বিশ্বাসঘাতক

0
1223

আমার বয়স যখন ১৭,তখন ২১ বছর বয়সী এক ছেলের প্রেমে পড়েছিলাম।সম্ভবত সেটাই ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল।ওই একটা ভুল আমার গোটা জীবন টাকে মিথ্যা করে দিয়েছে।
আমার বাবা ছিলেন এক স্বল্প বেতনের কর্মচারী।আমরা ছিলাম ৫ বোন এক ভাই।৮জনের সংসারে কোনরকমে আমাদের পেট চলতো। আমি ছিলাম বাবা মা এর প্রথম সন্তান।লেখাপড়াটা নিতান্তই বিলাসিতা ছিল আমাদের কাছে।তবুও কোন ভাই বোন পড়াশোনা ছাড়িনি।
সেবার মাধ্যমিক দিয়ে সবে কলেজে পা রেখেছি।আমাদের বাড়ি ছিল কলেজের গা ঘেসে।যদিও কলেজে ভর্তি করার সামর্থ্য বা মানসিকতা কোনটাই বাবার ছিল না তবুও আমার মাধ্যমিক এর ফলাফল দেখে আর শিক্ষকদের অনুরোধ এ বাবা ভর্তি করেন কলেজে।সে বছরই অনার্স ১ম বর্ষে ভর্তি হয় একটি ছেলে,নাম সায়ন।ছেলেটি দেখতে আহামরি কিছু ছিল না কিন্তু ওর চোখদুটো ছিল নজর কাড়া।যে মেয়ে একবার সেই চোখের গভীরতায় ডুব দেবে সে মেয়ের সাধ্য নেই ফিরে আসে।
কলেজের পাশেই হোস্টেল।আমাদের বাড়ির থেকে কয়েক গজ দূরে।কলেজে আসা যাওয়ার পথে রোজ দেখা হতো আমাদের।ছেলেটি আমার দিকে হা করে তাকিয়ে থাকতো। একদিন কলেজ থেকে ফেরার পথে দেখি ছেলেটা পিছু পিছু আসছে।অনেকটা রাস্তা আসার পর পিছু থেকে ডাক দিল।
-তিয়াসা একটু শোনো
-জ্বি ভাইয়া বলেন।
-এটা তোমার (একটা চিঠি আর কিছু গোলাপ)
-আমি নিতে পারবো না।
-নিতেই হবে না নিলে বাসায় যেতে দিব না কিন্তু।
আমি ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম ওনার কথা শুনে।সেদিনের মত ওসব না নিয়েই পালিয়ে আসি।তারপর আর কথা হয়নি অনেকদিন।উনিও আমার সামনে আসেননি।
সত্যি বলতে পড়ালেখা ছাড়া আমার মাথায় কিছু ছিল না।কারণ ওই বয়সে আমার বান্ধবীরা যখন সিনেমার নায়ক নিয়ে গল্প করতো তখন আমাকে নিজের পড়াশোনা সামলে,টিউশনি করে নিজের আর ভাইবোন দের পড়ার খরচ চালাতে হতো।

তবুও সেদিনের পর আমার দুচোখ শুধু ওনাকে খুজছিল।খুব মিস করছিলাম ওনাকে।মন থেকে সরাতেই পারছিলাম না।ওনার দেখা পেলাম ঠিক ৫ দিন পর আমার নিজের বাড়িতে।আমার ছোট বোনের জন্য টিউটর এর দরকার ছিল কিন্তু টিউটরকে দেওয়ার মত টাকা আমাদের ছিল না।
শুনলাম উনি আমার বোনকে পড়াবেন বিনিময়ে ওনাকে টাকা দিতে হবে না শুধু ৩ বেলা উনি আমাদের বাড়ি খাবেন।কারণ উনি নাকি হোস্টেলের খালার রান্না খেতে পারতেন না।
উনি ছিলেন আমার চাচাত ভাই এর বন্ধু।ভাইয়াই এই টিউশনি টা ঠিক করে দিয়েছিলেন।
প্রথমদিন যেদিন উনি পড়াতে এলেন ওনাকে খাবার দেওয়ার দ্বায়িত্ব পড়লো আমার ঘাড়ে।খাবার নিয়ে সামনে যেতেই দেখলাম উনি মুচকি মুচকি হাসছেন।
-কি ম্যাডাম?কেমন চমক দিলাম?সেদিন তো ফুলটা নিলেই না।এবার তোমাকে কে বাঁচাবে!!!
-মানে কি!!
-কি ভাবছো তোমার বোনের জন্য এসেছি?উহু এসেছি শ্বাশুরির কাছে জামাই আদর নিতে। স্যার হয়ে ডুকেছি জামাই হয়ে বের হবো।
-দেখেন এত সস্তা না।আমার বাবা জানতে পারলে আপনার খবর আছে।
-দেখোই না কেমন মন জয় করে নিই শ্বশুরমশাইয়ের।

এভাবেই চলতে থাকলো দিন।উনি প্রত্যেকদিন ৩বেলা আমাদের বাড়িতে খেতে আসতেন আর বাড়ির সবার চোখের আড়ালে একটু একটু করে আমাদের প্রেম শুরু হতে লাগলো। মিস্টি মধুর প্রেম।
রবীন্দ্রনাথ বলেছেন বালিকার প্রথম প্রেম সর্বনাসী।কৈশর ছেড়ে সদ্য যৌবনে পা দেওয়া আমার প্রেম ও কিছু কম ছিল না।
এর মধ্যে কেটে যায় কয়েক মাস।ততদিনে উনি হয়ে উঠেছেন আমাদের ঘরের ছেলে।আমার বাবা মা ভাই বোনেদের যেন ওনাকে ছাড়া চলেই না। আমার কলেজের ১ম বর্ষের হাফ ইয়ারলি পরীক্ষার আগের দিন খবর এল আমার নানাভাই মারা গেছেন।আমরা পুরো পরিবার ছুটলাম সাথে উনি।বাদ আসর নানার মাটি হলো।ঠিক হলো পরের দিন মিলাদ মাহফিল হবে।কিন্তু আমাকে যে ফিরতেই হবে,পরদিন পরীক্ষা।
শেষে সিদ্ধান্ত হলো সবাই একখানেই থাকবে শুধু উনি আমাকে আজ বাড়িতে নিয়ে যাবেন আর পরীক্ষা শেষে কাল আবার দিয়ে যাবেন।
ওটাই ছিল আমাদের দুজনের একা একা কোথাও যাওয়া।সারা রাস্তা কেদেছি আমি,বমি করে ওনার গা ভাসিয়ে দিয়েছি।মানুষ টা কিছুই বলেনি বরং হাসিমুখে আমার যত্ন করেছে।পুরা বাসে ওনার কাধে মাথা দিয়ে ছিলাম।মানসিক অবস্থা এতটাই খারাপ ছিল লজ্জা বা রোমান্স কিছুই মাথায় আসেনি।
বাড়ি ফিরতে ফিরতে রাত হয়ে গেল।উনি আমাকে বসিয়ে রেখে নিজেই রান্না করলেন,আমাকে খেতে দিলেন।

-থাকে পারবা একা?
-হু পারব।
-ভয় করবে না?আমি থাকি?
-ছি লোকে কি বলবে!আপনি যান আমি পড়তে বসবো।
-তিয়াসা।
-হু।
-ভালবাসি
-আমিও।
-আজকের দিনটা স্মরণীয় হয়ে থাকবে তিয়াসা।মনে হলো আমরা সংসার করলাম।
-শুধু রান্না করলেই কি সংসার করা হয়??
-আর কি করতে হয়?
-জানিনা
-আমি জানি।বলি?
-আপনি যাবেন?? ভাল্লাগছেনা আমার।
-আচ্ছা গেলাম। দরজাটা দিয়ে দাও।

আমার নানা মারা যাবার পরে আমার মা এর মাথায় আকাশ ভেংগে পড়লো কারণ আমাদের সংসারে নানা ভাই একটা মোটা অংকের টাকা দিতেন।বাবা একেবারে ভেঙে পড়লেন ৬টা সন্তান নিয়ে সে যাবে কোথায় আর ৫টা মেয়েকেই বা পার করবেন কিভাবে।
এই অবস্থায় উনি বাবাকে বিয়ের প্রস্তাব দিলেন আমার জন্য।বাবা যেন অন্ধকারে আলোর দিশা পেলেন।তবুও একটা বেকার ছেলের হাতে মেয়েকে তুলে দিতে কিছুটা সংকোচ হচ্ছিল।
কিন্তু সব সংশয় কেটে গেল যখন ৭দিনের মাথায় উনি পরিবার নিয়ে হাজির হলেন আর আমার শ্বশুর মশায় কথা দিলেন ওনার ছেলে নিজের পায়ে দাড়ানোর আগে আমার ভরণপোষণ এর দ্বায়িত্ব তার।শুধু তাই নয় তিনি আমাকে পড়াবেন এমনকি চাকরিও দিয়ে দেবেন।
একমাসের মাথায় ধুমধাম করে বিয়ে হয়ে গেল আমাদের।যেহেতু আমাদের বাড়ি থেকে শ্বশুরবাড়ি অনেক দুরে ছিল আর হুট করে বিয়েটা হয়ে গেল সেহেতু আমরা সেভাবে খোজ নিতে পারিনি।
শ্বশুরবাড়ি গিয়ে জানলাম আমার স্বামীদের পরিবারের জঘন্য ইতিহাস।আমার শ্বশুর এর দু পক্ষ।আমার শ্বাশুরী ২য় পক্ষের স্ত্রী। আমার শ্বশুড় এর ১মা স্ত্রী ও জীবিত অর্থ্যাৎ তিনি ২জন স্ত্রী নিয়ে ঘর করেন।শুধু তাই নয় পরকিয়া সম্পর্কের জের ধরে তারা বিবাহিত।আমার শ্বাশুরী আমার বড় শ্বাশুরীর চাচাতো বোন এবং আমার শ্বাশুরীও বিবাহিতা ছিলেন তাদের বিয়ের সময়।খুব কষ্ট হতো আমার বড় শ্বাশুরীর জন্য যখন দেখতাম আমার শ্বাশুরীর দুষ্টু বুদ্ধির জন্য ওই বুড়ো বয়সে পদে পদে হেনস্তা হতেন বেচারি। আমার জীবনে এমন পরিবার ১ম দেখেছিলাম যেখানে একজন লোক ২জন স্ত্রী, ছেলে, ছেলের বউ নিয়ে এক বাড়িতে থাকেন।
কিন্তু অবাক হওয়ার সেখানেই শেষ ছিল না।জানতে পারলাম আমার চাচাতো ননদ যে কিনা বিবাহিতা তার সাথে আমার স্বামীর অবৈধ সম্পর্ক ছিল আর সে জন্যই তাকে ওতদুরের কলেজে পড়তে পাঠানো। কান্নায় ভেঙে পড়েছিলাম সেদিন এ কোথায় এসে পড়লাম।কিন্তু সেদিন ভাবতেই পারিনি ওটা সুচনা ছিল মাত্র।সামনে আরও ভয়াবহ কিছু অপেক্ষা করছে।
(চলবে)

#১ম_পর্ব
#তামান্না_ইসলাম

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে