বেলা শেষে ২ পর্ব-০৪

0
819

#বেলা_শেষে- ২

[০৪]

ঢের মনোযোগ সহকারে স্যারের কথা শুনছি। কেমিস্ট্রির এক একটি সমীকরণ স্যার এত সুন্দর করে বুঝিয়ে দিচ্ছেন। মনোযোগ দিয়ে শুনছি আর বুঝার চেষ্টা করছি। তখনই আমার পাশে এসে বসল অর্ণা। অর্ণার চোখমুখে ছেয়ে আছে একরাশ বিষণ্ণতা। অবশ্য এটা নতুন কিছু নয়। ওর ছিয়ানব্বই তম বয়ফ্রেন্ড কে ও রিজেক্ট করে দিয়েছে সেটা ওর মুখ দেখে বোঝা যাচ্ছে। আমি নিশ্চিত এই মেয়ে একদিন সেঞ্চুরি করবে। নিজের কৌতুহল দমিয়ে রাখতে পারলাম না। অর্ণার উদ্দেশ্য বলে ফেললাম,

– প্রেম শুরুর আগে ব্রেকআপ করে দিলি তো। ডোন্ট ওরি বেবী । চিল করো চিল, আর মাত্র চারটা প্রেম তাহলেই তো সেঞ্চুরি হবে তোর। ইতিহাসের পাতায় বড় বড় অক্ষরে তোর নাম লেখা থাকবে। ওয়ার্ল্ড এর সেরা প্রেমিকা, অর্ণা শিকদার। শেষের বাক্যটা বলার সময় দুই হাত প্রসারিত করে বললাম। তারপর ওর দিকে তাকিয়ে আমার ভ্রুদ্বয় নাচালাম। তখন অর্ণা অসহায় মুখ করে আমার দিকে তাকালো এবং আবেগী কন্ঠে বলে উঠল,

– আমি না, ওই হ্যান্ডসাম টাই করে দিয়েছে আমার সাথে ব্রেকআপ। অর্ণার কথা শুনে আমার কপালে আপাআপনি কয়েকটা ভাজ পড়ে গেল। জিগ্যেসু দৃষ্টিতে তাকালাম ওর দিকে। তখন অর্ণা আবারও বলে উঠলো,

– ছেলেটা আমাকে না তোকে পছন্দ করে। শুধু মাত্র তোর কাছাকাছি আসার জন্যে আমার সাথে এতদিন ভাব জমিয়েছে। অর্ণার কথা শুনে আমি মনে হয় আকাশ থেকে পড়লাম। আমাকে পছন্দ করে মানে। কে ছেলেটা। কেন জানিনা ছেলেটাকে খুব করে জানতে ইচ্ছে করছে। আমি অর্ণার দিকে তাকিয়ে বললাম,

-আমাকে পছন্দ করে মানে??

-সেদিন রেস্টুরেন্টে আমার পঁচানব্বই তম বয়ফ্রেন্ডের সাথে দেখা করতে গিয়েছিলাম মনে আছে। আরে সেই দিন যেদিন তার সাথে ব্রেকআপ করলাম। সেদিন রেস্টুরেন্টে তোকে দেখেই নাকি তোর প্রেমে পরেছে। সে তোর সাথে আলাপ করতে চায়। আমার কাছ থেকে তোর নাম্বারটা নিয়ে নিয়েছে।

-নাম্বার নিয়েছে মানে। চেনা নেই জানা নেই আর তুই আমার নাম্বার দিয়ে দিলি। রেগে গিয়ে বললাম আমি।

– দেখ দোস্ত রাগ করিস না। এত কিউট হ্যান্ডসাম একটা ছেলে নাম্বার চেয়েছে না দিয়ে পারি বল। সে যদি চাইতো তবে আমি বিনা সংকোচে আমার জানটাও দিয়ে দিতাম।

– তোর জান কলিজা কিডনি ফুসফুস যা খুশি দে তাতে আমার কি। আমার নাম্বার কেন দিলি তুই। উত্তেজিত হয়ে বললাম আমি। তখনি স্যার আমাদের দিকে তাকালেন। এবং আমাদের দুজনকে দাঁড় করালেন। পড়ালেখায় ফাকি দেওয়ার কারনে আমাকে কয়েকটা কথা শুনাতেও ভুললেন না তিনি। তারপর আমাদের কাছে জানতে চাইলেন আমরা দুজনে কি নিয়ে কথা বলছি। আমি স্যারের কাছে সত্যিটা বলে দেই কিন্ত অর্ণা সে তখন উল্টোকথা বলে যার ফলে আমাদের দুজনের সাথে ঝগড়া লেগে যায় আর স্যার দুজনকেই ক্লাস থেকে বের করে দেয়।

এদিকে,
মিষ্টিকে কলেজে পৌঁছে দিয়ে নিজের কলেজে চলে আসে অভি। তারপর সে ক্যাম্পাসে তার বন্ধুমহলে যায়। সেখানে গিয়ে তাদের সাথে নেক্সট ব্লগ নিয়ে আলোচনা করতে থাকে। তাদের নেক্সট ব্লগটা কবে কোথায় কি নিয়ে হবে সেটারই আলোচনা হচ্ছে এখানে।অভিদের টিম মেম্বার মোট আটজন। তারমধ্যে তিনজন মেয়ে আর বাকি পাঁচজন ছেলে। তবে ব্লগার হিসাবে অভিই সবার কাছে বেশী পরিচিত।সকলের মতামতের উপর ভিত্তি করে সিদ্ধান্ত চুরান্ত করা হয় তাদের এবারের ব্লগ হবে খৈয়াছড়া ঝর্নায়।

খৈয়াছড়া ঝর্ণা (Khaiyachora Waterfalls) বাংলাদেশের চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ের পাহাড়ে অবস্থিত একটি জলপ্রপাত। মিরসরাই এর এই নয় স্টেপ এর ঝর্না বিস্ময়কর। খৈয়াছড়া – আকার আকৃতি ও গঠনশৈলির দিক দিয়ে এটা নিঃসন্দেহে এখনও পর্যন্ত বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ঝর্ণাগুলোর একটি । এর মোট নয়টি মুল ধাপ এবং অনেকগুলো বিচ্ছিন্ন ধাপ প্রমান করে যে এমন আর একটা ঝর্ণাও বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত দেখা যায়নি। খৈয়াছড়াতে সব সময় জ্বলে (এমন কি বৃষ্টিতেও) এমন একটি পাহাড় আছে, সেখানে আগুন কখনও নিভে না। প্রকৃতির নান্দনিক তুলিতে আঁকা সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ হচ্ছে দেশের ভ্রমণপিয়াসী মানুষ। অনেকে রাতের বেলায় চাঁদের আলোয় ঝর্ণার অপরূপ সৌন্দর্য উপভোগ করতে পাহাড়ের পাদদেশে তাবু টাঙ্গিয়ে অবস্থান করছেন। প্রকৃতির অপরূপ সৃষ্টি সেতুবন্ধন করে, সবুজের চাদরে ঢাকা বনানী রূপের আগুন ঝরায়, যেখানে প্রকৃতি খেলা করে আপন মনে, ঝুম ঝুম শব্দে বয়ে চলা ঝর্ণাধারায় গা ভিজিয়ে মানুষ যান্ত্রিক জীবনের অবসাদ থেকে নিজেকে ধুয়ে সজীব করে তুলছে খৈয়াছরা ঝর্ণায়।

সেদিন আর কোন ক্লাস করা হয়না আমার। অর্ণার সাথে রাগ করে কলেজ থেকে চলে আসি। বিকালে মামনির কাছে শুনছিলাম কলেজ ছুটির সময় ভাইয়া নাকি আমার কলেজে গিয়েছিল আমাকে আনতে। তখন আমার কলেজে একটা স্যার নাকি তাকে বেশ কড়া করে কথা শুনিয়েছে। এতে মহাশয় বেশ অপমানিত হয়েছে। বাসায় এসে মামনিকে নাকি সে কথা শুনিয়েছে আর এটাও বলেছে, এখন থেকে আমাকে সেই পড়াবে। এবার এইচএসসি তে নাকি আমার রেজাল্ট ভালো করে তবেই সে থামবে। মামনির মুখে কথাগুলো শুনে আমি সারাদিন আমার রুম থেকে বের হয়নি। সবাইকে কি করে বুঝাবো আমি আমার লেখাপড়া করতে ভালো লাগে না। ভাইয়ার ভয়ে আজ সারাদিন নিজেকে রুমের মধ্যে গুটিয়ে রেখেছি। তার উপর মাথায় ঘুরছে আরেকটা চিন্তা যদি সেই অনাকাঙ্ক্ষিত ব্যক্তিটি কল করে। আচ্ছা ছেলেটা কে হতে পারে! পুরো রুমে পায়চারি করছি আর ভাবছি তার কথা।

পড়ন্ত বেলায় পশ্চিম আকাশে তেজ কমে যাওয়া সূর্যটা নদীর জলে ছড়িয়ে দেয় রক্তবর্ণ আভা। তখন দর্শনার্থীর প্রাণে চাঞ্চল্য ফিরে আসে। গোধূলিলগ্ন নদীপাড়ের পড়ন্ত বিকেলের গল্পগুলো হয়তো এমনই। আর হ্যাঁ, এমন দৃশ্যের ছোঁয়া পেতে এ প্রজন্মের তরুণ-তরুণীদের আগ্রহেরও যেন শেষ নেই। হ্যাঁ এমন একটি দৃশ্যে নদীর পাড় ধরে পাশাপাশি হাঁটছি আমি আর ভাইয়া। লাঞ্চ করার সময় ভাইয়া যখন সবার সামনে আমাকে বলে আজ থেকেই সে আমাকে পড়াবে তখনি মেজাজটা বিগড়ে যায়। তুই আমার আব্বুর বন্ধুর ছেলে। তুই আমার সাথে গল্প করবি আড্ডা দিবি ঘুড়বি মাঝে মাঝে রেস্টুরেন্টে নিয়ে যাবি প্রেম করবি। তা না, তুই কেন আমার পড়ালেখার পিছনে পরে আছিস। যত্তসব। আর স্যারদের উদ্দেশ্যেও বলি, পরিচিত লোক দেখলেই আপনাদের নালিশ করার স্বাভাবটা কোন দিন যাবে না। শিক্ষক হয়ে এটা ভুলে গেছেন যে একদিন আপনারাও স্টুডেন্ট ছিলেন। যেহেতু এটা আমার পড়াশুনা নিয়ে কথা তার উপর আমি আগেও একবার এক্সামে ফেল করেছি। এবার পাশ করবো কি না তারও কোন নিশ্চয়তা নেই তাই আরাভ আংকেল ও মামনি দুজনেই চায় আমি অভি ভাইয়ার কাছে পড়ি। আংকেল ও মামনির সামনে আমিও স্বীকার করে নেই। পরেরটা পরে দেখা যাবে। তবে আমি একটা কন্ডিশন দেই আর সেটা হলো, আজ যদি ভাইয়া আমাকে কোথাও বেড়াতে নিয়ে যায় তবেই আমি তার কাছে পড়বো অন্যথায় না। আমার প্রস্তাব শুনে মহাশয় প্রথমে রেগে গেলেও পরে কিছু একটা ভেবে রাজি হয়ে যায়।

– ছেলেটা কে মিষ্টি??? মনের আনন্দে হেলেদুলে ভাইয়ার আগে আগে হাটছি। হঠাৎ করে তার ছুঁড়ে দেওয়া প্রশ্ন শুনে থমকে দাঁড়াই আমি। ততক্ষণে ভাইয়াও আমার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। এবং সে উৎসুক দৃষ্টিতে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। আমি আমতা আমতা করে বললাম,

-কো-কোন ছেলেটা ভাইয়া! তুমি কার কথা বলছো?

ভাইয়া চক্ষুদ্বয় কিছুটা সংকোচিত হলো। তারপর সে চিবুকে হাত বুলিয়ে বলল,

-যার কারনে আজ তোকে আর তোর বান্ধুবিকে ক্লাস থেকে বের করে দিয়েছে। ভাইয়ার কথা শুনে আমি শুকনো ঢোক গিললাম। কলিকা শুকিয়ে আসছে মনে নয়। জিহ্বা দিয়ে ওষ্ঠদ্বয় ভিজিয়ে নিয়ে বললাম,

-আ-আমি জানিনা সাথে সাথে ভাইয়া আমার বাহুতে চেপে ধরলো। ক্রোধান্বিত দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো আমার দিকে তারপর দাত কটমট করে বলল,

– স্কুলে যাওয়ার নাম করে ছেলেদের সাথে ঘুরতে যাস। বল কয়টা ছেলের সাথে ঘুড়ে বেড়াস। কয় জনের সাথে ফ্লড করেছিস। কি হলো চুপ করে আছিস কেন? বল। আমার প্রথম থেকেই তোর উপর ডাউট ছিলো, যে মেয়েটা কোন দিন ক্লাস ফাকি দেয়না। শত ঝড় বৃষ্টিতে যে স্কুলে উপস্থিত থাকে সে এক্সামে ফেল করে কি ভাবে। এই সব ই করে বেড়াস তো তুই। বল কতদিন ধরে চলছে এসব।

এক নাগারে কথাগুলো বলল ভাইয়া। আমি ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি ভাইয়ার দিকে। ভাইয়া এসব কি বলছে আমি আবার কার সাথে ফ্লড করলাম। ভাইয়া আমার বাহুতে আরো শক্ত করে চেপে ধরে বলল,

– কাল থেকে তোর কলেজ যাওয়া বন্ধ। বাসায় আমি তোকে পড়াবো। আর আংকেল আন্টি ফিরলে ওনাদের যা বলার আমি বলবো। তুই আর কলেজে যাবি না।

-কিন্ত ভাইয়া আমি তো,,,,

– চুপ একদম চুপ, কোন কথা বলবি না। আম্মুর আদর পেয়ে একদম মাথায় উঠে গেছিস তুই। এবার তোকে মাটিয়ে নামাবো আমি। এই খন্দকার জুবায়ের আহসান অভি। বলেই ধাক্কাদিয়ে কিছুটা দূরে সড়িয়ে দিলো আমাকে।

চলবে,,,,,,,,

#মাহফুজা_আফরিন_শিখা।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে