বৃষ্টিভেজা আলাপন পর্ব-২০

0
516

#বৃষ্টিভেজা_আলাপন (২০)

পুরুষ মানুষের সংস্পর্শ মারাত্মক। উষশী এখনোর ঘোরের মধ্যে ডুবে। তার পুরো শরীর জুড়ে অন্যরকম সুগন্ধ ছড়াচ্ছে। একটু দূরে দাঁড়িয়ে আছে অভিরাজ। আকাশের পানে মুখ করে বৃষ্টি মাখছে সে। মনে হচ্ছে পৃথিবীর সবথেকে সুখী ব্যক্তিটি সে নিজেই। খানিক আগের ঘটনাটা উষশী’র মস্তিষ্কে এখনো সেট হতে পারে নি। সে বোঝার চেষ্টা চালাচ্ছে কি ঘটে গেল। বৃষ্টি তখন প্রায় থেমে গেছে। এবার ফেরা প্রয়োজন। উষশীকে গাড়িতে উঠতে বললেই মেয়েটি সরাসরি প্রশ্ন করল।
“আর উই ইন লাভ?”

মুচকি হাসল অভিরাজ। মেয়েটির খুব নিকটে এসে বলল,”তেমনি কিছুটা।”

কি অদ্ভুত ছিল সময়টা। যার রেশ এখনো গেল না। ভেজা কাপড় শুকোতে অনেক সময় লাগবে। মৃদু হাওয়ায় শরীর শীতল হতে শুরু করেছে। উষশী’র শরীরে কম্পন ধরে গেল। তীর তীর করে কাঁপছে তার গোলাপ রঙা অধর। মেয়েটির জন্য বিশেষ কোনো পোশাক সাথে নেই। এভাবে থাকলে অসুস্থ হওয়ার সম্ভবনা শতভাগ। অভির খেয়াল হলো গাড়িতে থাকা টিশার্টের কথা। যা সর্বদা ক্যারি করে সে। সেটাই পরে নিল উষশী। তাকে দেখতে এখন অন্যরকম লাগছে। মেয়েটি ওর ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকা দেখে নড়ে উঠল।
“এভাবে তাকাচ্ছেন কেন?”

“কি মনে হয়?”

“আমি মানুষের মন পড়তে জানি না।”

“ভালো তো। না হলে নিশ্চিত তোমার নরম হাতের ধারালো স্পর্শে খু ন হতাম আমি।”

“কেন?”

“আমার মনের অবস্থা বুঝতে পারলে তুমি এভাবে দাঁড়াতে পারতে না। লজ্জাতেই ম রে যেতে।”

একটু সময় নিলেও উষশী বিষয়টা বুঝতে পারল। তার কালচারে শারীরিক মোহ গুলো বড়ো সহজ বিষয়। সে অভিরাজের বুকের কাছের জামাটা চেপে ধরল।
“আরে কি করছ?”

“খু ন করব।”

“অনেক আগেই তোমার হাতে খু ন হয়েছি রেইন।”

“এ নামে সম্মোধন করবেন না।”

“কেন? ভালো নাম তো।”

“বুকের ভেতর কেমন করে যেন।”

“তুমি গভীর প্রেমে ডুবে যাচ্ছ উষশী।”

“সব আপনার দোষ। কেন এভাবে কাছে টেনে নিলেন।”

কিশোরী উষশী অভিরাজের বুকের কাছে এসে নাক ঘষতে শুরু করেছে। একটা সময় পর মানুষটাকে ছেড়ে যেতে হবে এটা ভেবেই কান্না পাচ্ছে।

ওরা বেশ রাত করে ফিরল। তখন কেউ জেগে নেই। লাবণ্য একটু আগেই এসেছে। উষশী’র শরীরে থাকা টি শার্টটা চিনতে অসুবিধা হলো না তার। একটু সন্দেহ হতেই অভিরাজের দরজায় এসে দাঁড়াল। ছেলেটা তখন ভেজা শার্ট খুলতে ব্যস্ত।
“অভি,তুই উষশী’র সাথে গভীর কোনো সম্পর্ক গিয়েছিস?”

“এমন কেন মনে হলো তোর?”

“ওর শরীরে তোর টি শার্ট।”

“বৃষ্টিতে ভিজে গিয়েছিল তাই আমার টি শার্ট পরেছে।”

লাবণ্য’র সরাসরি প্রশ্নটা অভি’র পছন্দ হয় নি। তাই চোখ মুখে বিরক্তি।
“তোরা সম্পর্কে আছিস?”

“হুট করে কি সব প্রশ্ন করছিস লাবণ্য?”

“উষশী’র গলায় লাভ বাইট।”

“আমার থেকেই পেয়েছে।”

“এর মানে সম্পর্ক করছিস?”

“হুম।”

“কবে থেকে?”

“আজ থেকেই।”

লাবণ্য এ ব্যপারে আর কথা বলতে পারল না। ঘরে এসে দেখল উষশী জামা বদলে ফেলেছে। তাদের সম্পর্কটা গভীর না হলেও ভালোবাসার চিহ্ন গুলো ভীষণ চোখে লাগছে। এই দৃশ্যটা হুট করেই লাবণ্যকে কষ্টে ফেলে দিল। তাদের সেই মধুমাখা মুহূর্ত কল্পণা করতেই যন্ত্রণায় ম রে যাওয়ার ইচ্ছে হলো।

ভালোবাসা প্রকাশ হলে চাওয়া পাওয়া,মান, অভিমান, অধিকার সব কিছুই বৃদ্ধি পায়। পনের বছরের কিশোরীর মন এমনিতেই রঙিন থাকে। তারউপর প্রিয় পুরুষের গভীর স্পর্শ গুলো আরো বেশি কল্পনাসক্ত করে তুলে। বিলাসের মুহূর্তটুকু বার বার চোখে ভাসে। ভোর থেকেই তেমন কিছু ঘটে যাচ্ছে উষশী’র ভেতর। তার অন্তঃকরণে অভিকে দেখার জন্য আন্দোলন চলছে। সে থাকতে না পেরে সোজা অভি’র রুমে চলে গেল। ছেলেটার ঘুম ঘুম চোখ। অগোছালো উষশীকে দেখতে পেয়ে দ্রুতই দরজা লাগিয়ে ফেলল। মেয়েটি এক দৃষ্টিতে দেখছে তাকে।
“এত ভোরে এসেছ কেন?”

“ভালো লাগছিল না।”

উষশী’র শারীরিক স্বাস্থ্য ঠিক আছে কি না সেটা বোঝার জন্য কপালে হাত রাখল অভিরাজ। তাপমাত্রা ঠিক পেয়ে স্বস্তিবোধ করল সে।
“ঘুমাও নি সারারাত?”

“উহু।”

“শরীর খারাপ করবে তো। আসো একটু ঘুমিয়ে নিবে।”

মেয়েটিকে বুকের সাথে মিশিয়ে নিল অভি। ঘড়িতে ভোর পাঁচটা বাজে। বাড়ির সকলের ঘুম ভাঙতে আরো কিছু সময় লাগবে। বরাবরের মতোই মেয়েটির বাদামি রঙা চুলে হাত গলিয়ে দিল ছেলেটা। তার হাতের মাদকে ভেসে যাচ্ছে উষশী। ছেলেটার বুক থেকে মিষ্টি সুবাস নাকে লাগছে। এই অচেনা ফুলের ঘ্রাণে ঘোর লেগে যাচ্ছে কিশোরীর। অভি খুব সচেতনে মেয়েটিকে বিছানায় শুয়ে দিল। তারপরই ফ্রেশ হয়ে হসপিটালের ফাইল গুলো চেক করতে লাগল। ছয়টার কিছু পূর্বে উঠে পড়ল উষশী। উঠেই চোখে পড়ল অভিরাজের উন্মুক্ত পেশি। নিয়মিত শরীরচর্চা করা বডি যেন মাদকের মতো নিকটে টানছে। হাই তুলতে তুলতে কোকোকে কোলে উঠিয়ে নিল।
“চলে যাচ্ছি।”

“আরেকটু ঘুমিয়ে নাও।”

“ফরিনা আন্টি এসে যাবে। এখানে থাকলে বাজে মন্তব্য তৈরি করবে।”

“কে কি বলল তাতে কি যায় আসে উষশী? আমি তোমাকে তুমি আমাকে ভালোবাসো। আমরা সম্পর্কে রয়েছি। এটার সুন্দর একটা ভবিষ্যৎ রয়েছে। কারো কথা মাথায় নিবে না কেমন?”

“হুম।”

কিশোরী হলেও অভিজ্ঞতার দিক থেকে বেশ পরিপক্ক মেয়েটি। সে অভিরাজকে পুনরায় দু নয়নে দেখে নিল। তার দৃষ্টি শূন্য হয়ে এসেছে। ছেলেটার সাথে আত্মার সম্পর্কটা একটু বেশিই গাঢ় হয়ে উঠেছে। অথচ তাকে ফিরতে হবে।

লাবণ্য’র কষ্টটা চোখে মুখে ফুটে উঠেছে। এতদিন অভিরাজ সম্পর্কে বিশেষ কোনো ভাবনা তৈরি না হলেও ইদানীং তৈরি হয়েছে। তার সাথে অভি’র বিবাহ নিয়ে সবসময় আলোচনা চলত। তখন ওরা সবে এইচ এস সি শেষ করেছে। লাবণ্য মেডিকেলে আর অভিরাজ কম্পিউটার সাইন্সে ভর্তি হলো। আসা যাওয়ার সমস্যা’র জন্য দুজনকে ঢাকায় পাঠানো হয়। তারা তাদের ঢাকার বাড়িতে থেকেই পড়াশোনা করেছে। এক সাথে সুন্দর অনেক মুহূর্ত রয়েছে। তাদের সম্পর্কের বন্ধুত্বটা সব সময় মায়াযুক্ত ছিল। এই সম্পর্কের বাইরে কিছু ভাবতে হয় নি কখনো। তারপর যখন অভিরাজের পড়াশোনা শেষ হলো। লাবণ্য’র ইন্টার্নশীপ শুরু হলো সবাই চাইল ওদের বিয়েটা হয়ে যাক। দুজনেই এ বিষয়ে দ্বিমত করেছিল। অভি তো রাগ করে বাড়িই আসল না ছয়টা মাস। এর পরই ওদের জীবনে এল উষশী নামক কিশোরী। তখন থেকেই লাবণ্য’র ভেতরটা অভিকে নিয়ে ভাবতে শুরু করেছে। অভি’র সাথে অন্য কাউকে দেখলে কষ্ট হতে শুরু করেছে। এখন ওরা সম্পর্কে আছে এটা মানতেই পারছে না তার মস্তিষ্ক। নীরবে চোখের জল ফেলল মেয়েটি। উষশী নিশ্চয়ই অভির কাছে গিয়েছে। তাই সে রোজকার নিয়ম বদলে নিয়ে অভিরাজের রুমে এল না। উষশী কিছু সময় পর কোকো কে নিয়ে রুমে প্রবেশ করল। তার চোখে মুখে বাহারি স্নিগ্ধতা। ভালোবাসার চিহ্ন এখনো গলায় স্পষ্ট। বেহায়া মন বার বার সেই চিহ্নের প্রতি আকর্ষণ পাচ্ছে। অভিরাজের কতটা নিকটে গেলে এমন চিহ্ন হতে পারে সেটাই ভাবতে বসেছে মস্তিষ্ক।

সুন্দর গাউন পরেছে উষশী। অভিরাজ তার সাথে মিলিয়ে হাত ঘড়ি এনেছে। সেটা দেখেই উষশী’র মন পুলকিত হয়ে উঠল। এখন সে কাপলদের মতো অনুভূতি পাচ্ছে। সকলের অগোচরে ফুল দিয়ে গেছে ছেলেটা। সেটা হাতে করেই পুরো বাড়ি ঘুরঘুর করছিল। ঈশান নিজ কক্ষে আধশোয়া হয়ে আছে। তার ভেতরটা কতটা তিক্ত হয়েছে বলে বোঝানো যাবে না। তার অনুভূতি গুলো ক্রমশ নিভে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে ভেতরটা পাথরে পরিণত হবে ক্ষণিকেই।
“ঈশান, ঘরে বসে কি করছো? বেরিয়ে এসো। এভাবে তো মন খারাপ হবে।”

চোখ তুলল ঈশান। বাদামি রঙের চুল যুক্ত ফর্সা পাতলা মেয়েটি আজ লাল রঙে ডুবে আছে। তাকে দেখতে রেড ওয়াইন এর মতো মনে হচ্ছে। তার কোমল গোলাপি ঠোঁট ফের রক্তজবার ন্যায় সেজেছে।
“সুন্দর লাগছে উষশী।”

“তোমাকে মনমড়া দেখলে ভালো লাগে না ফ্রেন্ড।”

“মনমড়া কোথায়?”

“চোখ মুখের অবস্থা দেখেছ?”

“সব তো ঠিক ই আছে।”

উষশী তার নরম তুলতুলে হাতটা ঈশানের গালে স্পর্শ করাল। ছেলেটার চোখ যেন সিক্ত হয়ে এসেছে।
“এখনো সময় আছে ঈশান।”

“সব কিছু গল্পের মতো হয় না উষশী। অলোয়েজ লাইফ ইজ নট ফেয়ার এন্ড লাভ। সামটাইমস ইটস লাইক আ রাফ সী অর ব্রোকেন মাউন্টেন।”

কতটা আবেগতাড়িত হয়ে কথা গুলো বলল ছেলেটা তা উষশী’র বোধগম্য হতে সময় লাগল না। তার সুন্দর দুটি চোখ অশ্রুসজল হয়ে উঠল। বিচ্ছেদ বেদনা এতটা করুণ হয় ঈশানকে না দেখলে কখনোই বুঝত না সে। সর্বোচ্চ গতিতে ছুটে পালাল কিশোরী। অভিরাজ তখনো তৈরি হচ্ছে। সেই মুহূর্তে মেয়েটি অশান্ত ঢেউয়ের মতো নুয়ে পড়ল ওর বুকের মধ্যভাগে। কিশোরীর বুকের লাব ডাব শব্দটি বেশ করুণ শোনাচ্ছে। মেয়েটির হঠাৎ এমন গতিক না বুঝে এলেও অদূর ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে বুকের ভেতরটা ঠিকই আন্দোলিত হলো।

চলবে…
কলমে~ফাতেমা তুজ ন‍ৌশি

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে