভাবে তাকালো আমার দিকে। মামনী একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,

— ” ইশরাক মারা যাওয়ার পর থেকে তো ও ভুলেই গেছে ওর একটা পরিবার আছে। সারাটাদিন কোথায় না কোথায় থাকে আর যতটুকু সময় বাড়িতে থাকে নিজের রুমে নিজেকে বন্দি করে রাখে। ”

বড় আব্বু বললেন,

— ” আমরা সবাই জানি ওর জন্যে ইশরাক কী ছিলো। ওর মৃত্যুতে চরম আঘাত পেয়েছে ও। কিন্তু এতে সবার থেকে নিজেকে গুটিয়ে রেখে কী লাভ?”

সবার মুখেই আবার অন্ধকার নেমে এলো। আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে প্লেটটা হাতে নিয়ে উপরে চলে গেলাম। রুমে গিয়ে দেখি আদ্রিয়ান ভাইয়া সবে শাওয়ার নিয়ে বেড়িয়েছেন। আফটার শাওয়ার লুকে বরাবরেও মতোই নজর কারা লাগছে ওনাকে। কিন্তু আমি সেদিকে পাত্তা না দিয়ে বললাম,

— ” আপনার ব্রেকফাস্ট।”

— ” হুম রেখে দাও।”

আমি খাবারের প্লেটটা টি-টেবিলে রেখে একটু ইতস্তত করে বললাম,

— ” আচ্ছা আপনি এভাবে একা কেনো খাবার খান। বাড়ির সবার সাথে টেবিল বসেও তো খেতে পারেন?”

উনি কিছু বললেন না চুপচাপ আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের চুল ঠিক করছেন। আমি আরেকটু সাহস সঞ্চার করে বললাম,

— ” দেখুন আর কিছুর জন্যে না হোক বাবা, মামনী? ওনাদের কথা ভেবে তো এক টেবিলে বসে খেতেই পারেন তাইনা? জানেন ওনারা কতো কষ্ট পান আপনাকে এভাবে দেখে?”

উনি একটা শ্বাস ফেলে বললেন,

— ” অভ্যেস করে নিতে দাও। নইলে পরে আরও কষ্ট পাবে।”

আমি ভ্রু কুচকে তাকিয়ে রইলাম ওনার দিকে। কী বলতে চাইলেন উনি? পরে কেনো কষ্ট পাবেন সবাই? আমি ওনার কথার আগাগোড়া না বুঝলেও ভ্রু কুচকে রেখেই বললাম,

— ” পরে কী হবে সেটা পরে দেখা যাবে। তাই বলে আপনি সবাইকে এভাবে কষ্ট দিতে পারেন না। জানেন সবাই কতটা আপসেট? ওনাদের কী দোষ? আপনি ওনাদের সাথে এমন কেনো করছেন?ওনাদের কষ্টে আপনার কিচ্ছু যায় আসেনা?”

উনি চিরুনিটা ছুড়ে ফেলে একটু চেঁচিয়ে বললেন,

— ” না যায় আসেনা।”

আমি এবার একটু রেগে গেলাম। মানে কী? যায় আসেনা? বললেই হলো নাকি? নিজের বাবা মায়ের কষ্টে নাকি তার কিছুই যায় আসেনা। অদ্ভুত! আমি রাগী গলাতেই বললাম,

— ” যায় আসেনা মানে কী হ্যাঁ ? যারা আপনাকে এতো কষ্ট করে বড় করলো, মানুষ করলো তাদের কষ্টে আপনার কিচ্ছু যায় আসেনা? আপনি জানেন মামনী এখনো অপেক্ষায় বসে থাকে কবে আপনি আবার ওনার কোলে মাথা দিয়ে শুয়ে বাচ্চাদের মতো খাইয়ে দেওয়ার আবদার করবেন। বাবা আপনার একটা দুষ্টুমির আশায় এখনো বসে আছে? কবে আপনি আবার আগের মতো দুষ্টুমি করবেন আর উনি আপনার কান মুলে দেবে। খেতে বসে বড় মাছের পিসটা কে খাবে? বেশি মাংস কে নেবে? পায়েসে কিসমিস কার বেশি পরেছে এসব নিয়ে আবার আপনি ইফাজ ভাইয়ার সাথে ঝগড়া করবেন সেই আশায় ইফাজ ভাইয়াও বসে আছেন? বড় আব্বু, বড় আম্মুও আপনাকে আগের মতো দেখতে চায়। এসবের কোনো দাম নেই আপনার কাছে তাইনা?”

বলে জোরে জোরে দুটো শ্বাস নিলাম। বাপরে বাপ। কতগুলো কথা বলে ফেললাম? আমারই গলা ব্যাথা করছে। কিন্তু ওনার দিকে তাকিয় দেখলাম উনি চুপ করে আছেন। আমার কথাগুলো কী কোনো কাজে দিলো নাকি সবটাই ওয়েস্ট? এসব ভাবতে ভাবতেই উনি বললেন,

— ” প্লেটটা নিচে নিয়ে যাও।”

আমি ভ্রু কুচকে বললাম,

— ” কেনো? আপনি খাবেন না?”

উনি একটু ইতস্তত করে গলা ঝেড়ে বললেন,

— ” অব্ নিচে টেবিলে খাবো।”

আমি হা করে তাকিয়ে আছি ওনার দিকে। আমার কথাগুলো ওনাকে সত্যিই এফেক্ট করলো? সিরিয়াসলি? আরে বাহ অনি? তু সি গ্রেট হ্যা। উনি একটু ধমকের সুরে বললেন,

— ” হা করে দাঁড়িয়ে না থেকে যাও আমি আসছি।”

আমি তাড়াতাড়ি খাবারের প্লেটটা নিয়ে বেড়িয়ে এলাম। খুশিতে এখন নাচতে ইচ্ছে করছে আমার। আমি নিচে যেতেই মামনী বলল,

— ” কীরে? প্লেট নিয়ে চলে এলি যে? আদ্রিয়ান খাবেনা?”

আমি এখন ওনাদের কিছু বললাম না, হঠাৎ আদ্রিয়ান ভাইয়াকে দেখে সারপ্রাইজড হবে সেটাই ভালো। সবাই জিজ্ঞেস করছে কিন্তু আমি মুখ গোমড়া করে চুপ করে আছি। একটু পরেই উনি নিচে নেমে এলেন আর সবাইকে অবাক করে দিয়ে উনি ওনার চেয়ার টেনে বসেও পরলেন। সবাই প্রায় দুমিনিট হা করে তাকিয়ে ছিলো ওনার দিকে। উনি সবাইকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে ভ্রু কুচকে বলল,

— ” কী হলো? এভাবে তাকিয়ে আছো কেনো?”

মামনী অবাক কন্ঠে বললেন,

— ” তুই আমাদের সাথে বসে খাবি?”

আদ্রিয়ান সোজা ভাবেই বলল,

— ” খাবো বলেইতো এসেছি।”

সবাই এবার আমার দিকে তাকালো। যেনো সব ক্রেডিট আমার। ওনাদের ওভাবে তাকানোতে আমার অস্বস্তি হচ্ছে। আজব! আমি কী করেছি? শুনু দুটো কথা বলেছি। এটা তো যে কেউ বলতে পারতো। আমি ওনাদের থেকে চোখ সরিয়ে খাওয়ায় মনোযোগ দিলাম। কেউ এখন আর কথা বাড়ালো না। সবার চোখেমুখেই একরাশ খুশির ছাপ। উনি যদিও আগের মতো আড্ডা দুষ্টুমি করেননি একদম চুপচাপ খেয়েছে। তবে সবার সাথে বসে খেয়েছে এটাই অনেক। উনি খেয়ে উঠে চলে যেতেই বাবা বললেন,

— ” দেখেছো আমার সিদ্ধান্ত ভুল ছিলোনা। অনেক কিছু চিন্তা করেই কাজ করেছি আমি।”

সবাই মুচকি হাসলো। আমি মাথা নিচু করে খাচ্ছি। বাবা কথাগুলো কেনো বললেন বেশ বুঝতে পারছি তাই খুব লজ্জাও লাগছে।

______________________

অসহায় একটা বাচ্চার মতো বায়োলজি বই নিয়ে বসে আছি আমি। সেই বিকেল বেলা উনি আমাকে বিশ পেইজ পড়া দিয়ে গেছেন। যদিও দাগানো সাইডগুলো পড়তে হবে কিন্তু পড়া অনেক। অথচ আমি সবে পাঁচ পেইজ পড়েছি। তাও আগাগোড়া সব গুলিয়ে যাচ্ছে। কোচিং তো কাল শুরু হবে। এখনি আমায় এতো প্যারা দেওয়ার কী দরকার ছিলো? আল্লাহ জানে। আবার যাওয়ার আগে হুমকিও দিয়ে গেছেন এসে পড়া কম্প্লিট না পেলে নাকি স্কেল দিয়ে মারবেন। ভাবা যায়? সাধে বলেছি জীবন তেজপাতা হয়ে গেলো। রাত দশটা বেজে গেছে ওনার খাবারটা নিয়ে এসছি ওপরে। এখনো ফেরেন নি উনি। এসব ভাবতে ভাবতেই উনি এলেন। ওনাকে দেখে এমন একটা ভাব করলাম যেনো এতোক্ষণ মনোযোগ দিয়ে পড়তে পড়তে বিশ্ব উদ্ধার করে ফেলেছি। উনি শার্টটা খুলে রেখে ওয়াসরুমে ফ্রেশ হতে গেলেন। ফ্রেশ হয়ে এসে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,

— ” কম্প্লিট হয়েছে?”

আমি ক্যাবলাকান্ত একটা হাসি দিয়ে বললাম,

— ” হ্যাঁ মানে না। প্রায় হয়ে গেছে।”

— ” কতোটুকু?”

আমি ইতস্তত করে বললাম,

— ” প্ পাঁচ পেইজ।”

উনি বিরক্তিমিশ্রিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন,

— ” বিকেল থেকে মাত্র পাঁচ পেইজ? মাত্র ওয়ান ফোর্থ কম্প্লিট করে বলছো প্রায় হয়ে গেছে? এতোক্ষণ কী করেছো? আসার পরতো এমন ভাব করলে যেনো পড়তে পড়তে তুমি শহীদ হওয়ার পথে।”

অামি একটা শুকনো ঢোক গিলে মুখে জোরপূর্বক হাসি ফুটিয়ে বললাম,

— ” বিশ্বাস করুন আপনি যাওয়ার পর থেকে একদম মন, জান, প্রাণ, আন্তা ..”

উনি আমাকে থামিয়ে বললেন,

— ” কলিজা, হৃদপিণ্ড, ফুসফুস, কিডনি সব লাগিয়ে পড়েছো কিন্তু হয়নি। তাইতো? এতোগুলো জিনিস লাগিয়ে পড়লে? অথচ আমি তোমাকে যেটুকু পড়তে বলেছি পুরোটাই হৃদপিন্ড আর ফুসফুস নিয়ে। ওয়াও! ওয়ান্ডারফুল!”

এখন কথা না ঘোরালে সিউর মারবে। তাআ আমি কথা কাটিয়ে বললাম,

— ” আচ্ছা আপনি কোথায় ছিলেন? মানে বাড়ির সবাই বলছিল আগে এতো রাত করতেন না?”

উনি গম্ভীর কন্ঠে বললেন,

— ” সবার মন মতো চলা সম্ভব নয় আমার পক্ষে।”

— ” চাইলেই সম্ভব। আর তাছাড়াও বাড়িতে আপনার নতুন বউ আছে। তাকে এভাবে একা রেখে বাইরে বাইরে..”

এটুকু বলেই চুপ হয়ে গেলাম। শিট! মার থেকে বাঁচার ভয়ে কাকে কী বলছিলাম? শিউর এবার আমায় ঝাড়বে। উফফ। উনি খানিকটা শক্ত গলায় বললেন,

— ” এটা ঠিক যে তুমি লিগালি আমার বউ। যে পরিস্থিতিতেই হোক আমি তোমায় বিয়ে করেছি তাই তোমার সব দায়িত্ব আমার। তোমার ভরণপোষণ থেকে শুরু করে তোমার ক্যারিয়ার। ইভরিথিং ইজ মাই রেসপন্সিব্লিটি। আর আমি এসব করবো কিন্তু এরচেয়ে বেশি কিছু আশা করোনা আমার কাছ থেকে। ”

এটুকু বলে উনি কাবার্ড থেকে টি-শার্ট বেড় করে পরতে পরতে বললেন,

— ” এসে জেনো পড়া কম্প্লিট পাই।”

এটুকু বলে না খেয়েই হনহন করে বেড়িয়ে চলে গেলো। আমি ওনাকে ডেকে বললাম,

— ” আরে খাবারটা খেয়ে যান? ”

কিন্তু উনি আমার কথায় কর্ণপাত না করে চলে গেলেন। আমি একরাশ মন খারাপ নিয়ে বেডে বসে রইলাম। কেনো এমন করেন উনি? আর এই সবকিছুতে আমার কী দোষ? সবাই মিলে আমায় কেনো ঠেলে দিলো এই জটিল জীবণে? সেদিন যদি সত্যিই সত্যিই কারো কথা না ভেবে বলতাম আমি এই বিয়ে করতে চাইনা, করবো না মানে করবো না। তাহলে হয়তো এসব নাটক আর দেখতে হতোনা আমাকে। আমার এখনো ঐ দিনটার কথা মনে পড়লেই আফসোস হয়। এককথায় চরম আফসোস হয়। আচ্ছা সত্যিই কী আফসোস হয়? এসব ভাবতে ভাবতে আবার অতীতের কথা ভাবতে লাগলাম-

ইশরাক ভাইয়ার মৃত্যুর পর আদ্রিয়ান ভাইয়া কতোটা ভেঙ্গে পরেছিলেন সেটা দেখেই বোঝা যাচ্ছিল। নিজের প্রিয় কোনো ব্যক্তির লাশের খাটিয়া কাধে তুলে নেওয়াটা যে কতোটা কঠিন সেটা একমাত্র তারাই বোঝে যারা সেই কাজ করেছেন। তখন ঐ খাটিয়াটুকুই পৃথিবীর সবচেয়ে ভারী বস্তু মনে হয়। কাধ হয়তো ভেঙ্গে পরতে চায়, নিঃশ্বাস হয়তো আটকে আসে, পা হয়তো মাটিতে আটকে যেতে চায়। ওই মুহূর্তে হেটে এগোনোটা হয়তো অনেকটাই কঠিন। সাদা কাফনের কাপড়ে মোড়ানো ইশরাক ভাইয়ার লাশসহ খাটিয়াটা যখন আদ্রিয়ান ভাইয়াকে কাধে তুলতে হয়েছিল তখন দেখেছিলাম আমি ওনাকে। যে মানুষটা জিমে এরচেয়ে ভারী ভারী জিনিস সহজেই উঠাতে পারতো সেই মানুষটা যখন খাটিয়া কাধে তুলে নিচ্ছিল তখন মনে হচ্ছিল ওটা ওনার কাছে খুব ভারী মনে হচ্ছে বড্ড বেশি ভারী।

#চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে