ভালোবাসার রাত পর্ব ১

0
3427

#ভালোবাসার-রাত

#রোকসানা

পর্ব (১)

তিলকে পাজাকোলে করে চোখের সামনেই কাকিমার রুমে ঢুকে পড়লো রিদ। অস্থিরতায় চারপাশটা চোখ বুলিয়ে দরজায় সিটকিনি লাগিয়ে দিয়ে তিলের জামা টেনে খুলার চেষ্টা করছে। জামা খুলতে না পারায় এক পর্যায়ে টান দিয়ে ছিড়তে থাকে। রিদের হাতের আচরে ভ্যা ভ্যা করে কেদে উঠে তিল। চোখের পানি গাল বেয়ে পড়ছে আর নাকি নাকি কন্ঠে চিৎকার করে বলছে,

“” লিদ ভাইয়া,আমাল লাগছে। ছালো আমাকে। আমাল পুতুলের তো আজকে বিয়ে। ছালো আমাকে। আমার নতুন লাল জামাটা ছিলে ফেলছো কেন? আম্মু আমাকে মালবে,লিদ ভাইয়া,ছালো!””

তিলের কথা রিদের কানে যাচ্ছেইনা। সে তিলের দিকে তাকিয়ে আরো অস্থির হয়ে টান দিয়ে ছিড়ে পুরো জামাটা ফ্লোরে ছুড়ে ফেললো। নিজের গেন্জির ভেতরে প্যান্টের সাথে আটকে থাকা শাড়ীটা বের করে তিলের সামনে মেলে ধরলো। ওর লাল ফ্রকটার সাথে মেচিং করা লাল কুচি দেওয়া শর্ট প্যান্টের কোমড়ের রাবারটার ভেতর দিয়ে শাড়ী গুজতে গুজতে বললো,

“” ক্লাস ফ্লোরে পড়িস এখনো ‘ র’ উচ্চারন করতে পারিসনা? রিদ থেকে লিদ? আমার নামের অপমান করিস তুই? আর আমি তোর কাছে আসলেই তোর কান্না পায়?ব্যথা লাগে? আমাকে দেখলেই তোর চোখে সমুদ্র তৈরী হয়ে যায়? চুপ আর একবার চিৎকার করলে এই শাড়ীটা তোর কোমড়ে না পেচিয়ে গলায় পেচিয়ে ধরবো।””

তিলের কান্নার গতি কমার বদলে আরো বেড়ে গেলো। গলার শব্দ আরেকটু চিকন করে চিৎকার করে বলতে লাগলো,

“” আমাল নতুন জামা,আমাল পুতুল বউ। আমাল সুলসুলি লাগছে,লিদ ভাইয়া ছালো আমাকে!””

রিদ রক্তচক্ষুতে তাকালো তিলের দিকে। ধমক দিতে গিয়েও থেমে গেলো। নিমেষেই অসহায় ভঙ্গিতে শাড়ীর কুচিটা দিতে দিতে বললো,

“” এভাবে কাদিস না,তিল। আমি শুধু দেখতে চাই শাড়ী পড়লে তোকে কেমন লাগে। আমাকে একটু শাড়ীটা পড়াতে দে। তোর কান্না আমাকে খুব জ্বালাচ্ছে। শাড়িতে তোকে দেখতে কেমন দেখায়, এটা দেখেই চলে যাবো।””

রিদের কথা শেষ হওয়ার সাথে সাথেই দরজায় বাড়ি পড়ছে। দরজার অপরপাশ থেকে বাবার কন্ঠ পেয়ে রিদ ভয় পেয়ে যায়। আর তিলও গলা ফাটিয়ে চিৎকার করতে থাকে,

“” বলো আব্বু,বলো আব্বু। লিদ ভাইয়া আমাল জামা…””

তিলের কথা শেষ হওয়ার আগেই ওর মুখ চেপে ধরে রিদ। বাবা এবার প্রচন্ড শব্দ আর হুংকার দিয়ে রিদকে দরজা খুলতে বলছে। রিদের চোখটা আবার রক্তরঙে রাঙিয়ে তিলের শরীর থেকে শাড়ীটা খুলতে খুলতে বললো,

“” তোর এই কান্না আমাকে তিলে তিলে শেষ করে দিচ্ছে। যেদিন তুই লিদের জায়গায় রিদ বলতে শিখবি সেদিন আমাকে খুজে পাবিনা। আফসোস করবি তুই,খুব আফসোস করবি!””

রিদ হেচকা টানে পুরো শাড়ীটা আবার নিজের গেন্জির ভেতরে ঢুকাতে ঢুকাতে জানালাটা খুলে লাফ দিয়ে পালিয়ে গেলো।
~~
“” তিল,তুই এখনো রেডি হোসনি? গায়ে হলুদ তো শুরু হয়ে গেছে!””

মায়ের ডাকে তিল ছোটবেলার স্মৃতি থেকে বের হয়ে আসলো। আয়নায় মায়ের চোখে চোখ রেখে বললো,

“”আমি এখনি রেডি হয়ে আসছি আম্মু, রিমাকে কিন্তু সবার আগে আমিই হলুদ লাগাবো। তুমি গিয়ে পাহারা দাও যেন আমার আগে কেউ লাগাতে না পারে।””

তাসমিয়া বেগম মেয়ের কাছে এগিয়ে এসে মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললো,

“” এই হলুদ শাড়ীটাতে তোকে হলদে পাখির মতো সুন্দর লাগবে। কি এতো ভাবছিস? রিদের কথা?””
“” আমি নিজেকে ভেবেই কুল পাইনা আবার আরেকজনের কথা ভাববো। শাড়ীটা কোন স্টাইলে পড়বো সেটাই ভাবছিলাম। তুমি যাও তো,তুমি না গেলে আমি পড়বো কিভাবে?””

তাসমিয়া বেগম মুচকি হাসি দিয়ে বের হয়ে গেলেন।

তিল হাতের হলুদ শাড়ীটার দিকে তাকাতেই চোখটা ভিজে এলো। গলা বন্ধ হয়ে কান্না আসছে। আমি ‘র’ বলা শিখে গিয়েছি রিদ ভাইয়া। আপনি কি আজকেও আসবেননা? আমার আফসোসের পাহাড় ভেংগে গুড়িয়ে দিবেননা? এতো বড় পাহাড়টা আমি আর বয়ে বেড়াতে পারছিনা। আমার ঐ একটা নালিশ যে আপনাকে আমার থেকে এভাবে কেড়ে নিবে আমি বুঝতে পারিনি। আমার অবুঝের পাগলামীগুলো মনে পড়লেই সেগুলো তীর হয়ে বুকে বিদছে। ৮ টা বছর তো পেরোলো আর কত অভিমান করে থাকবেন? এবার অভিমানটা দিয়ে আমার আফসোসের পাহাড়টা ভেংগে গুড়িয়ে দিননা,প্লিজ!

তিল কাদতে কাদতে আয়নার সামনেই হাটু ভেংগে বসে পড়ে। খুব কষ্ট হচ্ছে খুব,এতো কষ্ট হচ্ছে কেন রিদ ভাইয়া??

তিল শাড়ীটা ঢিল মেরে ফেলে দিলো। পড়বোনা আমি শাড়ি! আপনার হাত যেদিন পড়াবে সেদিনই পড়বো। সেদিনি নিজের শরীরে শাড়ী জড়াবো।
~~
“” খবরদার তুই আমাকে হলুদ লাগাবিনা।””

রিমা তিলের হাতটা আটকে দিয়ে তিলের দিকে তাকিয়ে রইলো।

“” কেন?””
“” তুই তো আমাকে কথা দিয়েছিলি হলুদ শাড়ী পড়েই হলুদ লাগাবি। তুই কথার খেলাপ করেছিস। আমি তোর হাতে হলুদ লাগাবোনা। আমার সামনে থেকে যা!””

তিল অসহায়ভঙ্গিতে রিমার দিকে তাকিয়ে রইলো। ছোটবেলা থেকেই একসাথে বড় হয়েছে। একজনের পুতুলের সাথে আরেকজনের পুতুলের বিয়ে হয়েছে কতবার তা অগনিত। রিমা রিদানেরই ছোটবোন। রিদানের বাবা আর তিলের বাবা আপন দুইভাই। সে সুবাদেই তারা জয়েন ফ্যামিলির ন্যায় একসাথে থেকে আসছে। রিদানের বাবা বড় হওয়ায় তিল বড় আব্বু বলেই ডাকে। আর উনিও রিমার মতোই তিলকে মেয়ের মতোই দেখেন। সেভাবে দেখতে গেলে এ বাড়িতে সব থেকে আদরের মেয়ে হলো তিল। হবেইনা কেন? একটা ভদ্র,ভালো মেয়ের যা যা গুন থাকা সব তিলের মধ্যে বিদ্যমান। বরংচ অন্যদের মধ্যে যেগুলো নেই সেগুলোও আছে। এক কথায় ভদ্র,শান্ত,চুপচাপ মেয়েকে ছাড়িয়ে গিয়েছে। যদি এই নিয়ে কোনো প্রতিযোগিতা হতো তাহলে বিচারক চোখ বন্ধ করে তিলকে ফার্স্ট প্রাইজটা খুশিমনে তুলে দিয়ে নিজেকে ধন্য মনে করতো।

“” এমন করছিস কেন? শাড়ী দেখলেই আমার চুলকানি শুরু হয়ে যায়,আমার কি দোষ? আমি তো পড়তেই চাইলাম।””
“” তিল, আমার সাথে একদম মিথ্যা কথা বলবিনা। তুই যে মিথ্যে বলতে পারিস না সেটা আমার থেকে ভালো তুই নিজেও জানিস না। তুই যতক্ষননা শাড়ী পড়বি ততক্ষন আমার চোখের সামনে আসবিনা। আমাদের বন্ধুত্বের কসম।””

তিল মন খারাপ করে সেখান থেকে উঠে আসে। তোরা দুইভাইবোন এমন বিচ্ছিরী পোকা কেন রে? যখন তখন কামড়ে দিস। তোদের কি মনে হয়না তোদের বিষদাতগুলো আমার শরীরে কেমন জ্বলন ধরায়? ইচ্ছে তো করে তোদের বিষগুলো নিঙরিয়ে নিয়ে পুকুরের পচা পানির সাথে মিশিয়ে সরবত বানিয়ে তোদেরকে খায়িয়ে মেরে ফেলি। আমি তো শুনছি নিজের বিষ নিজে খেলে সাথে সাথে মারা যায়। সেটা তোদের উপর পরীক্ষা করে সিউর হতে হবে!

তিল বিড়বিড় করে হাটতে হাটতে বড়আম্মুর সাথে ধাক্কা খেলো।

“” উফ! শুভ কাজে বাধা দিলি কেন? একটু দেখে হাটতে পারিসনা?””
“” আবার কি শুভ হলো??””
“” আরে,আমার ছেলে এসেছে। আমার ছেলে আমার বুকে ফিরে এসেছে। আমি জানতাম নিজের আদরের ছোট বোনের বিয়ের কথা শুনে ও না এসে থাকতে পারবেনা। বাবার প্রতি রাগটা তাহলে এবার পড়লো।””
“” কার কথা বলছো,বড় আম্মু?””
“” কার কথা আবার আমার সোনার খনি,আমার রিদান এসেছে!””
“” রিদ ভাইয়া?””

তিলের মনে হলো তার শরীর বেয়ে বড়সড় একটা ঘুর্নিঝড় বয়ে গেলো। চারপাশের সবকিছু লন্ডভন্ড হয়ে গিয়েছে। হঠাৎই রিমার সজোরে চিৎকার করে ভাইয়া ডাকটা তিলের নিশ্বাসটা আটকে দিলো।

~~
তিল ড্রয়ার থেকে একে একে সব জামাকাপড় খুলে বের করছে। একের পর একটা পড়ে যাচ্ছে,আর খুলছে। সে তার রিদ ভাইয়ার সামনে কি পড়ে যাবে?? কোনটা পড়লে সব থেকে বেশি সুন্দর লাগবে?? উফ! আমার তো আজকে বেস্ট জামাটা পড়তে হবে। রিদ ভাইয়া এতো বছর পর বিদেশ থেকে এলো। ইউকে থেকে পড়াশুনা করেছে মানে তার পছন্দগুলোও অমনই হবে। আর তার পছন্দসই নাহলে আমার দিকে তো ফিরেও তাকাবেনা। কি যে করি! উফ! টেনশনে মাথা ভার হয়ে আসছে। সাথে সাথে মাথা ফাটিয়ে ব্যথা শুরু হয়ে গেছে।

তিলের মাথা ব্যথা আরো বাড়িয়ে দিলো তার বড় আম্মু!

“” একি তুই রুম এমন গোয়ালঘরের মতো করে রাখছিস কেন?””
“” এমনি,আমি কোন জামাটা পড়বো ঐটা…””
“” জামা কাপড় পরে খাচিস। রিদানের নাকি মাথা ধরেছে। আমার মাথা ধরলে তুই যে কি মশলা চা নাকি কি চা বানাস ঐটা বানিয়ে দেতো,মা।। যাতে চায়ে চুমুক দিতেই মাথা ব্যথা ফুরুৎ হয়ে যায়!””

বড় আম্মুর বিপরীতে কথা বলার সময়টাও পায়নি তিল। ওকে টানতে টানতে রান্নাঘরে নিয়ে গেলো।

তিল হাতে চায়ের ট্রেটা নিয়ে ড্রয়িংরুমের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। আমার বেস্ট সাজের বারোটা বাজিয়ে দিলো বড় আম্মু। এতো জামাকাপড় থাকতে কিনা শেষে এই সাদামাটা হলুদ জামাটা পড়েই উনার সামনে যেতে হবে?? শাড়ী পড়বোনা দেখে কি একটা গর্জিয়াস জামাও পড়তে পারলাম না? আর আমি চা বানালাম দেখে আমাকেই দিয়ে আসতে হবে? এই বড় আম্মুটাও আমাকে বুঝলোনা। রিদ ভাইয়ার সামনে আমাকে চাকরানী বানিয়ে দিলো? তিল মাথায় ওড়নার ঘোমটাটা আরো টেনে নিলো যাতে রিদ চিনতে না পারে।
I
ড্রয়িংরুমের সামনে যেতেই তিলের হাত পা কাপতে লাগলো। আল্লাহ এতগুলো ছেলে কোথা থেকে আসলো? এর মধ্যে রিদ ভাইয়া কোনটা? ছোটবেলা আর বড়বেলার চেহারা কি এক হবে?? আমি কি চিনতে পারবো?? ইশ! রিমা আমাকে কতবার উনার ছবি দেখাতে চাইলো আর আমি ফালতু রাগ দেখিয়ে মুখের উপর বলে দিয়েছিলাম,তোর ভাই কি ঘোড়ায়চড়া রাজকুমার যে আমি দেখতে যাবো? তোর ভাই গাদা চড়ার গরুকুমার। আর আমি গরুকুমারদের দেখিনা!

তিল ওড়নার নিচ দিয়ে সবাইকে দেখার চেষ্টা করতে লাগলো। কোনটা তার রিদ ভাইয়া! এদিকে পায়ের সাথে হাতটাও তাল মিলিয়ে কাপছে সাথে চায়ের কাপ টকটক করে শব্দ শুরু করে দিয়েছে। মনে হচ্ছে আজ কাপেরা মিলে যুদ্ধ বেধে যাচ্ছে কে আগে ফেটে গিয়ে চা নিচে গড়িয়ে ফেলতে পারে।

চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে