ভবঘুরে পর্ব-২১

0
768

ভবঘুরে পর্ব-২১
লেখাঃ আরিফুর রহমান মিনহাজ

এই বারিধারা কি কলংকের বেদনার নাকি অন্যকিছুর? আবিদ প্রশ্ন করতে গিয়েও থেমে গেল। উরবি খুব কষ্টে ঝরানো দুই ফোঁটা চোখের পানি আলগোছে মুছে নিয়ে দাঁত দিয়ে আমের চামড়া ছাড়াতে লাগল। চুলোয় যাক সব। মন খারাপ করে থাকার মানে হয় না। আম খেলেই মন ভালো হবে। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই ছাল ছাড়িয়ে নিয়ে গপগপ করে রসালো আম খেতে শুরু করে সে। আবিদ আড়চোখে একপ্রস্থ উরবির পাগলামি দেখে আর ঠোঁট আকর্ণ প্রশস্ত করে মুচকি হাসে। মেয়েটা পারেও বটে! এইতো মিনিট এক আগেও তার দু-চোখের পানি বর্ষার নদীর মতো কানায় কানায় পূর্ণ ছিল, অথচ এখন তার লেশমাত্র নেই। আম খেতে খেতে একপর্যায়ে উরবি বলল,
– এভাবে দেবদাসের মতো ঘুরেফিরে কতদিন?
আবিদ হেসে উত্তর দিল,
– যতদিন বাঁচি!
– আরেকটা আদিবা খুঁজে নিলেই হয়! শুনছি পৃথিবীতে একরকমের সাতজন মানুষ থাকে।
– তা হয়তো থাকে। কিন্তু যাকে আমি চাই, যাকে আমি আমার মতো করে গড়ে তুলেছিলাম সে তো আর আসবে না। অন্য আদিবা দিয়ে তো কাজ নেই আমার!
– দেখুন, পৃথিবী তো কারো জন্য থেমে থাকে না! এভাবে একটা দুর্ঘটনার শোকে-দুখে জীবনটা শেষ কেন করবেন? আজকে আমার সঙ্গে একটা দুর্ঘটনা ঘটানো হয়েছে। আমার নামে মিথ্যা অপবাদ গ্রামের পর গ্রাম ছড়িয়ে পড়ছে। কিন্তু আমাকে দেখুন। আমি রিল্যাক্স! আপনি কি আমার মতো একটা বাজে মেয়ের থেকেও নিচে নেমে গেছেন? নাকি আমার রিল্যাক্স থাকাকে আপনি নির্লজ্জতা আখ্যা দিবেন?
– একজন সুস্থ সচেতন মানুষ হিসেবে সেই আখ্যা আপনাকে আমি দেব না। আপনার কথা ঠিক। এভাবে জীবন করার অর্থ হয় না। কিন্তু একটা মানুষ যখন জীবনের নদীটাতে কূল হারিয়ে দিশেহারা হয় তখন আর কী করার থাকে? জীবনের পরিতৃপ্তিটা যদি পানিতে ডুবে যায় তাহলে জীবনকে নতুন করে সাজানোর ইচ্ছেটা থাকবে কেন?
– ‘নাহ সেকথা না। কিন্তু আপনি কূল হারিয়ে নদীর মাঝখানে ভেসে থাকলে কতক্ষণ সাঁতার কাটতে পারবেন আপনি? কূল খোঁজারও তো চেষ্টা করা উচিত। নদীর এক কূল ভাঙে অন্যকূল গড়ে। আপনার দুর্ভাগ্যবশত এককূল ভেঙেছে। আপনি অক্ষত আছেন পুরোপুরি। চোখ দিয়ে খোঁজ নিলে দেখতে পারবেন অন্যকূল তৈরি হয়ে আছে আপনার জন্য৷ সেই কূলে হয়তো আগের মতো সৌন্দর্যের ভারিক্কি নেই। কিন্তু হতেও সময় লাগবে না।’
আবিদ ওর যুক্তির কাছে হার মেনে চুপ করে রইল বেশ কিছুক্ষণ। মেয়েটা একটু উল্টাপাল্টা রণচণ্ডী স্বভাবের হলেও কথাবার্তায় ধার আছে মানতে হবে! মানুষের বাইরের স্বভাব দেখে ভিতরের মানুষটাকে জানা মুশকিল। আর মেয়ে মানুষ হলে তো কথাই নেই! সে সহসা মাথা তুলে হারমানা গলায় বলল,
– আপনার সঙ্গে কথায় পারা যাবে না। আমার থেকেও বড় তর্কবাগীশ আপনি। কিন্তু আপনার কথার সারমর্ম কী?
উরবি প্যাঁচিয়ে প্যাঁচিয়ে রহস্যময় হেসে বলল,
– আপনিই বুঝে নিন।
বলে উঠে দাঁড়াল সে। বাঁ হাতে পায়জামার ধুলো ঝেড়ে নিয়ে যেভাবে ধীরলয়ে এসেছিল সেভাবেই ধীরলয়ে নিজের ঘরে ফিরে এলো। সিঁড়ি ভেঙে যেতে যেতে তার মনটা বারবার একট কথা মনে করে বিদ্রোহ করে উঠল। সে কি কোনো ছলে কিংবা মনের অজ্ঞাতে নিজেকেই নদীর ঐ কূল বলে আবিদের কাছে গোপন ইঙ্গিত দিল না তো! কেনই বা তার মুখ দিয়ে তখন এমন কথার খই ফুটেছিল অনবরত! তার বিনা-অধ্যুষিত মন কী কারণে এমন ইঙ্গিত দিয়ে বসল আবিদকে। উরবি বেশ জানে লোকটার দূরদর্শী ভাবনার গভীরতার কথা। সে নিশ্চয় ইনিয়েবিনিয়ে বুঝে নিবে যে উরবির অবচেতন মন তারই দিকে এই অদৃশ্য ইঙ্গিত দিয়েছিল। কিংবা কে জানে লোকটার উরবির এলেবেলে কথা নিয়ে ভাবনার সময়ই হয়তো নেই। ঠিক তাই। উরবি চলে আসার পর আবিদ সেসব কথা নিয়ে আর বেশি ঘাটাঘাটি না করে নিজস্ব কাজে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ল।
কিন্তু উরবির মনের আন্দোলন ক্ষান্ত হল না। সে অস্থির হয়ে নিরুকে ফোন দিল। এতোদিন বাদে উরবি নিজ থেকে ফোন করেছে দেখে নিরু বেশ অবাকই হল। কোনো অতর্কিত দুঃসংবাদের আতংকে সে ভয়ে ভয়ে ফোন রিসিভ করল। রিসিভ করতেই উরবি ঝনঝনে কণ্ঠে বলল,
– ঐ ফোন ধরতে এতক্ষণ লাগে ক্যান?
নিরু একটু সময় চুপ করে থেকে বলল,
– সব ঠিক আছে তো?
উরবি আরো উত্তেজিত সুরে বলল,
– না-রে,কিচ্ছু ঠিক নাই। আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি এদিকে।
– কী হইছে বল্ তো?
এরপর উরবি নিরুকে সমস্ত খুলে বলল। শুনে নিরু উরবি শুনিয়ে একটা বড় নিঃশ্বাস ত্যাগ করে সহজ গলায় বলল,
– উরবি, তুই আবিদকে ভালোবেসে ফেলছস। খুব সিম্পল,সহজেই বোঝা যায়!
উরবির বুকের রক্ত তড়িৎ চঞ্চল হয়ে ছলকে পড়ল চারিদিকে! বাঁ পাশের হৃৎপিণ্ডটা ধকধক করে তার জায়গা দখলের আর্তনাদের জানান দিল। সে শুধু অস্ফুটে ‘যাহ,কী বলিস’ বলে রাঙা মুখে বিছানায় ধপাস করে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ল৷
নিরু বলল,
– হুম ঠিকই বলছি,
উরবি অস্বীকার করতে চাইল,
– বাজে কথা। সব কি এতোই সহজ নাকি!
নিরু জোর দিয়ে বলল,
– হ্যাঁ উরবি, এতোই সোজা আর সহজ। নাহলে এসব পাগলামির মানে হয় না। তুই এখন খুব শান্তিতে নেই যে এমন পাগলামি করতে যাবি। তোর মনের ঝড় তো আমার বুঝতে বাকি নাই!
উরবি উপেক্ষিত গলায় বলল,
– বাদ দে,এসব আলোচনা ভালো লাগতেছে না। আমার যদি কোনো ফিলিংস থাকেও লোকটা এসব বুঝবে না। সে বৈরাগী টাইপ। তাকে নিয়ে এসব ভাবাও অন্যায় হবে। কেন আমি হুদাই এসব বলে কয়ে নিজের মুখ বিক্রি করব বলতো? ছাড়… তুই কেমন আছিস বল।
নিরু একটু হেসে ফোনটা অন্য কানে দিয়ে বলল,
– আছি ভালো। কিন্তু তুই এতদিন আমার ফোন ধরস নাই। আজকে এই সমস্যার কারণে সব ভুলে নিজ থেকে কল দিলি। ব্যাপারটা তোর কাছে হালকা মনে হচ্ছে? দ্যাখ্, আমি তোকে চাপ দিচ্ছি না। বন্ধু হিসেবে, চাচাতো বোন হিসেবে তোর ফিলিংসটা নিয়ে নাড়াচাড়া করতেছি শুধু,যাতে তুই ওর কথা ভেবে ভবিষ্যতে কষ্ট না পাস।
– ‘হুম’ মুখের ভেতর শব্দ করে আকাশ-পাতাল ভাবতে লাগল সে।
– আচ্ছা তুই এটা বল যে তুই আবিদকে ভালোবাসিস কি না!
উরবির রাগ ধরে গেল বারংবার একটা বিষয় নিয়ে উত্যক্ত করাতে। সে গনগনে গম্ভীর গলায় বলল,
– জানি না, রাখলাম।
বলে সে ফোন কেটে দিল৷ উরবি আর এই বিষয় নিয়ে ভাবতে চায় না। সে নিজের মতো,আগের মতো স্বাভাবিক থাকতে চায়। অতিরিক্ত ভাবপ্রবনতা শুধু মানসিক পীড়া দেয়,শান্তি দেয় না।

মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরকে আবিদ জানিয়েছে এদিকে সব ঠিকঠাক। এবার মিশনের জন্য প্রস্তুত হওয়া যেতে পারে। যারা মাদক ছেড়ে দেওয়ার দিয়েছে,যারা আলোর পথের ফেরার ফিরেছে। বাকীদের শায়েস্তা করা ভিন্ন মাদক সেবন এবং অবাধ ব্যাবসা রোধ করা সম্ভব নয়। সারাদেশে এরিমধ্যে বিভিন্ন জায়গায় মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের পরিচালনায় মিশন চলেছে। গ্রেফতার হয়েছে নেপথ্যে থাকা বাঘা বাঘা সব শক্তিমান মানুষেরা। র‌্যাবের ক্রসফায়ারে প্রাণ হারিয়েছে বহু অসাধু মাদক-ব্যাবসায়ী। বাজেয়াপ্ত হয়েছে বিবিধ রকমের কাঁড়ি কাঁড়ি মাদকদ্রব্য। সেসব জায়গায় মিশনের কিছুদিন আগে নির্দিষ্ট এজেন্ট গিয়ে সাধারণ মানুষরূপে বসবাস করেছে, এলাকায় মাদকের সর্বাত্মক অবস্থান জেনেছে৷ সেই ধারাতেই আবিদ এই পল্লি-গ্রামে এসেছিল সম্পূর্ণ আলাদাভাবে। এর আগেও অনেক জায়গায় আবিদের বিচক্ষণতা আর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাগত যোগ্যতা দেখে তাকে স্পাই এজেন্টে যুক্ত হবার জন্য আহবান জানালেও সে বিনা-সংচোকে নাকচ করে দেয়। জানিয়েছিল, বাঁধাগৎ নিয়মে সে চলতে পারবে না, কিন্তু প্রয়োজনে তাকে অবশ্যই পাশে পাওয়া যাবে! এবং পাওয়া গেছে-ও। প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে, দিন দুয়েকের মধ্যেই সেই আস্তানায় মিশন শুরু করা হবে।
…………….

গভীর নিশুতি। রাত্রি অন্ধকার আলিঙ্গন করে আলস্যভরে পাশ ফিরে শুয়েছে কেবল। আবিদ গহন স্বপন- দেখা ঘুমে আচ্ছন্ন। মাথার ওপর ফ্যানের একঘেয়ে আওয়াজ ছাপিয়ে অনুভব করা যায় বাইরের ঝিল্লিমুখর পরিবেশ আর নাম না জানা পাখির হাঁক-ডাক। আবিদের ঘরের দেয়ালঘড়িতে কাঁটায় কাঁটায় একটা বাজল। রয়ে রয়ে আবিদের ঘুম আরো গভীর হয়। ঘুমের ঘরে আবিদ শুনলো এক কিন্নরকণ্ঠী রমণীর ডাক। স্বপ্নে বাড়িতে আবিদ তখন উরবিদের পুকুর ঘাটে নিরালা বসে কারো অভিসারে অপেক্ষা করছে। সেই সময় এই সুললিত কণ্ঠ,
– আবিদ!
আবিদ যেন তারই অপেক্ষাতেই ছিল। ফিরে তাকাল সে। খুব কাছেপিঠেই জ্বলজ্বলে মুখে দাঁড়িয়ে রয়েছে এক অন্যরকম আদিবা। তার পরনে সেই সুডৌল দেহে সুসজ্জিত রঙিন অভিজাত বস্ত্র। তার চারিপাশে ঘিরে আছে এক ঐন্দ্রজালিক আলোর বিস্তৃত বলয়। আলো টিকরে এসে লাগছে আবিদের সরল চোখে। অনেক কষ্টে আন্ধার পুকুরপাড়ে সেই আলো সয়ে নিয়ে আবিদ মৃদু স্বরে সাড়া দিল,
– ‘বলো আদিবা।’

– ‘কেমন আছ তুমি?’ কোমল আর্ত কণ্ঠস্বর আদিবার। অরুন্তুদ, শান্ত, স্থির চোখের দৃষ্টি।
আবিদ বলল,
– ভালো,এতদিন পর মনে পড়ল? সেই যে তোমার মৃত্যুর দিনে এসেছিলে, আর এলে না কেন?

– তুমি ডাকোনি বলে আসিনি।

– আজও তো ডাকিনি।

– আমি তো চিরকাল তোমার কাঙাল ছিলাম জানতে না?

– জানি।

– ‘তুমি বিয়ে করোনি কেন এখনো?’ একটু থেমে প্রশ্ন করে আদিবা।

– না,করব না।

– কেন? তোমাদের সমাজে তো স্ত্রী মারা যাওয়ার চল্লিশ দিনের ভিতর বিয়ে করা হয়!

– আমি সমাজ মানি না।

– মানতে হয় লক্ষ্মীটি!

– না,

– বিয়ে করে নাও, নদীর একূল ভাঙে ওকূল গড়ে যে!

– আমি ভাঙা কূলেই পড়ে থাকতে চাই আদিবা।

– আবিদ, মেয়েরা হিংসুটে হয় জানো তো? তোমার পাশে কোনো মেয়েকে দেখতে কষ্ট হয় আমার। এই দেখো আমার থ্যাতলানো হৃৎপিণ্ডটা কেমন ছটফট করছে…

আবিদের ঘুম ভেঙে গেল। যন্ত্রচালিত’র মতো ধড়ফড় করে উঠে বসল সে। খাটের পাশে টিপয়ের ওপর রাখা বোতল থেকে আধ লিটার পানি ঢকঢক করে পেটে চালান করে দেয় সে। এরপর জোরে একচোট নিঃশ্বাস নিতে নিতে মাথার এলো চুলগুলো পেছনে ঠেলে দিয়ে পুনরায় শুয়ে পড়ল সে। কিন্তু ঘুম যে সেই আদিবার দগদগে হৃৎপিণ্ডটা দেখে ভয়ে পালিয়ে আর ফিরে এলো না। এর আগে বহুবার মৃত মাকে স্বপ্নে দেখেছে আবিদ। কিন্তু আদিবা? এই প্রথম! কী মনে করে? সারারাত দু-চোখের পাতা এক হবার অবকাশ মিলল না আবিদের। মনের কোণে খাপছাড়া সব ভাবনার ধূসর মেঘ জমতে শুরু করেছে অনবরত। এতবছর পর স্বপ্নে এসে এ কি দুর্বোধ্য, দুর্ভেদ্য গোলকধাঁধায় আটকে দিয়ে দিয়ে গেল আদিবা। যদি আবিদের পাশে কোনো মেয়েকে সহ্য না-ই হয় তবে আবার বিয়ে করে সংসারী হতে বলা কেন? বাস্তব জীবনের গণ্ডি মাড়িয়ে স্বপ্নেও কেন কুহেলিকার রাজ্য সৃষ্টি করে নারী? কাজী নজরুল মিথ্যে বলে যাননি,”নারী কুহেলিকা”। মুসাফির পথিক পথ হারিয়ে সর্বস্ব হওয়ার মতোন কঠিন আস্তরণের কুহেলিকা।
এখনই জয়েন করুন আমাদের গল্প পোকা ফেসবুক গ্রুপে।
আর নিজের লেখা গল্প- কবিতা -পোস্ট করে অথবা অন্যের লেখা পড়ে গঠনমূলক সমালোচনা করে প্রতি মাসে জিতে নিন নগদ টাকা এবং বই সামগ্রী উপহার।
শুধুমাত্র আপনার লেখা মানসম্মত গল্প/কবিতাগুলোই আমাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হবে। এবং সেই সাথে আপনাদের জন্য থাকছে আকর্ষণীয় পুরষ্কার।

গল্পপোকার এবারের আয়োজন
ধারাবাহিক গল্প প্রতিযোগিতা

◆লেখক ৬ জন পাবে ৫০০ টাকা করে মোট ৩০০০ টাকা
◆পাঠক ২ জন পাবে ৫০০ টাকা করে ১০০০ টাকা।

আমাদের গল্প পোকা ফেসবুক গ্রুপে জয়েন করার জন্য এই লিংকে ক্লিক করুন: https://www.facebook.com/groups/golpopoka/?ref=share


আজ শুক্রবার। গ্রামের বুকে বিকাল না গড়াতেই বাড়ির সামনে এসে ভিড়েছে একটা দামি চকচকে কার গাড়ি৷ সেখান থেকে নেমে এলো কিছুসংখ্যক লোকজন। একজন ক্ষীণদেহী যুবক, দুইজন মধ্যবয়সী নর-নারী, দু’টো গোলগাল টসটসে বাচ্চা আর একজন পুরু গোঁফে ঢাকা রাশভারি লোক৷ সবার চালচলনে, পোকাশ-আকাশে একটা শহুরে আভিজাত্যের ছোঁয়া বিদ্যমান। মানুষগুলো চারপাশটা চোখ বুলিয়ে দেখতে দেখতে সদর দরজা দিয়ে প্রবেশ করল এবং গ্রাম্য পরিবেশে এমন সুরম্য ধারার বাড়ির প্রশংসায় পঞ্চমুখ হলো চুপিচুপি। এঁনারা ইশতিয়াক সাহেবের কলিগের খুব কাছের প্রতিবেশী। স্থায়ী বাসস্থান ঢাকাতেই। ইশতিয়াক সাহেবের কলিগকে নিজের মেয়ের জন্য ঢাকার ভেতরে ভালো সম্মন্ধ খুঁজতে বললে এঁদের নিয়ে আসে অন্তরঙ্গ কলিগের গ্রাম্য বাড়ি ঘুরে আসার সুযোগটাও হাত ছাড়া করেন না তিনি। ঐ পুরু গোঁফবিশিষ্ট গম্ভীর-মুখো লোকটাই ইশতিয়াক সাহেবের কলিগ। নাম মোজাফফর হোসেন। দেখতে গুরগুটে গুরুগম্ভীর মনে হলেও বাস্তবে বেশ মজার মানুষ তিনি। তারই কথাতে উরবিকে দলবেঁধে দেখতে এসেছে তারা। মেনে নিতেই হয়, এদেশের মেয়ে দেখা প্রথা অনেকটা চিড়িয়াখানার জন্তু দেখার মতো। পরিবার বর্গ নিয়ে মেয়ে নামক জন্তুকে না দেখলে এদেশের সংস্কৃতিকে অবমাননা করা হবে যে! যাক,সেদিকে পরে যাওয়া যাবে।
শুরুতে মোজাফফর সাহেবের অত্যাধুনিক প্রতিবেশীরা গ্রামের মেয়ে শুনে নাক সিঁটকালেও মোজাফফর সাহেবের সুপারিশে তারা একটিবারের জন্য দেখতে এসেছেন মেয়েকে। এবার বাড়িতে পা রাখার পর তাদের প্রত্যেকেরই মনে হল, গ্রামাঞ্চলে জমিদারি প্রথা উঠে না গেলে এরাই বোধহয় জমিদার হবার সার্বিক যোগ্যতা রাখে। এতদূর পথ পাড়ি দিয়ে আসাটা বোধহয় সার্থক হল! মোদ্দাকথা সবাই একটু উৎসাহিত হল বুঝতে পেরে মোজাফফর সাহেবের বুক আপন গরিমায় উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠল।
নয়া অতিথিদের বেশ খাতিরযত্ন করে ঘরে ঢোকানো হল। ঘটা করে দেওয়া হল চা-নাশতা। বাড়িতে আয়োজনের উপলক্ষে আবিদকে ডাকা হয়েছিল নাশতার টেবিলে। সে ইনিয়েবিনিয়ে নিজেকে লাজুকলতার চেয়েও দ্বিগুণ লাজুক প্রমাণ করে ইশতিয়াক সাহেবকে বিদায় করেছিল। আদতে অপরিচিত মেহমানের সামনে যাবার ইচ্ছে তার নেই। বলা উচিত, ইশতিয়াক সাহেব বেশ আমোদিত পুরোনো বন্ধু তথা কলিগকে পেয়ে। নিভৃতে তাঁর এটা ভেবে ভালো লাগে যে, মেয়েটার কপাল বুঝি এবার খুলেই গেল। আল্লাহ সহায়!

নিরু মায়ের সঙ্গে তুমুল ঝগড়া পাকিয়ে উরবির কাছে এসেছে আজ। উরবিকে ছেলেপক্ষ দেখতে আসছে আর সে ঘরে বসে থাকবে এ-তো হতে পারে না। নিরুর ভাষ্যমতে উরবি নির্দোষ এবং একটা মানুষকে অন্যায়ভাবে নিঃসঙ্গ করে দেওয়ার তো কোনো মানে হয় না! এটাই তাদের মা মেয়ের ঝগড়া অর্থাৎ বাগবিতণ্ডার বিষয়বস্তু ছিল। অবশ্য মা হার মেনে নিয়ে শেষে মেয়েকে যাওয়ার অনুমতি দিয়েছে যাতে মেয়ে অবাধ্য হয়েছে এমনটা লোকমুখে শুনতে না হয়।… অনেক্ষণ অবধি ড্রেসিং টেবিলের সামনে মুখে প্রসাধন মাখা নিয়ে পীড়াপীড়ি চলছে। উরবি কিছুতেই মুখে এক রত্তি মেকআপ মাখতে রাজি নয়। ওদিকে মেয়ে দেখার জন্য তাড়া এদিকে নিরু এই নিয়ে তিক্ত-বিরক্ত হয়ে বারবার অনুরোধ অনুযোগ করছে। কিন্তু কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। নিরু শেষমেশ হার মেনে শুধুমাত্র শাড়িটা গায়ে পেঁচিয়ে দিতে দিতে বলল,
– তুই কি বিয়েটাই করতে চাচ্ছিস না? আরে দেখতে আসছে শুধু,বিয়ে তো হয়ে যাচ্ছে না!
উরবি আয়নার দিকে চোখ রেখে মুখ ভেংচে বলল,
– বিয়ে হয়ে যাচ্ছে না বলেই এখন এসব জিনিস মাখব না আমি। বিয়ে হলে তখন মাখব।
নিরু টিপ্পনী কাটল,
– তোর জামাই কিন্তু তোর মতোই চিকনা। ভালোই হইছে চিকনা জামাই পাইছিস। জলহস্তী হলে মানাতো না।
– চুপ ছেমরি। আমি চিকনা তো কী? চিকনা মাল পছন্দ না আমার। শুধু দ্যাখ,ব্যাটারে কেমন ধাতানিটা দিই আমি।
নিরু উরবির চুলের জট ছাড়াতে ছাড়াতে মলিন করুণ গলায় বলল,
– তোর বিয়ে করতে ইচ্ছে না করলে করবি না, উল্টাপাল্টা কিছু করলে তো মানসম্মান নিয়ে প্রশ্ন উঠবে। চাচা কষ্ট পাবে।
– যেভাবে না পায় সেই নিয়মেই ব্যাটাকে ধুনা দিয়ে বিদায় করব নিরু। তারপর বাবাকে বলে দিব,যাতে চিক্নাজামাই আর না দেখে। সালমান খানের মতো জামাই না হোক ভরুন দাওয়ানের মতো জামাই তো আমার চা-ই, চা-ই।
– হুদাই আকাশ-কুসুম চিন্তা।
– হইছে,পাকনামি করিস না তুই।
নিরু জিসান কিংবা সেই সম্পর্কীয় কিছু জিজ্ঞেস করতে গিয়েও দ্বিধান্বিত হয়ে চেপে গেল। থাক, মেয়েটা আজ প্রফুল্ল আছে,অযথা তার কাছে ওসব কথা তুলে দাবড় খাওয়ার মানে হয় না।

চলবে…