বিষাদময় নিষাদ পর্ব-১১ এবং শেষ পর্ব

0
2663

#বিষাদময়_নিষাদ
পর্বঃ ১১ পর্ব(শেষ পর্ব)
জাহান আরা

মাস্ক পরা মহিলার ফোন বেজে উঠতেই সোহেল থেমে যায়,ভুলবশত মহিলাটা মুখের মাস্ক খুলে ফেলে ফোন রিসিভ করে হ্যালো বলে চন্দ্রর সামনে।

চন্দ্র হা করে তাকিয়ে থাকে সেই মহিলার দিকে।এই মহিলা তো চন্দ্রর চেনা।বিয়ের পর দিন এই মহিলাই চন্দ্রর চুলের জট ছাড়িয়ে দিয়েছিলো।

চকিতেই চন্দ্রর মনে পড়ে যায় সেদিনের কথা।চন্দ্র জিজ্ঞেস করেছিলো,”আপনি কি ওনাকে ভালোবাসেন নাকি খুব।”
সেই মুহুর্তেই তার হাত থেকে চিরুনি পড়ে যায়,খুব দ্রুত রুম থেকে বের হয়ে যায়।

মহিলার ফর্সা মুখ অন্ধকার হয়ে যায় হঠাৎ করে।কেমন দিশেহারা ভাব চেহারায়।
সোহেল এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করে,”কি হইছে?”

মহিলা কোনো জবাব না দিয়ে দৌড়ে চলে যায়,চাপাস্বরে বলে,”পালা এখান থেকে,নিষাদ আসছে।”

চন্দ্রর চেহারা উদ্ভাসিত হয়ে যায় আনন্দে,চেহারায় আনন্দের ছাপ,চন্দ্রর কেমন যেনো স্বস্তি হচ্ছে,সেই সাথে বুকে ব্যথাও।

নিষাদ বসে আছে একটা পোড়া বাড়ির সামনে,সামনে দাঁড়িয়ে আছে নুহা,নুহার পাশে একজন মহিলা কনস্টেবল। নুহার পিছনে হাত বাঁধা অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে সোহেল,জাকির।
ফোন কানে নিয়ে নুহা কাউকে কল দিলো,তারপর কাঁপাকাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করলো,”স্যার,আপনার আর কতোক্ষণ সময় লাগবে আসতে?”

ওপাশ থেকে একটা গম্ভীর কণ্ঠস্বর জবাব দিলো,”চলে এসেছি আমি,আর ১৫-২০ মিনিট। সব ঠিক আছে তো?”

“জ্বি স্যার,সব ঠিক আছে,আপনি আসুন।”

একজন মহিলা কনস্টেবল এসে নুহার হাতে হাতকড়া পরিয়ে দিলো।
সোহেল,জাকিরের কলার চেপে ধরে বাড়ির ভিতরে নিয়ে গেলো,তারপর পরই ভেসে এলো সোহেল,জাকিরের গগনবিদারী চিৎকার।
ওসি কামরুল হাসান চিৎকার শুনে দৌড়ে ভিতরে এলেন,উপরতলায় চন্দ্র ও কেঁপে উঠলো কিছুটা এরকম চিৎকার শুনে।
চন্দ্র এখনো জানে না কি হচ্ছে এখানে,শুধু জানে নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে তার।

সোহেল,জাকিরের পুরুষাঙ্গ কেটে ফেলেছে নিষাদ,কামরুল হাসান কিছুটা থতমত খেয়ে যায় এরকম অবস্থা দেখে।
তারপর মুহুর্তেই তার মুখে হাসি ফুটে উঠে।এই কাজ নিষাদ আগেও করেছে,এই পশুদের এভাবে শাস্তি না দিলে সমাজের বাকি পশুরা সতর্ক হবে না।দুজনকে হাসপাতালে পাঠিয়ে দিয়ে অপেক্ষা করতে থাকে আসল নাটেরগুরুর।

নিষাদের শরীরের সমস্ত শক্তি যেনো ফুরিয়ে গেছে।কোনোমতে নিজেকে টেনে নেয় নিষাদ উপরের দিকে,চন্দ্রর কাছে,চন্দ্রকে স্প্রে দিতে হবে এইমুহুর্তেই।

দরজা খুলতেই দেখে চন্দ্র এককোনে বসে আছে।পকেট থেকে নিষাদ স্প্রে নিয়ে চন্দ্রর জিহ্বার নিচে দিয়ে স্প্রে করে দেয়।তারপর হুট করে জড়িয়ে ধরে চন্দ্রকে।

কিছুটা সময় চন্দ্র কোনো নাড়াচাড়া করতে পারে না,কিছু বলতেও পারে না বুকের ব্যথায়।টের পায় নিষাদের চোখের উষ্ণ জল চন্দ্রর ঘাড়ের উপর পড়ছে।
একটু ব্যথা কমতেই চন্দ্র শক্ত করে জড়িয়ে ধরে নিষাদকে,তারপর কাঁদতে শুরু করে ফুঁপিয়ে।
শক্ত করে খামচি দিয়ে ধরে নিষাদকে ,নিষাদ চন্দ্রর চুলে মুখ গুঁজে দেয়।
চন্দ্রর কান্নার বেগ বেড়ে যায় আরো।
নিষাদের ইচ্ছে করে চন্দ্রকে বুকের সাথে পিষে ফেলতে,কিভাবে বুঝাবে সে চন্দ্রকে বুকের ভিতর কি আগুন জ্বলেছে তার।
চন্দ্র স্থির হওয়ার পর নিষাদ চন্দ্রর কপালে একটা চুমু খায়,তারপর কোলে তুলে নেয় চন্দ্রকে,শরীরে যেনো শক্তি ফিরে এসেছে চন্দ্রকে কাছে পাওয়ার পর। নিচে নিয়ে আসে।

রশিদ সাহেব সিএনজি থেকে নেমে দাঁড়ায়। সিএনজি ড্রাইভারের ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে পিছনে ঘুরতেই সাদা পোশাক পরা ২জন পুলিশ এগিয়ে গেলো তারদিকে,কিছু বুঝে উঠার আগেই হাতে হ্যান্ডকাপ লেগে গেলো।
রশিদ সাহেব বিস্ময়ের চূড়ান্তে পৌঁছে যায়।

পুলিশ দুইজন টেনে নিয়ে আসে তাকে ভিতরে।
হঠাৎ করে রশিদ সাহেব কে এখানে দেখে চন্দ্র কিছুটা অবাক হয়।
রশিদ সাহেবের চেহারা ফ্যাকাসে হয়ে যায় চন্দ্র নিষাদ কে একসাথে দেখে।
চন্দ্র বাবা বলে কাছে যেতে চায় কিন্তু নিষাদ বাঁধা দেয়।

কিছুই বুঝতে না পেরে চন্দ্র জিজ্ঞেস করে,”কি হয়েছে?
বাবাকে কেনো নিয়ে এসেছো তোমরা এখানে?”

ওসি সাহেব মিষ্টি হেসে জিজ্ঞেস করে,”উনি কি আপনার বাবা?”

চন্দ্র কিছুটা থতমত খায় এই প্রশ্ন শুনে।জবাব নেই এই প্রশ্নের তার কাছে।চন্দ্রকে কাছে টেনে নেয় নিষাদ।তারপর চুলে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে,”অনেক কিছুই তোমার অজানা চন্দ্র,তবে তুমি ও জানো আমিও জানি,উনি তোমার আসল বাবা নন।”

চন্দ্রর চোখ ঝাপসা হয়ে আসে,চন্দ্র জানে এই মানুষ টা তার বাবা না,বাবার কথা মনে হলেই চন্দ্রর মনে পড়ে সেই শৈশবের কথা,ঝড়ে আম কুড়ানোর কথা,ভাট ফুলের তীব্র ঘ্রাণের কথা।ছোট ছিলো চন্দ্র,কতোটা ছোট তা মনে নেই।তবে মনে আছে একটা শক্ত হাত,চন্দ্রর কোমল আঙুল আলতো করে ধরে আছে।
মনে পড়ে কেউ একজন তাকে কাঁধে চাপিয়ে নিয়ে ছুটে বেড়াচ্ছে।জোছনা রাতে কেউ একজন জোনাকি পোকা ধরে এনে চন্দ্রর হাতে দিচ্ছে।ঘুম পাড়ানোর সময় কেউ একজন সুর করে করে বলে যেনো,”মা,মা,চন্দ্রিমা,আমার মা চন্দ্রিমা।”
আর???
না আর মনে নেই কিছু চন্দ্রর,কানে যেনো বাজছে কারো চন্দ্রিমা বলে ডাকা।
বাকি সব ঝাপসা লাগে চন্দ্রর।

নিষাদ শক্ত করে চেপে ধরে বুকের সাথে।

তারপর রশিদ সাহেবকে জিজ্ঞেস করে,”কেনো করেছেন এরকম?”

রশিদ সাহেব জবাব দিলেন না।তার এতোদিল ধরে করা প্ল্যান নষ্ট হয়ে গেলো ভাবতেই মাথা গরম হয়ে যায় রশিদ সাহেবের।

তারপর হাল ছেড়ে দিয়ে বলে,”৩০ কোটি টাকার সম্পত্তি,ভাবতে পারো তুমি নিষাদ,চন্দ্রর নামে ৩০ কোটি টাকার সম্পত্তি রয়েছে। যা চন্দ্রর নিজেরও অজানা।আজকে রাত পার হয়ে গেলেই সেই সম্পত্তি চলে যেতো একটা এতিমখানাতে।আমার এতো বছরের সাধনা,যে সম্পত্তির লোভে আমি এতোদূর এসেছি,এতোকিছু করেছি,তা আমি কিভাবে হাত ছাড়া করতাম?”

চন্দ্রর মুখ হা হয়ে যায় এতো টাকার কথা শুনে।

রশিদ সাহেব অনেকটা আপন মনে বলতে থাকে,”চন্দ্রর মা জামিলা ছিলো আমার চাচাতো ভাইয়ের বউ,চাচার বিশাল সম্পত্তি চাচা চন্দ্রর বাবা সাইদুলের নামে লিখে দেয়।আমার বাবার অবস্থা ছিলো খুব কমতির দিকে,বাবা আর চাচার মধ্যে সবই ছিলো অমিল,চাচা ছিলো পরিশ্রমী,উদ্যোগী,কর্মঠ,আমার বাবা ছিলো তার উলটো,সারাজীবন বাবাকে দেখেছি জুয়ার আসরে বসে সব শেষ করতে,বাবার এই গুণ আমরা সব ভাই পেয়েছি,কিন্তু লোভ ও হতো চাচার এতো সম্পদ অথচ আমরা তখন শূন্য অবস্থায়।চন্দ্রর মায়ের সাথে আমি তখন ভাব জমাই,তার থেকেই আসরে বসার টাকা ম্যানেজ করতাম জামিলার থেকে।চন্দ্রর বাবার চাইতে আমি বেশি সুদর্শন ছিলাম,জামিলা বুঝতে পারে নাই চকচক করলেই সোনা হয় না।
আমার প্রেমে জামিলা তখন দিশেহারা প্রায়,ঠিক সেই সময় আমি জামিলা কে বুদ্ধি দিই সাইদুলকে বলতে ফ্যাক্টরি রোডের জমিটা তার নামে লিখে দেয়ার জন্য।তাহলে আমি তাকে বিয়ে করবো।
মেয়ে মানুষের বুদ্ধি কম বুঝলা,তা না হলে আমার এই চাল জামিলার ধরে ফেলার কথা ছিলো,কিন্তু সে এতোটাই পাগল হয়েছে যে বুঝতেই পারে নি কিছু।সোজা চাপ দেয় সাইদুলকে।
সাইদুল করেছে আরেকটা ভুল,সুন্দরী বউয়ের কথামতো জামিলার নামে সে জমি লিখে দেয় জামিলাকে খুশি করতে।
তার ৬ মাস পরেই আমি জামিলা কে নিয়ে গ্রাম থেকে চলে আসি শহরে,কিন্তু সাইদুলের সাথে ছলনা করলেও জামিলা চন্দ্রকে ভীষণ ভালোবাসতো,আমার ও চন্দ্রর জন্য কিছুটা মায়া ছিলো,কেননা আমাদের বংশে না শুধু,পুরো গ্রামেও চন্দ্রর মতো সুন্দর একটা মেয়ে ছিলো না,এটা নিয়ে আমরা সবাই খানিকটা অহংকার ও করতাম।
ঢাকায় আসার পর আমি জামিলা কে বিয়ে করি,আমাদের একটা ছেলে হয়।বিয়ের ৩ বছর পর আমি জামিলাকে চাপ দিই ওই জমি আমার নামে লিখে দেওয়ার জন্য।
জামিলা তখন সতর্ক হয়ে যায়।
এই প্রথম জামিলা তার মাথা খাটায়,তারপর আমার অজান্তেই উইল করে ফেলে,চন্দ্রর ২২ বছর হবার আগে চন্দ্র যদি এই জমি দাবি না করে তবে এই জমি চলে যাবে এতিমখানার নামে।চন্দ্র চাইলে উইল চেঞ্জ করতে পারে কিন্তু ২০ বছর হওয়ার আগে এই উইল চেঞ্জ করতে পারবে না।
মাথা খারাপ হয়ে গেলো আমার তখন,জামিলার ঘুমের ঘোরে দিয়ে দিলাম বালিশ চাপা।
মেরে ফেলেছি সেদিন জামিলা কে।অপেক্ষায় ছিলাম সুযোগের,ভেবেছিলাম চন্দ্রকে ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করে এই জমি নিজের করবো চন্দ্রর ২০ বছর হওয়ার পর কিন্তু পারি নি।তার আগেই চন্দ্র রাজনীতিতে মগ্ন হয়ে গেলো,অনেকবার অনেক পরিকল্পনা করেছি কিন্তু ব্যর্থ হয়েছি বারবার।তারপর চন্দ্রর বিয়ে হয়ে যায় তোমার সাথে।
নুহাকে খুঁজে পাই তখন,নুহার প্রয়োজন ছিলো নিষাদকে আর আমার ছিলো চন্দ্রর সম্পত্তি।
চন্দ্রকে কিডন্যাপ করার প্ল্যান অনেক আগে করেছি কিন্তু বিয়ের পর আর চন্দ্র আমাদের বাসায় যায় নি।তোমার সেই দুর্ঘটনার পর তো চন্দ্র বাসা থেকে বের হওয়াই ছেড়ে দিয়েছে।আগামীকাল চন্দ্রর ২২ বছর পূর্ণ হবে,কিন্তু এবারও আমি ব্যর্থ।”

বিস্ময়ে চন্দ্র হতবাক হয়ে যায়।এতোকিছু ঘটে গেলো অথচ চন্দ্র ঘুণাক্ষরেও টের পায় নি।

————————-

নিষাদের বুকে মাথা রেখে চন্দ্র বসে আছে,চন্দ্রর কোমর জড়িয়ে ধরে আছে নিষাদ।বাতাসে চন্দ্রর চুল উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে নিষাদের মুখে।
চোখ বন্ধ করে নিষাদ অনুভব করে চন্দ্রর পুরো অস্তিত্ব। নিজেকে মনে হয় সবচেয়ে সুখী মানুষ আজ।
চন্দ্রর অনেকক্ষণ ধরে মাথায় ঘুরছে একটা প্রশ্ন,নিষাদ কিভাবে চন্দ্রকে খুঁজে পেলো!
কৌতূহল চেপে রাখতে না পেরে চন্দ্র জিজ্ঞেস করে নিষাদকে,”আচ্ছা,তুমি কিভাবে জানলে আমি কোথায় আছি,নুহাকে কিভাবে খুঁজে পেলে ওখানে?”

“বলতে পারি একটা শর্তে?”

“কি শর্ত?”

নিষাদের হাত কোমর বেয়ে উপরের দিকে উঠে আসে,অজানা শিহরণে শিহরিত হয় চন্দ্র,খপ করে চেপে ধরে নিষাদের হাত।
তারপর হেসে দিয়ে বলে,”এই দিনে দুপুরে কি শুরু করেছো তুমি?”

“আমার অধিকার,আমার পাওনা এটা মিসেস নিষাদ,আমাকে আমার পাওনা মিটিয়ে না দিলে আমি তোমার কৌতূহল মিটাবো না।”

কৃত্রিম অভিমানের ভান করে,টুক করে চুমু খেয়ে নেয় নিষাদ চন্দ্রর ফর্সা গালে।
শার্টের নিচে হাত দিয়ে খামচে ধরে চন্দ্র নিষাদের পিঠে। চন্দ্রর নখের আঁচড়ে নিষাদ মৃদু আওয়াজ করে,খুব শক্ত করে জড়িয়ে ধরে চন্দ্রকে নিষাদ।
তারপর আস্তে আস্তে বলে,”থানায় গিয়ে গাড়ির লাইসেন্স নাম্বার দিয়ে এসেছি কার গাড়ি তা জানার জন্য,মন কিছুতেই মানছিলো না কেনো জানি,বসে থাকতে পারি নি আর তাই থানায়,বাসায় আসতেই মনে হলো মৃত্যুপুরীতে ঢুকেছি। তোমাকে ছাড়া কেমন শূন্য লাগে বাসা চন্দ্র তোমাকে তা বুঝাতে পারবো না।
দৌড়ে ছাদে গেলাম,পুরো ছাদ তন্নতন্ন করে খুঁজতেই চোখে পড়ে নুহার হাতের ব্রেসলেট টা।
এই ব্রেসলেট টা নুহা বানিয়েছে আমাকে ইমপ্রেস করতে,আমার আর ওর নাম দিয়ে।
ব্রেসলেট টা দেখেই আমার সব বুঝা হয়ে গেছে।
ওর সবগুলো পার্লারে কল দিয়েছি,সবশেষে জানতে পারি বিশেষ কাজে ও গতকাল থেকে পার্লারে যাচ্ছে না।
ওর ফোনের লোকেশন বের করতে বলি কামরুল ভাইকে,তারপর তো জানোই তুমি,পুলিশ নিয়ে কামরুল ভাই ও চলে আসে সাদা পোশাকে।
চন্দ্র,আমার দম যেনো বন্ধ হয়ে আসছিলো তোমাকে ছাড়া,কি ভীষণ অনুশোচনা হয়েছে আমার তোমাকে বুঝাতে পারবো না,বারবার মনে হয়েছে কেনো তোমার হাত সরিয়ে দিলাম,কেনো তোমার দিকে ফিরলাম না,যদি তোমাকে ফিরিয়ে না দিতাম তবে তো তুমি হারিয়ে যেতে না।তোমার যদি বিন্দুমাত্র ক্ষতি হতো তবে আমি রক্তের বন্যা বইতে দিতাম।আমার চন্দ্রাবতীর একফোঁটা অপমান আমি সহ্য করতাম না।”

নিষাদের আলিঙ্গন আরো গভীর হয়,চন্দ্রর নিজেকে কেমন তৃষ্ণার্ত মনে হয়,মন চাইছে আরো বেশি কিছু।
ভালোবাসার বৃষ্টিতে ভিজে যায় দুজনেই পরক্ষণে।

—————-

হাসনাত সাহেব,মনোয়ারা বেগম বাসায় ফিরে আসে রাত ১০টায়,নিষাদ আর চন্দ্র রুম থেকে বের হয়ে আসে।
অচেনা এক লোক কে হাসনাত সাহেবের পাশে দেখে চন্দ্র কিছুটা অবাক হয়।
নিষাদ সালাম দেয় সবাইকে,সাথেসাথে চন্দ্র ও দেয়।
হাতে বাঁধানো একটা ছবি নিয়ে লোকটা একবার চন্দ্রর দিকে তাকায় একবার ছবির দিকে তাকায়।তারপর আপনমনে বলে,”আমার চন্দ্রিমা কতো বড় হয়ে গেছে আজ!”

বুকের ভিতর কিসের ভাঙন শুরু হয় চন্দ্রর।চন্দ্রিমা!!
এতো তাকে তার বাবা বলতো।

হাসনাত সাহেব আপনমনে বলেন,”তোমাদের গ্রামটা অনেক সুন্দর বুঝলে বউমা,আমি তো ভেবেছি আমি আর মনু আর কয়েকদিন গিয়ে বেড়িয়ে আসবো,আজ তো নিষাদের কল পেয়ে তাড়াহুড়োয় তোমার বাবাকে পাকড়াও করে নিয়ে এসেছি,সময় পাই নি মনুকে নিয়ে ঘুরার।”

মনোয়ারা বেগম চোখ বড় করে তাকান হাসনাত সাহেবের দিকে তারপর বিড়বিড় করে বলেন,”জীবনে এই লোকের আক্কেল হবে না।”

ধীর পায়ে এগিয়ে আসে লোকটা চন্দ্রর দিকে,তারপর সুর করে বলে,”মা মা,চন্দ্রিমা।আমার মা চন্দ্রিমা।”

কেউ বলে দেয় নি,তবুও চন্দ্র বুঝে গেছে এই লোকটাই তার বাবা,ঝাঁপিয়ে পড়ে চন্দ্র সাইদুল সাহেবের বুকে।
চন্দ্রর আজ ভীষণ খুশির দিন।অনেক বেশি খুশির দিন আজ চন্দ্রর।

রাতে খাওয়াদাওয়ার পর হাসনাত সাহেব একজন উকিল কে কল করেন।চন্দ্র সম্পত্তি সাইদুল সাহেবের নামে লিখে দিবে বলে মনস্থির করে।কথাটা জানতে পেরে সাইদুল সাহেব আপত্তি জানান।মেয়েকে পেয়েছেন খুঁজে এর চেয়ে বেশি কিছু তার দরকার নেই এখন আর।

এই সম্পদ যতো অনিষ্টের মূল চন্দ্র বুঝতে পারে।উকিল আসার পর চন্দ্র সব নিষাদের নামে করে দেয়।
মুচকি হেসে নিষাদ চন্দ্রর দিকে তাকায়।তারপর নিজেই লিখে দেয় সেই সম্পদ এতিমখানার নামে।
চন্দ্র সোফায় বসে ছিলো সাইদুল সাহেবের পাশে,নিষাদ চন্দ্রর পায়ের কাছে বসে ফ্লোরে।তারপর দুই পা কোলে তুলে নিয়ে বলে,”তোমার চাইতে বেশি দামী আর কি হতে পারে চন্দ্র?
সেই তুমিই তো আমার,তবে এই সম্পদ দিয়ে কি হবে?
খেয়েপরে ভালোভাবে বেঁচে থাকার জন্য যা দরকার তা আমার আছে,আমি নিজেও চাকরিজীবী। রাজনীতিতে গিয়েছি নিজের পকেট ভরতে নয় চন্দ্র,দেশের সাধারণ মানুষের পকেট যেনো কেউ ফাঁকা করতে না পারে তার ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে।আমার এই পৃথিবীতে কিছুর উপর লোভ নেই চন্দ্র,শুধু তুমি ছাড়া।
তুমি আমার পাশে আছো,মানে এই পৃথিবী আমার।শুধু তুমি আমার হয়ে থেকো আমি প্রমাণ করে দিবে,সব মানুষ ছেড়ে যায় না।”

চন্দ্র কাঁদছে বাবার কাঁধে মাথা রেখে,সাইদুল সাহেব মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন।
কেউ আটকাচ্ছে না চন্দ্রর কান্না,আজ চন্দ্রর কান্নার দিন,জীবনের শেষ কান্না এটাই,এরপর শুধু সুখ আর সুখ চন্দ্রর।সব সুখ তার।

মনোয়ারা বেগম আর হাসনাত সাহেব ও কাঁদছে।মাঝেমাঝে অকারণে কান্না পায়,খুব কষ্টে বা খুব খুশিতে।
আজ খুশির দিন,সবচেয়ে বেশি খুশির দিন আজ হাসনাত সাহেবের পরিবারে।

৪ বছর পর একদিন,হাতে খাবারের প্লেট নিয়ে চন্দ্র ছুটছে,৩ বছর বয়সী বিপাশা একবার তার দাদু হাসনাত সাহেবের বুকে গিয়ে লুকাচ্ছে,একবার নানা সাইদুল সাহেবের বুকে গিয়ে লুকাচ্ছে।কিছুতেই খাবে না সে।নিষাদ ডাইনিং এ বসে দেখছে আর হাসছে, বিপাশা কে ডেকে ডেকে বলছে,”বিপা,দাদুর কাছে যাও,নানার কাছে যাও এবার,তাইলে আর তোমার আম্মু ধরতে পারবে না।”
বিপাশা ও তার বাবার কথামতো পালাচ্ছে।বিরক্ত হয়ে চন্দ্র নিষাদের সামনে এসে দাঁড়ায়। নিষাদ মুগ্ধ হয়ে তাকায় চন্দ্রর দিকে,কোমরে আঁচল গুঁজে রাগী দৃষ্টিতে চন্দ্র দাঁড়িয়ে আছে,খোঁপা করা চুল,একগাছি চুল চন্দ্রর কপালের উপর,এতো মায়া কেনো এই মেয়ের মধ্যে?
নিষাদ যে প্রতি মুহুর্তে পাগল হয়ে যায়।

কিছু না বলে পুডিং এর টুকরো নিষাদের মুখে ঢুকিয়ে দেয় চন্দ্র,তারপর রাগে গজগজ করতে করতে বলে,”তোমার মেয়ে যখন খাবে না,তো তুমি খাও ওর বদলে। এক যন্ত্রণায় আছি আমি,বাবা যেমন,মেয়েও তেমন,আমার কথা শুনে না বাপ-মেয়ে কেউই।”

চন্দ্র কিচেনে চলে যায়,পিছন থেকে গিয়ে জড়িয়ে ধরে নিষাদ,তারপর খোঁপা খুলে দেয় চন্দ্রর,চুলে নাক গুঁজে দিয়ে ফিসফিস করে বলে,”চলো চন্দ্রাবতী,তোমাকে ঝামেলা থেকে মহাঝামেলায় ফেলে দিই,বিপাশার জন্য একটা ভাই নিয়ে আসি।৩জন থেকে ৪ জন হয়ে যাই আমরা।”

রাগী দৃষ্টিতে চন্দ্র ফিরে তাকায় নিষাদের দিকে।হুট করে নিষাদ তার ঠোঁট নামিয়ে আনে চন্দ্রর ঠোঁটের উপর,মুহুর্তেই চন্দ্রর রাগ গলে যায়,খামচে ধরে নিষাদকে।

মনোয়ারা বেগম কিচেনে যাচ্ছিলেন রান্নার বিষয়টা দেখতে,নিষাদকে পিছন থেকে দেখে থমকে দাঁড়ান তিনি,তারপর কিচেনের দরজা বন্ধ করে দেয় বাহির থেকে।
সোফায় গিয়ে বসেন,আজ আবার তার কান্না পাচ্ছে। জীবন এতো আনন্দের কেনো?
বিপাশা এসে দাদীকে জড়িয়ে ধরে,মনোয়ারা বেগম বিপাশাকে বুকের সাথে জড়িয়ে নেয়।
তার সুখের সংসার,আল্লাহ এই সুখ যেনো বিষাদে রূপান্তর না করে কখনো।

নিষাদ সাইদুল সাহেবকে আর যেতে দেয় নি এই বাসা থেকে,সবাই একসাথে এক ছাদের নিচেই আছে।কি ভীষণ ভালোবাসা তাদের সবার মধ্যে,এই বন্ধন যেনো আজীবন থাকে মনোয়ারা বেগম প্রতিদিন সেই কামনা করেন।
হাসনাত সাহেব ডাক দিয়ে বলেন,”মনু,খবরের কাগজটা দাও তো।”
মনোয়ারা বেগমের রাগ করার কথা,কিন্তু তিনি রাগ করলেন না,ফিক করে হেসে ফেললেন। আজ তার ভীষণ ভালো লাগছে,হাসনাত সাহেবের মুখে মনু শব্দটাও আজ ভীষণ আপন লাগছে।
জীবন অনেক সুন্দর,অনেক বেশি সুন্দর।

(সমাপ্ত)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে